Tuesday, March 5, 2019

কাশ্মীরের আর্তনাদ



কাশ্মীর, ফিলিস্তিন সংক্রান্ত ইস্যুগুলো যখন কোন কারণে - মূলত যুদ্ধের কারণেই - আমাদের কাছে আলোচিত ইস্যু হিসাবে ফেসবুকের নিউজফিডে ঘুরপাক খায় তখনই আমাদের জানা-শোনার সীমাবদ্ধতা প্রকটভাবে ধরা পড়ে। ভারত-পাকিস্তানের যাবতীয় যুদ্ধসংক্রান্ত আলোচনার সবচেয়ে বড় অংশ আসলে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। কিন্তু দুঃখজনক হলে সত্য যে, ব্রিটিশদের বিদায়ের পর হতে ভারতবর্ষের যেকয়টা অঞ্চলে এখনো আগুন জ্বলছে তারমধ্যে কাশ্মীর অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও এর সম্পর্কে আমাদের জানা-শোনা একেবারেই সীমিত। তাই, কেন্দ্রে কাশ্মীর না থেকে কেন্দ্রে চলে আসে ভারত না হয় পাকিস্তান। যারা ভারতীয় মিডিয়ার প্রপাগান্ডা হজম করে ফেলেন তাদের অবস্থান ভারতের পক্ষে, এবং যারা পাকিস্তানের প্রপাগান্ডা হজম করেন তারা পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু, কখনোই কেন্দ্রে থাকে না কাশ্মীর। এ নিয়ে জানার পাইপলাইনটাও সীমিত। আলতাফ পারভেজের 'কাশ্মীর ও আজাদির লড়াই' গ্রন্থের গুরুত্ব এখানেই যে, যারা কাশ্মীর নিয়ে জানতে চান তাদের জন্যে এটা হতে পারে এক দরজার মতোন। তথ্যে ঠাসা একটা গাইড বই যেনো; সাথে সহজ-সরল উপস্থাপনা।

কাশ্মীর সমস্যার শুরু কীভাবে, কোন কোন চুক্তি কাশ্মীরকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে, নেতৃত্বস্থানীয় লোকদের ভূমিকা কি ছিল, কীভাবে সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক চিহ্ন ধারণ করলো, সেকুলার কাশ্মীর আন্দোলন ধীরে ধীরে কেন ধর্মীয় রূপ ধারণ করছে, কেন জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে ধর্মভিত্তিক প্রতিরোধী মনোভাব দৃঢ়তা পাচ্ছে, কাশ্মীরীদের জটিল ডেমোগ্রাফি কিভাবে সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে, ঐতিহাসিক 'গণভোট' কেন এখনো অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, সেখানে পানিকেন্দ্রিক জটিলতা কীভাবে 'গণভোট' অনুষ্ঠানে বাধাস্বরূপ, কোন প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র বিদ্রোহের দিকে ঝুকলো কাশ্মীর, তাদের বর্তমান অবস্থা কেমন, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মিলিটারাইজড এলাকায় কাশ্মীরিরা কেমন আছেন - এই সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন, মিনিমাম পরবর্তী ধাপের জন্যে একটা দরজা পাবেন। 


আলতাফ পারভেজের বই থেকেই কাশ্মীররে বর্তমান অবস্থার কিছু চিত্র তুলে দেই। ভারতীয় পার্লামেন্টে ১৯৫৮ সালে একটি আইন তৈরি করা হয়, Armed Forces Special Powers Act নামে। এই আইন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে 'ডিস্টার্বড এরিয়া' সমূহে অভিযান পরিচালনার জন্যে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়েছে। যেমন, 'সন্দেহজন' মনে হলে যখন যাকে ইচ্ছা গুলি করার অধিকার দেয়া হয়েছে। ভারতে যখনই জাতিগত বঞ্চনাপূর্ণ এলাকাতে কোন বিদ্রোহ দেখা দেয় তখনই এই আইনের আশ্রয় নেয়া হয়। কাশ্মীরে এই আইন কার্যকর আছে ১৯৯০ সাল হতে। 

কাশ্মীরকে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে অধিক সামরিকায়িত এলাকা হিসেবে অভিহিত করা হয়। জম্মু ও কাশ্মীরে বর্তমানে প্রতি বর্গমাইলে প্রায় ১০০ জন ভারতীয় সৈনিক কর্মরত; প্রতি ১০ জন বেসামরিক নাগরিকের বিপরীতে সেখানে কোনো না কোনো বাহিনীর একজন সৈনিক আছে। ভারত সবসময় দাবি করে আসছে যে, কাশ্মীরে মাত্র ১৫০-২০০ জন জঙ্গি আছে, কিন্তু ১৯৯০ এর পর থেকে তাদের হিসাবেই সেখানে ২১ হাজার জঙ্গি মারা গেছেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরের কেবন পাচটি জেলায় সাত হাজার অজানা ব্যক্তির কবর/গণকবর খুঁজে পাওয়া গেছে। 

কাশ্মীরে ভারতের অনেকগুলো সশস্ত্র বাহিনী সক্রিয় আছে, তারমধ্যে একটা হচ্ছে 'স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ' বা (এসওজি)। এই গ্রুপে বেসামরিক ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয় - যাদের কাশ্মীরী স্বাধীনতাকামীদের প্রতি কোনো বিশেষ বিরাগ রয়েছে। প্রত্যেক সশস্ত্র স্বাধীনতাকামীকে হত্যার জন্যে এই গ্রুপকে ৩০-৫০ হাজার রুপি পুরষ্কার দেয়া দেয়া হয়। ২০১০ সালে সপোরে একটা ঘটনা ঘটে। সেখানে তিন তরুণকে হত্যার পর ভারতীয় বাহিনী জানায় যে, নিহতরা নাকি পাকিস্তান থেকে সশস্ত্রভাবে প্রবেশ করেছিল। এই পরে বিক্ষোভ হলে সেখানে সেনাবাহিনীর গুলিতে ১১২ ব্যক্তি নিহত হন। ঘটনার তদন্ত শেষে সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও পরে সেটা মওকুফ করা হয়। ১৯৯১ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি কপওয়ারা জেলায় ভারতীয় বাহিনীর ৪র্থ রাজপুত রাইফেলের জওয়ানদের হাতে ৫৩ জন নারী দলবদ্ধভাবে ধর্ষনের শিকার হন; তাদের নিয়ে একটা ডকু নির্মিত হয় 'Ocean of tears' নামে, যদিও ভারতে প্রচারের অনুমতি মেলেনি। ১৯৯৩ সালে human rights watch জানিয়েছিল, কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী ধর্ষণকে একটা যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনা ঘটছে তল্লাশির সময় - বাড়িতে পুরুষদের হত্যা বা আটক শেষে। এইরূপ অনেক নারী পরে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। 

এইসব তথ্য তুলে দিলাম আলতাফ পারভেজের বইটা থেকেই। বই প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য প্রকাশনী। কাশ্মীরের পাশাপাশি এইবার বার্মা নিয়েও আলতাফ পারভেজের আরেকটা বই প্রকাশিত হয়েছে। এরপূর্বে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার তামিলদের নিয়েও দূর্দান্ত একটা বই প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলো প্রকাশিত হচ্ছে 'এথনো-পলিটিচস ইন সাউথ এশিয়া' ব্যানারে। 

পড়ে ফেলুন। 


No comments:

Post a Comment