Sunday, August 26, 2018

হুমায়ূন আহমেদ ফিরে আসেন বারে বারে


হুমায়ূন আহমেদ 'হলুদ হিমু কালো র‍্যাব' বইটা লিখেছিলেন ২০০৬ সাল নাগাদ। খুব সম্ভব তার বছর দুয়েক আগেই র‍্যাব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং 'ক্রসফায়ার' আমদানির কারণে রীতিমতো নায়কও বনে যায়। এমতাবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ র‍্যাব ও ক্রসফায়ারকে হিমুর সাথে মোলাকাত করালেন, তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন। আমরা, বাঙালি মধ্যবিত্ত, তাঁর আসল চিন্তাটুকু না নিয়ে খুব সম্ভব শুধুই হিমুর 'রস' খেয়েছিলাম। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন হুমায়ূন আহমেদ 'ক্রসফায়ারে'র বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন খুবই শক্তভাবে, তাঁর নিজস্ব হেঁয়ালি ঢঙয়ে।
হিমু র‍্যাবের সামনে বসে ছড়া তৈরি করছে,

'ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
র‍্যাব এলো দেশে
সন্ত্রাসীরা ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?'

র‍্যাবের অফিসার হিমুকে ধমক দিয়ে যখন বলেন, ফাজলামি ধরনের কথা বলে যে র‍্যাবের হাত থেকে পাৱ পাওয়া যায় না এটা সে জানে কি না, তখন হিমু উত্তর দেয় 'জানি স্যার উপরে আছেন রব আর নিচে আছেন র‍্যাব।' র‍্যাবের সে অফিসেই হিমুর সাথে দেখা হয় শীর্ষ দশ সন্ত্রাসীর একজন 'মুরগী ছাদেকে'র সাথে। ততক্ষণে মুরগী ছাদেকের অবস্থাও বেশ করুণ। সে মোটামুটি নিশ্চিত আগামীকালই তারে ক্রসফায়ার করা হবে। পরেরদিনের নিউজ-পেপারে যে খবর পাওয়া যায় তাতে সেসময়ের একটা চিত্র পাওয়া যায়।

'গোপন খবরের ভিত্তিতে কাওরানবাজার এলাকা থেকে র‍্যাব সদস্যরা মুরগি ছাদেককে গত পরশু ভোর পাঁচটায় গ্রেফতার করে।তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। তার দেয়া তথ্যমতো গোপন অস্ত্ৰভাণ্ডারেরখোঁজে র‍্যাব সদস্যরা তাকে নিয়ে গাজীপুরের দিকে রওনা হয়। পথে মুরগি ছাদেকের সহযোগীরা তাকে মুক্ত করতে র‍্যাবের প্রতি গুলিবর্ষণ শুরু করে। র‍্যাব সদস্যরা পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই সুযোগে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে পালিয়ে যাওয়ার সময় ক্রসফায়ারে মুরগি ছাদেক নিহত হয়। তার মৃতদেহের সঙ্গে পীচ রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল পাওয়া যায়।'

কেউ চাইলে (বা না চাইলেও) এই খবরের সাথে বর্তমানের চিত্রও খুঁজে পাবেন। ঐ উপন্যাসের (উপন্যাস বলতেও অনেকে হয়তোবা রাজি হবেন না) আরেকটা চরিত্র হিমুর বড় খালু। তিনি প্রতারণা ও ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে র‍্যাবের  বিশাল ভক্ত হয়ে যান। অসুস্থ অবস্থায় অপরাধ বিষয়ে তিনি কিছু চিন্তাভাবনাও করা শুরু করেন। যেমন,

'ক্রসফায়ার বাংলাদেশের জন্য মহৌষধ। যারা ক্রসফায়ারের বিপক্ষে কথা বলে তাদেরকেও ক্রসফায়ারের আওতায় আনা উচিত।'

'একটি বিশেষ দিনে বাংলাদেশে র‍্যাব দিবস পালিত হবে। সেদিন সবাই কালো পোশাক পারবে। আর্ট কলেজ থেকে একটা র‍্যালি বের হবে। প্রেস ক্লাবে থামবে। সবার হাতে থাকবে নানান ধরনের অস্ত্রের মডেল।'

'র‍্যাব সঙ্গীত বলে সঙ্গীত থাকবে। ক্রসফায়ারের যে-কোনো খবর রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারের পর পর র‍্যাব সঙ্গীত বাজানো হবে।সঙ্গীতের কথা এরকম হতে পারে–

আমার কৃষ্ণ র‍্যাব
আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার অস্ত্র তোমার বুলেট
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।'

'র‍্যাব ভাইদের জন্যে একটি দৈনিক পত্রিকা থাকবে। কালো নিউজ প্রিন্টের উপর লাল লেখা। পত্রিকার নাম হতে পারে দৈনিক র‍্যাব।'

হিমুর খালু একটা চিঠিও লিখেন যেখানে উল্লেখ করেন,

'নগরকে পঙ্কিল অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যে আমি র‍্যাব ভাইদের আহবান জানাচ্ছি। দুষ্ট লোকের সমালোচনায় আপনারাবিভ্ৰান্ত হবেন না। যারা মানবাধিকারের বড় বড় কথা বলছেন তাদেরকে সাবধান। যখন নিরীহ মানুষ গুপ্তাকর্তৃক আক্রান্ত হয়ে কাতর আর্তনাদ করে তখন আপনারা কোথায় থাকেন? দয়া করে মানবাধিকারের ফাঁকা বুলি আপনারা আওড়াবেন না।আপনাদের প্রতি আবেদন, আপনারাও সমস্বরে র্যাব ভাইদের সমর্থন করে তাদের হাত জোরদার করুন।'

এই খালু হচ্ছেন আমাদের সমাজের বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিত ও অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষেরা, যারা নিজেদের অভিজ্ঞতার উন্মাদনা থেকে 'ক্রসফায়ার'কে সমর্থন করেন, ক্ষণিকের জন্যে হলেও। এই চিত্র ২০০৬ সালের 'হলুদ হিমু কালো র‍্যাব'এর মধ্যে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় বর্তমানে ধর্ষণ ও মাদক নির্মূলের নামে শুরু হওয়া 'বন্দুক-যুদ্ধে'র মাঝে। অবশ্য বর্তমানে দলকানা বুদ্ধিজীবীরাও একে সমর্থন দেন।

হিমু র‍্যাবের  অফিসারকে যখন বলে 'আপনারা মানুষের জীবন নিয়ে রিডিকিউল করেন; তখন অফিসার অপরাধীদেরকে ক্যান্সার সেলের সাথে তুলনা করে পাল্টা প্রশ্ন করেন, 'আপনি কেন আমদের সমর্থন করেন না?'। এর উত্তরে হিমুর মুখ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের শোনান,

'মানুষ ক্যান্সার সেল না। প্রকৃতি মানুষকে অনেক যত্নে তৈরি করে। একটা ভ্রূণ মায়ের পেটে বড় হয়। তার জন্যে প্রকৃতি কি বিপুল আয়োজনই না করে! তাকে রক্ত পাঠায়। অতি যত্নে তার শরীরের একেকটা জিনিস তৈরি হয়। দুই মাস বয়সে হাড়, তিন মাসে চামড়া, পাঁচ মাস বয়সে ফুসফুস। এত যত্নে তৈরি একটা জিনিস বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে মরে যাবে–এটা কি ঠিক?'

অফিসার যখন পাল্টা প্রশ্ন করেন 'পিশাচের আবার বিচার কি?' তখন হুমায়ূন আহমেদ আবারো হিমু জবান দিয়ে বলেন, 'পিশাচেরও বিচার আছে। পিশাচের কথাও আমরা শুনব। সে কেন পিশাচ হয়েছে এটাও দেখব।'



২০১১ সালে রাষ্ট্রপতি একজন ফাঁসির আসামির বিচার মওকুফ করে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি তখন ছিলেন জিল্লুর রহমান।আসামীর হাতে নিহত ব্যক্তির স্ত্রী তখন রাষ্ট্রের কাছে দুটো প্রশ্ন করেছিলেন,

১. প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর পিতার হত্যার বিচার চাইতে পারেন, আমার পিতৃহারা সন্তানেরা কেন বিচার চাইতে পারবে না?
২. রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভি রহমানের হত্যাকারীদের যদি ফাঁসির আদেশ হয়, তিনি কি তাদের ক্ষমা করবেন?

এরপর হুমায়ূন আহমেদ 'প্রথম আলো'তে খুবই সংক্ষিপ্ত একটা মতামত লিখেছিলেন। সেখানে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'নন্দিত নরকে'র মন্টু চরিত্রের কথা বলছিলেন, যার ফাঁসি হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেও ক্ষমা পাওয়া যায় নি। তো, সেটা উল্লেখ করে হুমায়ূন আহমেদ লিখেন,

'উপন্যাসের রাষ্ট্রপতি নির্মম, কিন্তু বাস্তবের রাষ্ট্রপতিরা মমতা ও করুণায় আর্দ্র। তাঁরা ভয়াবহ খুনিকে ক্ষমা করে দেন। শুধু ফাঁসির হাত থেকে বাঁচা না, মুক্তি। এখন গলায় ফুলের মালা ঝুলিয়ে ট্রাক মিছিল করে বাড়ি ফিরতেও বাধা নেই।'

এ কথা উল্লেখ করে নতুন একটা ঘোষণাও দেন আমাদের প্রিয় লেখক। তিনি বলেন, 'আমিও এই দুই প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। প্রশ্নের উত্তর শোনার পরপরই নন্দিত নরকে উপন্যাসটি নতুন করে লিখব।'

আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা নিহত ব্যক্তির স্ত্রীর প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছিলেন কি না জানি না। তবে উপন্যাসও নতুন করে লেখা হয় নাই। হুমায়ূন আহমেদও আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাই নতুন করে লেখার আর কোন প্রশ্নও উঠে না।




হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে হাজারটা বিশ্লেষণ থাকতে পারে, সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক - যে কোন কিছু হতে পারে। ও দিকে আমি যাব না। কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে, হুমায়ূন আহমেদ আমাদের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সংগঠনকে নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলছিলেন এবং এই প্রশ্নগুলো যে কতটা গুরুতর ছিল তা আমরা দেখতে পারছি। এই প্রশ্নগুলোর সমাধান দিতে না পারলে 'তেলের ডিব্বার ভর্তি' এই সমাজে হুমায়ূন আহমেদ আসলে বারে বারে আমার কাছে ফিরে আসবেন।

No comments:

Post a Comment