Saturday, January 12, 2019

সাক্ষাৎকার ১৯৭১: রক্তটাতো এই মাটির সাথেই মিশে আছে


নাম: অসীত বরণ দে
পিতার নাম: ক্ষিতিশ চন্দ্র দে
পিতার পেশা: মেডিকেল অফিসার, চা বাগান
ঠিকানা: করের পাড়া, পাঠানঠুলা, সিলেট।
১৯৭১ সালে বয়স: আনুমানিক ২১
১৯৭১ সালে পেশা: ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র
বর্তমানে পেশা: ট্রাভেল এজেন্সি

শুরুর কথা
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে চা’র সন্ধান পাওয়া যায় আসাম অঞ্চলে; পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক শাসক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কাছে এ বাগানগুলোর আকর্ষণ এবং দুর্ভিক্ষ ও দরিদ্র-পীড়িত অঞ্চল থেকে সস্তা শ্রমিক আনার কারণে আসাম, সিলেট প্রভৃতি অঞ্চলে চা শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটে। ‘গাছ হিলায়েগা তো পায়সা মিলেগা’ বলে বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্রিশগড় অঞ্চল থেকে ভূমিহীন দরিদ্র মানুষগুলোকে চা বাগানে নিয়ে আসে ব্রিটিশরা।


পরবর্তীতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় এই নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত শ্রমিকরা যেমন ‘মুল্লুকে চল’ আন্দোলনে ঝাপ দিয়েছিল তেমনি বিভিন্ন কারণে ১৯৬৯ সালের পর থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে তুমুল জোয়ার শুরু হয় সেখানেও যোগ দেন চা শ্রমিকরা। চা বাগানে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার জন্য সবসময়ই  বিভিন্ন কমিউনিস্ট দল কাজ করে থাকলেও এবং চা শ্রমিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠন গড়ে না উঠলেও সত্তরের নির্বাচনে ‘বঙ্গবন্ধু’কে তারা দেখেছিলেন মুক্তির প্রতীক হিসেবে। অবশ্য, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রতাও ছিল। ১৯৫৬ সালে খাদিমনগর চা বাগানে বঙ্গবন্ধু শ্রমিকদেরকে একবার বলেছিলেন, ‘তোমাদের সকল দুঃখের খবর। এসব দুঃখ দূর করার জন্যই চেষ্টা করবো এখন।’

মুক্তিযুদ্ধের সময়ও চা বাগানের এই শ্রমিক ও স্টাফদের ছিল অসামান্য অবদান। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের আক্রমণের একেবারে শুরুর দিকে চা শ্রমিকরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়েও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন অনেক জায়গায়। পরে অনেক চা শ্রমিক যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। চা বাগানের ব্যবস্থাপকদের মধ্যে অবাঙালিদের সংখ্যা বেশি হলেও কর্মচারীদের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালি। অবাঙালি ব্যবস্থাপকের অনেকেই মার্চের শুরুতে নিরাপদ আস্তানায় চলে যান এবং বাঙালি ব্যবস্থাপক ও কর্মচারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে তাদের হাত বাড়িয়ে দেন। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিকদের পাঠিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বাগানের মধ্যদিয়ে নির্বিঘ্ন চলাচলে সাহায্যও করেছিলেন। এ কারণেই গবেষক দীপঙ্কর মোহান্ত বলেন, যুদ্ধের সময় বাঙালি মালিকানাধীন বাগানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক প্রকার আত্মীয়-বাড়ির মতো ছিল।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে চা শ্রমিক ও বাগানের কর্মচারীদের এমন সম্পৃক্ততা মোটেও ভালো চোখে নেয়নি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। চা বাগানগুলো ছিল সীমান্তবর্তী এলাকাজুড়ে, এ কারণে পাকিস্তানিদের বিশেষ নজর ছিল এসব এলাকায়। তাই কখনো মুক্তিযোদ্ধা খোঁজার নাম করে, কখনো রেশন কার্ড দেবে বলে, কখনো কিছু না বলেই একাত্তরের সেই ৯ মাসের যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাগানে পাকিস্তানি আর্মি চালায় ভয়ঙ্কর গণহত্যা।


তারাপুর চা বাগানের শ্রমিকদের এখানেই হত্যা করা হয়                        

মূলের গল্প

১৮ এপ্রিল, ১৯৭১। সিলেট নগরীর তারাপুর চা বাগানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালায় এবং ৪০ জন নিহত হন। এই ৪০ জনের মধ্যে একজন ছিলেন ডা ক্ষিতিশ চন্দ্র দে; তাঁর দেহাবশেষ পরে খুঁজে পাওয়া যায় নি। তিনি তখন ছিলেন তারাপুর চা বাগানের মেডিকেল  অফিসার; ১৯৪৭ এর পূর্বেই যোগদান করেছিলেন এখানে। আমরা এক দুপুরে মুখোমুখি হয়েছিলাম ডাক্তার ক্ষিতিশ চন্দ্র দে’র ছেলে অসীত বরণ দে’র। সিলেটের আম্বরখানায় তাঁর কর্মস্থলে বসেই কথা হয়েছিল তাঁর সাথে। আমরা যখন তাঁর অফিসে পৌছাই, তখন তিনি খানিক ব্যস্ত, হাতের কাজটা সেরেই কথা বলা শুরু করেন আমাদের সাথে। একাত্তরের উত্তাল সময়ে তিনি  ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র, বাবার সাথে বাগানে থাকতেন। তাঁর মুখেই শুনেছি তারাপুর চা বাগানের গণহত্যার বিবরণ, পিতাকে হারিয়ে ফেলার মর্মবেদনা, পিতার স্মৃতি বুকে নিয়ে দিনযাপনের বিবরণ। তার সাথে মোটামুটি ঘণ্টা দেড়েক কথা হয়, বাবাকে মনে করে কখনো তিনি কেঁদেছেন, কখনো নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিলেন কিছু সময় জুড়ে। ৪৫ বছর পরে এসেও বাবার কথা মনে করে চোখ টলমল করছিল পানিতে। বাবার স্মৃতিতে গত ৪৫ বছর যাবত প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার পুরো পরিবারকে নিয়ে নিরামিষ খাওয়া দাওয়া করেন। দেশকে নিয়ে কখনো হতাশ হয় পড়েন, রাজাকারদের উন্নতি ও ক্ষমতা দেখে ভেতরে ক্ষোভ জমা হয়; আবার সেই ক্ষোভকে পাশে সরিয়ে স্বপ্ন দেখেন দেশকে নিয়ে, পরিষ্কারভাবে বলেন, ‘দেশ ভালো চলুক, এটাই চাই’ ।

প্রশ্ন: আপনার বয়স তখন কত ছিল?
উত্তর: আমার জন্ম ১৯৫১ সালে; তখন ছিলাম ডিগ্রি প্রথম বর্ষে।
প্রশ্ন: আনুমানিক বিশ একুশের মতো?
উত্তর: হ্যাঁ! এরকমই।
প্রশ্ন: একাত্তরে আপনি ও আপনার পরিবার যে ঘটনার শিকার হয়েছেন সেটা আমরা শুনতে চাই যদিও এই ঘটনা কিছু কিছু বইতে [৩] লিপিবদ্ধও হয়েছে
উত্তর: তারাপুর চা বাগান আর মালনীছড়া চা বাগান একেবারে পাশাপাশি অবস্থিত। মালনীছড়া বাগানে তখন পাকিস্তানিরা ক্যাম্প স্থাপন করে। শালুটিকরে তাদের প্রধান ক্যাম্প ছিল। প্রতিদিনই তারা হেঁটে হেঁটে মালনীছড়া বাগান আর তারাপুর বাগান দিয়ে সালুটিকর ক্যাম্প থেকে আখালিয়ার ইপিয়ার ক্যাম্পে যেত। একদিন তারা জিজ্ঞেস করেছিল যে, বাগানে কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না? বাগান মালিক তখন জানিয়েছিলেন যে, মালনীছড়া বাগানের কাঁটাতারের ঐদিকেই গেলেই মিলিশিয়ারা যখন তখন গুলি করে, শ্রমিকদের কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে এতে।

হঠাৎ একদিন দুপুরের দিকে পাকিস্তানিরা বাগানের মালিকের বাংলোতে আসে। মালিক রাজেন্দ্রলাল গুপ্ত, তার ছেলে ডা পঙ্কজ গুপ্ত। তার তিন ছেলে, বাকিদেরকে মেরা ফেলা হয়েছিল। শুধু পঙ্কজই বেঁচে আছেন। পঙ্কজের চাচা এবং চাচাতো এক ভাইও মারা যান ঐদিন। তো, দুপুরের সময় - বাবা তখন ঘরে শুয়েছিলেন; একজন লেবার এসে বলল, মালিক বাবু তাঁকে ডাকছে। আমি তখন বাথরুমে ছিলাম। বাথরুমে না থাকলে আমার বোধহয় যাওয়া লাগত। পাকিস্তানিরা এসে তখন বলেছিল, সবাইকে ডান্ডি কার্ড বা আইডি কার্ড দেয়া হবে। এটা দেখালে মিলিশিয়ারা আর কাউকে গুলি করবে না।
তারা সবাই ভাবছিলে যে আসলেই ডান্ডি কার্ড দিবে, তাই সকলে ইন্টারেস্টেড হয়েই গিয়েছিল।

আর্মিরা নাকি শ্রমিক ও কর্মচারীদেরকে দুটি দলে বিভক্ত করে, বাবাসহ সাত জনের একটা দল আর শ্রমিকদের আরেকটা দল তৈরি করে। আমরাতো তখন বাসায় অপেক্ষায় ছিলাম কখন আসবেন। শ্রমিকদের কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পরই গুলি করে সবাইকে লাইনে দাড় করিয়ে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে দুজন আহত অবস্থায় ফিরে এসেছিল। [৪] তারাই এসে তখন বলেছিলে যে শ্রমিকদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তারা বাবাদের খবর জানত না। বাবা, মালিক আর মালিকের ছেলেদেরকে যে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটা তাদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম। আমরা তখনো জানতাম না বাবাদের কি অবস্থা! ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় মালিক তখন যে কোন একজন পুরুষ মানুষকে রেখে যেতে বলেছিলেন, তাই তারা একজন বাবুকে রেখে যায়।[৫] তিনি এখনো জীবিত আছেন, করেরপাড়ায় থাকেন বর্তমানে। মালিকের ছেলে পঙ্কজের বয়স কম হওয়ায় তাকেও রেখে যায় পাকিস্তানিরা।
প্রশ্ন: কবে জানতে পেরেছিলেন যে, বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে?
উত্তর: সেটা বিজয়ের পরে। আমরা তখন ভেবেছিলাম যে বাবাকে দিয়ে ওরা কাজ করাচ্ছে ক্যাম্পে। তখন সিলেটের নামী দামী মানুষকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে তাদের কাজ করাত। আমিনুর রশিদ চৌধুরীদেরকেও তখন নিয়ে গিয়েছিল।

আমরা তো দেখি নাই কই মারছে, আমরা যে নয় মাস ইন্ডিয়াতে ছিলাম তখন ত জানতাম তারা বেঁচে আছে। দেশে আসার পর অনেক জায়গায় খুঁজছি, অনেক জেলে খুঁজছি, অনেক পাগলা গারদ খুঁজছি, কেউ বলেছে বেঁচে আছেন, কেউ বলেছে পাগল হয়ে গিয়েছেন। অনেক পরে একজন লাক্কাতুরা চা বাগানের একজন লেবার জানিয়েছিল যে সে দেখেছে তাদেরকে একটা মাঠের মাঝখানে এনে মারা হয়েছিল।
প্রশ্ন: ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা কি করেছিলেন? বাগানেই ছিলেন?
উত্তর: এপ্রিলের ১৭-১৮ তারিখের দিকে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আরও কিছুদিন আমরা বাগানেই ছিলাম। পাকিস্তানিরা তখন টর্চার করতো। তারা তখন মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসত, লুটপাট করে নিয়ে যেত, সোনা-গয়না, টাকা পয়সা যা পেত সবই নিয়ে যেত। আর্মিরাও আসত তবে বেশিরভাগ সময়ই মিলিশিয়ারা আসত।

এরপর দেখলাম পরিস্থিতি শুধু খারাপই হচ্ছে। আমাদের ঘরে তখন কিছু বাকি নাই আর তারা বিশ্বাস করে না যে আমাদের দেয়ার মত কিছুই অবশিষ্ট নাই। আমার মা একদিন বলেছিল, পেটতো ভুখা, ঘরে কোন খাবার নাই। একজন মিলিশিয়া তখন বন্দুকে গুলি ভরে বলেছিল, এইখানে তোমার খাবার আছে!

ঘরে তখন আমার দুই বোন, মালিকের মেয়েরাও টিনেজার! তারপর আর কোন উপায় না দেখে মালিকের পরিবার সহ রওয়ানা দেই ভারতের উদ্দেশ্যে। সিলেটের কিছু জায়গায় কয়দিন লুকিয়েও ছিলাম। দোকানপাটগুলোও তখন দেখলাম ধীরে ধীরে খোলা শুরু করেছে। রাস্তায় তখন টুপি পরে আমাদের হাটাহাটি করতে হত। আমরা ভারতে প্রবেশ করি খুব সম্ভব ১১ মে।

পঙ্কজ শুধু রয়ে গিয়েছিল বাগানে। আমরা চলে যাওয়ার অর মিলিশিয়ারা আবার বাগানে আসে, মালিকদের পরিবারের কাউকে না পেয়ে পঙ্কজ, বাংলোর দারোয়ান এবং আরও কয়েকজনকে বেঁধে নিয়ে যায়। একটা ছনের ঘরে আগুন লাগিয়ে তারপর তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে সে আগুনে ফেলে দেয়। পঙ্কজ নাকি তখন বলেছিল আমাকে মারবেন না, আমি মুসলমান হয়ে যাব। পাকিস্তানিদের মধ্যে তখন একজন তার মাথায় টুপি পরিয়ে দিয়ে বলে যে, ঠিক আছে তারে মারবে না। তারপর পঙ্কজের নাম দেয়া হয় আমানত; স্থানীয় একজনের কাছে পরে তাঁকে স্থানান্তর করা হয়।
প্রশ্ন: আপনারা যেহেতু ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, সেখানকার শরণার্থী শিবিরের অবস্থা কেমন ছিল?
উত্তর:  বাবা, আমরা তো শিবিরগুলোতে উঠি নাই। এমনিতেই শিবিরের অবস্থা তখন খারাপ, তার উপর আমরা তখন morally weak, physically weak, financially weak! এই অবস্থায় যদি শরণার্থী শিবিরে গিয়ে উঠি তখন নির্ঘাত মারা যাব। বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাসায় দিন কাটাই।
প্রশ্ন: কবে দেশে ফিরেছিলেন?
উত্তর: দেশ স্বাধীনের পরপরই ফিরে এসেছিলাম। আমরা যে  নয় মাস ইন্ডিয়ায় ছিলাম তখন তারা [বাবা সহ অন্যান্যরা] আছেন [বেঁচে] জেনেই সেখানে ছিলাম। তখন মনের অবস্থাই অন্যরকম ছিল। নাহলে হয়তোবা ইন্ডিয়া থেকে আরও দশদিন পরে আসতাম। আমি ইন্ডিয়ান হাইকমিশন ধর্মনগর চাকরি করেছি। দেড়শ টাকা মাইনে বেতন পাইতাম, কাগজটা বোধহয় এখনো আমার কাছে আছে! আমাদের বলা হয়েছিল যে, যে সকল জায়গা শত্রুমুক্ত হবে সে সকল জায়গায় গিয়ে সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন চালাবেন। আরও কয়েকজন অফিসার স্টাফ ছিলেন আমার সাথে, তারা কেউ আর এখন নাই। প্রথম ঢুকছি আরও জুড়ি হয়ে কুলাউড়ায়। দু একদিন ঐখানে ছিলাম, পরে আসি মৌলভীবাজার। যখন মৌলভীবাজারে প্রবেশ করে তখন একটা মাঠে দেখলাম কাফনের কাপড়ে সাদা হয়ে গেছে, মাইন ব্লাস্ট করে সবাই মারা গেছিল।
প্রশ্ন: এটা কবেকার ঘটনা?
উত্তর: তারিখটা ভুলে গেছি, তবে দেশ স্বাধীনের পরে!
প্রশ্ন: আপনার পরিবার কি তখন সাথে ছিল?
উত্তর: না, না। মৌলভীবাজারে আসা হয়েছে চাকরির সুবাদেই। তখন আমার একটা ফ্রেন্ড ছিল ডা ইকবাল নামে, সে তখন সিলেট থাকত। হঠাৎ দেখি সে একটা মোটরসাইকেল করে আসতেছে। আমারে বলছে, ‘অসীত, তুই যাবি?’ আমি তখন ফাইল পত্র গাড়িতে রেখে কাউকে কিছু না বলেই চলে আসি; তখন একটাই কারণ আমার বাবকে দেখার জন্য।
প্রশ্ন: বাগানে ঐদিন আনুমানিক কতজন শহিদ হয়েছিলেন?
উত্তর: সর্বমোট ৩৯ জনের মত হবে, বাগানের শহিদ মিনারে নাম লেখা আছে মোটামুটি সবার, দু একজন বাদ পড়তে পারে।
প্রশ্ন: দেশ স্বাধীনের পর শহিদ পরিবার হিসেবে কি কোন সাহায্য এসেছিল তখন?
উত্তর: একটা চিঠি সহ বঙ্গবন্ধু দশ হাজার টাকার চেক পাঠিয়েছিলেন, এটা পেয়েছিলাম। [৬] আমার জানামতে বাগানের শহিদ পরিবার সবাই এই টাকা পেয়েছিল। সেটা বাহাত্তরেই এসেছিল।
প্রশ্ন: আপনি বাড়িঘর লুটপাটের কথা বলছিলেন, স্থানীয় রাজাকাররাও কি এতে অংশগ্রহণ করেছিল?
উত্তর: নাহ! এগুলো মিলিশিয়ারাই করত। তবে শুনেছিল আমরা যাওয়ার পর স্থানীয়রাই বাড়িঘর লুটপাট করেছে। ঐদিন বিকালে আর্মিরা যে এসেছিল এটার পেছনে স্থানীয় রাজাকারদের হাত থাকতে পারে।
প্রশ্ন: আপনি কি তখন স্থানীয় রাজাকারদের চিনতেন? কিংবা এখনো চিনেন?
উত্তর: না, ঐসময় মন মানসিকতাও এরকম ছিল না। বাগান থেকেও আমরা তখন খুব একটা বের হতাম না। আর রাজাকারদের পরিচয় দিয়েই কি লাভ, অনেকেই তো এখন আর দুনিয়াতেই নাই। তার সবাই এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তাদের ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত, তারা সকলে এখন প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এসব নিয়ে বলে আর কি হবে? এসব কাহিনী তো এখন বলার কথা ছিল না। তোমাদের আগের লোকদের এসব শোনা উচিৎ ছিল। আর এখন বহুত রাজাকারের সন্তানেরা তো আ’লীগ করে।
প্রশ্ন: তখন কি সিলেটের দিকে কোন রাজাকারের বিচার হয়েছিল বলে আপনার জানা আছে?
উত্তর: ঠিক জানি না, আর তখন তো বাবা এসব জানার মতো মানসিক অবস্থাও ছিল না।   
প্রশ্ন: আপনি জানেন বর্তমানে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে, এই বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
উত্তর: যুদ্ধ শেষ হওয়ার তো অনেক বছরই হয়ে গেল, বেশিরভাগ রাজাকারই মারা গেছেন, তারপরও যারা প্রমিনেন্ট ছিলেন তাদের বিচার হচ্ছে, সেটা ভালো। তবে যদি তারাও আজকে বেঁচে না থাকত, তাহলে কার বিচার হত?
প্রশ্ন: বর্তমান বাংলাদেশকে নিয়ে আপনি কেমন স্বপ্ন দেখেন? আপনার অভিমত কি?
উত্তর: আমরা তো চাই দেশ ভালো থাকুক। আমাদের তো আর যাওয়ার কোন জায়গা নাই। দেশ যদি আমার না হইত তাইলে ঐতো যখন গেছিলাম তখনই রয়ে যেতে পারতাম। যারা থেকে গিয়েছিল তারাতো ঐখানে সিটিজেনও হয়ে গেছে। কিন্তু দেশটা তো আমাদেরই, যাব আর কই? এইটা আমাদের জন্ম-মাটি। এখন ছেলেপেলে মানুষ হইছে, কিন্তু শহিদ পরিবার হিসেবে যেভাবে তখন দিন কাটাতে হয়েছে সেটা অনেকটা ভিক্ষা করার মতো। দেশের এখন ভালো অবস্থা হয়ে আমার আর কি হবে? আমি তো এখন ইস্টাবলিস্ট। তখন তো আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে নাই, Nobody asked me how are you going on! তখন তো কাউকে পাই নাই। দস্তুর মতো ভিক্ষা করে খাইছি, আমার মা বোনকে আমি পালছি। এই দেশ আমারে কি দিব আর কি পাব আমি? আর কোনদিনই পাব আমি কিংবা কি দরকারই বা আছে পাওয়ার? দেশের কাছ থেকে কিছুই চাই না। সব যেন শান্তিতে থাকে এইটাই ভালো, আমি আর কয়দিন আছি!
বহুত তো আছে যারা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও তাদের সার্টিফিকেট আছে! আমাদের তো কোন স্বীকৃতিই নাই। দেশ ভালো চলুক, ভালো হউক, কিন্তু যে সময় আমার দরকার ছিল, যে সময় আমার কিছু ছিল না, ধন নাই, জন নাই, বাড়ি নাই, ঘর নাই, তখন তো কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে নাই। নেতা তো তখনো জীবিত ছিলেন। এখন আমাকে কি জিগাবে? জিগানোর দরকার নাই। এসব নিয়ে কথা বলার এখন আর স্পৃহা পাই না বাবা!

আমরা দেখছি লিবারেশন কি জিনিস! এখন লিবারেশন নিয়ে যারা কথা বলে, চিৎকার করে আর লাফালাফি করে তারা তো… যাত্রা গান সামনে বসে দেখা এক জিনিস আর টিভিতে বসে দেখা আরেক জিনিস! বল খেলা সামনে বসে দেখা এক জিনিস আর বল খেলা টিভিতে বসে দেখা আরেক জিনিস।

মন মানসিকতাও আর এখন ঐরকম নাই। যে সময় শহিদ পরিবার হিসেবে মূল্যায়ন পাবার কথা ছিল তখন তো আর কেউ মূল্যায়ন করে নি। আমার দুই ছেলে, পড়ালেখা করিয়েছি, তাদেরকেও বলে দিয়েছি, দেখ বাবা ভালো করে পড়াশোনা কর, আমি কাউকে চাকরির জন্যে কোন ধরণের রিকোয়েস্ট করব না। এই পরিচয় দিয়ে চাকরি নিব না। যদি মেরিটে চাকরি পাও তাইলে পাবে। আর আমি জানি এই পরিচয় দিয়ে চাকরি পাব না। চাকরি শহিদের ছেলে হলে পাওয়া যাবে না, রাজাকারের ছেলে হলে পাওয়া যায়।

আমরা তো আর টাকা পয়সা চাই নাই, চাইছিলাম মূল্যায়নটা থাকুক। রক্তটাতো এই মাটির সাথেই মিশে আছে।  

শেষের কথা
অসীত বরণ দে সাক্ষাৎকারের মাঝপথে আমাদের জন্যে চা-নাস্তার ব্যবস্থাও করেন। চায়ের কাঁপে চুমুক দিচ্ছিলাম আর তন্ময় হয়ে তাঁর কথা শুনে যাচ্ছিলাম। কখনো কখনো তিনি মাথা নিচু করে বসে ছিলেন অনেক সময় ধরে। না বললেও বুঝতে পেরেছিলাম যে তাঁর গলা কেপে কেপে উঠছে। বিশেষ করে শেষ কথা গুলো যখন বলছিলেন, তার গলা কাঁপছিল, আঙ্গুল দিয়ে বারেবারে চোখ ঢাকার চেষ্টা করছিলেন। কথার মাঝে চুপ করে বসেছিলেন কিছুটা সময় জুড়ে, নির্বাক দৃষ্টিতে চোখের পানি ফেলেছেন। তার সাথে ঘণ্টা দেড়েক সময় কাঁটিয়ে বের হওয়ার সময় বলে উঠলেন, ‘বাবা, এই যে মনে করায়ে দিয়ে গেলে আগামী একটা সপ্তাহ এই স্মৃতি খুবই পীড়া দিবে।’
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২০১৬
ফুটনোট
১) মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের চা শ্রমিক, দীপঙ্কর মোহান্তে
২) ঐ
৩) মুক্তিযুদ্ধে শহিদ চিকিৎসক জীবনকোষ, বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ।
৪) সদানন্দ এবং গনেশ হালদার। ৩ নং সূত্রানুসারে তারা দুজনেই আর ইহজগতে নাই।
৫) কন্দর্পয় মজুমদার, বর্তমানে করেরপাড়া থাকেন।
৬) খুরশিদ রিয়াজের বইতে (৩) এই টাকার পরিমাণ দুই হাজার বলে উল্লেখ আছে। অসীত বরণ দে’র সাথে আবার কথা বললে তিনি জানান, দুই হাজার হইতেও পারে! নির্দিষ্ট অংক তাঁর স্মরণে নাই, তবে টাকা এসেছিল তা মনে আছে।

No comments:

Post a Comment