Tuesday, November 6, 2018

হুমায়ূন আহমেদ সমাচার: একটি 'সহজ' প্রস্তাব।


হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মের প্রচুর সমালোচনা রয়েছে, এমনকি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও। একজন লেখকের সেটা থাকাই স্বাভাবিক বলে মনে করি, সময়ে সময়ে একজন লেখক সম্পর্কে মূল্যায়নগুলো পরিবর্তন হয়, এটাও স্বাভাবিক। বিশেষ করে তার লেখা-পত্র বা সৃষ্টিকর্ম একটা প্রজন্মকে বি-রাজনৈতিকহতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এটাই সবচেয়ে বড় বা সর্বাধিক প্রচারিত সমালোচনা। বাংলা কমিউনিটি ব্লগ যখন তুঙ্গে তখন হুমায়ূন আহমেদকে পুস্তক ব্যবসায়ীআখ্যা দিয়েও অনেক লেখা বেশ বাজার গরম করেছিল। তার বিরুদ্ধে অপ-বিজ্ঞানের চর্চা, কুসংস্কার জিয়িয়ে রাখার চেষ্টার বেশ গুরুগম্ভীরঅভিযোগও তোলা হয়েছিল।
অনেক সাহিত্যিক বা সাহিত্য সমালোচক হুমায়ূন আহমদের শুরুর দিকের কাজ দেখে তার কাছ থেকে যে আশা করেছিল পরবর্তীতে সেটা পূর্ণ না হওয়াতে একধরণের হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন। যেমন আহমদ ছফার একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য আমাদের এই প্রত্যাশা এবং আশাভঙ্গের জায়গাটা পরিষ্কারভাবেই ফুটিয়ে তুলে, ‘তাঁর প্রথম বই যখন বেরিয়েছিল, আমিই সবচাইতে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি। তখন আমার মনে হয়েছিল হয়ত হুমায়ূনের মধ্যে কালে কালে আমরা চেখভের মত একজন প্রতিভার সন্ধান পাব। তিনি তো সে পথে গেলেন না।অর্থাৎ, হুমায়ূনের মধ্যে ছফা চেখভের সন্ধান করেছিলেন, এবং, ‘নন্দিত নরকের উচ্চকিত প্রশংসাও করেছিলেন। কিন্তু, ‘তিনি তো সে পথে গেলেন নাবলে হুমায়ূনের যে নতুন পথের দিকে ছফা ইঙ্গিত করেছিলেন সেটা কেমন ছিল তাও তিনি উল্লেখ করেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ এখন শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের চেয়েও জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু মেরিটের দিক দিয়ে সে নিমাই ভট্টাচার্যের সমান। হি রাইটস ওনলি ফর বাজার!

হুমায়ূন আহমেদ প্রচুর লিখেছেন, সিনেমা বানিয়েছেন, নাটক বানিয়েছেন। পুরো বিষয়টাকে আমরা হুমায়ূনের সৃষ্টিকর্ম হিসেবে আখ্যা দিতে চাই। তো সেই সৃষ্টিকর্মের মধ্যেও মন্দের অভাব নেই। বাজারের জন্যে লিখতে হবে বলে লিখেছিধরণের সৃষ্টিও মেলা। এইসব কিছু স্বীকার করেও আমার প্রস্তাব হচ্ছে তার কিছু সৃষ্টিকে আমরা অন্যভাবে দেখতে পারি কি না। উদাহরণস্বরূপ, কিছুদিন আগে হলুদ হিমু কালো র্যােবেরর কথা বলেছি; সেখানে উপন্যাসের বয়ান শতভাগ রাজনৈতিক ছিল; বর্তমান সময়ে এসে এর প্রাসঙ্গিকতাও নতুন করে টের পাচ্ছি। তো, এই বিকল্পভাবনার প্রস্তাব হিসেবে আমি হুমায়ূন আহমেদের দুয়েকটা নাটক সম্পর্কে উল্লেখ করতে চাই।


হুমায়ূন আহমেদের নাটকের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হাস্যরসাত্মকউপস্থাপনা। এই হাসি-তামাশার কারণেই আমরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হাসির খোলসটুকুই শুধু নিয়ে থাকি, গভীরের রস আমাদের আয়ত্বের বাইরেই থেকে যায়। এখানে বলা যেতে পারে উড়ে যায় বকপক্ষীনাটকের কথা। কাহিনীর কেন্দ্রে একটা গানের দল, আর তার চারপাশ জুড়ে আছে গ্রামজীবন। আমাদের নাট্যজগতে গ্রাম্য জগতকে কেন্দ্র করে যে নাটকগুলো তৈরি হয় তার অধিকাংশতেই হাসিথাকে, কিন্তু গ্রামথাকেনা। এই নাটকে কিন্তু আমাদের গ্রাম পুরোমাত্রায় উপস্থিত, যেখানে ভালো মানুষ আছে, মন্দ মানুষ আছে, একই মানুষের ভিতরে ভালো-মন্দের দুটোই উপস্থিতি আছে, গ্রাম্য রাজনীতি আছে, কুসংস্কার আছে। এই গ্রামে হুমায়ূন আহমেদ দুইজন শহুরে মধ্যবিত্তকে (অবশ্য নাটকে দেখানো হয় যে বিদেশ থেকে এসেছেন, কিন্তু তারা শহুরে মধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী) এনে ছেড়ে দেন। একজন এদের সাথে থেকে এদের চোখ দিয়ে এদের মতো গ্রামকে দেখার চেষ্টা করে, এবং সে মুগ্ধ হয়। অন্যজন তার শহুরে চোখ দিয়ে গ্রামকে দেখার চেষ্টা করে, এবং তার চোখে গ্রামের সবগুলো মানুষকে অস্বাভাবিকঠেকে। গ্রামের মানুষদের মুখে যে গান মুখে মুখে ঘুরাফেরা করে, তার অর্থ শহুরে মধ্যবিত্ত সহজে ধরতে পারে না। কিন্তু গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সেই গানের চমৎকার অর্থ দাঁড় করায়, তাদের মতো করে। প্রেমের মরা জলে ডুবে নাএই গানের গূঢ়ার্থ বৈদেশীর কাছে অপরিচিত ঠেকে, কিন্তু সব মৃত্যুই মানুষ ভুলে যায়, কিন্তু প্রেমে যে মরে তারে কেউ ভুলে নাপুষ্পের মুখে এই ব্যাখ্যা শুনে বৈদেশি চমৎকৃত হয়। গ্রামের মানুষদের মুখে মুখে যে গানগুলো ফিরে আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তের কাছে এগুলো অস্বাভাবিকঠেকে, কখনো কখনো এগুলোকে সস্তা বলেও মনে হয়। বাউল গান নিয়ে শহুরে মধ্যবিত্তের এমন ফ্যালাসির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। গ্রামে বাউল গান জনপ্রিয়’, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখনো কেন সকলের হতে পারলেন না এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সনজীদা খাতুন মন্তব্য করেছিলেন যে, বাউল গানের মর্মগ্রহণের জন্যে নতুন কোন চিন্তা বা বোধশক্তির প্রয়োজন নেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শিক্ষিত ও কর্ষিত চিন্তা ও বোধগ্রহণে সেটার দরকার। পরে সলিমুল্লাহ খান এই মন্তব্য বা এই মনোভাবের সমালোচনা করে বলেছিলেন, বাউলদের মর্মগ্রহণের জন্যে একটু-আধটু নতুন চিন্তা বা বোধশক্তি সম্ভবত অপ্রয়োজনীয় নয়।উদাহরণটা খানিক অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে কেননা নাটকের গানের দল কোন বাউল দলনা। তবু, তারা তো সেই গ্রামীণ গানের ধারারই উত্তরাধিকারী। কিন্তু তাদের গানের মর্ম শহুরে মধ্যবিত্তের কাছে কতটা অপরিচিত তারও একটা নমুনা কিন্তু এই নাটকে বেশ পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে বৈদেশির বন্ধুর কাছে গ্রামীণ পুরো জীবনরীতিটাই অস্বাভাবিক

গানের দলের ওস্তাদের একটা আলাদা জীবনরীতি আছে, যেমন, তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। সাথে আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এই ওস্তাদ কিন্তু গানও গাচ্ছেন, আবার নামাজও পড়ছেন। উপদেশও দিচ্ছেন, কখনো ফজরের নামাজ যেন কাজা না হয়। অর্থাৎ, গান ও ধর্মচর্চার সাথে তিনি/তারা কোন বিরোধ দেখতে পাচ্ছেন না। অস্বীকার করা যাবে না ঐতিহাসিকভাবে, এটা আমাদের গ্রামবাংলার আসল চরিত্র। এই বিরোধ শুধু দেখতে পায় এই জমানার মধ্যবিত্ত। তার কাছে গান ও ধর্মচর্চা বিপরীতমুখী মনে হয়। কুষ্টিয়াতে গিয়ে একজনের সাথে কথা হচ্ছিল, তিনি মাগরিবের নামাজ পড়েই আখড়ায় গান শুনতে যান। এর মধ্যে কোন বিরোধ দেখতে পান না তিনি। কেননা, এসব তার কাছে বাইরে থেকে চাপানো কোন বিষয় না; মাটি, মানূষ ও তার যাপিত জীবনের সাথে এটা এতটাই অবিচ্ছেদ্য যে এই সংস্কৃতিতাঁকে আলাদা করে রপ্ত করতে হয় না, জোর করে নান্দনিকহতে হয় না। হয়তোবা এই ধর্ম তার কাছে সংস্কৃতিরই অংশ। কিন্তু মধ্যবিত্তকে এই দুটোই মানে ধর্ম ও সংস্কৃতি রপ্ত করতে হয়; তাঁকে যেমন ধার্মিকহতে হয়, ‘সংস্কৃতিবানও হতে হয়। এই কারণে সে এদের মধ্যে বিরোধ দেখতে পায়।


এবার আসি অন্য নাটক প্রসঙ্গে।

নাইন ইলেভেনের হামলার পর পুরো ইউরোপ চমকে গিয়েছিল। এমন নৃশংসতা তো পৃথিবী জন্যে নতুন কিছু না, ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে আরও অনেক নৃশংসতাই পৃথিবী দেখেছে, তবু কেন ইউরোপ চমকে গেলো। এর একটা ব্যাখ্যা নোয়াম চমস্কি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, এত দিন ইউরোপ দেখেছে যে তারাই আক্রমণকারী, তারা এশিয়া আফ্রিকাতে আক্রমণ করছে। ইউরোপে আক্রমণ হলেও সেটা আরেক ইউরোপিয়ানই করছে। কিন্তু প্রথমবারের মতো ইউরোপ দেখলো যে এবার আক্রমণকারী বহিরাগত, মানে ইউরোপের বাইরের কেউ। এটাই ছিল চমকানোর মূল উদ্দেশ্য। সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ হলো শত্রু-মিত্রের পরিচয় নির্ধারণ করা। একবাল আহমদ যেমন টেররিজমঃ দেয়ারস এন্ড আওয়ার্সপ্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন যাদেরকে কিছুদিন আগেও মুক্তিযোদ্ধাঘোষণা দেয়া হয়েছিল, সেই তারাই আবার টেররিস্টহয়ে যাচ্ছে কিভাবে। একই ধরণের কর্মকাণ্ড হওয়া সত্ত্বেও তাদের সংজ্ঞায়ন বিপরীতমুখী হয়ে যাচ্ছে। নাইন-ইলেভেনের হামলার অজুহাতে ইরাকে আক্রমণ করা হলো, পুরো দেশটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হলো। মিডিয়ার কল্যাণে ৯/১১শব্দবন্ধ পাওয়া গিয়েছে যার সাহায্যে আমরা সহজেই টুইন টাওয়ারে হামলার দিনের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু, ইরাকের কবে হামলা হয়েছে তার জন্যে কোন শব্দআমাদের জন্যে বরাদ্দ নাই। জন পিলজার কিছু ডকুমেন্টারিই যথেষ্ট এটা বুঝার জন্যে যে, কিভাবে যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরি করে ইরাকে হামলা করা হয়েছিল, জনগণের মধ্যে এর বৈধতা আদায় করে নেয়া হয়েছিল। তিনি দেখিয়েছেন যে, বিবিসি, ফক্স বার্তা সংস্থাগুলো কিভাবে খবরকে ম্যানুপুলেট করে যুদ্ধের জন্যে জনগণের মধ্যে সম্মতি তৈরি করে, কিভাবে যুদ্ধের জন্যে উন্মাদনা তৈরি করে। তিনি এমন কয়জন সাংবাদিকদের সাক্ষাতকার নিয়েছেন যারা ইরাক যুদ্ধের আগে ইরাকে পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে টিভিতে রিপোর্ট করেছেন। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন যে, যদি মিডিয়া ক্রিটিকাল হতো, তাইলে হয়তোবা এই আগ্রাসনগুলো ঠেকানো যেত। এই যুদ্ধের মূল শিকার যে বেসামরিক লোক তা এই পিলজারের দেয়া এই তথ্য থেকেই বুঝা যাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হতাহতদের মধ্যে ১০% ছিল বেসামরিক লোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেটা হয়ে দাঁড়ায় ৫০%, ভিয়েতনাম যুদ্ধে সেটা হয় ৭০% এবং ইরাক যুদ্ধে সে সংখ্যা হয়ে যায় ৯০%। ইরাকে যখন এই বেসামরিক লোকেরা যখন মারা পড়ছিল তখন ইরাক থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার দূরত্বে বাংলাদেশে বসে একজন নাটক বানাচ্ছেন চৈত্র দিনের গান। নাটক দিয়ে তিনি প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

তো, এই নাটকে মজিদ মিস্ত্রী একজন ছোটখাটো মিস্ত্রী, অভাব-অনটনের পরিবার। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কাজে যাওয়ার সময় প্রেসিডেন্টের বুশের মুখে ছেপছুঁড়ে দেন। রাতের বেলা কাজ শেষে ইরাক যুদ্ধের খবর শোনেন। ইরাকের শিশুরা পানি পাচ্ছে না এই খবরে মজিদ মিস্ত্রীর মনটা বেজায় খারাপহয়ে যায়। ভাতের অভাব খাওন দাওনের অভাব ঠিক আছে, কিন্তু পানির অভাব এটা কেমন কথামজিদ বিষয়টা মানতে পারে না। তার সহজ সরল কথা ছোট ছোট পোলাপান, মুখে পানি নাই, তারা কি দোষ করছে। মজিদ মিস্ত্রী যুদ্ধের খবর শোনে এতটাই মর্মাহত হয় যে সে ওয়াদা করে যতদিন পর্যন্ত এই যুদ্ধ শেষ হবে না ততদিন পর্যন্ত সে পানি খাবে না। তারে যখন বুঝানো হয় যে, সে পানি না খাইলে কারো কিচ্ছু হবে না, তখন সে বলে যুদ্ধ দেখতে দেখতে তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মজিদ তার এই ওয়াদা রাখেও। নাটক শেষ হয় অসুস্থ মজিদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

নাটকে মজিদ মিস্ত্রীর মেয়ের জামাই আসে বিদেশে যাওয়ার জন্যে টাকা চাইতে। মেয়ের জামাই সৌদি যাবে, ব্যাগে সবসময় আমেরিকার পতাকা রাখে। কেননা তখন আমেরিকা আর সৌদি একে অপরের মিত্র পক্ষ। তার কাছে যুদ্ধ-টুদ্ধ কিছু না, আপাতত ক্ষমতাই বড় আকর্ষণ। আমেরিকার পতাকা মাথায় জড়িয়ে সে সহজভাবেই বলে এই জিনিস মাথায় থাকলে আর কোন চিন্তা নাই। মজিদের মেয়ের জামাই তার মেয়েকে যে কথা বলে হুমকি দেয় সেটা আমাদের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে বলে, ‘আমি প্রেসিডেন্ট বুশ, আমার হিসাবে চলবা তুমি খুব ভালো, তুমি আমার জান, তুমি আমার ময়না পাখি; আমার হিসাবে চলবানা মাথার উপরে বোমা, বুম!পূর্বে নোয়াম চমস্কি এবং একবাল আহমদের বরাত দিয়ে যে সন্ত্রাসবাদের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞায়নের কথা বলেছিলাম সে কথাটা একজন পরিচালক তার নাটকের চরিত্রে কি সুন্দর ও সহজভাবে বলিয়ে নিচ্ছেন। এটাকে কি পরিচালকের অ- রাজনৈতিকচেতনা বলে কোনভাবে উড়িয়ে দিয়ে যায়? পশ্চিমা শক্তি বা আমেরিকার পক্ষে যখন আপনি থাকবেন তখন আপনার সবদোষ মাফ, কিন্তু আপনি যদি এই শক্তির বিপক্ষে যান তাহলে আপনার প্রতি পদক্ষেপেই টেররিজমের গন্ধ পাওয়া যাবে, আপনি তখন খারাপ।

কিছুদিন পূর্বে তানভীর আকন্দ হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটা লেখা শুরু করেছিল, যদিও আলসেমির কারণে সে শেষ করতে পারে নি এখনো। বর্তমান লেখার শিরোনামের কিয়দাংশ তানভীরের লেখা থেকেই নেয়া। সে হুমায়ূন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিল যে, ‘এটা বরাবরই হচ্ছে, সমকালে অনেক শিল্পীরই সঠিক মূল্যায়ণ হয় না, বিশেষ করে নিজের সময়টাকে যারা তুলে আনে তাদের শিল্পে। এটা হয়, কারণ আমরা অতীতকে যতটা গ্লোরিফাই করি, সমকালকে বুঝতে গিয়ে ঠিক ততটাই বিভ্রান্ত হই। কারণ যেই কাল আমরা যাপন করি, তার কোনও সাধারণ প্রবণতা আমরা দেখতে পাই না, বুঝি না তার গতিপথ ঠিক কোনদিকে!সেই সাথে এও লিখেছিল, ‘...স্পষ্টতই হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম সে সময়টা পার করার সুযোগ পায়নি এখনো বা বলা যায় সময় পরিবর্তনের সাপেক্ষে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি ... হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মের প্রকৃতই কোনও গুরুত্ব রয়েছে কিনা, নাকি সেগুলি কেবলই মধ্যবিত্ত রুচি বাঁচিয়ে চলা ঝালমুড়ি সাহিত্য তা আমাদের ধারণাই বাইরেই রয়ে গেছে। এই শেষ কথার সাথে আমি শতভাগ একমত।

হুমায়ূন আহমেদের যাবতীয় সমালোচনাকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছিনা, বা খারিজ করেও দিচ্ছি না। আমি শুধু যেটা জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছি, তার সৃষ্টিকর্মগুলোকে - সব না হোক, অল্পবিস্তরই হোক - একটু অন্যভাবে বিবেচনা করতে পারি কি না। ঢালাও ভাবে মধ্যবিত্তের রুচিকিংবা অরাজনৈতিকবয়ানের বিপরীতে একটু অন্যভাবে ভাবতে পারি কি না এই হচ্ছে আমার প্রস্তাব।

তথ্যসূত্র:
১) আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারসমগ্র - নূরুল আনোয়ার
৩) ৯/১১ – নোয়াম চমস্কি
৪) একবাল আহমদ পাঠ ও বিবেচনা – শরীফ আতিক-উজ-জামান

কিছু মন্তব্য

এই লেখা ফেসবুকে পোস্ট করার পর অনেকেই লেখা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। এর মধ্যে কিছু কিছু মন্তব্য আমাদের বিষয়ের সাথে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। মানে, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমরা যে ‘অন্য’ভাবনার প্রস্তাব করছি তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিছু কিছু মন্তব্য এ নিয়ে ভবিষ্যতে আরো কাজ করারও ইঙ্গিতও দেয়। তাই, সেই মন্তব্যের দুয়েকটা এখানেও পোস্ট করে রাখলাম। যারা মন্তব্য করেছেন তাদের কোন অনুমতি ছাড়াই তাদের মন্তব্যকে জুড়ে দেয়া হলো; তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

সোহাগ পারভেজ ভাই’র মন্তব্যঃ ‘’... ... যাই হোক, হুমায়ূন আহমেদের ছোটো গল্প অনেক সমৃদ্ধ, অথচ এই দিকটা নিয়ে আলোচনা হয়না বলা যায়। জলিল সাহেবের পিটিশন সেরা গল্পের কাতারে। ইউসুফ ভাই যেদিকটা বলেন, ভাষারীতি উপস্থাপনের প্যাটার্নে রশিদ করিম যেভাবে শুরু করেছিলেন, হুমায়ূনের হাতে তা সার্থকতা পেয়েছে। হুমায়ুনের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ধরণ ও সামর্থ্য তার সফলতার জায়গা বলে আমি মনে করি। হিরণ ভাই আরও বলেন যে, মধ্যবিত্তের নানান অসংগতি বিকার বিগলন হুমায়ূন তার হিউমার ও সার্কাসের ক্যারিকেচারে দিয়ে উপস্থাপন করেন, মধ্যবিত্তকে উদোম ও ফোকলা করে বুঝিয়ে দেন যে তাদের পোশাকি কালচারাল নর্ম কতটা খেলো। ভাইয়ের এই কথার স্বপক্ষের বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের মধ্যবিত্তরা হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ কাজকে হাস্য কলরস আর আমোদ বিনোদন নিয়ে উপভোগ করেছে, নিজেদের পচনশীল কাঠামো নিয়ে হুমায়ুনের পর্যবেক্ষণ বুঝে শুনে মধ্যবিত্ত দেখেনি। আধা গ্রামীণ, মফস্বল, নগর নির্বিশেষে মধ্যবিত্তের নিউরন সেভাবে সচকিত হয়নি।”

তানভীর আকন্দের মন্তব্যঃ “তিন নম্বর লেখাটায় হুমায়ূন আহমেদ নিয়া, দুইটা পয়েন্টে আলোচনা শুরু করেছিলাম, বিস্তারিততে ঢুকি নাই। এক. হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের চশমা দিয়েই দুনিয়াকে দেখতেছে, আবার সেই মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণকেই একরকমের ক্রিটিক করতেছেন তার স্বভাবসিদ্ধ হাস্যকৌতুক দিয়ে। কখনও সেটা তীব্র ক্ষোভ বা আক্ষেপে রূপান্তরিত হয় না। এইক্ষেত্রে তার লেখায় হোরেশিয়ান স্যাটায়ারের লক্ষণ স্পষ্ট।প্রশ্ন হল, কেন এই আক্রমণ তীব্র না? কারণ ঐ মধ্যবিত্তের যে জীবনকে তিনি রূপায়ন করছেন, তার প্রকৃতিটাই অমন। কোনও কিছুই তার মধ্যে তীব্রতর হয়ে দানা বাঁধতে পারে না। জীবনের গতানুগতিকতার বাইরে সে যেতে চায় না সহজে, একটু অস্বাভাবিকতাকেও সে ভয় পায়, গ্রহণ করতে পারে না। ফলে তার ক্ষোভ, আবেগ, দ্রোহ, সবকিছুকেই হতে হয়, স্বাভাবিক, সরল, মামুলি ও গতানুগতিক। হুমায়ূন আহমেদ এই পরিসীমার মধ্যে থেকেই মধ্যবিত্তের জীবনকে নেড়ে চেড়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। আর এই কারণেই, বিশেষত, মধ্যবিত্তের চশমা দিয়ে মধ্যবিত্তরূচিকেই মৃদু আক্রমণ করার মাধ্যমে একধরনের প্যারাডক্সিকেল সিচুয়েশান তৈরি হচ্ছে। যেই প্যারাডক্স থেকে আমরা সহজে বের হতে পারি না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই স্থূল রসিকতার মাঝে যেই সূক্ষ্ম সমালোচনাটা থাকে সেটা আমাদের চোখে পড়ে না।

দুই. আমাদের যে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি গড়ে উঠেছে বিগত কয়েক দশক ধরে, এদের শ্রেণি চরিত্র কখনই প্রকট হয়ে উঠতে পারেনি। সবসময়ই একরকমের আত্মপরিচয়ের টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে গেছে। একদিকে তার ছেড়ে আসা গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সামন্ত সংস্কৃতি, অন্যদিকে নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন, এই দুটোর মধ্যে ব্যাল্যান্স করতে গিয়ে তার যেই সংকট সেটা হুমায়ূন আহমেদে বেশ প্রবলভাবেই পাই। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও এই শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত। ফলে এই সংকটটা বরং তার নিজেরই বলা যায়। একই সাথে ফিউডাল সোসাইটি ও তার সংস্কৃতির প্রতি একটা তীব্র নস্টালজিক আকর্ষণ, আবার পাশাপাশি নাগরিক যান্ত্রিক জীবনে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রবল চেষ্টা, আর এই সংকটের মধ্য থেকে বের হয়ে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে তার চরিত্রগুলোকে মাঝে মাঝে জোছনা রাতে রাস্তায় বের হয়ে পড়তে দেখা যায়, বা, বৃষ্টির দিনে কদমফুলের সন্ধানে বের হয়ে পড়তে দেখা যায়। এর মাধ্যমে জীবনকে তার একটা ফ্যান্টাসির মধ্যে আটকে ফেলার প্রবণতা দেখতে পাই আমরা। হুমায়ূন আহমেদ হয়তো মধ্যবিত্তের শ্রেণি-চরিত্র বলতে এই ব্যাপারটিকেই দাঁড় করাতে চেয়েছেন।

সেটা আরও গভীর পাঠের বিষয়। হুমায়ূন আহমেদ, শওকত আলীসহ অন্যান্য লেখকদের বুঝতে গেলে আসলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের প্রেক্ষাপটটা বুঝতে হবে। তা না হলে হুমায়ূন আহমেদকে ছেদ করা সম্ভব না বলেই মনে হয়।”

সারোয়ার তুষারের মন্তব্যঃ “হুমায়ূন আহমেদের 'ফেরা' উপন্যাসটা পড়সো নাকি তোমরা? হুমায়ূনের সাহিত্যকে দুইভাগে ভাগ করতে দেখসি তাঁর ক্রিটিকদের। 'সিরিয়াস' আর 'বাজারি''সিরিয়াস' সাহিত্যের মধ্যে নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাস দুইটারে ফেলা হয়। আরো দুই চারটা থাকতে পারে। নাম মনে পড়ছেনা। আর বাদবাকি ম্যাক্সিমামই 'বাজারি' সাহিত্য বলে বিবেচিত। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় 'অপন্যাস'। তো 'অপন্যাস' এর বিপরীতে 'নান্দনিক উপন্যাস' আজাদ লিখসেন ১১ টা সম্ভবত। সেইগুলা নিয়া আর কিছু না বলি। মহা 'নান্দনিক' উপন্যাস সেইগুলান! তো যেইটা বলতে চাচ্ছিলাম, আহমেদের 'ফেরা' উপন্যাসটা নানা কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমার। ভাটিয়ালি গ্রাম, গ্রামের সংস্কৃতি, রাজনীতি সবই আছে চমৎকারভাবে। এবং ক্রিটিকরা যদি হুমায়ূনকে নিয়া প্রচলিত কুসংস্কার দ্বারা চালিত না হয়ে 'ফেরা' উপন্যাসটা বিচার করতে বসেন, এইটা বাংলা সাহিত্যের 'সিরিয়াস' উপন্যাসের স্বীকৃতি পাওয়ার কথা।”

সারোয়ার তুষারের মন্তব্যের বিপরীতে তানভীর আকন্দের মন্তব্যঃ “এইটা নিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন আলোচনাই টানা যায়, শুধু 'ফেরা'ই না আরও কিছু জায়গায় গ্রামীণ সংস্কৃতির ব্যাপারগুলো যেভাবে আসতেছে। হুমায়ূন আহমেদের গ্রাম কিন্তু শহুরে চোখ দিয়ে দেখা ছিল না, আজকালকার ফারুকীয় ঘরনার নাটকগুলোতে যেমন দেখি, গ্রাম মানেই টিনের ঘর, একটা দীঘি, ধানক্ষেত আর কাঠালবাগান- এই ফর্মুলার বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু হুমায়ূন আহমদের গ্রামগুলো আরও অনেক জীবন্ত ও বাস্তব, তিনি গ্রামের চিত্র তৈরি করতেছেন অনেক সূক্ষ্মভাবে, ঐসব ফর্মুলার বাইরে এসে সন্ধ্যার পরে ঘরে বাতি দেয়ার মতো কুসংস্কারগুলোও বেশ গুরুত্বের সাথে তুলে আনতেছেন। এইটাই তার কাছে গ্রামীণ সংস্কৃতি।

আর তার বিভিন্ন সিনেমা, নাটক ও বইগুলাতে, বিশেষ করে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ অঞ্চলের ভাটিয়ালি, বাউল সংস্কৃতিকে যেভাবে তুলে আনছেন অন্যকিছু বাদ দিলে একমাত্র সেটার জন্যই হুমায়ূন আহমেদ অন্য অনেকের চেয়েও ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।”


No comments:

Post a Comment