জনসংযোগ বা মতামত তৈরিতে প্রোপাগান্ডার ব্যবহার ও এর সাফল্য রীতিমতো ঈর্ষনীয়।
স্বৈরাচারী
শাসকের কাছে ডান্ডা যেমন বর্তমান গণতন্ত্রীদের কাছে প্রোপাগান্ডাও তেমন
- চমস্কির এই কথার প্রমাণ একটু চোখ-কান
খোলা রাখলেই পাওয়া যাবে।
এর
আবার কিছু টেকনিক আছে।
যেমন
প্রথমেই ডাকার মতো একটা নাম লাগবে; আমেরিকায়
কমিউনিস্ট অভিধা দিয়ে শত্রু হিসেবে হাজির করার রেওয়াজ বহুত পুরনো। বাংলাদেশেও
কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে শত্রুর চেহারা বানানোর যেমন রেওয়াজ আছে, তেমনি
নাস্তিক, মৌলবাদী ইত্যাদি নামও বহুত জনকে দেওয়া
হয়। সেই
সাথে বর্তমানে রাজনীতিতে ‘পাকিস্তানপন্থী’,
‘স্বাধীনতাবিরোধী’ বা
‘বামাতি’ ইত্যাদি
নাম দেয়া সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।
কিছুদিন আগে ব্লগার ও এক্টিভিস্ট মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার ‘বামাতি’ শব্দের রাজনীতির সন্ধান চালিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে, কাদেরকে ও কেন বামাতি নাম দেয়া হচ্ছে। তিনি দেখাচ্ছেন যে, দেশিয় রাজনীতিতে যারা আওয়ামী বয়ানের বিপরীতে অবস্থান নেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যারা মার্কিন/পশ্চিমা আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তাদেরকেই বলা হচ্ছে ‘বামাতি’। এই শব্দের ব্যবহার নিয়ে গোলাম সারোয়ারের শেষ মন্তব্যটাও বেশ আগ্রহোদ্দীপক, ‘“বামাতি’ শব্দটি আসলে আমাদের দেশে চলমান ও ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির একটা প্রকাশ মাত্র। আন্তর্জাতিক ভাবেও এই প্রবণতাটি বিদ্যমান, আমেরিকান ডানপন্থী ও তাঁদের মিত্রদের দ্বারা ব্যবহৃত “রিগ্রেসিভ লেফট” হচ্ছে বাঙালী “বামাতি”র আরেক সংস্করণ।’
কিছুদিন আগে ব্লগার ও এক্টিভিস্ট মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার ‘বামাতি’ শব্দের রাজনীতির সন্ধান চালিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে, কাদেরকে ও কেন বামাতি নাম দেয়া হচ্ছে। তিনি দেখাচ্ছেন যে, দেশিয় রাজনীতিতে যারা আওয়ামী বয়ানের বিপরীতে অবস্থান নেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যারা মার্কিন/পশ্চিমা আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তাদেরকেই বলা হচ্ছে ‘বামাতি’। এই শব্দের ব্যবহার নিয়ে গোলাম সারোয়ারের শেষ মন্তব্যটাও বেশ আগ্রহোদ্দীপক, ‘“বামাতি’ শব্দটি আসলে আমাদের দেশে চলমান ও ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির একটা প্রকাশ মাত্র। আন্তর্জাতিক ভাবেও এই প্রবণতাটি বিদ্যমান, আমেরিকান ডানপন্থী ও তাঁদের মিত্রদের দ্বারা ব্যবহৃত “রিগ্রেসিভ লেফট” হচ্ছে বাঙালী “বামাতি”র আরেক সংস্করণ।’
নাম দেয়া হলো,
এখন
লাগবে ‘Glittering Generalities’, মানে একধরণের
চাকচিক্যময় সাধারণত্ব যার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একধরণের সম্মতি আছে বা আবেগ আছে তাকে ফুসলিয়ে
ফাঁসলিয়ে প্রচার করা।
যেমন,
আমেরিকা
বলবে ‘আমেরিকান ওয়ে’। কিংবা বলবে
‘সোসিয়াল জাস্টিস’ এর কথা। বাংলাদেশে
বর্তমানে বলা হচ্ছে যেমন উন্নয়ন, বা মহা-উন্নয়ন। আপনি আমি
উন্নয়ন চাই, সবাই উন্নয়ন চায়। তাই বড়ো
বড়ো বিলবোর্ড লাগছে উন্নয়নের মহড়া নিয়ে, মিছিল হচ্ছে
উন্নয়ন নিয়ে, গানবাজনা-নৃত্য
সবই হচ্ছে উন্নয়নকে কেন্দ্র করে।
প্রোপ্যাগান্ডার জন্যে ব্যবহৃত
যে কোন আইডিয়াকে কোন বিখ্যাত মানুষ বা ছবি বা দেশের জাতীয় পতাকার সাথে মিলিয়ে দেখাতে
হবে। যেখানে
উন্নয়ন জোয়ারের ছবি আছে সেখানে ‘সোনার বাংলা’র
কথা বলা আছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র
কথা বলা আছে, ‘শেখ মুজিবের স্বপ্নের’
কথা
বলা আছে। তাইলে
সেটা আরও কার্যকর হয়।
সুন্দরবন
বিনাশকারী প্রকল্পকেও বলা হয় ‘চেতনা’র
স্ফুরণ! আর সেই আইডিয়াকে বৈধতা দিতে বিখ্যাত মানুষের
উদ্ধৃতি, ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি প্রদান,
বড়ো
বড়ো অঙ্কের তথ্য উপস্থাপন খুব কার্যকর।
কখনো
কখনো প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর জবানকেও বৈধতা দেয়ার উপকরণ হিসেবে নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী
তো আর অবুঝ না, তিনি যেহেতু বলেছেন তাইলে অবশ্যই ভালো
বুঝেই করছেন!
এতকিছু করেও প্রধানমন্ত্রী
কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানকে বুঝাতে হবে, আমি তোমাদেরই
একজন। তোমাদের
মতোই সাধারণ মানুষ, আমার চেহারাও গণতন্ত্রী। জিয়া সবাইকে
নিয়ে খাল কেটেছিলেন, এখনকার নেতারাও মাঝেমধ্যে খালি গায়ে মাটি
কাটেন, পাবলিক বাসে চড়ে বেড়ান। সেই ছবি
আমরা ভাইরাল করি, বিলবোর্ডে টানাই। দেখাই দেখো,
আমরা
মানুষের কতটা কাছের!
এই ছবির পাশাপাশি দরকার হয়
তথ্যের চমকপ্রদ উপস্থাপন, কী কী খারাপ
কাজ করছি, তা লুকিয়ে তখন প্রচার করা হবে কী কী ভালো
কাজ করা হয়েছে এবং সেই কাজ বা পলিসিকে উপস্থাপন করা হবে অতিরঞ্জিত করে। সেই সাথে
যুক্ত হবে সবচেয়ে ভয়াবহ/সুন্দর
আইডিয়া -দেখো সবাই ‘এইটাই’
করছে
এবং জিতে যাচ্ছে। তাইলে
তুমি কেন বাদ পড়বে? তুমিও আসো দলে। তুমি জিতে
যাবে। দেখো
সবাই লুটপাট করছে, টাকাওয়ালা হচ্ছে,
তুমি
কেন বাদ পড়বে, আসো, তুমিও
দলে আসো। অংশগ্রহণ
করো লুটপাটে। সাধারণ
মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী কেউ বাদ পড়ে না অংশগ্রহণের দৌড় থেকে।
দুই
নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন,
কিছু
কিছু স্লোগান তৈরি করা হয় যাদের আসলে কোন অর্থ নাই, কিন্তু
আপনাকে স্লোগানের ‘পক্ষে- বিপক্ষে’
সিদ্ধান্ত
নিতে হবে। এতে
আসলে ‘ক্ষমতা’ যা
চায়, তাই ঘটে থাকে। অন্যভাবে
বললে, এর মাধ্যমে একভাবে জনগণের অংশগ্রহণের
পথ রুদ্ধ করা হয়, যদিও দেখানো হয় যে,
জনগণ
সক্রিয়!
ঠিক একইভাবে,
আমার
মনে হয়, ক্ষমতাশীলরা এমন কিছু
‘দাবি’ করেন তা
এতটাই নির্জলা মিথ্যা যে, একে মিথ্যা
প্রমাণ করা অনেকটা অস্তিত্বহীন বিষয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করার মতো। এই মিথ্যে
জনগণের মনোবল গুঁড়িয়ে চুরমার করে দিতে বেশ কার্যকর, কেননা,
ক্ষমতাশীলরা
চোখে আঙুল তুলে দেখায় - ‘দেখো,
তুমি
জানো আমি মিথ্যে বলছি, তবু কিছুই
করতে পারবে না!’
মাদক যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন তিনশ’র অধিক এবং
গ্রেফতার হয়েছেন ৪০ হাজারের অধিক![1]এই
সংখ্যাটা বাড়ছে ও বাড়বে।
এই
যজ্ঞের শ্লোগান হচ্ছে, চল যাই
যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে। এখন আপনি
চান মাদকের করাল গ্রাস হতে দেশ মুক্ত হোক, নৈতিক
‘যুদ্ধ’ হোক,
যে
সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ছেলেপেলে মাদকে জড়ায় সেটার বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন
হোক। কিন্তু,
আপনি
‘বন্দুকযুদ্ধ’ চান না,
তাইলে
এই শ্লোগানের পক্ষে না বিপক্ষে আপনি! কোন শ্লোগানই
ক্ষমতাবানদের দেখানো পথ ছাড়া আর কিছুই বাতলে দেয় না, বরং,
সমস্যা
সমাধানের বিকল্প পথের চিন্তাভাবনা করাও নিষিদ্ধ করে দেয়।
এই ‘যুদ্ধে’র
স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি
বলছেন যে, আমাদের কাউকে মারার উদ্দেশ্য নাই,
কিন্তু
যখনই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে তখনই ‘এসব’
ঘটছে। নিরানব্বই
ভাগ লোক জানে র্যাবের বয়ান বানানো, সেইম স্ক্রিপ্ট
অল দা টাইম! তারপরও এমন
মিথ্যাচার আসলে আপনাকে বুড়ো আঙুল দেখায়, ‘দেখ শালা কিচ্ছু করতে
পারবি না!’
সেই সাথে কেউ যদি প্রশ্ন তুলেন
কেন মানুষ মারা হচ্ছে, তখন ক্ষমতাবানরা
এর উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, এখন পর্যন্ত
কোন নিরাপদ মানুষ মারা গেছেন, এমন প্রমাণ
দিতে পারবেন? এটা হচ্ছে মাইন্ড গেইম। যারা মারা
গেছেন তার নিরপরাধ এটা প্রমাণ করতে হবে ক্ষমতাবানদের আইন দ্বারাই,
সেখানে
আপনি কখনো তাদের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে পেরে উঠবেন না। সেই সাথে
এই পাল্টা প্রশ্ন আরেকটা গুরুতর বিষয়কে চাপা দিয়ে দেয়। একজন মানুষ
অপরাধী হলেই কি তাহলে বিনা বিচারে তাকে মেরে ফেলতে হবে? তবে
‘বিচার’ প্রসঙ্গে
যে জরুরি প্রশ্ন না তুললেই নয় তা হচ্ছে, এই যে পুলিশ-র্যাব-আইনশৃংখলা
বাহিনী যে সকল হত্যাকাণ্ড করছে সেসবের বিচার যদি করতে চাইও তবু কি প্রচলিত আইন অনুযায়ী
সম্ভব? নাকি এইসব হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সংবিধানের
কোন চোরাপথও রয়েছে? এই যে আমরা বলি আইনের শাসন হলে এসব বিচার
বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ঘটতো না তা কি আসলেই সত্যি? নাকি
এই বিচার বহির্ভুত হত্যাকা-ও আইনের
মারফতেই হচ্ছে? এই আলোচনা এখানে সম্ভব না,
তবে
প্রশ্নটা তোলা গুরুত্বপূর্ণ।
এই ‘বন্দুক
যুদ্ধে’র পক্ষে জনমত তৈরিতে আমাদের মিডিয়াও সক্রিয়। বিশেষ করে
একেবারে মূলধারার কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টালে যে ধরণের প্রবন্ধ-নিবন্ধ
প্রকাশ করা হচ্ছে সেগুলোর দিকে বিস্তারিত না হলেও শিরোনামের দিকে চোখ বুলালেই এই জনমত
তৈরির প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
‘মাদক বিরোধী অভিযান যেন ইতিহাসের কলঙ্ক না হয়’
শিরোনামের
লেখার শুরুতেই প্রবন্ধের লেখক ‘লজিক্যাল
ফ্যাসিবাদ’ নামক শব্দদ্বয় ব্যবহার করে বলছেন,
‘একটি গরীব সদ্য স্বাধীন দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য লজিক্যাল
ফ্যাসিবাদের প্রয়োজন আছে।’
যদিও
এই শব্দযুগল দিয়ে তিনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন তা আসলে পরিষ্কার না। তিনি র্যাবের
ক্রসফায়ার নিয়ে লিখতে গিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক
বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার’ উদাহরণ
দিয়ে বলেছেন যে এতে ‘তথাকথিত মানবাধিকার’
লঙ্ঘন
হলেও উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থে এসব করতে হয়। মাদকবিরোধী
অভিযানে ক্রসফায়ারের সাথে ‘বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব’
এর
প্রতি তুলনা থেকে তার উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবেই বুঝা যায়। বিনা বিচারে
এইসব হত্যাকা- যে সকল আইন ও নীতির বাইরে এটার চেয়ে তার
বড়ো দুঃখ হল আওয়ামীলীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ভুলবশত মারা গিয়েছেন। তিনি মানছেন
এই কোলাট্যারাল ড্যামেজ (মানে,
একরামুল
হকের মারা যাওয়া) আসলে আমাদের জন্যে লাভজনক হবে না। সেটা তার
মুখে শুনলেই আরও ভালো করে বুঝতে পারবেন তিনি আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন,
‘সমাজের জঞ্জাল সরাতে যে উদ্যোগ নিতে হয় সেটি খুব শোভন নাও হতে
পারে, কিন্তু জঞ্জালের ভেতর দুয়েকটি সোনার খণ্ড
চলে গেলে আখেরে গৃহস্থেরই ক্ষতি।’
সেই
সাথে তিনি এরকম একটা অভিযান চেয়েছেন ‘দুর্নীতি
রোধে’।
আরেকজন লেখক
‘যুদ্ধ এবার না হয় বাঁচার জন্য চলুক’ চমৎকার
শিরোনামের একটা লেখা লিখেছেন।
তিনিও
মানেন বিচার পাওয়ার অধিকার সবার আছে, কিন্তু
তার মতে, ‘বৃহৎ স্বার্থে অনেক কিছু হতে হয়’। তিনি ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতা থেকেই বলছেন যে ইয়াবা বন্ধ না হলে সর্বনাশ হবে দেশের,
তাই
লেখার ইতি টানছেন এই বলে যে, ‘যে যাই
ভাবুক বা বলুক বন্দুকযুদ্ধ চলছে, চলুক। এতোদিন
তো নানা কাজে চলেছে এই যুদ্ধ এবার না হয় বাঁচার জন্য চলুক, বন্দুক
যুদ্ধ।’ এই
লেখক তার আরেক লেখায় (একেবারে
সাম্প্রতিক) সরাসরি আরেকটা দাবি তুলছেন,
‘জীবনবিনাশী চালকদের জন্য কেনো এনকাউন্টার নয়?’
ঠিক একই ভাবে অন্য একজন লেখক
দাবি তুলছেন, ‘মাদকের মতো দ্রব্যমূল্যের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি
অভিযান পরিচালনা করা যায় না?’ সহজ কথা
হচ্ছে, এই অভিযানের পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার। ঠিক একইভাবে
আরেক লেখকের প্রশ্ন হচ্ছে ‘মাদক ব্যবসায়ীদের
জন্যে এত মায়াকান্না কেন?’ যারা এই
অভিযানের সমালোচনা করছেন তাঁরা সকলেই, তার মতে,
বিভিন্ন
এনজিও ও মানবাধিকার সংস্থার সদস্য, যারা
‘মাদকে দেশ সয়লাব হলে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে-ঠিক
তেমনই মাদক অপরাধীরা মারা গেলে সেটার বিরোধিতা’ করে। তাই তার
মত হচ্ছেমাদক দমনে সরকার কোন পথে হাঁটবে সেই বিষয়টা সরকারের ওপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত।’ অবশ্য শক্তি
প্রয়োগের পাশাপাশি তিনি সামাজিক আন্দোলনের কথাও বলছেন।
যে কয়টা লেখা চোখে পড়েছে তন্মধ্যে
হাতেগোনা কয়টা উল্লেখ করলাম।
তাদের
কথা উল্লেখ করলাম শুধু এটা দেখাতে যে, আমরা কীভাবে
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সম্মতি গড়ে তুলছি। তাঁরা সকলেই
বিচার ছাড়া এই হত্যাকা-কে সমর্থন
করেন এবং আরও বিভিন্ন ইস্যুতে এমন অভিযানের (বন্দুকযুদ্ধের)
প্রত্যাশা
করেন। আর
যিনি সমালোচনা করছেন তিনি শুধু একরাম হত্যাকা-ের
সমালোচনা করছেন, এবং এই হত্যাকে ‘কোল্যাটারাল
ড্যামেজ’ হিসেবেই দেখছেন।
এই বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডকে
যারা সমর্থন করছেন প্রথমত তাদের লেখা থেকে পরিষ্কার যে, তারা
সরকারি সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
সরকারি
সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন কারণ সরকার তার দলীয়। তারা ফ্যাসিবাদের
সমর্থক, দল যেহেতু করছে, আমিও
করবো এই ভাবনায় তাড়িত এবং এখানে ‘লজিক্যাল’
ফ্যাসিবাদের
মতো সুন্দর সুন্দর শব্দ ব্যবহার করছেন।
বিচার
বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের আরেকদল সমর্থক আছেন যারা প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি হতাশ
হয়েই এমন মত প্রকাশ করছেন।
তাদের
মতামত মোটেই কোন স্বাভাবিক ক্রিয়া নয়, বরং বিচার-ব্যবস্থার
ব্যার্থতার প্রতিক্রিয়া মাত্র।
কিন্তু
প্রোপ্যাগান্ডা তারা চালান না, তারা মূলত
উপরোক্ত দলের প্রোপ্যাগান্ডায় প্রভাবিত হয়ে থাকেন।
তবে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে,
বন্দুক
থাকলে যুদ্ধ হবে। বন্দুক
থাকবে, কিন্তু যুদ্ধ হবে না,
তা
হবে না তা হবে না। এ
তো কঠিন কম্ম! তবে, এই
যুদ্ধ শেষ হলে আরও যুদ্ধ শুরু হবে।
কারণ
কবি তো বলেছিলেন, জনগণ যখন চায় খাদ্য,
সীমান্তে
বেজে উঠে যুদ্ধের বাদ্য।
আমরা
অবশ্য সীমান্তে যুদ্ধ করি না, দেশের ভেতরেই
করি। যদি
আপনি এই যুদ্ধে একমত না হন, তাইলে অবশ্যই
আপনার দেশপ্রেমে ঘাটতি আছে।
কেননা,
আমরা
আমাদের দেশপ্রেম বর্গা দিয়েছি সশস্ত্র বাহিনীর হাতে (সেনাবাহিনীর
বিজ্ঞাপন দেখলেই বুঝবেন)। কিন্তু
এটা কে বুঝাবে এটা দেশপ্রেম না, এটা
‘জাতীয়তাবাদ’! এও ঠিক
যে, বর্তমান ডিসকোর্সে দেশপ্রেমও আফিমস্বরূপ
কাজ করে।
তিন
‘চল যাই
যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’ রীতিমতো
এমন স্লোগান তুলে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ‘ক্রসফায়ার’
যেহেতু
প্রচলিত অর্থে খানিক নেতিবাচক হয়ে গিয়েছে, সবার এর
বিরুদ্ধে কথা বলে, তাই বোধহয় এবার ইংরেজিতে না বলে বাংলায়
বলা হলো ‘বন্দুকযুদ্ধ’। শুরুতে
গল্পের কাহিনী একই ছিল, ‘জিনিসপত্র’
উদ্ধার
করতে যাওয়ার পথে পুলিশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে এই ‘মাদকব্যবসায়ী’রা
দুনিয়া ত্যাগ করেছেন।
কিন্তু
অডিও ফাঁস হওয়ার পর র্যাব-পুলিশ
আবারো সৃজনশীলতার পরিচয় দিলেন।
এবার
বন্দুকযুদ্ধ আর পুলিশের সাথে হলো না, বরং হলো
দুই গ্রুপের মধ্য, পুলিশ খালি লাশ খুঁজে এনে রেখেছ।[2]
এই
অভিজ্ঞতার কোনটাই কিন্তু নতুন কিছু না।
এখানে
কারা মারা যাচ্ছে এর একটা ফিরিস্তি নিলে দেখা যাবে এর একটা বড়ো অংশ সমাজের গরিবি হালতে
থাকা মানুষ এবং মাদক চলাচলের যে পাইপলাইন তাঁর নিচের স্তরে এদের অবস্থান।
ফিলিপাইনেও মাদকের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ হয়েছিল, সেটাকে তো ‘War
on poor’’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। সেখানে
নিহত ব্যক্তিদের অবস্থান বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছিল যে, এরা
প্রায় সকলেই দরিদ্র শ্রেণির এবং বস্তি-শহরতলিতে
বসবাসকারী। এদের
বড়ো অংশই পেটের তাগিয়ে এই পথে পা বাড়ায়।
যেমন
নিহত হওয়া এক ব্যক্তির আত্মীয় বলেছিলেন, বড়ো বড়ো
বিক্রেতার কোন সমস্যা হচ্ছে না, চুনোপুঁটিরা
তো স্রেফ জীবিকার তাগিদে, তাদের সন্তানদের
মুখে খাবার জোগাতে এর সাথে যুক্ত হয়।
এই
আক্ষেপটা ফিলিপাইনের সবাই করেছিলেন।
নিহতদের
আত্মীয়রা যেমন প্রশ্ন করেছিলেন কেন গরীবরা শুধু খুন হচ্ছে, তেমনি
পুলিশ কর্মকর্তারাও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, পুলিশ
যাদের হত্যা করছে তারা কোন বড়ো কর্মকর্তা নয়, ছোটখাটো
মানুষ।
থাইল্যান্ডের মাদকের বিরুদ্ধে
যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও এমনই।
পুলিশ
পুকুরের ছোট ছোট মাছকেই বেঁছে নিত হত্যা করার জন্যে। নিচের স্তরের
ডিলার বা পার্বত্য অঞ্চলের গ্রামবাসী থাকত এই টার্গেটে। আবার এই
লাশের সংখ্যার উপর নির্ভর করত যুদ্ধের সাফল্য ও ব্যর্থতা। সেখানেও
পুলিশ একই দাবি করে যে, পরস্পরবিরোধী
গ্রুপের মারামারির কারণেই এই মৃত্যু ঘটেছে।
পরবর্তীতে
দেখা গিয়েছে যে এই নিহত হওয়া একটা বড়ো অংশের মানুষের সাথে মাদকের কোন সম্পর্কই ছিল
না।
মাদকের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ কারা
মারা যাচ্ছে তাঁর খতিয়ান বাদ দিলেও এই যুদ্ধের ফলাফল কী তা নিয়েও কিন্তু সবাই একমত। ফিলিপাইন
বা থাইল্যান্ড কোন খানেই কোন ফলাফল আসে নাই, শুধু বিচার
বহির্ভূত হত্যাকা- ছাড়া। ফিলিপাইনে
নিহত হওয়া ৮ বছর বয়সী এক ছেলের মা বলেছিলে যে, কর্তৃপক্ষ
ডালপালা কাটছে, কিন্তু শেকড়ে হাত দিচ্ছে না;
সুতরাং
গাছ থেকেই যাচ্ছে। আমাদের
বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে যে, মাঝেমধ্যে
ডালপালা কেটে দিলে গাছ কিন্তু আরও বড়ো হয়।
থাইল্যান্ড
অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, নিচু স্তরে
বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- উঁচু স্তরে
বসে মানুষদের বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে রেহাই দেয়। এই ফলাফল
নিয়ে সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মুখ ফুটে স্বীকার করেছেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট সিজার
গ্যাভিরিয়া। তিনি
স্বীকার করেছেন মাদকের বিরুদ্ধে এইধরনের যুদ্ধ আসলে কোনো কাজের কথা না;
শুধু
যে টাকার অপচয় তা না, বরং এইটা
আরও সমস্যা বাড়িয়ে দে।
তিনি
আরও স্বীকার করেছেন যে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আসলে মানুষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ,
এবং
রাজনীতিবিদদের কাছে কখনো সখনো এইটা খুবই জনপ্রিয় কাজ। তাঁর এই
অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের প্রতি সতর্ক বার্তাও পাঠিয়েছিলেন।[3]
বাংলাদেশে মাদকের বিরুদ্ধে
এখনো চলছে, যদিও মূলধারার মিডিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে
ধীরে ধীরে। এটা
কী আদৌ সফল হবে? তবে প্রায় সবারই কথা হচ্ছে,
এইটা
আসলে কোনো ফল দিবে না।
মাদক
কারবারিরা নতুন নতুন উপায়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের
অন্যান্য অভিজ্ঞতাও আমাদের জানান দেয় যে, মাদকের
বিরুদ্ধে এমন যুদ্ধ কখনো কোন ফল আনে না।
বরং,
কিছু
মানুষের জান কেড়ে নেয়।
এবং,
মাদকের
মূল প্রশ্ন, কেন সমাজে মাদকের ছড়াছড়ি ঘটে তা ধামাচাপা
দিয়ে দেয়, এবং মূল হোতাদের আড়ালে নিয়ে যায়।
মাদকের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ সফল
না হলেও রাষ্ট্র - সে স্বৈরাচারী হোক,
বা
গণতন্ত্রী হোক - একে ব্যবহার করে সবসময়। কারণটা
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টও বলেছেন।
চমস্কিও
একে গরীবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলেছেন, এবং এও
বলেছেন যে এই ‘যুদ্ধ’ আসলে
মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার হাতিয়ার, মানে
‘প্রোপাগান্ডা’র জন্যে
খুবই দরকারি। রাষ্ট্র
‘ভয়’ উৎপাদন
করতে পছন্দ করে, জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে এটার প্রয়োজন তার
কাছে খুব বেশি। এই
মাদক ব্যবসায়ীরা শত্রু তাই এদের হাত থেকে আমাদের বাঁচতে হবে। যখনই জনগণ
ফুসতে থাকে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তখন এমন একটা যুদ্ধ দরকার হয় রাষ্ট্রের। আর প্রোপাগান্ডার
সাথে যদি সন্ত্রাস (terror) যুক্ত হয় তখন তো সেটা হয়ে ওঠে আরও কার্যকরী।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১) নোয়াম চমস্কি, গণমাধ্যমের চরিত্র,
অনুবাদ:
গৌতম
গঙ্গোপাধ্যায়, মনচাষা প্রকাশপ্রকল্প।
২) Noam Chomskyy,
The drug war industrial complex, High Times, April 1998 [Chomsky.info]
৩)‘সর্বজন কথা’, আগস্ট
-অক্টোবর ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘মাদকের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড
ও কলম্বিয়ার অভিজ্ঞতা’।
৪) ‘বামাতি
সমাচার : বাঙালীর নতুন বুদ্ধিবৃত্তির শুলুক সন্ধান’,
মুহাম্মদ
গোলাম সারওয়ার, মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার এর ব্লগ,
২০১৮।
৫)‘মাদকবিরোধী
অভিযান যেন ইতিহাসের কলঙ্ক না হয়’, রোকন রহমান ২৯ মে, ২০১৮, লিংক -
shorturl.at/CT138
৬) ‘যুদ্ধ
এবার না হয় বাঁচার জন্য চলুক’, রাজীব আহমেদ
২০ মে, ২০১৮। লিংক
- shorturl.at/fqrvS
৭) জীবনবিনাশী
চালকদের জন্য কেনো এনকাউন্টার নয়?, রাজীব আহমেদ
১ জুন, ২০১৮। লিংক
- shorturl.at/fnq04
৮) মাদকের
মতো দ্রব্যমূল্যের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা যায় না?,
ইফতেখার
ইফতি ৩০ মে, ২০১৮। লিংক
shorturl.at/dDHU7
৯) মাদক
ব্যবসায়ীদের জন্য এত মায়াকান্না কেন?, সুলতান
মির্জা ২৪ মে, ২০১৮। লিঙ্ক
- shorturl.at/bfBLT
বিঃদ্রঃ প্রবন্ধটি
নেয়া হয়েছে সহুল আহমদ ও সারোয়ার তুষার লিখিত গ্রন্থ সময়ের ব্যবচ্ছেদ থেকে। প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ বইমেলায়।
[1] এই তথ্য ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। নিউ এইজ ‘Drugs still aplenty
despite drive across Bangladesh (Jan 25, 2019) শিরোনামের
খবরে জানায় যে নিহতে তালিকা ৩০০ অতিক্রম করেছে। আইন
ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিভিন্ন উপায়ে প্রাণ হারানো
মানুষের সংখ্যা ৪৬৬।
[2] ‘The police recovered
the bullet-hit body of a suspected drug peddler from Keyar Math area of
Jibannagar upazila in Chuadanga on Saturday morning ... The deceased, Shahin
Ali, 35, son of Munnaf Darji of Ashtalapara area of Jibannagar upazila town in
Chuadanga, was in the list of suspected drug peddlers prepared by the home
ministry, said Jibannagar police officer-in-charge Mahmudur Rahman. ... The
victim might have been killed by rival drug ped - dlers over previous enmity,
he added.’, ‘Drug peddler’s’ bullet-hit body found in Chuadanga, New age, (Sep 01,2018)
[3] The war on drugs is
essentially a war on people. But old habits die hard. Many countries are still
addicted to waging this war. ...Winning the fight against drugs requires
addressing not just crime, but also public health, human rights and economic
development. ...Taking a hard line against criminals is always popular for
politicians. I was also seduced into taking a tough stance on drugs during my
time as president. The polls suggest that Mr. Duterte’s war on drugs is equally
popular. But he will find that it is unwinnable. I also discovered that the
human costs were enormous. We could not win the war on drugs through killing
petty criminals and addicts. We started making positive impacts only when we
changed tack, designating drugs as a social problem and not a military one.’,
President Duterte Is Repeating My Mistakes, By César Gaviria, New York times, Feb. 7, 2017.
No comments:
Post a Comment