[শুরুর কথা: এই
প্রবন্ধের লেখক, জন বেভেরলি রবিনসন,
সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানি না; দেড়
পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধ ছাড়া তাঁর আর কিছু পড়া হয় নাই। ডিজিটাল দুনিয়ার কল্যাণে আপাতত
যদ্দুর জানতে পেরেছি তা হলো রবিনসনের জন্ম ১৮৫৩ সালে এবং মারা যান ১৯২৩ সালে। সাথে
এটাও জানতে পেরেছি মতাদর্শের দিক থেকে লেখক একজন
individualist anarchist; তাঁর পরিচয় হিসেবে আরও বলা
আছে যে তিনি একজন প্রকাশক, অনুবাদক এবং আর্কিটেক্টও বটে।
স্বাধীনতা কী(What is freedom?) এই প্রশ্নের চমকপ্রদ ও সহজ-সরল আলাপই এই প্রবন্ধ অনুবাদে আগ্রহী করে
তোলে। লেখক প্রবন্ধটা লিখেছিলেন ১৮৯৪ সালে।
রবিনসন
যে স্বাধীনতার কথা বলেন তাকে এক কথায় বলা চলে ‘নিঃশর্ত স্বাধীনতা’; অবশ্য শর্ত আরোপিত হলে সেটা আর
স্বাধীনতাই থাকে না। তাঁর এই স্বাধীনতার নীতি যেমন সবধরনের জোরজবরদস্তি বিরোধী,
তেমনি বাধাহীন। তাই তিনি জোর দিয়ে বলতে পারেন, স্বাধীনতা মানে শুধু নিজের স্বাধীনতা চর্চাই না, বরং
অন্যকেও স্বাধীনতা চর্চা করতে দেয়া। এই সিদ্ধান্তে পৌছানোর পূর্বে লেখক কিছু
জনপ্রিয় প্রশ্ন/সমস্যা উত্থাপন করেছেন, আবার সাথে সাথে এও
বলেছেন যে, এগুলো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই সমাধান করা সম্ভব।
মানুষকে বিভিন্ন আইনের মারপ্যাঁচে যারা ফেলে দেন, সেইসব
আইন-প্রণেতারা, লেখকের মতে, জোরজবরদস্তিই
করে থাকেন; তারা নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অন্যের উপরে চাপিয়ে
দেন।
রাজা-বাদশার
আমলে রাজরাজড়ারা ছাড়া আর কারো কোন স্বাধীনতা ছিল না, স্বাধীনতা শুধু একজনের দখলেই ছিল। এখন সময় পাল্টেছে, স্বাধীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু, লেখকের মতে,
শাসকচক্রের কাছে এখনো আমাদের স্বাধীনতা বর্গা দিতে হয়, সেই শাসকচক্র রাজতন্ত্রী হোক কিংবা গণতন্ত্রীই হোক। যেহেতু ক্ষমতা পূর্বের
মতো একজনের হাতে কুক্ষিগত নয়, এবং ক্ষমতা ব্যবহারকারীর
সংখ্যাও বেড়েছে, তাই লেখকের শেষ উপদেশ হচ্ছে, এই ক্ষমতার সবচেয়ে ভালো ও যথার্থ ব্যবহার হবে যদি একে স্বাধীনতা রক্ষার
কাজে লাগানো যায়। লেখক এও জোর দিয়ে বলেছেন, এটাই সবচেয়ে
নিরাপদ কাজও বটে।
লেখকের
সিদ্ধান্তের সাথে একমত-দ্বিমত-ত্রিমত হওয়ার সুযোগ আছে, কিংবা স্বাধীনতার এই আলাপকে আরও বড় পরিসর
থেকে দেখার সুযোগও আছে। তবু, স্বাধীনতা নিয়ে আলাপের স্বাধীন
চর্চাটা অন্তত ঠিকে থাকুক, এটাই কামনা আপাতত।
হুটহাট
করেই অনুবাদ করেছিলাম। এটাকে ‘লেখা’
হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব ছোট ভাই ও বন্ধু তানভীর আকন্দের।
তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা! লেখক freedom এবং liberty দুটো শব্দ বারেবারে ব্যবহার করছিলেন, দুই ক্ষেত্রেই অনুবাদ ‘স্বাধীনতা’
করা হয়েছে। ]
‘আপনার
কি মনে হয় স্বাধীনতা সবার জন্যে মঙ্গলজনক?’ এক চিন্তাশীল
নারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লাগামহীন ক্ষমতার নানা উদাহরণ
যদি ধরুন, যেমন রোমান সম্রাটগণ; তাদের
তো নিশ্চয়ই স্বাধীনতা ছিল; কিন্তু, সেটা
থাকা কি ভালো ছিল?’
তাই, স্বাধীনতার সম্পূর্ণ ধারণা মনে জায়গা করে নেয়ার পূর্বেই মানুষ তা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে। যে চুরি করে সে কি স্বাধীন নয়?
যে বউ পিটায়, সে কি স্বাধীন নয়?
কিন্তু, অন্যদের ক্ষেত্রে কি হচ্ছে? আমরাও প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞেস করি। যখন রোমান সম্রাটরা শাসন করেছিলেন,
তারা হয়তোবা স্বাধীন ছিলেন, কিন্তু, শাসিতরা কি স্বাধীন ছিল? চোর হয়তোবা স্বাধীন হতে
পারে, কিন্তু যাকে চুরি করছে সে যে নিগৃহীত হচ্ছে তাতে তো
কোন সন্দেহ নাই। যে তার বউকে পেটাচ্ছে, সে হয়তোবা তার
শারীরিক শক্তির কল্যাণে বউ পিটাতে স্বাধীন, কিন্তু বউ কি
স্বাধীন?
স্বাধীনতা
মানে সবার জন্যেই স্বাধীনতা, যত দ্রুত সম্ভব এটা
আমাদের বুঝতে হবে। এটা আরেকজনের মাথায় মুগুর মারার স্বাধীনতা নয় যেখানে একজনের
শুধু মার খাওয়ার পথই খোলা থাকবে! বরং, এটা হচ্ছে একে অন্যকে
কোন ধরণের মুগুর না মেরে শান্তিতে যে যার জীবন-যাপনের স্বাধীনতা।
কিন্তু, আপনি হয়তোবা আপত্তি জানাতে পারেন, এটা সবার জন্য দূরে থাক, কোন একক ব্যক্তির পক্ষেও
অন্যের স্বাধীনতা খর্ব না করে খেয়াল খুশিমতো কাজ করা সম্ভব নয়। ধরুন, দুজন ব্যক্তি একই কাজ করতে চায়, এক্ষেত্রে তারা
সমঝোতায় আসবে কিভাবে? মনে করুন, আমি
একটা নির্দিষ্ট জমিতে একটা বাড়ি তৈরি করতে চাই এবং অন্য আরেকজনও একই জমিতে তার বাড়ি তৈরি করতে চায়। এ ক্ষেত্রে কিভাবে
আমরা দুজনেই নিজেদের খুশিমতো কাজ করার স্বাধীনতা পেতে পারি?
উত্তরটা
হচ্ছে এই: সকলের স্বাধীনতাই যৌক্তিক এই রীতি যদি আমরা মেনে নেই, তাহলে যে ঘটনাগুলো অন্যের স্বাধীনতা চর্চার
সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে, সেগুলোর সমাধান খুব সহজেই হয়ে যাবে। একই জমি নিয়ে সমস্যাটা সাধারণ
কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই সমাধান করা সম্ভব, যেভাবে বিনামূল্যের শো’র আসন বিন্যাস সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করা হয়, আগে
আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে। এরকম অনেক কূটতর্কের যেগুলো স্বাধীনতা কার হবে এই প্রশ্ন
তুলে, সেখানে এই নিয়মে, একই রকম ভাবে,
এমন সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
রাস্তায়
হাটার স্বাধীনতা সবারই আছে, কিন্তু এর মানে এই না
যে একে অন্যের গায়ে এসে পড়তে হবে।
কিন্তু
মুশকিল হচ্ছে, সাংঘর্ষিক কর্ম ও একে
অন্যকে দখল করার মতো ঘটনা ব্যতীত যখন আমরা সবার জন্যেই স্বাধীনতা এই নীতি পরিত্যাগ
করি; সে স্বাধীনতা
যথেষ্ট নয়, কেউ না কেউ কাউকে না কাউকে দমন করবেই। এই দমন
প্রক্রিয়ারও কোন সীমানা নাই। যে ঘটনায় কর্মের সাথে কর্মের সংঘর্ষ হয় সেটা হতে শুরু
করে একেবারে যেখানে সংঘর্ষ দূরে থাক, সবার সম্মতি আছে এমন
ঘটনা পর্যন্তও সে (দমন প্রক্রিয়া) নিজেকে প্রসারিত করে থাকে। রোববারের আইন (Sunday
laws), অন্যান্য দিনে স্বাধীন ভাবেই যা কেনা যায় তা সপ্তাহের একদিন
কিনতে নিষিদ্ধ করা, স্পষ্টতই জঘন্য। কেনাকাটার কর্ম যেখানে
সপ্তাহের ছয়দিন অন্য কারো স্বাধীনতায় বাঁধা দেয় না, সেখানে
সপ্তম দিন এটা বাঁধা দিবে তা চিন্তা করাই নির্বুদ্ধিতা। এই আইনগুলো প্রণীত হয় যারা
এটাকে সমর্থন করে তাদের স্বাধীনতার জন্যে নয়, বরং, এই জন্যে যে তারা অন্যের উপর তাদের চিন্তা ও কর্ম চাপিয়ে দিতে চায়,
এবং সেটা অন্যদের স্বাধীনতার বিনিময়েই। তারা চান, এবং আমাদের প্রত্যেক আইন-প্রণেতারাই চান, সবার উপর
কিছু নির্দিষ্ট কর্ম চাপিয়ে দিতে, কারণ এগুলো ধর্ম অথবা
প্রথা অথবা কুসংস্কার দ্বারা অনুমোদিত। এই নীতিগুলো একদল মুখোশ-ধারী দুর্বৃত্ত দ্বারা
পরিচালিত হয় যাদের সম্পর্কে পত্রিকায় আমরা খুব কমই পড়ি, এবং
তারা মাঝরাতে এমন কিছু পুরুষ বা নারীকে চাবুক মারেন, বা
পুড়িয়ে মারেন যারা অন্যের সাথে বোঝাপড়া তৈরিতে আদর্শ হতে পারত, এবং, যার কার্যাবলীর সাথে অন্যের কোনধরণের সংঘর্ষও নাই। এটা আসলে সংঘর্ষের প্রশ্ন নয়, বরং আমরা যা সঠিক মনে করি তা সবাইকে মানতে বাধ্য করার প্রশ্ন। প্রকৃতপক্ষে,
এই হোয়াইট ক্যাপরা সাধারণত কমিউনিটিতে সর্বোচ্চ সম্মানিত
ব্যক্তিবর্গ, চার্চ ও রাষ্ট্রের স্তম্ব।
একটা
সময় ছিল যখন স্বাধীনতা বরাদ্দ ছিল মাত্র এক ব্যক্তির জন্যে, যার কাছে সবাই ছিল স্বেচ্ছাদাস। তার
অবস্থানের প্রতি অন্ধভক্তি থেকে এই স্বেচ্ছাচার তন্ত্রের বশ্যতা-স্বীকার করতে হতো,
যেমন হয়েছিল রোমান সম্রাটগণের আমলে। শাসকচক্রের প্রতি বশ্যতা-স্বীকারের এই মনোভাব এখনো দেখানো হয়,
সেটা রাজতন্ত্রে হোক কিংবা গণতন্ত্রে হোক। এমন সময়ে, এবং এমন
হামাগুড়ি দিয়ে নিজেকে বিসর্জন দেয়ার মনোভাবের বিরুদ্ধে, মানুষের মনকে চালানোর জন্যে যে
কোন উপায়ে বিদ্রোহ করাই হচ্ছে এর একমাত্র প্রতীকার।
কিন্তু, ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে এবং আংশিক
হয়েও গিয়েছে। প্রচুর লোকের হাতে ক্ষমতা আছে এবং তা ব্যবহার করাও তারা শিখছে।
মুষ্টিমেয় কিছু লোকের থেকে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সবাইকে তাগাদা দেয়ার
প্রয়োজন আর এখন নেই। বরং, আমাদের এখন এই প্রেরণা দিতে হবে যে,
স্বাধীনতা মানে নিজের স্বাধীনতা চর্চার পাশাপাশি অন্যকে স্বাধীন হতে
দেয়া।
যে
স্বাধীনতার অর্থ জানে সে জানে তাঁকে কি করতে হবে। যে স্বাধীন সে কখনো চাইবে না
অন্য আরেকজন তার ইচ্ছেমত কাজ করুক, কি করতে হবে তা নিয়ে বড়জোর তিনি উপদেশ বা পরামর্শ দিতে পারেন।
এর
বিপরীতের যে চেতনা, - শাসকের বর্তমান ক্ষমতাকে আরও দৃঢ় করে। এভাবে
যারা মনে করে যে তারা শাসন করছে, তারা আসলে নিজেরাই দাসত্বকে
কবুল করছে।
এর বিপরীতের যে চেতনা, মানে দাসত্বের মনোভাব যা আমরা অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে
পেয়েছি, যা অন্যকে আমাদের পথে চলতে বাধ্য করে, তার উপরেই
বর্তমানের শাসন-ক্ষমতা নির্ভর করে। যারা মনে করে তা দিয়ে শাসন করবে তারা আসলে
নিজেরাই দাসত্বকে কবুল করে।
এটা সত্য
যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা আছে, কিন্তু এর অন্ধ ব্যবহার সবসময়ই ব্যবহারকারীকে পাল্টা আঘাত করবে। এবং সেটা
করবে অর্থনৈতিক দাসত্বের এই ব্যবস্থাকে সমর্থনের মাধ্যমে যা কিনা শাসক ও শাসিতকে
সমানভাবেই পেষণ করে থাকে।
সংখ্যাগরিষ্ঠকে
বুঝতে হবে যে, - যা আমরা বুঝাতে চাচ্ছি - একমাত্র স্বাধীনতা রক্ষার কাজে ক্ষমতাকে
ব্যবহার করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ ও যথার্থ। এবং, এটা বাধ্যতামূলক করারোপণ থেকে বাঁচায়।
No comments:
Post a Comment