Tuesday, March 3, 2020

হুমায়ুন আজাদ ও পাহাড়ে নব্য ঔপনিবেশিক বুদ্ধিবৃত্তিক 'হিংসার ঝর্ণাধারা'


হুমায়ুন আজাদের 'পার্বত্য চট্টগ্রাম সবুজ পাহাদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরণাধারা' বইটা পড়া আর একাত্তরে যুদ্ধফেরত কোন পাকিস্তানি জেনারেলের আত্মজীবনী পড়ার অভিজ্ঞতা আসলে সমান; অন্তত আমার জন্যে। শুধু সাব্জেক্ট ও অবজেক্ট আলাদা। পাকিস্তানি জেনারেলরা পাকিস্তানি হিসেবে যে অবস্থান নেন, আমাদের আজাদ বাঙালি হিসেবে একই অবস্থান নেন।

সামরিক বাহিনীর সাথে সাধারণ জনগোষ্ঠীর যে মানসিক দূরত্ব সেটাকে কাজে লাগিয়ে 'উপজাতি' শান্তিবাহিনীরা সেনাবাহিনীর নামে অপপ্রচার চালিয়েছে। এটা আজাদের সিদ্ধান্ত। বিশ্বাস না হলে আমি সরাসরি উদ্ধৃতি দিচ্ছি, 'শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে জিতেছে সেনাবাহিনী, এবং হেরেছে প্রচারে'। তাই তিনি মনে করেন, 'সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উদ্ধার করা দরকার'। সেই উদ্ধারকার্যেই আজাদ সাহেব গিয়েছেন এবং সেটা সামরিক বাহিনীর আমন্ত্রণেই। তার এই বই লেখা এবং পাহাড় নিয়ে পূর্বের 'আবেগপ্রবণ' লেখা থেকে বিচ্যুতি এই সফরেরই ফসল। পূর্বের লেখাটা তার ভাষায় 'আবেগপ্রবণ' হলেও সেখানে বাস্তব সমস্যা এবং জ্ঞানের অনুপস্থিতি প্রবলই।

আজাদ সাহেব সহজে সেনাবাহিনীর কোন আগ্রাসনের খবর দেন না এই বইয়ে। আগ্রাসনের কোন খবর না দিয়েই তিনি 'উপজাতি'দের নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। একান্তভাবে না পেরে তিনি সেনাবাহিনীর কিছু আক্রমণের কথা উল্লেখ করেন, কিন্তু তার ' বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষীরা এসব কিছু করতে পারে।' তার মনে হয়, হয়তোবা এগুলো সত্য, হয়তোবা এগুলো অতিরঞ্জিত! সব 'হয়তো'। কিন্তু সেনাবাহিনীর কয়জন মারা গিয়েছে তার পুংখানুপুঙ্খ হিসাব দেয়া আছে, তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি সেনাবাহিনীর যুক্তিও উল্লেখ করছেন, 'কোন বিদ্রোহই প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা দিয়ে দমন করা যায় না, রক্ত ঝরাতে হয়...' সামরিক বাহিনীর যুক্তি তুলে ধরলেও তার কাছে এই দমন বা আগ্রাসন কখনোই অযৌক্তিক মনে হয় না, যতটা অযৌক্তিক 'উপজাতি'দের দাবি-দাওয়া। খুব দরদ দিয়েই আজাদ সাহেব বলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবিচ্ছিন্ন রাখা ও বিদ্রোহ দমনের জন্যে সেনাবাহিনীকে বেশ খাটতে হয়েছে, এবং হচ্ছে'।

পুরো বইজুড়ে আজাদের প্রতিতুলনাগুলো খুবই স্পষ্ট। 'আধুনিক বাঙালি'র সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসাররা 'সুদর্শন' ও 'মেধাবী'; আবার অন্যদিকে আজাদ সাহেবের 'উপজাতিরা' 'আদিম'।

মুক্তিযুদ্ধে 'উপজাতি'দের অবস্থান কেমন ছিল তা আমরা জানি এবং সেটা যে মোটেই একরৈখিক না তাও জানি। অনেকেই যেমন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়, তেমনি কিছু কিছু রাজা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনও করেন। আজাদও সে কথা উল্লেখ করেন, কিন্তু একটু পরেই বলে দেন, '... কিন্তু সাধারণভাবে পাহাড়িরা ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে'। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হওয়াদের মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাড় করিয়ে দেয়ার রাজনীতি বেশ আগেই আজাদ সাহেব তাহলে শুরু করে দিয়েছিলেন।

তবে, সবচেয়ে মজাদার ও ভয়াবহ যে সিদ্ধান্ত হুমায়ূন আজাদ দেন সেটা হচ্ছে, 'পূর্বপুরুষের বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে অনেক সময় রচিত হয় উত্তরপুরুষের সুখ'। যুক্তির প্যাটার্ণ খুবই পরিচিত মনে হচ্ছে? তাহলে আরো শোনাই, 'বাংলাদেশের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সমগ্র জনগণের মতোই পাহাড়ি জনগণকে আধুনিক গণতান্ত্রিক অধিকারসম্পন্ন সচ্ছল শিক্ষিত মানুষে পরিণত করা'। হ্যাঁ, কলোনাইজাররা ঠিক একই রকম কথা বলেছিল। ভারতবর্ষের রেললাইন স্থাপনের উদ্দেশ্য যে লুটপাট করা এবং এর ফলে যে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ সঙ্ঘটিত হয়েছিল ভারতবর্ষে এইসব আলোচনায় না এনে আমাদের এখন ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি খুশি হওয়ার কথা কারণ, তারা রেল লাইন স্থাপন করেছিল। কেননা, আজাদ সাহেবের মতে আজকের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভেতর লুকিয়ে আছে আগামী দিনের সুখ।

এখন কথা হচ্ছে, হুমায়ূন আজাদ তো জ্ঞানী মানুষ; তিনি কি উপনিবেশায়নের কথা জানতেন না? উপনিবেশের ইতিহাসের কথা জানতেন না? তিনি কি 'আদার' তৈরি করার প্রক্রিয়া জানতেন না? তিনি কি সাইদের সাথে পরিচিত ছিলেন না? অবশ্যই তিনি এইসব জানতেন। এডওয়ার্ড সাইদের সাথেও পরিচিত ছিলেন। তবু কেন তার বয়ানের এই হাল? খুব সহজ। এটাই জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভ। একে তো জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভ, তারউপর ঘুরতে গিয়েছেন সামরিক বাহিনীর স্পন্সরে! আমার তো শাহাদুজ্জামানের 'মিথ্যে তুমি দশটি পিপড়া' গল্পের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! গল্পটা পড়ে থাকলে উত্তর পেতে পারেন।

হুমায়ূন আজাদ আমাদের প্রধানতম বুদ্ধিজীবীদের একজন ছিলেন, এখনো তার প্রভাবে প্রভাবিত তরুণদের সংখ্যা কম নয়। যে দেশের বুদ্ধিজীবী 'পূর্বপুরুষের বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে অনেক সময় রচিত হয় উত্তরপুরুষের সুখ' - টাইপের ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট লাইন অবলীলায় বলতে পারেন,সেই দেশে ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। আমাদের রাষ্ট্র কীভাবে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠলো, কিংবা এই দেশে ফ্যাসিবাদী জমিন কীভাবে তৈরি হলো তার ব্যাখ্যা যারা খোঁজে পান না, তাদের দয়া করে আমাদের বড়ো বড়ো বুদ্ধিজীবীদের লেখাপত্রের দিকে নজর দিতে বলবো। আশা করি উত্তর পাবেন।

ফেসবুক পোস্ট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ 

1 comment:

  1. বইটি পড়ার পর ঠিক যে যে পয়েন্টগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো,এখানে খুব সুন্দরভাবে তাইই সাজিয়ে লেখা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ যে কাউকেই প্রভাবিত করে, সে বুদ্ধিজীবী হোক আর আম জনতা।

    ReplyDelete