গত শতকের শুরুতে যখন ব্রিটেনের নারীরা ভোটাধিকারের জন্যে লড়ছিলেন, মানে বিষয়টাকে অন্যভাবে বললে, যে সময়ে ব্রিটেনের নারীরা উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় পুরুষের সাথে তাদেরকেও সমানভাবে যুক্ত করতে যাচ্ছিলেন/চাচ্ছিলেন, ঠিক সে সময়ে ভারতের নারীরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্যেই লড়ছিলেন।
সেই সাথে ব্রিটেনে নারীদের যে ভোটাধিকার দেয়া হলো সেটাও ... was limited to the British mainland and whites in settler colonies... while European women could vote in Kenya as early as 1919, African men and women would have to wait until 1956 for this same right...
মানে আমি বলতে চাচ্ছি যে, ইউরোপে নারীবাদের যে ঢেউগুলো এসেছিল সেগুলোর দৃষ্টিতে আমাদের নারীদের বিবেচনা করাটা মনে হয় খানিক বিপদের। বিষয়টাকে অন্তত আমার তাই মনে হয়, সঠিক নাও হতে পারি।
আবার, আমাদের এইখানে নারী মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম সমান্তরালে চললেও নারীদের অংশগ্রহণ এক রকম ছিল না। গান্ধী নারীদের শরিক হওয়ার আহ্বান জানালেও সেটাও আসলে সেই প্রথাগত 'নারী' রূপেই। নারীর সনাতনী জেন্ডার-রুলে তার বিশেষ আস্থা ছিল। সেই নারী যিনি তার স্বামী, পরিবার এবং দেশের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবে, মানে সেই 'সতী'র ছবির চেহারায়। তবে, নারীকে সক্রিয়ভাবে টেনে আবার কৃতিত্ব গান্ধীকে দিতেই হবে!
অন্যদিকে, এই নারীদের একটা অংশ ছিল যারা সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপ দিয়েছিলেন। এর একজন উজ্জ্বল প্রতিনিধি হচ্ছেন যেমন প্রীতিলতা;তাদের সংগ্রাম আবার সহজ ছিল না। গান্ধীর সহযোগী নারীদের 'প্রথাগত' চেহারা অনেকে মেনে নিলেও অস্ত্র হাতে নারীদের কেউ মানতে পারছিলেন না, তাদেরকে স্ট্রিট গার্ল বা মিস্ট্রেসেস নামে ডাকা হয়েছে। ইংরেজ সমর্থক পত্রিকাগুলো তাদেরকে নিন্দার সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছিল।
এটাও মনে রাখা উচিৎ, অনেকেই বলেন যে, খুব উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যে নারীর সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থানের ফলে তা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফলে, নারীকে বানানো হয় 'ঘরের লক্ষ্মী'। তো, এই ঘরের লক্ষ্মীরা যখন রাস্তায় নামলেন, দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া হলো। যারা অসহযোগ আন্দোলন করেছিল তাদেরকে একটা স্থান দিলেও, সশস্ত্র বিপ্লবী নারীদের কপালে সেটাও জুটে নি।
প্রীতিলতা তখন একটা লেখায় লিখেছিলেন, ' দেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভাগিনীরা কেন উহা পারিব না?' তো, প্রীতিলতাদের এই সংগ্রাম কিন্তু থেমে থাকে নি। তেভাগায় গ্রামীণ নারীদের যে অভূতপূর্ব প্রতিরোধ দেখা যায় সেটা তো বহুত বইপত্রে লিপিবদ্ধ করা আছে।
নারীদের এই অবদানগুলো আমরা কিন্তু খুব একটা সামনে আনি না; আনি যখন তাঁকে/তাদেরকে আমাদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত করা যায়। না আনার কারণ হয়তোবা যুদ্ধের প্রকৃতি। সেলিনা হোসেনের 'দুই যুদ্ধ' নামে বোধহয় একটা ছোটগল্প আছে। নারী যখন যুদ্ধে নামে তখন আসলে সে দুটো শত্রুর বিরুদ্ধে নামে। একটা শত্রু হচ্ছে এক্সিস্টিং শত্রু (সে বিভিন্ন নামে/বিভিন্ন চেহারায় হতে পারে), আরেকটা চিরকালীন শত্রু, মানে পুরুষতান্ত্রিকতা। আমরা যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক পরিমণ্ডলেই বড়ো হয়েছি, তাই অবচেতনভাবে/চেতনভাবেই নারীর যুদ্ধটাকে লুকিয়ে রাখতে চাই। আর যখন সামনেও আনি তখন একান্তই পুরুষের সাপেক্ষে।
আমাদের নারীবাদীতাকে আমাদের স্থানের নারীদের আন্দোলন/অবদানের এবং বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বুঝতে হবে। না হলে আমাদের প্রগতিশীলতা খুব সূক্ষ্মভাবে মিশে যাবে রক্ষণশীলতার সাথে। যুক্তির প্যাটার্ন হয়ে উঠবে প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো। যেমন, কাপড়-চোপড় দিয়ে আমাদের প্রগতিশীলরা 'প্রগতি' নির্ধারণ করেন, বা করার চেষ্টা করেন। কিছুদিন পূর্বে ফেসবুকে একটা ছবি প্রচুর শেয়ার হচ্ছিল: ঢাবির কয়েকজন 'আধুনিক' ছাত্রীর ছবি। সবাই এটাকে মিলিয়ে দেখছিলেন বর্তমান হিজাবের আধিক্যের সাথে এবং 'প্রগতি' ও 'প্রতিক্রিয়া'র সংজ্ঞায়ন করা হচ্ছিল।
এই বিষয়টাকে এতটা সরলীকরণ করে ফেলাটা আমার কাছে একটু আপত্তিকর লাগছিল। প্রথমত, যুক্তির ধরণ ছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের মতোই, কাপড়-চোপড় দিয়ে ভালো-মন্দ মাপা। দ্বিতীয়ত, তৎকালীন সময়ে মেয়েদের মধ্যে যারা ঢাবিতে পড়তে আসছিল তাদের অধিকাংশই এলিট সমাজের বাসিন্দা। বিপরীতে বর্তমানে যারা আসছেন তাদের একটা বড় অংশ মফঃস্বলের বা গ্রামের। এই বাস্তবতা আমাকে মানতে হবে। সেই সাথে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার ঘরে আমার ছোট বোনকে জাস্ট এডমিশন টেস্ট দেওয়ানোর জন্যে ঢাকায় নিয়ে আসতে গিয়ে আমারে রীতিমতো ঝগড়াঝাঁটি করতে হয়েছে বাসার মধ্যে। আমার এক কাজিন তো কান্নাকাটি করেও ঢাকায় আসতে পারে ন পড়ার জন্যে। বাসা থেকে অনুমতি মিলে নি। মফঃস্বল বা গ্রাম থেকে যে মেয়েরা পড়তে আসছে তাদের অনেককে এই বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে এই আসাটাই রীতিমতো একটা সংগ্রাম। তার পক্ষে 'আধুনিক' পোশাক পরা পসিবল না। সেই সাথে মেকআপ ও সাজগোজের দুনিয়ায় হিজাব/বোরখাকে এরা একটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, কেননা, প্রতিদিন আধুনিক পোশাক পরা/সাজুগুজূ করা তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে! কিন্তু, আপনার কাছে তার এই কোনো সংগ্রামই -এতগুলো প্রতিকূলতাকে পাড়ি দিয়ে ওঠে আসা - চোখে পড়লো না, পড়লো শুধু কাপড়!
মানে, আমি বলতে চাচ্ছি, মৌলবাদী মেয়েরা বোরখা/হিজাব পরে বলে এই সিদ্ধান্তে আসা ভুল যে, যারাই বোরখা/হিজাব পরে সবাই মৌলবাদী! যাবতীয় বহুরৈখিকতা বাদ দিয়ে এমন সরল ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা আসলে এই নারীদেরকেই দূরে ঠেলে দিচ্ছে, সেই সাথে এদেরকে আরো মার্জিনালাইজ করে ফেলবে, মৌলবাদীতার দিকে ঠেলে দিবে।
বরং, যদি হিজাব/বোরখার আধিক্য দেখাই যায়, তবে এটা বের করা জরুরী যে, কেন এটা হচ্ছে? কোন অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নারীদেরকে ঠেলে দিচ্ছে সেটা বের করা বরং বেশি জরুরী। কিন্তু আলোচনা যদি 'প্রগতিশীল' আর 'প্রতিক্রিয়াশীল' বর্গে চালাইতে থাকি তাহলে সমূহ বিপদ আছে সামনে ...
নারী দিবস শেষ। তবু লেখাটা লিখলাম। চিন্তাভাবনা ভুল হতে পারে, 'বিপদজনক' হতে পারে! সহমত-দ্বিমত-ত্রিমত থাকতে পারে। আলাপ-আলোচনা আমাকে হয়তোবা অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসবে।
No comments:
Post a Comment