জঙ্গিবাদ নিয়ে আমাদের
যাবতীয় আলাপ-আলোচনা দু'ধরণের প্রথাগত ডিসকোর্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
একপক্ষের কথা হচ্ছে, জঙ্গিবাদ ইউরো-মার্কিন দখলদারিত্ব ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে
তাদেরই আলো-হাওয়ায় পুষ্টিলাভ করা এক দানব ; আবার
আরেকপক্ষের কথা হচ্ছে, যেহেতু বর্তমান সময়ের জঙ্গিরা
ইসলাম ধর্মের সাথে যুক্ত সেহেতু খোদ ইসলামেই এই সহিংসতার বীজ লুকিয়ে আছে। আমাদের
আলোচনা এই দুই প্রভাবশালী যুক্তির সাথে মত-দ্বিমতের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের কারণ ও
প্রবণতাকে যাচাই বাছাই করতে চাইবে। তবে, ফরাসি গবেষক
অলিভার রয় এই চিরায়ত আলোচনায় একেবারে নতুন ও চমকপ্রদ কিছু তথ্য ও তত্ত্ব হাজির
করেছেন। কারা জঙ্গিবাদের বর্তমান পর্যায়ে এসে আইএস এর ডাকে সাড়া দিচ্ছে ; এটাই তাঁর মূল অনুসন্ধানের বিষয়।
নমুনা (sample) হিসেবে তিনি নিয়েছেন ফরাসি দেশের
মাটিতে বিস্তার লাভ করা জঙ্গিদের তথ্য;
বিশেষ করে ফ্রান্স, বেলজিয়াম সহ
ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে আক্রমণকারীসহ যারা জিহাদে অংশ নেয়ার জন্যে ফ্রান্স
ছেড়ে গিয়েছেন এমন প্রায় ১০০ জনের তালিকা তৈরি করেছেন। পুলিশ ও সাংবাদিকদের মারফত
এবং তাদের সোশিয়াল মিডিয়ার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের জীবনবৃত্তান্ত
তদন্ত করে দেখেছেন। অলিভার রয় এই
জিহাদিদের বলছেন homegrown jihadi। এবং, তাদের জীবন বৃত্তান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা
করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন যে, এরা মূলত সহিংস নিহিলিস্ট যারা
ইসলামকে আশ্রয় করেছে।
অলিভার রয় গত দুইযুগের
জিহাদি সন্ত্রাসের সাথে পূর্বের জিহাদি সন্ত্রাসের গুরুত্বপূর্ণ অমিল লক্ষ্য
করেছেন। জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদ প্রায় অনেক বছর যাবতই ‘বিশ্বায়িত’ সন্ত্রাস হিসেবে বিদ্যমান, অন্তত উনিশ শতকের
নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন থেকে। ‘বিশ্বায়িত’ সন্ত্রাস বলতে বোঝানো হচ্ছে, কোনো জাতীয়
সীমানা বিবেচনায় না এনে অতিশয় প্রতীকী স্থাপনাসমূহ ও বেসামরিক লোককে লক্ষবস্তু করা
হয়। কিন্তু, অন্যান্য যেকোন সময়ের জিহাদি কার্যকলাপের
সাথে বর্তমানে পর্যায়ের জঙ্গিবাদের একেবারে মৌলিক তফাত হলো, মৃত্যু এখন আর জিহাদি কার্যক্রমের সম্ভাব্য অনুষঙ্গ নয় বরং জঙ্গি
তৎপরতার একেবারে গোড়ার বিষয় মৃত্যু। অর্থাৎ বর্তমানে জঙ্গিরা নিহত হওয়ার
স্বপ্রণোদিত তাগিদ থেকেই জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে।
এই তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য মাথায় রেখে আমাদের জঙ্গি সহিংসতার সুলুকসন্ধান
করতে হবে।
ফ্রান্সে গত বিশ বছরে, একেবারে
১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত, যেসকল বোমা হামলা হয়েছে তার
সবগুলোতে প্রায় প্রত্যেক সন্ত্রাসীরাই হয় নিজেদের উড়িয়ে দিয়েছে অথবা পুলিশের হাতে
মারা পড়েছে। ২০১২ সালে তুলুজের (Toulouse) একটি ইহুদি
স্কুলে আক্রমণ করে একজন রাব্বী এবং তিনজন শিশুকে হত্যা করা হয়। আক্রমণকারীর নাম
ছিল মোহাম্মদ মেরাহ; সে এমন একটা বাক্য আওড়াচ্ছিল যা
ওসামা বিন লাদেনের নামে চালু আছে এবং অন্যান্য জিহাদিরাও নিয়মিত জপতোঃ “We
love death as you love life” (আমরা মৃত্যুকে ভালোবাসি, তোমরা যেমন জীবনকে ভালোবাসো)। তার মানে, জঙ্গি
সন্ত্রাসীদের মৃত্যু এখন আর তাদের কৃতকর্মের সম্ভাব্য অথবা দুর্ভাগা ফলাফল নয়,
বরং এটা তাদের পরিকল্পনার একেবারে কেন্দ্রীয় অংশ। মৃত্যুর প্রতি
মোহ (fascination) ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়া জিহাদিদের
মধ্যেও দেখা যায়। অলিভার রয় বলছেন যে, এই জিহাদিরা
আত্মঘাতী হামলাকে তাদের সংযুক্তির চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবেই গ্রহণ করেছে।
এভাবে মৃত্যুকে
নিয়মতান্ত্রিকতায় পরিণত করা , অলিভার রয়ের মতে, একেবারে নতুন বিষয়। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ সালের দিকে ফ্রান্সে যেসকল সন্ত্রাসী
আক্রমণ করে, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে তাদের সংযোগ থাকুক আর নাই
থাকুক, তারা পালানোর জন্যে সতর্কভাবে পরিকল্পনা করেছিল।
মুসলিম ঐতিহ্য যুদ্ধের ময়দানে নিহতদের শহিদি মর্যাদা দিলেও যারা নিজেরা নিজেদের
মৃত্যু ঘটায় মানে আত্মহত্যা করে তাদের জন্যে কোনো পুরষ্কারের ব্যবস্থা রাখে নি,
বরং আত্মহত্যাকে অন্যায়-অনৈতিক মনে করেছে। কারণ, ইসলাম মনে করে, যারা আত্মহত্যা করে তারা
আল্লাহর ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ ঘটায়। তাহলে গত বিশ বছর যাবত সন্ত্রাসীরা কেন নিয়মিত
মৃত্যুকেই বেছে নিচ্ছে? সমসাময়িক ইসলামিক র্যাডিকালিজম
বিষয়ে এই তথ্য আমাদের কী জানান দেয়? এবং আমাদের এখনকার
সামাজিক সম্পর্ক ও মূল্যবোধের রূপান্তরের কী ইশারা দেয়? অলিভার
রয়ের একেবারে গোড়ার প্রশ্ন মূলত শেষেরটি। অলিভার রয়ের মতে, এই শেষের প্রশ্নটি বেশি প্রাসঙ্গিক, কেননা এটা
আমাদের দেখায় যে, মৃত্যুর প্রতি এমন মনোভাব সমসাময়িক
জিহাদিবাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মাঘরেব, তুরস্কসহ ইউরোপে এই জিহাদিবাদ এমন একটা
যুব আন্দোলন যা শুধু পিতামাতার ধর্ম ও সংস্কৃতির কারণেই নির্মিত হয়নি বরং, এর শিকড় যুব-সংস্কৃতিতে (youth culture) প্রোথিত।
আধুনিক জিহাদিবাদের এই দিকটাই মৌলিক।
অলিভার রয় জানাচ্ছেন যে, যেখানেই
এমন generational hatred ঘটে, সেখানে
এটা সাংস্কৃতিক আইকনোক্লাজমের আকার নেয়। শুধু যে মানুষকে ধ্বংস করা হয়, তা না ;বরং মূর্তি, ভাস্কর্য,
ভজনালয়, বই-পুস্তকও ধ্বংস করা হয়।
স্মৃতিকে ধ্বংস করা হয়। অলিভার রয় অতীত থেকে উদাহরণ দিতে গিয়ে মাও সে তুঙয়ের রেড
গার্ড এবং কম্বোডিয়ার খেমার রোজের সাথে আইএসের যোদ্ধাদের একটা মিল দেখাচ্ছেন।
তাদের সকলের লক্ষ্য হচ্ছে, ‘“Wiping the slate clean”। প্রায় হুবুহু
একজন ব্রিটিশ জিহাদিও লিখেছিল, ‘যখন আমরা লন্ডন প্যারিস এবং
ওয়াশিংটনের রাস্তায় অবতরণ করবো, আমরা শুধু তোমাদের রক্তই
ঝরাবো না, বরং, আমরা তোমাদের
মূর্তি ভাঙবো, তোমাদের ইতিহাস মুছে দেবো এবং সবচেয়ে
বেদনাদায়ক-ভাবে, তোমাদের বাচ্চাদের ধর্মান্তরিত করবো যারা
আমাদের নামে জয়ধ্বনি করবে এবং তাদের পূর্বপুরুষদের অভিশাপ দিবে’।
যদিও সকল বিপ্লবই
তরুণদের শক্তি ও উদ্দীপনাকে আকৃষ্ট করে, তবু অধিকাংশই অতীতকে মুছে ফেলতে
চায় না, যা ঘটেছে তা ধ্বংস করার চেষ্টা করে না। উদাহরণ
হিসেবে অলিভার রয় ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব এবং
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। বলশেভিকরা তাদের অতীতকে
ধ্বংস না করে বরং জাদুঘরে স্থান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং ইরানিরা কখনোই পারসেপোলিসকে
উড়িয়ে দেয়ার কথা বলেনি।
নতুন জিহাদিবাদের এই
আত্ম-ধ্বংসাত্মক দিকের সাথে, অলিভার রয়ের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সম্পর্ক খুবই অল্প। আত্মঘাতী হামলা কৌশল
হিসেবেও counterproductive, সেটা যেমন রাজনৈতিক দিক থেকে,
তেমনি সামরিক দিক থেকেও। আইএস যতই খেলাফতের পুনরুদ্ধারের দাবি
করুক না কেন, তাদের এই নিহিলিজম কোনো রাজনৈতিক সমাধানে
পৌঁছানো অসম্ভব করে ফেলছে, এমনকি যেকোনো স্বীকৃত সীমানার
মধ্যে স্থিতিশীলতা অর্জনেও। আবার সামরিক দিক থেকে বলা যায় এটা মোটেও কোনো কার্যকর
পথ না। কমিটমেন্টের দিক থেকে এত দৃঢ় একজন যোদ্ধাকে মাত্র একবার ব্যবহার করা সামরিক
দিক থেকে অযৌক্তিক। সেই সাথে সন্ত্রাসী আক্রমণ পশ্চিমা সভ্যতাকে মোটেই দুর্বল
কিংবা নত করছে না, বরং প্রবল পরাক্রমে পাল্টা আক্রমণে আরও
বেশি প্রলুব্ধ করছে। এবং, এই ধরণের হামলায় পশ্চিমাদের
তুলনায় মুসলমানদের রক্তই বেশি ঝরছে। অলিভার রয়ের মতে, এই
খেলাফত একটা উদ্ভট কল্পনা। মতাদর্শিক সত্তার মিথ। এর কৌশলগত অসম্ভাব্যতা আমাদের
দেখায় যে, যারা এর সাথে একাত্মতা পোষন করেন তারা কেন
সাধারণ স্থানীয় মুসলমানদের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত না করে বরং মৃত্যুকেই বেছে
নিচ্ছেন। এর কোনো রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত
নেই, কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই, এমনকি,
অলিভার রয়ের ভাষায়, শান্তিতে প্রার্থনা
করারও জায়গা নেই। মুসলমানদের ধর্মীয় কল্পনায় খেলাফতের অস্তিত্ব আছে সত্য, কিন্তু তাই বলে মৃত্যুর প্রতি এমন অবিচলিত সাধনার কথা সমান্তরালে বলা
যায় না। তাই, অলিভার রয়ের মতে, আজকের
র্যাডিকালাইজেশন বোঝার অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে মৃত্যুর সাথে এই নিয়মানুগ সংযোগকে
বোঝা; যার কেন্দ্রে আছে ফলাফলশূন্য নিহিলিস্ট দিক। ফলে
তাঁর মতে, ‘খাঁটি বিদ্রোহের (pure revolt) ধারণাটাই প্রলুব্ধ ও বিমোহিত করে। সহিংসতা আর কোনো উছিলা নয়, বরং এতেই তার পরিসমাপ্তি।’ অর্থাৎ সহিংসতা এখন
আর কেবল জিহাদের অবলম্বন নয়, জিহাদের উদ্দেশ্য।
অবশ্য অলিভার রয় এও বলেন, এটাই
সমগ্র চিত্র নয়। সন্ত্রাসের এই ধরণটা অস্থায়ী। রয় সংশয় প্রকাশ করেন যে, শীঘ্রই নতুন এবং আরও ‘যৌক্তিক’ সন্ত্রাসের ধরণ দৃশ্যপটে হাজির হতে পারে। আইএসের উত্থানের কারণসমূহ
নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সাথে জড়িত, এবং এর মরণ
বা পরাজয় পরিস্থিতির মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটাবে না। রয় স্মরণ করিয়ে দেন, আইএস সন্ত্রাসবাদ আবিষ্কার করেনি, বরং,
ইতোমধ্যেই কাটা পুকুর থেকে পানি নিয়েছে মাত্র। এখানে আইএসের
কৃতিত্ব হচ্ছে তারা তরুণ-স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে এমন এক আখ্যানমূলক কাঠামো হাজির
করেছে, যেখানে এই তরুণরা তাদের আকাঙ্ক্ষাকে অর্জন করতে
পারে বলে মনে করে। এই স্বেচ্ছাসেবকরা, আন্দোলনের সাথে
সামান্য সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও যারা কিনা মৃত্যুর জন্যে সদাপ্রস্তুত, তারা আইএসের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক না থাকলেও এই
স্বেচ্ছাসেবকরা আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নিজেদের জান কোরবান করতে প্রস্তুত
যেন তাদের এই আত্মঘাতী কর্ম বৈশ্বিক বয়ানের অংশ হয়ে যায়।
উপরোক্ত কারণেই অলিভার
রয়ের মনে হয়েছে আইএসের সমস্যাকে ভিন্নভাবে দেখা দরকার। তিনি এও বলেন যে, কেউ
যদি সমসাময়িক ইসলামিক সহিংসতার পাশাপাশি অন্যান্য ধরণের সহিংসতা ও র্যাডিকালিজমকে
বুঝতে চান তাহলে এদের মধ্যে কিছু সাধারণ বিষয় খুঁজে পাবেন। তাঁর মুখেই শোনা যাক,
‘...one that seeks to
understand contemporary Islamic violence alongside other forms of violence and
radicalism that are very similar to it – those that feature generational
revolt, self-destruction, a radical break with society, an aesthetic of
violence, doomsday cults.’
এটা প্রায়ই ভুলে যাওয়া
হয় যে, আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদ এবং আল-কায়েদা ও আইএসের মতো বিষয়গুলো মুসলিম
দুনিয়ার ইতিহাসে নতুন। এবং এই বিষয়গুলো শুধু মৌলবাদের উত্থান দিয়ে ব্যাখ্যা করা
যাবে না। তাই অলিভার রয় বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে
যে ইসলামের র্যাডিকালাইজেশন থেকে সন্ত্রাসবাদ উদ্ভূত হয়নি, বরং এটা হয়েছে র্যাডিকালিজমের ইসলামীকরণ থেকে।’ তাই তাঁর মত হচ্ছে কেন এবং কিভাবে বিদ্রোহী তরুণরা ইসলামের মধ্যেই
তাদের বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়, সেদিকে মনোযোগ
কেন্দ্রীভূত করা।
অলিভার রয়ের এই পদ্ধতি
বা নতুনভাবে দেখার সমালোচনাও হচ্ছে। সেই সমালোচনা মূলত দুই ধরণের। একপক্ষের কথা
কথা, অলিভার এই বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণসমূহকে আমলে নেন নি বা অস্বীকার
করেছেন। বিশেষ করে, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের ওপর পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর জুলুম, এবং অভিবাসী ও তাদের শিশুদের সামাজিক বর্জনই তাদের বিদ্রোহী করে তুলছে।
আবার, অন্যপক্ষ ইসলামের মৌলবাদীতার সাথে সন্ত্রাসীদের
সহিংসতার সম্পর্কে নিরূপণ করতে অলিভার রয় ব্যর্থ বলে অভিযোগ তুলেছে। তাদের কথা
হচ্ছে, সালাফিবাদ দ্বারা ইসলামের র্যাডিকালাইজেশন এবং
ঈমানের অতি-রক্ষণশীল ব্যাখ্যার সাথে এই সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক আছে।
অলিভার রয় তাঁর বিরুদ্ধে
উত্থাপিত সমালোচনা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল। এই দিকগুলো সম্পর্কেও তিনি সচেতন।
কিন্তু তাঁর মতে,
তিনি যেসকল তথ্য উপাত্ত পেয়েছেন বা যেসকল তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়
তাতে উপরোক্ত সিদ্ধান্তে চলে যাওয়া সম্ভব না। কারণ, তাঁর
তথ্য-উপাত্ত তাঁকে ভিন্ন-পথে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর প্রথম যুক্তি হচ্ছে, এই সহিংস র্যাডিকালাইজেশন ধর্মের র্যাডিকালাইজেশনের ফলাফল নয়,
যদিও তারা প্রায়ই একই পথ নিতে পারে এবং একই দৃষ্টান্ত হাজির করতে
পারে। তিনি ধর্মীয় মৌলবাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন এবং এটাও মানেন যে, ধর্মীয় মৌলবাদীতা সমাজে প্রচুর সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু এটা
অপরিহার্যভাবে রাজনৈতিক সহিংসতার পথে ঠেলে দেয় না। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমাবাহিনীর জুলুম-নির্যাতন, উপনিবেশায়ন,
অরিয়েন্টালিজম ইত্যাদির কথা উল্লেখ করে বলার চেষ্টা করা হয় যে,
এই বিদ্রোহ আসলে আক্রান্তরাই করছে। মানে, ভিক্টিমদেরই বিদ্রোহ। কিন্তু, অলিভার রয়ের মতে,
র্যাডিকাল ও ভিক্টিমদের মধ্যকার এই সম্পর্ক যতটা না বাস্তব,
তার চেয়ে বেশি কল্পনা। তিনি দেখান যে, ইউরোপে
যারা আক্রমণ করছে তারা গাজা উপত্যকার বাসিন্দা না, বা
লিবিয়া বা আফগানিস্তানেরও বাসিন্দা না। তারা যেমন অপরিহার্যভাবে গরীবও না, তেমনি সর্বাধিক অপমানিতও না। বরং, ২৫ ভাগ
ধর্মান্তরিত জিহাদির পরিসংখ্যান- এই সত্য প্রমাণ করে যে, র্যাডিকাল
ও ভিক্টিমদের মধ্যে যে সম্পর্কের কথা বলা হয় সেটা বহুলাংশে কাল্পনিক নির্মাণ।
নব্বই দশকের মাঝপর্যন্ত
অধিকাংশ আন্তর্জাতিক জিহাদি মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছিল যারা আফগানিস্তানে লড়ছিল।
পরবর্তীতে তারাই নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে নিজদেশেই জিহাদ চালিয়ে যেতে আগ্রহী হয়, অথবা
দুনিয়াব্যপী ছড়িয়ে দেয়। ‘বিশ্বব্যাপী’ আক্রমণের এটাই প্রথম ওয়েভ বলা যায়। কিন্তু, ১৯৯৫
সালের পর থেকে নতুন ধরণের জিহাদি জন্ম নিতে থাকে; যাদেরকে
বলা হচ্ছে homegrown terrorist।
এই ‘ঘরের
ভেতর বেড়ে ওঠা’ সন্ত্রাসীদের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে
অলিভার রয় আমাদের বলছেন, এই সন্ত্রাসীদের সাধারণ কোনো
প্রোফাইল নেই, কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু পৌনঃপুনিক
বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্য গত ২০ বছরে খুব অল্পই পরিবর্তন হয়েছে। ফ্রান্সের
প্রথম ‘ঘরের ভেতর বেড়ে ওঠা’ সন্ত্রাসী
খালেক কেলকাল(১৯৯৫) এবং ২০১৫ সালের শার্লি হেবদো আক্রমণকারী সাইদ এবং শেরিফ
কোয়াশি সবাই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে; সেগুলো
হচ্ছে –
‘second generation;
fairly well integrated at first; period of petty crime; radicalisation in
prison; attack and death – weapons in hand – in a standoff with the police.’
অলিভার রয় আরেকটা
বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন যেগুলো প্রায় সবগুলো পশ্চিমা দেশের র্যাডিকালদের মধ্যে
দেখা যায়। এদের প্রায় সবাই খুব সেক্যুলার
জীবন যাপন করতেন। নিয়মিত বারে যেতেন, মদ্যপান করতেন, ছোটখাটো অপরাধের সাথেও জড়িত ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা 'ধার্মিক' হয়ে ওঠেন। এই হঠাৎ রূপান্তরিতদের
অলিভার রয় বলছেন ‘Born-again’ মুসলমান। ২০১৫ সালের বাতাক্লানে আক্রমণকারী আব্দেস্লাম
ভ্রাতৃদ্বয় ব্রাসেলসে একটি বার পরিচালনা করতো। অলিভার রয় এটাও বলছেন যে, তারা এই ধর্মীয় “reconversion” অথবা
“conversion” এর কিছুদিনের মধ্যেই আক্রমণ চালায়।
যে প্রক্রিয়াতে এই
মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো গঠিত হয় তা প্রায় একই রকম। গ্রুপের সদস্যপদ সবসময় একই রকম:
ভাই, শৈশব বন্ধু, কারাগার থেকে পরিচিতি, কখনও কখনও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রচুর সংখ্যক সহোদরকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এত অধিক সংখ্যক সহোদরের
উপস্থিতি আর কোনধরনের র্যাডিকালাইজেশনে দেখা যায়নি, তা
উগ্র বাম হোক আর ইসলামিস্টই হোক। এখানে অলিভার রয়ের পূর্বোক্ত একটা সিদ্ধান্তই আরো
পোক্ত হয়, It highlights the significance of the generational dimension
of radicalisation.
পুরো প্রজন্মের প্রতি
ঘৃণা ফুটে ওঠে এক সাবেক জিহাদির লেখায়, ‘তোমাদের পিতার ইসলাম হচ্ছে যা
উপনিবেশকরা ফেলে গেছে, যে ইসলাম তোমার মাথা নত করায়।
আমাদের ইসলাম হচ্ছে যোদ্ধাদের ইসলাম, রক্তের ইসলাম,
প্রতিরোধের ইসলাম।’ এই র্যাডিকালরা
প্রায়ই অনাথ, অথবা অকার্যকর (dysfunctional) পরিবার থেকে উঠে আসা। রয়ের তথ্য-উপাত্ত মতে, ফ্রান্সের
প্রায় ৫০ ভাগ জিহাদিদেরই মাদকব্যবসা, সহিংসতা, চুরি-ডাকাতির মতো ছোটখাটো অপরাধের অতীত আছে। জার্মানি ও আমেরিকাতেও এই
প্রবণতা লক্ষ করা যায় - বেশ অবাক করা
সংখ্যক জিহাদি কখনো না কখনো মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছে। তারা
প্রায় সকলেই এসময়কার ইয়ুথ কালচারে ডুবে থাকা মানুষ। তারা নাইটক্লাবে যায়, ধূমপান করে, মদ খায়। তাদের পোশাক-আশাকও এই ইয়ুথ
কালচারের পরিচয় বহন করে - ব্র্যান্ড, বেসবল ক্যাপ,
হুডি ইত্যাদি। তাদের সংগীত নির্বাচনও এই সংস্কৃতির পরিচয় বহন
করে। তারা র্যাপ গান পছন্দ করে, নিয়মিত ক্লাবে যায়। তারা
ভিডিও গেম পছন্দ করে এবং সহিংস আমেরিকান সিনেমার ভক্ত। উদাহরণস্বরূপ অলিভার রয়
জার্মান র্যাপার ডেনিস কাস্পার্টের কথা উল্লেখ করেছেন। সে ২০১০ সালে ইসলাম ধর্ম
গ্রহণ করে আবু-তালহা আল-আলমানি নাম গ্রহণ করে এবং সিরিয়াতে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ
করে।
কোনো সন্দেহ নেই অলিভার
রয়ের বিচার-বিশ্লেষণ ইউরোপকে কেন্দ্র করে। কিন্তু, বাংলাদেশের নিকট-অতীতের
জঙ্গিবাদের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে আমরা তাঁর সিদ্ধান্তের প্রখরতা আরও বেশি বুঝতে
সক্ষম হবো বলে মনে হয়। গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনায় অংশগ্রহণকারী জঙ্গিদের
জীবনবৃত্তান্তও উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের সাথে হুবহু মিলে যায়। জঙ্গিদের ফেসবুক বা
সোশ্যাল মিডিয়া দেখলেই বোঝা যায় তারা উপরোক্ত ‘ইয়ুথ
কালচারে’রই অংশীদার। হামলার পর হামলাকারীদের প্রশংসা করে একটা ভিডিও প্রচারিত হয়,
ভিডিওতে অংশ নেয়া তিন তরুণের একজন তাহমিদ শান্তিনিকেতনে পড়েছে,
বাংলাদেশের জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ক্লোজ আপ ওয়ানের প্রথম আয়োজনে সে
শীর্ষ ১৫ কণ্ঠশিল্পীর মধ্যে ছিল। (বাংলাট্রিবিউন, জুলাই
৭, ২০১৬, গানের শিল্পী যেভাবে
জঙ্গি হলো!)
যে উপায়ে নতুন জিহাদিরা যুক্ত
হচ্ছে সেটাতেও নতুনত্ব আছে। তারা ধর্মীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্ত হচ্ছে না, বা
ধর্মীয় কোনো আন্দোলনের মাধ্যমেও না। বরং, তারা যুক্ত
হচ্ছে বক্সিং ক্লাবের মতো স্পোর্টস ক্লাবের মাধ্যমে। এই জিহাদিদের সামাজিক জীবনে
মসজিদের তুলনায় স্পোর্টস ক্লাবের গুরুত্ব বেশি। জেলজীবনও এই সংযোগ স্থাপনে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অলিভার রয়ের মতে, জেলখানাই
অনেক হেতুকে বিকশিত করে যা সমসাময়িক র্যাডিকালাইজেশনে জ্বালানী যোগায়। হেতুগুলো
হচ্ছে –
the generational
dimension; revolt against the system; the diffusion of a simplified Salafism;
the formation of a tight-knit group; the search for dignity related to respect
for the norm; and the reinterpretation of crime as legitimate political
protest.
এই র্যাডিকালদের আরেকটা
সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরিচিত সার্কেল থেকে তাদের দূরত্ব। তারা কোনো নির্দিষ্ট
ধর্মীয় পরিবেশে বসবাস করতো না। স্থানীয় মসজিদের সাথেও তাঁর সম্পর্ক প্রতিকূল, মাঝেমধ্যে
হয়তোবা মসজিদে যেতো। কখনো কখনো ইমামকে অশ্রদ্ধা করার জন্যে এলাকা থেকে বহিষ্কৃত
হওয়ারও নজির আছে। কোনো ধরণের মুসলিম ব্রাদারহুড বা মুসলিম চ্যারিটি বা এমন কোনো
আন্দোলনের সাথেও এরা যুক্ত না। এরা কেউই ফিলিস্তিনদের মুক্তি সংগ্রামের সদস্য ছিল
না। সন্ত্রাসবাদের পথে আসার পূর্বে এরা কোনো ধর্মীয় আন্দোলনের মাধ্যমে র্যাডিকালাইজডও
হয়নি। এদের এই ধর্মান্তর বা ধর্মকে গ্রহণ লুকানো থাকেনা, প্রদর্শিত
হয়, যদিও সেটা যে ধর্মচর্চার মাধ্যমেই প্রদর্শিত হয় তাও
আবশ্যিক না। তারা নিয়মিত জপতে থাকে- কাফিররা আমাদের শত্রু, এদের সাথে কোনো আপোষ সম্ভব নয়। কিন্তু, এই ‘কাফির’ ক্যাটাগরিতে তাদের নিজেদের
মাতাপিতা-পরিবার-আত্মীয়স্বজনও অন্তর্ভুক্ত থাকে। হয় পরিবার তাদের কথানুযায়ী
সঠিকভাবে ধর্মপালন করছে না অথবা ধর্মান্তরিত হতে রাজি হয় নি। অবশ্য, ব্রিটেন এর ব্যতিক্রম। সেখানে জিহাদিদের নেটওয়ার্ক অনেকটা মসজিদ
ভিত্তিক। তাই, অলিভার রয় প্রশ্ন করেন,
The question is
therefore when and where jihadis embrace religion. Religious fervour arises
outside community structures, belatedly, fairly suddenly, and not long before
terrorists move into action.
পাশাপাশি অলিভার রয় এটাও
বলেন যে, র্যাডিকালদের এই সিদ্ধান্ত - জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া এবং কোনো র্যাডিকাল
ইসলামিক দলের সাথে মিশে যাওয়া - নিছক কোন সুযোগসন্ধানী নির্বাচন নয়। মৌলিক বিষয়
হচ্ছে, এই তরুণরা তাদের চিন্তা ও কর্মের কাঠামোরূপে
ইসলামকে নির্বাচন করে। তাই, র্যাডিকালিজমের এই
ইসলামিকরণকেই আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
উপরোক্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বাইরে জিহাদিদের আর কোনো আদর্শ সামাজিক ও
অর্থনৈতিক ছবি দেখা যায় না। যদিও সন্ত্রাসবাদকে সংহতির অভাবের (unsuccessful
integration) ফলাফল হিসেবে দেখার একটা জনপ্রিয় মত চালু আছে।
অলিভার রয় এই মতের সাথে একমত নন। তিনি বরং
বলেন, এই মত দুনিয়াজুড়ে থাকা সুসংহত ও সামাজিকভাবে
উদীয়মান মুসলমান জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে। সেই সাথে তিনি এই তথ্যও যোগ করেন,
ফ্রান্সে যত মুসলমান জিহাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে তার চেয়ে বেশি
মুসলমান পুলিশবাহিনীতে যুক্ত হচ্ছে।
জিহাদিবাদকে
সালাফিবাদেরই একটা বর্ধিতরূপ আকারে দেখার প্রবণতাও আছে। সকল সালাফি জিহাদি নয়, বরং
সকল জিহাদিই কমবেশি সালাফি। তাই, সালাফিবাদই হচ্ছে জিহাদিবাদের
সদর দরজা। মানে, ধর্মীয় র্যাডিকালাইজেশনকেই রাজনৈতিক র্যাডিকালাইজেশনের
প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ধরা নেয়া হয়। কিন্তু, অলিভার রয়
উপরের উদাহরণ ও আলোচনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, বিষয়গুলো
এর চেয়ে আসলে অনেকবেশি জটিল।
কোনো সন্দেহ নেই এই তরুণ
র্যাডিকালরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, তারা বেহেশতে যাবে। তারা ইসলামী
ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় এমন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়, অথবা,আইএসের মতো যারা খেলাফত পুনরুদ্ধার করতে চায় তাদের সাথে যুক্ত হয়।
কিন্তু, তারা যে ইসলামের কথা বলছে সেটা কোন ধরণের ইসলাম?
অলিভার রয় জানাচ্ছেন যে, এই জিহাদিরা
ধর্মীয় গ্রন্থ একাগ্রভাবে পড়ে সহিংসতার পথে যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয়
ধর্মীয় সংস্কৃতির লেশমাত্রই নেই এবং, এমনকি তারা এসবকে
খুব একটা পাত্তাও দেয় না। তারা ভুল পাঠ করে বা মস্তিষ্ক ধোলাই হয়ে র্যাডিকাল
হচ্ছে না। তারা র্যাডিকাল হচ্ছে কারণ তারা এটাই পছন্দ করে, কারণ র্যাডিকালিজম তাদের আকৃষ্ট করে। অলিভার রয়ের কাছে যেসব
তথ্য-উপাত্ত রয়েছে তার নিরিখে তিনি বলেন যে, জিহাদীদের
মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব প্রকট। ৪০০০ বিদেশি যোদ্ধার মধ্যে, অধিকাংশই সু-শিক্ষিত, এবং ৭০% যোদ্ধার ইসলামের
প্রাথমিক জ্ঞানটাই কেবল আছে। তারা যখন ‘সত্যে’র কথা বলে তখন তারা হয় নিজস্ব
নিশ্চয়তার সূত্র ধরে বলে, অন্যথায় বিভিন্ন হুজুরের (বা
শেখ) কথা বলে যাদের কিছুই তারা কখনো পড়েনি। একজন ধর্মান্তরিত ফরাসী আদালতে বলেছিল,
‘আমি কোনো কিবোর্ড জিহাদি না, আমি
ইউটিউবে ধর্মান্তরিত হই নি। আমি পণ্ডিতদের লেখাপত্র পড়ি, আসল
পণ্ডিতদের’। এই দাবি করা সত্ত্বেও সত্য হচ্ছে যে, তিনি আরবি পড়তেই জানেন না, এবং
ইন্টারনেটের মাধ্যমেই নেটওয়ার্কের সদস্যদের সাথে যুক্ত হয়েছেন।
২০০৫ সালের ৭ জুলাই
লন্ডনের বোমা হামলার প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ সিদ্দিক খান। সে তার বিবৃতিতে যা বলেছিল
সেটা গুরুত্বপূর্ণ। অলিভার রয়ের লেখা থেকে হুবহু তুলে দিলেই বুঝতে সুবিধা হবে বলে
আশা করি,
The first motivation he
cited is atrocities committed by western countries against the “Muslim people”
(in the transcript he says, “my people all over the world”); the second is the
role of avenging hero (“I am directly responsible for protecting and avenging
my Muslim brothers and sisters,” “Now you too will taste the reality of this
situation”); the third is death (“We love death as much as you love life”), and
his reception in heaven (“May Allah ... raise me amongst those whom I love like
the prophets, the messengers, the martyrs”).
প্রায় প্রতিটা জিহাদি
সংগঠন যা বলে তারই একটি খসড়া বলা যায় এই বিবৃতিকে। কিন্তু, এই
সন্ত্রাসীরা যে মুসলিম সম্প্রদায়ের কথা বলেন যাদের তারা উদ্ধার করতে চাচ্ছেন বা
যাদের প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছেন তা কখনো নির্দিষ্ট করেন না। এটি একটি অনৈতিহাসিক ও
অ-স্থানিক বাস্তবতা। তারা যখন মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা-নীতি বিষয়ক কথাবার্তা বলেন তখন
‘ক্রুসেডর’ শব্দ ব্যবহার করেন;
কিন্তু তারা কখনো আলজেরিয়াতে ফ্রান্সের উপনিবেশায়নের কথা বলেন
না। তারা কখনো উপনিবেশ আমলের কথা বলেন না।
তার পূর্বে যেসব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে সেগুলোর কথা তারা কখনো
উল্লেখ করেন না। তাদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রামের কথাও উল্লেখ করেন না। এমনকি তারা
কেউ পূর্বপুরুষদের দেশে ফেরতও যান না জিহাদের জন্য। অলিভার রয় বলেন, তার জানামতে একজন জিহাদিও নেই যিনি কিনা ফিলিস্তিনদের মুক্তিসংগ্রামে
জড়িত ছিলেন বা ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।
এমনকি কোনো ইসলামিক এনজিওর সাথেও না। এরা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্রই পড়ে,
এর বাইরে কিছু না। এই জিহাদীদের জীবনবৃত্তান্ত ঘেটেঘুটে অলিভার
রয় বলছেন, ইসলামিক
সমাজে বসবাস করতেও এই জিহাদিরা আগ্রহ পায় না;
‘They
do not go to the Middle East to live, but to die. That is the paradox: these
young radicals are not utopians, they are nihilists.’
পূর্বের জিহাদি বা
বিপ্লবীদের সাথে এই নতুন আমলের র্যাডিকালদের এটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ তফাত। তারা
বিদ্যমান সমাজকে - তা পশ্চিমা হোক আর
মুসলিম দুনিয়া হোক - প্রচণ্ড ঘৃণা করে। হত্যাযজ্ঞ চালানোর সময় নিজেকেও মেরে ফেলাটা
সেই ঘৃণাকেই মূর্ত করে তুলছে। দুনিয়াকে অস্বীকার করার পাশাপাশি নিজেকেই হত্যা
করছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর থেকে এটাই তাদের কর্মপদ্ধতি হয়ে
দাঁড়িয়েছে।
আত্মঘাতী হত্যাকারী এই
সময়ের একটা সাধারণ চিত্র। আমেরিকান স্কুল শুটারের উদাহরণ নেয়া যেতে পারে। সে
অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্কুলে যায়, যত পারে মানুষ মারে, এরপর নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করে বা পুলিশের গুলিতে মারা পড়ে।
ততক্ষণে সে অনলাইনে তার বিবৃতি ছবি ভিডিও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এসবের মধ্যে সে
বীরত্বপূর্ণ ভঙ্গি নেয় এবং এটা ভেবে আনন্দিত হয় যে, সবাই
এখন জানতে পারবে সে কে ছিল। আমেরিকায় ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রায় ৫০ টার মতো
এমন আক্রমণ হয়েছে। খেলাফতের যোদ্ধা এবং এমন আত্মঘাতী হত্যাকারীর মধ্যে সীমানাটুকু
খুবই অস্পষ্ট। অলিভার রয় বলছেন যে, তিনি এইসব ক্যাটাগরিকে
মিশিয়ে ফেলতে চান না। প্রতিটাই সুনির্দিষ্ট, কিন্তু এটাও
মানতে হবে যে, এদের সবার মধ্যে একটা লক্ষণীয় মিল আছে। এই
খুনিরা ‘disaffected, nihilistic and suicidal youths’। আল কায়েদা এবং আইএসের মতো
সংগঠন যেটা করছে সেটা হলো ; এদের
হাতে একটা স্ক্রিপ্ট তুলে দিচ্ছে।
অলিভার রয় তাঁর লেখা শেষ
করেছেন তাঁর নিজের দেশের মানুষদের মানে পশ্চিমাদের উপদেশ দিয়ে। তিনি বলেন যে, আইএসের
মূল শক্তি হচ্ছে সে আমাদের ভয় নিয়ে খেলছে। এবং প্রধান ভয় হচ্ছে ইসলাম। এইসকল
আক্রমণের একমাত্র কৌশলগত প্রভাব হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক। তারা কোনোভাবেই পশ্চিমা
সামরিক বাহিনীর সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারছে না, উলটো
বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা এই ভয় তৈরি করছে যে, আমাদের সমাজ
ভেঙ্গে যাবে এবং মুসলমান ও ‘অন্যান্যদের’ মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধবে। আল কায়েদা বা আইএস মূলত এমন এক সুবিশাল
কাল্পনিক জগত তৈরি করেছে যেখানে নিজেদের বিজয়ী এবং পশ্চিমাদের পরাজিত আকারে দেখানো
হয়। এই জিহাদিবাদ একটা উদ্ভট কল্পনা এবং এর রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি খুবই
সংকীর্ণ। তারা জনসাধারণকে আলোড়িত করতে পারে না, পারে কেবল
কিনারে থাকা কয়েকজনকে আকৃষ্ট করতে। তাই অলিভার রয় বলেন,
‘The
reality is that Isis’s pretension to establish a global caliphate is a delusion
– that is why it draws in violent youngsters who have delusions of grandeur.’
লেখার মূল সূত্র:
Olive Roy, Who are new jihadist?, The
Guardian, 13 April, 2017
সাহায্যকারী উপাদান:
It'sNot Islam That Drives Young Europeans to Jihad, France's Top Terrorism ExpertExplains, Haaretz, Aug 20, 2017
″Radicalisation is not the result of failed integration″ (Interview with French
extremism researcher Olivier Roy), Quantara.de
No comments:
Post a Comment