কাহলিল জিব্রানকে আমরা যেভাবে
চিনি ও জানি, বিশেষ করে তার বহুল পঠিত ‘দ্যা প্রফেট’ কিংবা বিভিন্ন
প্যারাবল এর মাধ্যমে, তাতে তার ‘কবি’ এবং ‘ধ্যানমগ্ন ঋষি’
পরিচয়
যতটা পাওয়া যায়, ‘বিদ্রোহী’ পরিচয় ততটা পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ‘কবি’ পরিচয় যে অন্যান্য সব
পরিচয়কে ছাড়িয়ে গিয়েছে সেটা তাঁর এক অনুবাদকের মন্তব্য থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়। “শুধু কবিতা বলি কেন,
তাঁর
দর্শন, চিত্রকলা, গল্প, উপন্যাস সবই কবিতা”। কিন্তু, তাঁর ‘বিদ্রোহী’ পরিচয়ের সন্ধান না
পেলে জিব্রান পরিপূর্ণভাবে আমাদের কাছে ধরা দিবেন না।
তাই, ‘ভালোবাসাকে তুমি পথ দেখাতে যেও না, বরং যদি যোগ্য হও,
ভালোবাসাই
তোমাকে পথ দেখাবে’ এমন ভাবের বাইরেও যে
আরেক জিব্রান আছেন যিনি কিনা সমাজের সকল প্রচলিত রীতিনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন, ধর্মীয় ভণ্ডামি ও শাসকদের মুখোশ উন্মোচন করছেন সেটা আমাদের
আড়ালে রয়ে যায়। লেখক হিসেবে জিব্রানের আত্মপ্রকাশ ঘটে যে বইয়ের মাধ্যমে সেই ‘স্পিরিটস রেবিলিয়াস’
বা ‘বিদ্রোহী আত্মা’
প্রকাশিত
হওয়ার পরপর লেবাননের ক্যাথলিক গির্জা থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়, লেবানন থেকে থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। আর, ‘বিদ্রোহী আত্মা’কে বৈরুতে পোড়ানো হয়।
জিব্রানের এই বইয়ের গল্প সংখ্যা
তিনটি। প্রতিটা গল্পে তিনি সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে চরম সমালোচনামূলক
বাক্য উচ্চারণ করেছেন। মানুষের তৈরি সকল আইন-কানুনকে প্রশ্ন করেছেন, সেটা যেমন অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে, তেমনি বিয়ে-আইন-আদালত-বিচারব্যবস্থা নিয়েও। মানবসৃষ্ট এই
আইন-কানুনকে তিনি ‘অনৈতিক’ ঘোষণা করেছেন, সাথে এও উল্লেখ করতে
ভুলেন নাই যে এই ‘অনৈতিক’ কাজ করা হয় নৈতিক মূল্যবোধের নামে। তার এই গল্পগুলোর কয়টা
গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে, যেমন, প্রথমত, এটা তৎকালীন লেবাননের
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা তুলে ধরে। সামন্ততন্ত্রের নিচে গরীবদের পিষে মরার ছবি
বেশ ভালোভাবেই বুঝা যায়; ধর্মীয় ও রাজনৈতিক
দুই ফায়দাই সামন্ত-প্রভুদের কবলেই থাকতো। দ্বিতীয়ত, এই বই জিব্রানের দার্শনিক অবস্থান বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। জিব্রানের
গবেষকরা বলেন যে, তার দার্শনিক অবস্থা
পরবর্তীতেও খুব একটা পরিবর্তন হয় নাই,
অবশ্য, জিব্রান আর কোন বইতে এত সরাসরি ‘উচ্চারণ’ করেন নি। এই বই
পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, জিব্রানের সাহিত্যে
যখন ‘গড’, ‘হেভেন’, ‘ইটারনাল ল’, ‘ভালোবাসা’ এমন শব্দসমূহ পাওয়া
যায় (এগুলো প্রচুর আছে) তখন প্রচলিত অর্থে বিবেচনা করলে মুশকিল তো হবেই, সাথে তাঁর সৌন্দর্যও উপভোগ করা সম্ভব না, মূল সুরও ধরা যাবে না।
জিব্রানকে নিয়ে যারা কাজ
করেছেন তারা জানান যে, জিব্রান বুদ্ধ, রুশো, নীৎসে, উইলিয়াম ব্লেক এবং বাইবেল দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কখনো
চিন্তা, কখনো লেখার আঙ্গিক, কখনো গল্প বলার ধরণ। জানা যায় যে জিব্রান বারো তেরো বছর বয়স
থেকেই নীৎসে পড়তেন। তিনি আদর করে বলতেন,
‘the loneliest man of the nineteenth century and surely the greatest’. তাঁর লেখা এবং গল্প
বলার ঢং সহ অনেক কিছুতেই নীৎসের প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে। প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও
নিয়ম-কানুনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি তাঁর কথাগুলো মসীহের সুরে কিভাবে মানুষের
কাছে পৌঁছানো যায়, সেটা তিনি শিখেছিলেন
নীৎসের কাছ থেকে। আবার, নীৎসের দর্শনের বিপদ সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। তাই বলতেন, “I thought his philosophy was terrible and all
wrong. I was a worshipper of beauty and beauty was to me in the loveliness of
things.”
দুই
যাই হোক, আমরা কাহলিল জিব্রানের ‘বিদ্রোহী আত্মা’র কাছে ফিরে যাই।
গল্পের সংখ্যা তিন হলেও, আমরা আলোচনা করবো
মাঝের জনকে নিয়ে। নাম ‘কবরের কান্না’ (The Cry of the Graves) । গল্পে প্রবেশ করি আদালতের
দৃশ্য দিয়ে। আমির, মানে বিচারকের আদালতে
প্রবেশের সাথে সাথে আমরাও গল্পে প্রবেশ করার অনুমতি পাই। তিনটা ঘটনা আমরা দেখি।
প্রথম ঘটনা একজন যুবককে কেন্দ্র করে। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারী কর্মকর্তাকে খুন করার
অভিযোগ উঠেছে। আমিরেরে লোকজন যুবককে যখন গ্রেফতার করে তখনও তাঁর হাতের রক্তমাখা
ছুরি থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছিল। সে পালানোর চেষ্টাও করে নি। ঘটনার ভয়াবহতায়
আমির ফাঁসির আদেশ দেন। গল্পের কথকের মাধ্যমে আমরা কিছুক্ষনপর সাক্ষাৎ পাই এক
তরুণীর। শোকাহত তরুণীর মুখে এই ঘটনার ‘শেকড়’ জানা যায়। আমিরের লোকবল খাজনা আদায়ের জন্যে তাদের বাড়িতে
আসেন। তরুণীর পিতাকে অতিরিক্ত খাজনা দেয়ার জন্যে আদেশ দিলে পিতা জানান যে তিনি এই পরিমাণ খাজনা দিতে
অসমর্থ। খাজনা আদায়কারীরা তখন ‘টোকেন’ হিসেবে তরুণীকে নিয়ে যেতে চাইলে এই তরুণের আবির্ভাব হয়
উদ্ধারকারী হিসেবে। খাজনা আদায়কারীর তলোয়ার দিয়েই দণ্ডপ্রাপ্ত আমাদের এই যুবক সেই
কর্মকর্তাকে খুন করে বসে, সেটা এই তরুণীকে
বাঁচাতেই। তরুণীর দৃষ্টিতে এই যুবক একজন বীর।
দ্বিতীয় ঘটনা এক তরুণীকে
কেন্দ্র করে, ব্যভিচারিণী অভিশাপে আদালত
তাকে উলঙ্গ করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করানোর এবং পাথর ছুঁড়ে মারার আদেশ দেন। গল্পের
কথক আরও দূরে গিয়ে আমাদের সাথে দেখা করান এই তরুণীর প্রেমিকের সাথে। প্রেমিক তখন
পরম-ভালোবাসায় অশ্রু ও রক্তসিক্ত পৃথিবী দিয়ে এই তরুণীর দেহ ঢেকে দিচ্ছিল। তারা
প্রেমাসক্ত সেই বাল্যকাল থেকে। ভালোবাসায় দিনকে রাত রাতকে দিন বানাচ্ছিল। স্বয়ং
আল্লা এসে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের মনমন্দিরে। কিন্তু, জোর করেই তরুণীর পিতা অন্যের সাথে তাঁর বিয়ে দেন। বিচ্ছেদের বিষে নীল হয়ে
প্রেমিক এক রাতে দেখা করতে গিয়েছিল তাঁর বহু সাধনার প্রেমিকার সাথে। কপাল ফেরে
দুজনেই ধরা পড়ে যায় প্রেমিকার স্বামীর সাথে। পুরো এলাকা রটিয়ে দেয়া হয় এই মেয়ে
ব্যভিচারিণী। আদালতের হাতে তোলা দেয়া হয় তরুণীকে।
তৃতীয় ঘটনা এক বৃদ্ধকে
কেন্দ্র করে। অভিযোগ উঠেছে চুরির। এই বৃদ্ধ বয়সের ভারে পেশি শক্তিতে খানিক দুর্বল
হয়ে পড়লে মালিক তাকে তাড়িয়ে দেয়। বউ-বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মাঝ-সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে আশ্রয় নেয় শহরে। সেখানেও
একই অবস্থা। কেউ দুর্বল লোকদের কাজ দিতে চায় না, সবাই সবল ও জোয়ান মানুষ চায়। অনাহারী বউ-বাচ্চাদের মুখের চেহারা সহ্য করতে না
পেরে এই শেষবয়সে শেষেমেষে আশ্রয় নেয় চুরির। কিন্তু সেখানেও ধরা পড়ে যায়। তোলা হয়
আদালতে। আমির চরম ঘৃণাভরা কণ্ঠে এই চোরকে মৃত্যুর দণ্ড দেন। মাঠে পড়ে থাকা লাশকে
পরম আদরে বৃদ্ধার স্ত্রী পৃথিবীর বুকে জমা রেখে চলে যান।
এই তিনটা ঘটনার প্রেক্ষিতে
গল্পবয়ানকারী আমাদের ভদ্রসমাজের সামনে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। তিনি বলেন, তিনজন মানবসন্তান,
যারা
গতকালও জীবনের কোলে লুটোপুটি খাচ্ছিল,
তারা আজ
মানবসমাজের নিয়ম ভাঙ্গার অপরাধে আজরাইলের শিকার হতে হয়েছে। যখন একজন লোক আরেকজনকে
হত্যা করে, সবাই তাকে খুনি বলে, কিন্তু যখন আমির তাকে হত্যা করে, সেটা হয়ে যায় বিচার। যখন একজন লোক চুরি করে, তখন তাকে সবাই চোর বলে, কিন্তু যখন আমির তার জীবন থেকে তাকেই চুরি করে ফেলেন, তখন তিনি হোন সম্মানিত। যখন একজন নারী তার স্বামীর সাথে
বিশ্বাসঘাতকতা করেন তখন সবাই বলে ব্যভিচারিণী, কিন্তু যখন আমির তাকে উলঙ্গ করে রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য করেন এবং পরবর্তীতে পাথর
ছুঁড়ে মারেন, তখন আমির হোন মহান। রক্ত
ঝরানো যদি নিষিদ্ধই হয়, তবে কে এটা আমিরের
জন্যে আইনসম্মত করে দিল? কারো টাকা চুরি করা
অপরাধ, কিন্তু কারো জীবন ছিনিয়ে নেয়া
মহান কম্ম। স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কদাকার হতে পারে, কিন্তু জলজ্যান্ত আত্মাকে পাথর ছুঁড়ে মারা সুন্দর। এক
দুর্নীতিকে পরাস্ত করতে আরও বড় দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া কিভাবে আইন হতে পারে? এক অপরাধকে পরাস্ত করতে আরও অসংখ্য অপরাধ করাটা কিভাবে ন্যায়বিচার
হতে পারে? আমির কি তার অতীত জীবনে কোন
শত্রুকে হত্যা করেন নি? এরা কারা যারা চোরকে
গাছে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে? উনারা কি বেহেশত থেকে
নাজিল হওয়া ফেরেশতা নাকি স্রেফ লুটপাটকারি ও দখলকারী? কে খুনির মস্তক ছিন্ন করলো? তারা কি পবিত্র নবী-রসুল নাকি রক্তের বন্যা ছোটানো সৈনিক? কারা ঐ ব্যভিচারিণীকে পাথর ছুড়ে মেরেছে? তারা কি কোন নিষ্পাপ মুনিঋষি নাকি নৃশংস অত্যাচারী? তারা নৃশংসতার উল্লাস করে অন্ধ, মূঢ় আইনের অধীনে। আইন জিনিসটাই বা কি? তাকে সূর্যের রশ্মির সাথে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় আসতে কেউ কি
দেখেছে? নাকি, মানুষ আল্লার হৃদয় থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে? কোন যুগে ফেরেশতারা মাটির এই দুনিয়ার বুকে হেটে হেটে এসে
মানুষের কাছে এগুলো দিয়ে গেছেন? কবে তারা বলেছেন যে, ‘দুর্বলকে তার জীবন উপভোগ করতে নিষিদ্ধ করো, এবং যে আইন ভঙ্গ করবে তাকে তলোয়ারের চকচকে ধারালো প্রান্ত
দিয়ে হত্যা করো, এবং পাপীদেরকে পিষে
মারো?’
তিন
কাফকাও এই মানবসৃষ্ট
আইন-আদালতের অসারতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর ‘Before the law’র কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। আইনের সহায়তা নেয়ার জন্যে এক
গেঁয়ো লোক এসেছিল। আইনের দরজার সামনেই তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আইনের প্রহরীর মুখে
নির্দেশনা শুনে সে থমকে দাঁড়ায়, এতসব জটিলতা লোকটা
আশা করে নাই। তবু সে অপেক্ষা করতে থাকে। আইনের প্রহরী তাকে একটা চেয়ারও এনে দে
দরজার সামনে বসার জন্যে। বছরের পর বছর সে অপেক্ষা করতে থাকে। আইনের প্রহরীকে
মাঝেমধ্যে গালাগালিও দেয়, নিজের ভাগ্যকেও
দোষারোপ করে। কিন্তু সে আর প্রবেশ করতে পারে না। একসময় কাফকা আমাদের শোনান,
অবশেষে তার চোখের
পাতা ভারি হয়ে আসতে থাকে, সে ঠিক বুঝতে পারে না
চারপাশের পৃথিবীই কি অন্ধকার হয়ে আসছে নাকি তার দৃষ্টিই তার সাথে প্রতারণা শুরু
করেছে। এমনকি এই অন্ধতা সত্ত্বেও আইনের প্রবেশপথ হতে বিচ্ছুরিত এক অদম্য আভা সে
দেখতে পায়। আর বেশি সময় নেই। মৃত্যুর পূর্বে এতবছরের সমস্ত স্মৃতি তার চিন্তার
কেন্দ্রবিন্দুতে জড়ো হতে থাকে, একটি প্রশ্ন সে এখনও
জিজ্ঞেস করেনি প্রহরীকে। প্রহরীর উদ্দেশ্যে সে হাত নাড়ে, নিজের এই জড়তাগ্রস্ত শরীর নাড়াতেও সে অক্ষম। প্রহরী লোকটিকে
কুঁজো হতে হল, দুইজনের উচ্চতার পার্থক্যই
লোকটির অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। “বড্ডো নাছোড়বান্দা
লোক দেখছি তুমি, কী জানতে চাও বল?”- প্রহরী বলল। লোকটি জিজ্ঞেস করে “আইনের অধিকার পাবার জন্যে সবাই লড়াই করে, কিন্তু এত এত বছরে আমি ছাড়া আর কাউকেইতো আসতে দেখলাম না
এখানে?” প্রহরী বুঝতে পারল লোকটির
অন্তিম অবস্থা সমাগত। লোকটির কানের কাছে সে চিৎকার করে বলল যাতে তার বিকল
ইন্দ্রিয়গুলো সেই শব্দ ধরতে পারে, “আর কেউ কোনও কালেই
এখানে প্রবেশের অনুমতি পাবে না, এ তোরণ কেবলমাত্র
তোমার জন্যেই তৈরি হয়েছে যা এখন বন্ধ হয়ে যাবে।” [আইনের দরজায়, অনুবাদ - তানভীর
আকন্দ]
কাফকা আমাদের দেখাচ্ছেন যে, এই মানবসৃষ্ট আইনের কাছে যারা ন্যায়বিচার চাইতে যায় তারা
কখনোই ন্যায়-বিচার পায় না, বরং তাদের অধিকার
আদায়ের পূর্বেই তারা মারা যায়। এই আইনের প্রহরী যেমন সরাসরি ‘আইনে’র কাছ থেকে কোন আদেশ
পায় নি, আদেশ পেয়েছে তাঁর উপরের
প্রহরী থেকে, তেমনি কেউ জানেনা এই ‘আইন’ কিভাবে এসেছে।
জিব্রানও তাঁর প্যারাবলে অনেকটা প্রবন্ধের মতোই সরাসরি প্রশ্ন করছেন, আইন জিনিসটাই বা কি?
তাকে
বেহেশত থেকে দুনিয়ায় আসতে কেউ কি দেখেছে?
নাকি, মানুষ আল্লার কাছে থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে?
কাফকা যেমন করে ‘কর্তৃত্বে’র বিপদ সম্পর্কে
সচেতন ছিলেন, তেমনি জিব্রানও। জিব্রানের ‘বিদ্রোহী আত্মা’র পুরোটা জুড়েই সেই ‘কর্তৃত্বে’র সমালোচনা। এই
প্যারাবলে আইনকে দেখালেও বাদবাকি দুই প্যারাবলে বিয়ে ও রাজনৈতিক অবস্থাকেও একই
ধারায় সমালোচনা করেছেন। অর্থাৎ, জিব্রানের ‘বিদ্রোহী আত্মা’
মূলত
কর্তৃত্বপরায়নাতার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ। বিদ্রোহ করছেন ঐতিহ্য বলে যে বস্তাপচা
জিনিসগুলোকে আমরা আঁকড়ে ধরে বসে থাকি তাঁর বিরুদ্ধে। আমাদের সবসময় এই শিক্ষাই দেয়া হয় যে, আইনের শাসন মেনে চলো,
শাসককে
মেনে চলো। জিব্রানের বিদ্রোহ এই শিক্ষার বিরুদ্ধেও। কাজিনের কাছে লেখা এক চিঠিতে
জিব্রান লিখছেন,
“The people in Syria are calling me heretic, and
the intelligentsia in Egypt vilifies me, saying, He is the enemy of just laws,
of family ties, and of old traditions. Those writers are telling truth, because
I do not love man-made laws and I abhor the traditions that our ancestors left
us. This hatred is the fruit of my love for the sacred and spiritual kindness
which should be the source of every law upon the ears, for kindness is the
shadow of God in man…” [Wings of
thought]
মানবসৃষ্ট আইনকে না-মানার এই
যে প্রচেষ্টা জিব্রানের মধ্যে তা তাকে অনেকটা ‘আইন ব্যবস্থার’ কট্টর সমালোচক
এনার্কিস্টদের পাশে নিয়ে যায়। যেমন পিটার ক্রপোটকিন তাঁর এক লেখায় এই ‘আইনের শাসন’কে প্রশ্নবিদ্ধ করে
বলছেন, “প্রতিটি আইনের নামে যে অপকর্ম
করা হয় এবং এর মাধ্যমে ভালো যা কিছু হয় তার তুলনা করে দেখুন। এই ভালো আর মন্দকে
মেপে দেখুন। তা হলেই বুঝতে পারবেন আমরা সঠিক কি না।” সাথে এও বলছেন, “আর কোনো আইন নয়! আর
কোনো বিচারক নয়! স্বাধীনতা, কেবল সমতা ও বাস্তব
মানবীয় সমবেদনা হলো একমাত্র কার্যকর দেয়াল যা দিয়ে আমাদের মাঝের নির্দিষ্ট কিছু
মানুষের সমাজবিরোধী প্রবৃত্তির মোকাবিলা করা সম্ভব।” প্রচলিত আইন এবং এর বিকল্প কি হতে পারে সে বিষয়ে জিব্রানের ভাবনা অনেকটা তাঁর
মতোই। এই জন্যে দেখা যায় ‘বিদ্রোহী আত্মা’কে নিয়ে জিব্রান-বিশ্লেষকরা সমস্যায় পড়ে যান। জিব্রানের এই
দুঃসাহসী উচ্চারণ বিশ্লেষণ করে তাঁর দার্শনিক অবস্থান পরিষ্কার করতে তাদের বেশ বেগ
পেতে হয়। তাই বারেবারে তাদের বলতে হয় এবং বিভিন্নভাবে নিশ্চয়তা দিতে হয় যে, জিব্রান এনার্কিস্ট ছিলেন না। জিব্রান এনার্কিস্ট ছিলেন না
সত্য, কিন্তু ঘোর ‘কর্তৃত্বপরায়নবিরোধি’
ছিলেন
সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রমাণ যেমন এই গল্প, তেমনি অন্যান্য গ্রন্থও। তাঁর এক বিশ্লেষকও বলেছেন, জিব্রান প্রথাগত গণতন্ত্রেও বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি বরং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস ছিলেন এবং সেটা মুক্তিপরায়ন
সমাজতন্ত্র।
আমাদের বিচার ব্যবস্থা যে ‘প্রতিশোধ প্রবণ’
সেটা
জিব্রান ভালো করেই জানতেন এবং সেজন্যে প্রশ্নও তুলছেন। খুন করা অপরাধই হয়, তবে বিচারকের খুন কেন ‘বিচার’ হয়ে যায়? সেই সাথে ব্যক্তি যে অপরাধ করে তাঁর উৎস কোথায় এর সন্ধানও
তিনি করেছেন আলোচ্য গল্পে। আমাদের প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ‘ব্যক্তি মানুষ’কে ক্রিমিনালাইজ করার
যে প্রবণতা দেখায়, এর বিরুদ্ধেও
জিব্রান সচেতন। মানুষের মানবীয়তার দিকেই
তাঁর দৃষ্টি। এই দৃষ্টির পূর্নাঙ্গ ছবি পাওয়া যায় তাঁর এই ‘স্পিরিট রেবিলিয়াস’
গ্রন্থের
তিনটা প্যারাবলেই। পূর্বেই বলেছি তাঁর দর্শনের এই সুর অন্যান্য গ্রন্থেও বিদ্যমান
ছিল। তেমনি ছিল বিখ্যাত ‘দ্যা প্রফেটে’ও। অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ে প্রেরিতপুরুষ অর্ফালিসের মুখে
জিব্রানের কথা দিয়েই লেখাটার ইতি টানি এইবার।
“And if any of you would punish in the name of
Righteousness and lay the axe unto the evil tree,
let
Him see to its roots.” (The Prophet)
“ন্যায়পরায়ণতার কথা বলে কেউ যদি দণ্ডদান করে,
কুঠার চালাতে চায়
পাপবৃক্ষকে,
যে যেন বৃক্ষের শেকড়
দেখে।” [অনুবাদ: সুরেশ রঞ্জন বসাক]
সহায়ক গ্রন্থ:
১) Kahlil Gibran: wings of thought; the people's
philosopher - Joseph P Ghougassian.
২) Beforethe law - Franz Kafka, অনুবাদ : তানভীর
আকন্দ।
৩) পিটার ক্রপোটকিনের আইন ও
শাসন একটি এনার্কিস্ট প্রবন্ধ - অনুবাদ : মাজহার জীবন ও জাভেদ হুসেন, রাষ্ট্রচিন্তা, বর্ষ ২ সংখ্যা ১।
৪) The Prophet - Kahlil Gibran; অনুবাদ : সুরেশ রঞ্জন
বসাক।
No comments:
Post a Comment