গবেষকদের কাছে ম্যাসাকার, গণহত্যা, পলিটিসাইড শব্দগুলো মূলত ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। তাই স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন চলে আসে, একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক এই হত্যাযজ্ঞকে কি তাহলে ‘গণহত্যা’ বা Genocide বলা যায়? পাকিস্তানীদের আক্রমণে প্রচুর সংখ্যক বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে বটে তবে সেটা ‘গণহত্যা’ নয়! তখন যুদ্ধ চলছিল দেশব্যাপী, যুদ্ধের সময় এমন প্রাণহানি হবেই! – যারা একাত্তরের গণহত্যাকে স্বীকার করতে চান না তাদের যুক্তিগুলো অনেকটা এ ধরণের। এই যুক্তিকে ঘিরেই মূল আলোচনা। বিশেষজ্ঞরা গণহত্যার বিভিন্ন ধাপ নিয়ে প্রচুর একাডেমিক আলোচনা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন পাঁচ ধাপে সংঘটিত হয়, কেউবা আট ধাপের কথা বলেছেন, আবার কেউ দশ ধাপের কথাও বলেছেন। তবে, সবার মূল সুর আসলে একই।
১৯৯৬ সালে প্রখ্যাত গবেষক ড. গ্রেগরি এইচ স্ট্যান্টন (Gregory H. Stanton) একটা আর্টিকেল লিখেন “8 stages of genocide” নামে; যেখানে তিনি গণহত্যা সংগঠনের বিভিন্ন ধাপ নিয়ে বিশদ আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেন। তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করে আমাদের উপর সংগঠিত গণহত্যাটিকে তুলনামূলক ভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রথমত, গণহত্যা বা Genocide বলতে আমরা কি বুঝি? এই অপরাধ অনেক পুরনো হলেও রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে প্রথম এই শব্দটা চালু করেন। Genocide এর উৎপত্তি গ্রীক শব্দ Geno এবং ল্যাটিন শব্দ caedere থেকে। Geno এর অর্থ জাতি বা গোষ্ঠী এবং caedere এর অর্থ হত্যা করা; অর্থাৎ সংক্ষেপে দাঁড়ায়, ‘Genocide is intentional action to destroy a people (usually defined as an ethnic, national, racial, or religious group) in whole or in part’ (উইকিপিডিয়া)। জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক অধিবেশন অনুযায়ী, গণহত্যা হচ্ছে নির্দিষ্ট কোন একটা গোষ্ঠীকে (National, ethnical, racial or religious) পুরোপুরি কিংবা আংশিক ধ্বংসের উদ্দেশ্যে (intent) নিম্নের অপরাধসমূহ -
১) গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা
২) গোষ্ঠীর সদস্যদেরকে মারাত্মকভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন করা
৩) ইচ্ছাকৃত ভাবে হানা দিয়ে গোষ্ঠীর প্রকৃত অবস্থা পুরোপুরি কিংবা আংশিক ধ্বংস করা
৪) আইন প্রণয়ন করে গোষ্ঠীর ভেতর জন্মরহিত করণ চালু করা
৫) জোরপূর্বকভাবে গোষ্ঠীর শিশুদেরকে অন্য গোষ্ঠীতে ঢুকিয়ে দেয়া।
উপরের সংজ্ঞাগুলোতেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী যে কোন গোষ্ঠীর মানুষদের হত্যা করলেই যে শুধু গণহত্যা তা নয়, বরং এর পাশাপাশি সদস্যদের যে কোন মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিসাধনও এর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি নির্দিষ্ট কোন গ্রুপকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে এর শিশুদেরকে অন্য গোষ্ঠীতে ঢুকিয়ে দেয়া কিংবা সেখানে জোর করে জন্মদানে বাধা দেওয়াও গণহত্যার সামিল। প্রধান আলোচনায় যাওয়ার আগে জেনে নেয়া যাক কারা কিংবা কোন অপরাধগুলো গণহত্যার সাথে সম্পর্কিত এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ-
১) গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণ করা
২) গণহত্যার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করা
৩) প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উস্কানি দেয়া যা গণহত্যার পথ সুগম করে
৪) গণহত্যার চেষ্টা করা
৫) গণহত্যায় সহায়তা করা।
গণহত্যার জন্যে ‘উদ্দেশ্য’(intent) জরুরী; আইনি ভাষায় ‘intent’ এবং’motive’ এর মধ্যে পার্থক্য আছে[1]। গণহত্যাকে বুঝতে তাই গুরত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ‘উদ্দেশ্য’কে বুঝতে পারা। স্ট্যন্টনের ভাষায়, ‘Genocidal intent is determined by the specific purpose of the act: Did the killer purposely kill the victim as part of a plan to destroy a national, ethnic, racial, or religious group, at least in part?’ সেই সাথে শুধুমাত্র কোন এক গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে কোন মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে কি না - গণহত্যাকে বুঝতে এটাও খতিয়ে দেখতে হয়। এই উদ্দেশ্য কখনো কখনো গণহত্যাকারীদের বিভিন্ন উদ্ধৃতি-বিবৃতি থেকেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে, আবার কখনো কখনো তাদের কর্মপরিকল্পনাও তাদের নিয়তের কথা জানান দেয়। তাদের কাজের প্যাটার্ণের মধ্যেই তাদের মতিগতি ফুটে ওঠে। এমন না যে তাদের এসব পরিকল্পনার কোন লিখিত দলিল থাকতেই হবে। তবে পুরো ‘উদ্দশ্য’ বুঝা যায় গণহত্যা সংগঠিত হওয়ার ধাপগুলোকে নাড়াচাড়া করলেই। গণহত্যা এমন এক সংস্কৃতিতে সংগঠিত হয় যেখানে গণহত্যকারীরা আক্রান্তদেরকে ‘মানুষ’ হিসেবে মনেই করে না, তাই এদেরকে হত্যা করলেও ‘মার্ডার’ কিংবা ‘আইন বহির্ভুত’ হিসেবে এটা গণ্য হয় না। এই আচরণ যেমন হতে পারে কোন এক নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীর প্রতি, তেমনি হতে পারে গোষ্ঠীর একাংশের (যেমন, অফিসার, বুদ্ধিজীবী, নেতৃবৃন্দ) প্রতিও।
ড. গ্রেগরি তার প্রবন্ধে গণহত্যা সংগঠনের প্রক্রিয়াকে ৮ টা ধাপে কিংবা পর্যায়ে ভাগ করেছেন। ধাপগুলো নিম্নরূপ:
1. Classification, 2. Symbolization, 3. Dehumanization, 4. Organization, 5. Polarization, 6. Preparation, 7. Extermination, 8. Denial.
প্রথম দুটি পর্যায় প্রতিটা সমাজেই প্রতীয়মান; Classification কিংবা শ্রেণীকরণ ধর্মের ভিন্নতা, ধর্মের ভেতরে মতাদর্শের ভিন্নতা, মুখের ভাষার ভিন্নতা এবং সাংস্কৃতিক বিচিত্রতা সহ আরও অনেক কারণেই হয়ে থাকে। আবার প্রতিটা শ্রেণীকে চিহ্নিত করা হয় ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দ্বারা, যাকে লেখক বলেছেন Symbolization। দাড়ি টুপি যেমন মুসলিমদের পরিচয় বহন করে তেমনি ধুতি সিঁদুর বহন করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পরিচয়। সেই চিহ্নিতকরণ কখনো কখনো করা হয় গাত্রবর্ণের দ্বারা, কখনো শারীরিক গঠন দ্বারা; যেমন, উপজাতি। সামনেই আমরা দেখতে পাব এই Symbolization কিভাবে গণহত্যায় সহায়তা করে।
লেখকের মতে, প্রথম দুটি পর্যায় প্রতিটা সমাজেরই অংশ এবং তা সর্বত্র বিদ্যমান থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই দুটোর সাথে যখন একত্র হয় Dehumanization বা ‘অমানবিকরণ’, তখনই প্রথম দুটো পর্যায় “গণহত্যার” সাথে সম্পর্কিত হয়ে উঠে। এটা অনস্বীকার্য, অন্যের মনুষ্যত্বকে অস্বীকারই উদ্দীপনা যোগায় একের পর এক দায়হীন হত্যার। প্রতিটি গণহত্যাতেই দেখা যায় ভিকটিমদেরকে শুরুতেই বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের সাথে তুলনা করা হয় যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় এই অমানবিকরণের প্রথম পর্যায়। কখনো কখনো ভিকটিমদেরকে রোগ, জীবাণু হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। নাৎসিরা ইহুদিদেরকে প্রকাশ্যেই ইঁদুর, ক্ষতিকর পোকামাকড় (Vermin) বলে সম্বোধন করত। রুয়ান্ডায় হুতুরা টুটসিদেরকে ‘তেলাপোকা’ বলে সম্বোধন করত। মনুষ্যত্বের প্রতি তাদের সর্বোচ্চ অবজ্ঞা কিংবা ঘৃণার প্রকাশ পাওয়া যায় গণহত্যার সময় প্রতিপক্ষকে হত্যার পর তাদের অঙ্গহানি করা, কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা কিংবা সীমাহীন নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করার মধ্য দিয়ে।
এবার এই ধাপটাকে আমরা মিলিয়ে দেখি ১৯৭১ এর ঘটনাপ্রবাহের সাথে। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার বইতে লিখেছিলেন, আওয়ামীলীগ বাঙালি জাতীয়তাবোধের ‘Virus’ ছড়াচ্ছিল যা বাঙালি সাধারণ মানুষ ও সেনাদের ‘Infect’ করছিল। শব্দ দুটো খেয়াল করে দেখুন, virus এবং infect! আওয়ামীলীগ কর্মীরা ছিলেন তাদের কাছে ‘গুণ্ডা’। কারো কারো কাছে তো পুরো বাঙালি সমাজটাই ছিল “বাস্টার্ড” এবং “জারজ”। বাঙালিদেরকে উদ্দেশ্য করে কসাই টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘Reduce the number of Bengali bastards’। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের দিকে এক নৈশভোজের জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘Don’t worry .. We will not allow these black bastards to rule over us.’ (Sadik, 1997)
মার্চে যখন মুজিবের সাথে ইয়াহিয়ার আলাপ আলোচনা চলছে তখনকার ঘটনা; প্রথমদিন আলোচনার পরই ইয়াহিয়া একটু বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিলেন দেখে সিদ্দিক সালিকের মন্তব্যটা শুনুন, “Amazingly, he had (apparently) failed to see the snake in the grass”। এ বিষয়ে গবেষক মুনতাসীর মামুন লিখেন, “রূপক অর্থে হয়তো এটি ব্যবহৃত কিন্তু ‘সাপ’ বলতে তো বাঙালিকেই বোঝাচ্ছে”। (মামুন, ২০১০ )
এরপরই আসে পরবর্তী পর্যায়, Organization; পৃথিবীর সবগুলো গণহত্যাই চালানো হয়েছে দলবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়ে, অবশ্য বেশিরভাগই হয়েছে সরকারী ভাবে কিংবা মিলিটারি দ্বারা। হত্যা করার জন্যে নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনার দরকার পড়ে না কিংবা প্রতিপক্ষকে মারার জন্যে কোন জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে যাওয়ার দরকার পড়ে না, যেমন – রুয়ান্ডায় টুটসিরা মারা গিয়েছিল ছোরা ঘাতে, কম্বোডিয়ায় গণহত্যা চালানো হয়েছিল নিড়ানির মত একধরনের ছুরি দিয়ে। কম্বোডিয়ার গণহত্যাকারীদের নীতি ছিল, Bullets must not be wasted – যা কিনা ভিকটিমদের প্রতি ছিল সর্বোচ্চ Dehumanization। কখনো কখনো ফায়ারিং স্কোয়াড কিংবা ক্যাম্প স্থাপন করেও ম্যাসাকার চালানো হয়। এই সাংগঠনিক কাঠামোতে ভিন্নতা দেখা দেয় সমাজ থেকে সমাজে, দেশ থেকে দেশে; তবে এটা সর্বদা সুসংগঠিত অবস্থায়ই হয়ে থাকে। ৭১ এ পাকিস্তানি সরকার এবং মিলিটারির পাশাপাশি সংগঠনে অংশ নিয়েছিল দেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তিসেনা নামের দলগুলো। এসব দেশিয় দলগুলোতে ঢুকতে হলেও ফরম পূরণ করা আবশ্যক ছিল।
এরপরই আসে মেরুকরণ (Polarization) এবং প্রস্তুতি (Preparation) পর্যায়। উগ্রপন্থীরা গোষ্ঠীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যমে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিপক্ষে ঘৃণা ছড়িয়ে মেরুকরণের চেষ্টা করা হয়, বিভিন্ন আইনকানুন দিয়ে অন্তঃগোষ্ঠীর মেলামেশার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পাশাপাশি উগ্রপন্থীরা নিজেদের গোষ্ঠীর ‘মডারেট’দের আক্রমণ করে, কেননা, এরা গণহত্যা বন্ধ করে দিতে পারে, কিংবা এর গতি কমিয়ে দিতে পারে। কখনো এদের হত্যা করে অথবা গ্রেফতার করে। ‘মেরুকরণ’ মোটেই কোন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়, এটা কৃত্তিমভাবে তৈরি এবং মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আক্রান্ত গোষ্ঠীকে পুরো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। ‘মেরুকরণে’র জন্ম ‘organization’ এর ফলে এবং শীঘ্রই ‘প্রস্তুতি’র পথ সুগম করে। আমরা জানি যে, ফেব্রুয়ারির থেকে দশ মার্চ এর মধ্যে তিনবার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বদলি করা হয়। কারণ, এরা ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপারগ ছিলেন। এর মধ্যে জেনারেল ইয়াকুব বিবেকের তাড়নায় নাকি পদত্যাগ করেছিলেন; পাকিস্তানি ভাইদের উপর তিনি গুলি চালাতে পারবেন না। পাকিস্তানের অনেক বিবেকবান মানুষই তখন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাঙালিদের; প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেল খেটেছেন, নিগৃহীত হয়েছেন ইয়াহিয়ার আমলে। (শাহরিয়ার কবিরের “যুদ্ধাপরাধ – ৭১” নামক ডকুমেন্টারিটা দেখতে পারেন)
প্রস্তুতিরই (Preparation) একটা অংশ হচ্ছে সনাক্তকরণ (Identification)। লেখকের মতে, সনাক্তকরণ হত্যার গতি ও তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। ভিকটিমদের তালিকা তৈরি করা হয়, বাড়ি ঘর চিহ্নিত করা হয়, ম্যাপ তৈরি করা হয়। রুয়ান্ডায় সবার পরিচয় পত্রের ব্যবস্থা করে হয়েছিল যেন সহজেই টুটসিদের চেনা যায়। এই আইডি কার্ড ছুড়ে ফেলে দিলেও কাজ হত না, ‘হুতু’ হিসবে নিজের পরিচয় প্রমাণ করতে না পারলে ‘টুটসি’ বলেই ধরে নেয়া হত। এই পরিচয়ের ক্ষেত্রে Symbolization এর ভূমিকা ব্যাপক। পাকিস্তানিরা ছিল হিন্দু বিদ্বেষী, হিন্দুদের উপর তাই প্রকোপও পড়েছিল বেশী। তাই হিন্দু নারীরা তখন মাথার সিঁদুর মুছে ফেলত, পুরুষরা মাথায় টুপি পরত, ধুতির বদলে লুঙ্গি পরত। পাকিরা “চার কলেমা”র মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম যাচাই করতো; কেউ বলতে না পারলেই গুলি করে হত্যা করা হত। কখনো কখনো লুঙ্গি খুলে পরীক্ষা করতো হিন্দু না মুসলমান! অবশ্য শুধু হিন্দুরাই নয়, পুরো বাঙালি সমাজই তাদের গণহত্যার শিকার হয়েছিল। সনাক্তকরণের আরেক প্রমাণ হচ্ছে রাও ফরমান আলীর ডায়রি, যেখানে বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা পাওয়া গিয়েছিল। তার ডায়রিতেই লেখা ছিল, ‘Green land of East Pakistan will be painted red’।
ভিকটিমদের সম্পত্তি লুটপাট করা কিংবা বাজেয়াপ্ত করা ও প্রস্তুতির অংশ; যার বেশীরভাগই করেছিল পাকিদের এ দেশীয় দোসররা। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করা ও যাতায়াতের জন্যে Transportation ব্যবস্থা করাও গণহত্যার প্রস্তুতির ভেতরে পড়ে। আমরা সকলেই জানি এ দেশের স্কুল, কলেজ, বিমানবন্দর, বিভিন্ন বাড়িকেই পাকিস্তানিরা ক্যাম্প বানিয়েছিল। কখনো কখনো খোলা মাঠে জমা করতো সবাইকে অতঃপর নির্বিচারে হত্যা করা হত সবাইকে।
প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরেই আসে সপ্তম ধাপ, Extermination; যাকে বলা যেতে পারে সমূলে বিনাশ করা। এটাকে মার্ডার না বলে Extermination বলার কারণ এই যে, এ ক্ষেত্রে আক্রান্তদের কে মানুষ বলে বিবেচনা করা হয় না। পরিকল্পনামাফিক হত্যা করা শুরু হয় প্রতিটা লক্ষ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে, এমনকি বাচ্চাদেরকেও রেহাই দেয়া হয় না। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর কথা সকলেই জানি। পাকিস্তানি জেনারেলদের বইপত্র প্রমাণ করে যে, ‘অপারেশন সার্চলাইট’ তাদের বহু দিনের পরিকল্পনা, হুট-হাট কোন সিদ্ধান্ত নয়। সমূলে বিনাশ করার সে পরিকল্পনা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এক পাকিস্তানি জেনারেলই (নিয়াজি) এটাকে চেঙ্গিস খানের নিষ্ঠুরতার চেয়ে বেশী ভয়াবহ বলেছিলেন।
উল্লেখ্য, প্রতিটা Extermination এর শেষে হত্যাকারীরা শোধন প্রক্রিয়া বলে একে ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। বসনিয়াতে বলা হয়েছিল, “ethnic cleansing”, আলজেরিয়া তে বলা হয়েছিল “Ratonade”(Rat extermination)। যেমন পঁচিশ মার্চ রাতের পর ভুট্টো বলেছিলেন, “আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে”।
সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে অস্বীকার করা (Denial)। খেয়াল করে দেখবেন, প্রতিটা গণহত্যাই শেষ হয় প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে। এই প্রত্যাখ্যানের জন্যে অপরাধীরা কয়েকটি নির্দিষ্ট পন্থা বেছে নেয়।
১) গণকবর গুলো লুকিয়ে ফেলা হয়
২) ঐতিহাসিক দলিলগুলো পুড়িয়ে নষ্ট করে ইতিহাসের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়
৩) গণহত্যা সংক্রান্ত সকল রিপোর্টকে বিরোধীদলের প্রোপাগান্ডা হিসেবে অবিহিত করা হয়
৪) গণহত্যার তথ্যগুলো সরকারীভাবে অনুমোদিত (Officially approved) সূত্র হতে আসেনি – এই অজুহাতে গণহত্যার সকল রিপোর্টকে Unconfirmed অথবা alleged হিসেবে চিহ্নিত করা হয়
৫) হত্যাযজ্ঞ প্রচলিত গণহত্যার সংজ্ঞাকে সংজ্ঞায়িত করে কি না এই নিয়ে কু - তর্ক করা হয়
৬) ভিকটিম দলের হতাহতদের সংখ্যার চেয়ে নিজ দলের হতাহতের সংখ্যা আরও বেশী বলে দাবি করা হয়
৭) মানুষ মারা গিয়েছে “গৃহযুদ্ধ” এর কারণে, তাই এটা গণহত্যা না - বলে দাবি করা হয়
খুব মনোযোগ দিয়ে ৭ টা পয়েন্ট পড়ে দেখুন তো, এই কথাগুলো আমাদের সাথে খুবই পরিচিত কি না? প্রতিটা যুক্তি কিংবা পন্থাই কি আমাদের উপর চালানো গণহত্যাকে অস্বীকার করতে ব্যবহৃত হয় নি? যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় গণহত্যার সংক্রান্ত সব খবরকেই “ভারতীয়দের চক্রান্ত” হিসেবে উল্লেখ করা হত। ৭১ এর আগস্ট মাসে পাকিস্তানি সরকার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যেখানে আওয়ামীলীগকেই গণহত্যার জন্যে দায়ী করা হয়। এই শ্বেতপত্র নিয়ে ৬ ই আগস্ট New York Times প্রতিবেদন ছাপায় “Pakistan accuses of Bengalis massacring 100,000” শিরোনামে। খবরে বলা হয়, ‘In a white paper, the government asserted that 100,000 men, women and children had died since March 1 in a “reign of terror unleashed by the Awami league” the now banned political party that pressed for autonomy and then independence”। এই শ্বেতপত্র প্রকৃত ইতিহাস থেকে কতটা দূরে ছিল সেটা সহজেই অনুমেয়। মে মাসের ২৫ তারিখ পাকিস্তানি এক সংবাদপত্র শরণার্থীদের নিয়ে খবর প্রকাশ করে ‘Refugees are victims of Indian propaganda’ শিরোনামে।
গণহত্যায় পাকিস্তানিদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামস দের মুখপাত্র “দৈনিক সংগ্রাম” তখন নিয়মিতই মুক্তিযুদ্ধ কিংবা পাকিদের গণহত্যাকে ‘ভারতীয়দের চক্রান্ত’ বলে প্রচার করেছিল। ৬ মে পত্রিকাটি “শরণার্থী বাহানা” শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে লিখে, “হিন্দুস্থান এখন নিজ দেশের তালাবদ্ধ মিল কারখানার বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ও বেকার নাগরিকদের একত্র করে তাদের শরণার্থী বলে প্রচার করছে। এবং বিশ্ববাসীর দরবারে মানবিকতার দোহাই দিয়ে তাদের নামে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছে”। ব্রিটিশ পত্র পত্রিকা তখন গণহত্যার খবর নিয়মিত ছাপানো শুরু করলে এ নিয়ে ৫ জুলাই “দৈনিক সংগ্রাম” খবর প্রকাশ করে; শিরোনাম “হিন্দুস্থানের চক্রান্ত জালে ব্রিটিশ”।
এই পর্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ কিংবা দলিল হচ্ছে পাকিস্তানি জেনারেল-মেজরদের লেখা বইপত্র। অস্কার বিজয়ী সিনেমা Judgment at Nuremberg(1961)’তে দেখা যায়, যখন নাৎসি আসামীদের কে ‘ইহুদী গণহত্যা’ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন তাদের উত্তর ছিল অনেকটা ‘এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না’ ধরণের। পাকিস্তানি জেনারেলদের অবস্থাও অনেকটা সেরকমই। তারা তাদের বইতে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-যুদ্ধ এসব কিছু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেও ‘গণহত্যা’ বিষয়ে তারা নিশ্চুপ। সবার উত্তর হচ্ছে, ১৯৭১ এ দেশে কি হচ্ছিল তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না এবং সবই তাদের অগোচরে হয়েছিল। নাৎসি বাহিনীর সাথে এদের অমিল এক জায়গায় ওদের বিচার হয়েছিল, আর পাকি জেনারেলদের বিচার হয় নি।
যুদ্ধের এতটা বছর পর, এই ২০১৫ সালেও এসে পাকিস্তানিরা অস্বীকার করছে গণহত্যার কথা, বলছে ভিত্তিহীন এসব অভিযোগ। ৩০ নভেম্বর পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গণহত্যার কথা অস্বীকার করে বলা হয়, ‘baseless and unfounded assertions’ of Bangladesh against Pakistan.
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মাধ্যমে পাকিস্তানীদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নাকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই অভিযোগ করে বাংলাদেশের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে সে বিজ্ঞপ্তিতে আবার বলা হয়, “It is regrettable that attempts have been made by the Government of Bangladesh to malign Pakistan, despite our ardent desire to develop brotherly relations with Bangladesh. Pakistan believes that the peoples of both countries not only want to maintain but also further strengthen the bonds of friendship and brotherhood. However, sadly, the Government of Bangladesh does not seem to respect these sentiments.”
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই অস্বীকারটা শুধু পাকিস্তানিরাই করেনি বরং এই পাকিস্তানি জেনারেলদের মন মানসিকতার সাথে আমাদের একটা গোষ্ঠীর মানসিকতার প্রচণ্ড মিল বিদ্যমান। জেনারেলরা ‘গণহত্যা’কে কোনভাবেই মানতে চান না; সংখ্যাটা খুব বেশী হলে হাজার বিশেক হতে পারে! একজন জেনারেল জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল ঘুরে এসে লিখেছেন, ‘হল দুটি পরিত্যক্ত, কিন্তু ধ্বংসলীলা তেমন হয় নি’। অথচ আমরা সবাই জানি এখানকার নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা। আমাদের সে গোষ্ঠীর অবস্থাও ঠিক একইরকম; আগে বলতো ত্রিশ লাখ না আরও কম হবে; এর পরে বলল, আসলে ৩ লক্ষ, ভুল করে ৩০ হয়ে গেছে! সংখ্যাটা শুধু নামছে, কয়দিন পর হয়তোবা বলবে, ‘১৯৭১ এ আসলে কিছুই হয় নাই, সবই ষড়যন্ত্র!’
পাকিস্তানি থেকে শুরু করে যারাই এটাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না তারা মোটামুটি সকলেই ৭ নম্বর যুক্তিটা দেখান সবসময়: ‘ইহা একটি গৃহযুদ্ধ; তাই গণহত্যা হইতেই পারে না’। অথবা এটাও বলেন যে, ‘যুদ্ধের সময় হতাহতের ঘটনা ঘটবেই তো!’ তাদের জন্যে ড. গ্রেগরির দুটো লাইন হুবহু তুলে দিচ্ছি। তিনি বলেন, ‘In fact civil war and genocide are not mutually exclusive. Most genocide occur during wars’।
এটা স্বীকার করতেই হবে, যে কোন ধরনের অপরাধের পর এর “বিচারহীনতা” কিংবা “দায় থেকে অব্যাহতি” সে ধরনের অপরাধ ভবিষ্যতে সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলে। এ কথাটা গণহত্যার সাথেও সম্পর্কিত। হিটলার তখন পোল্যান্ড আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল; সে সময় হিটলারের সামনে ‘আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গের’ প্রসঙ্গ তুললে সে জবাব দেয়, “Who ever heard of the extermination of the Armenians!” এটা বুঝতে হবে, যে কোন গণহত্যার একটি ভয়াবহ নেতিবাচক দিক হচ্ছে সেটাকে ভুলে যাওয়া কিংবা দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে না পারা – যা ইন্ধন যোগায় ভবিষ্যতের আরেক গণহত্যাকে। তাই গণহত্যাকে অস্বীকার করার এই প্রবণতা দূর করার জন্যে ড. গ্রেগরি জোর দিয়েছেন পাবলিক ট্রায়াল ও ট্রুথ কমিশনের উপর; “... public trials and truth commission, followed by the years of education about the fact of genocide”।
যখন আদালত আক্রান্তদেরকে সুবিচার দিতে পারে না তখন তাদের মধ্যে জন্ম নেয় প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতা বা আকাঙ্ক্ষা যা কিনা সমাজে অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আরও বহু গুনে, এমনকি কখনো কখনো সুগম করে গণহত্যার পথ। ড. গ্রেগরি বলেন, ‘In societies with histories of ethnic violence, the cycle of killing will eventually spiral downward into the vortex of genocide’। এই প্রবন্ধের শেষ লাইনটাও তাই ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ নিয়ে, ‘The strongest antidote to genocide is justice’
গণহত্যা পরবর্তী সময়ে গণহত্যার শিকার হওয়া যে কোন গোষ্ঠীর ওপর সেই রক্তাক্ত ঘটনার কারণেই অনেক ধরণের সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক প্রভাব পড়ে। রুয়ান্ডাতেও গণহত্যার পরবর্তী সময়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা বেঁচে যাওয়াদের অনেক সমস্যার কথা জানা যায়। একাত্তরের পরবর্তীতে এই গণহত্যার কি ধরণের প্রভাব আমাদের সমাজ ও ব্যক্তি মানসে পড়েছিল সেটাও গবেষণার দাবি রাখে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে হলিউডে এখনো সিনেমা বানানো হয়, সেসব সিনেমা দর্শক নন্দিতও হয়। বিভিন্ন উপায়ে হিটলারের কুকর্মগুলো উপস্থাপন করা হয় এই প্রজন্মের কাছে যেন তারা জানতে পারে আসলে তখন কি হয়েছিল। নাৎসি বাহিনী ও মতবাদের প্রতি ঘৃণা নিয়েই তাই বড় হচ্ছে ইউরোপের এই প্রজন্ম। এইতো কয় দিন আগে রাশিয়ান একটা ফুটবল টিমকে শাস্তি দেয়া হয় দলের সমর্থকেরা নাৎসি বাহিনীর চিহ্ন দেখিয়েছিল বলে। রাশিয়ান ফুটবলের অফিসিয়ালরা বলেন, “In Nazi Germany, they were used as emblems of the Hitlar Youth. We can’t ignore the appearance of these symbols – especially in our country”। (Russian soccer team punished after fans bring Nazi signage to a match, 2015) অথচ, মুদ্রার ঠিক উল্টো পাশে আমরা। পাকিস্তানকে শুধু সমর্থনই করেই ক্ষান্ত হই না, খেলার মাঠে নিয়ে যাই তাদের জাতীয় পতাকাও। মাত্র ৪৫ বছরের মাথায় আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি সকল পাকি গনহত্যাকারীদের, আমার দেশের পতাকা টানিয়ে দিয়েছি এক রাজাকারের গাড়িতে, গনহত্যাকারীদের বুক ফুলিয়ে বলতে দিয়েছি “এই দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই”, শহীদের সংখ্যা নিয়ে কু তর্কে মেতেছি। যুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পার না হতেই আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রে কিভাবে ‘পাকিস্তানি ভূত’ চেপে বসল সেটা খতিয়ে দেখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্যে।
“আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ন-নৃত্য দেখি
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে...”
(রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ)
[1] Intention refers to a purposeful action and a conscious decision to perform an act that is forbidden by law. Motive alludes to the ulterior cause that induces a person to do or abstain from doing a particular act. Intention is the objective; motive is driving force. Intention is substantial to determine criminal liability; Motive is insubstantial to determine criminal liability.
No comments:
Post a Comment