ভূমিকা
জর্জ অরওয়েলকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো কিছু নাই; এনিমেল ফার্ম, ১৯৮৪ উপন্যাসদ্বয়ের বদৌলতে তার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুনিয়া ব্যাপী। যে প্রবন্ধ নিয়ে এই আলোচনা সেটাও তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। বরাবরের মতো অরওয়েল এখানেও বিশেষ একধরণের প্রবণতার কথা বলেছেন। অরওয়েলের এই ‘প্রবণতা’ সবাই ধরতে পারেন না বলে মুশকিলে পড়ে যাওয়ারও একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। যেমন, উপরোক্ত দুই উপন্যাসে তিনি রাষ্ট্রের যে কর্তৃত্বপরায়নতার কথা বলেছেন সেটা অনেকেই ধরতে পারেন না। তাই দেখা যায়, স্ট্যালিন আমলের কর্তৃত্বপরায়নতার সমালোচনাকে অনেকে সমাজতন্ত্রের সমালোচনা হিসেবে নিয়ে নেন। আমাদের দেশে একদল যেমন অরওয়েলকে সমাজতন্ত্র বিরোধী পুঁজিবাদী সমর্থক প্রমাণ করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন, তেমনি বামঘরণার রাজনীতির সাথে জড়িত অনেকের কাছে অরওয়েল প্রায় অচ্যুত।
জাতীয়তাবাদ নিয়ে অরওয়েলের এই প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল ১৯৪৫ সালে। ইউরোপ তখন ফ্যাসিবাদ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত; যুদ্ধের ভয়াবহ তিক্ত স্মৃতি টাটকা। প্রথম পঞ্চাশ বছরের ভেতরেই দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে ইউরোপ তখন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও মানসিকভাবে একপ্রকার বিপর্যস্ত। জার্মানিতে হিটলার, ইতালিতে মুসোলিনি। আবার রাশিয়াতে স্ট্যালিন। সবাই কর্তৃত্বপরায়ন। এই গোটা কয়েক বিষয় মাথায় রেখেই প্রবন্ধের ভেতরে ঢোকা উচিৎ, কেননা, যুদ্ধ হিটলার মুসোলিনি স্টালিন এই বিষয়গুলো প্রবন্ধে ঘুরেফিরেই আসবে। তাই বলে এটা ভেবে নেয়া ঠিক হবে না যে, আলোচনা তাদের নিয়ে বা তাদের আমল নিয়ে। বরং, তাদের কর্মকাণ্ড এবং তাদের আমলনামা ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা নিয়েই মূল আলোচনা। তাই একেবারে শুরুতেই এই ধারণটাও নিয়ে নেয়া উচিৎ যে, পুরো আলোচনা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে, তাদের এক ধরণের বিশেষ চিন্তা-পদ্ধতি নিয়ে। অরওয়েল সরাসরি না বললেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এটাও বলে দেন যে আমরা যাদের আমজনতা বলে থাকি তাদের তুলনায় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই বিশেষ ধরণের প্রবণতা অনেক বেশি পরিমাণে দেখা যায়।
দ্বিতীয়ত যে বিষয়টা পরিষ্কার করা উচিৎ, অরওয়েলও শুরুতেই পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন, তিনি ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটা প্রথাগত বা প্রচলিত অর্থে ব্যবহার করছেন না। জাতি, রেস জাতীয়তা – এমন প্রচলিত অর্থে ব্যবহার না করে বিশেষ এক ধরণের চিন্তাপ্রবণতা এবং মানসিক অভ্যাসকে বুঝাতে তিনি ‘জাতীয়তাবাদ’ ব্যবহার করেছেন। তাঁর ভাষায়, কোন যুতসই শব্দ না পেয়েই তিনি এই শব্দ ব্যবহার করছেন। এই জাতীয়তাবাদ কোন দেশ বা জাতির প্রতি আনুগত্য যেমন হতে পারে, তেমনি এসব ছাড়াও যে কোন ধরণের ইউনিটের প্রতিও আনুগত্য হতে পারে; আবার যে কোন ইউনিটের প্রতি বিরাগও হতে পারে। এই আনুগত্য কোন ‘নিরীহ’ জিনিস নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে ক্ষমতা-লিপ্সা। মান ইজ্জতের প্রশ্ন। নিজ পক্ষের ক্ষমতা বাড়ছে না কমছে, ইজ্জত বাড়ছে না কমছে একজন জাতীয়তাবাদী দিনরাত এমন ভাবনাতেই ডুবে থাকেন। এই চিন্তাপ্রবণতা বাদবাকি সবকিছুকেই আড়াল করে দেয়। তিনি নিজে যে পক্ষকে পূজা করেন সবকিছুতে তার শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজেন। ইতিহাসের বয়ান হাজির করারও তার একটা নির্দিষ্ট পন্থা আছে। তিনি যেভাবে অতীতকে দেখতে চান জোরজবরদস্তি করে তাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। পূর্বেই তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, পরে সেই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষের যুক্তিসমূহ খুঁজতে থাকেন হন্য হয়ে। এমন জাতীয়তাবাদীর ইতিহাস বয়ানে নিজেদের ক্ষমতার উত্থানের গল্প ছাড়া আর বেশি কিছু থাকে না। এই ‘উত্থান-পতন’ জাতীয়তাবাদীর চিন্তাভাবনাকে এতটাই বিকৃত করে ফেলে যে, যে কোন খারাপ কাজ সেটা যদি ‘আমাদের পক্ষ’ করে তবে তার বৈধতা পেয়ে যায়। তার যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা-চেতনা সব পার্টি কেন্দ্রিক, দুনিয়াকে দেখেন পার্টির চশমা চোখে পরে। যাবতীয় সত্যকে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে শুধু নিজেদের মহান-মহীয়সী করে উপস্থাপন করার আপ্রাণ চেষ্টায় মত্ত থাকেন সবসময়য়। অরওয়েলের মতে এমন জাতীয়তাবাদীর অবস্থা ‘সিজোফ্রেনিয়া’ রোগীর চেয়ে বেশি দূরে না।
অরওয়েল তাঁর প্রবন্ধের প্রারম্ভেই জাতীয়তাবাদের সাথে দেশপ্রেমের একটা ফারাক দেখান। যে কোন ইউনিটের প্রতি আমার প্রেম-ভালোবাসা থাকতেই পারে, আমি বিশ্বাস করতেই পারি যে আমরটা সেরা, কিন্তু আমি কখনোই আমার মতটা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবো না। অরওয়েলের কাছে এটাই দেশপ্রেম। মানে এই দেশপ্রেম সামরিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে প্রতিরক্ষামূলক যেখানে জাতীয়তাবাদ চরিত্রগত দিক থেকে আক্রমণাত্মক। ক্ষমতা-লিপ্সার সাথে এর সম্পর্ক গভীর। ক্ষমতা-মান-ইজ্জত এসবের লাগাতার বৃদ্ধি হোক জাতীয়তাবাদী মন এটাই চায়। অরওয়েল এই দেশপ্রেমের মধ্যে দোষের কিছু দেখেন না। অবশ্য, বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে, যখন প্রোপ্যাগান্ডা আরও শক্তিশালী রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে, ‘দেশপ্রেম’ও শাসকগোষ্ঠীর কাছে খুবই প্রিয় শব্দ। শাসনের হাতিয়ার। শাসকের আদেশ না মানা মানে তোমার দেশপ্রেম নাই। তুমি শাসকের সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করেছো মানে এইবার শাসক তোমার দেশপ্রেম নিয়েই প্রশ্ন তুলবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেমও কোন নিরীহ বিষয় থাকে নি।
বুঝাই যাচ্ছে, অরওয়েল জাতীয়তাবাদ একটা বিশেষ ও বিস্তৃত অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাই, সেখানে জায়নবাদ যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তেমনি কমিউনিজমও এসেছে। উল্লেখ্য, জায়নাবাদ বা কমিউনিজম নিয়ে কথা বলা হয় নাই, বরং জায়নবাদি বা কমিউনিস্টদের নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এই সব ধরণের জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে হাজারটা ফারাক থাকা স্বত্বেও যে একধরণের সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে তা চিহ্নিত করেন অরওয়েল। প্রত্যেক জাতীয়তাবাদীই মোহগ্রস্ত থাকেন, স্থিতিহীনতায় ভুগেন এবং সত্যের প্রতি উদাসীন থাকেন। সত্যকে শুধু অস্বীকারই করেন না, বরং এগুলো শুনতে না পারার মত একটা দারুণ ক্ষমতাও তাদের থাকে। তৎকালীন ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে ধরণের জাতীয়তাবাদী প্রবণতা দেখা যেত সেগুলোকে অরওয়েল তিনভাগে ভাগ করেছেন। ইংরেজিতেই বলি – positive nationalism, transferred nationalism এবং negative nationalism। এখানে positive এবং negative এর পরিভাষা কি হবে তা নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। শেষেমেষে এদের পরিভাষা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক রেখেছি, কিন্তু প্রচলিত অর্থে - ভালো বা মন্দ এই অর্থে – এদের বুঝতে গেলে মুশকিলে পড়তে হবে। কারণ অরওয়েল এখানে positive এবং negative দিয়ে ভিন্ন কিছু বুঝাচ্ছেন। যে ইউনিট বা দেশে নিজের অবস্থান তার পক্ষে কিংবা যে কোন ইউনিটের পক্ষে যে আচ্ছন্নতা সেটাকে তিনি পজিটিভ ন্যাশনালিজম বলছেন। যেমন জায়নবাদীদের আনুগত্য একটা নির্দিষ্ট ইউনিটের প্রতি, মানে নিজ ধর্মের প্রতি। তেমনি সেল্টিক জাতীয়তাবাদীদের আনুগত্যও তাদের ভূখণ্ডের প্রতি। আবার কোন নির্দিষ্ট ইউনিটের বিপক্ষে কারো বিরোধাত্মক অবস্থানকেই তিনি নেগেটিভ ন্যাশনালিজম বলছেন। যেমন ট্রটস্কিবাদীদের অবস্থান স্টালিন আমলের বিরুদ্ধে। এন্টি সেমেটিজম তেমনি ইহুদী-বিদ্বেষী।
জুলিয়েন বেন্দা বলেছিলেন, প্লাটোর আমলে বলা হতো নৈতিকতা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, ম্যাকেয়াভেলির আমলে বলা হলো নৈতিকতা ও রাজনীতি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, আর এই আমলে বলা হচ্ছে রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করবে নৈতিকতাকে।[1] অরওয়েল বুদ্ধিজীবীদের যে প্রবণতা চিহ্নিত করেছেন সেটা বেন্দার এই কথা থেকে আরও পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। প্রশ্ন হতে পারে আমরা কেন এই প্রবন্ধ পাঠ করছি। এটা সত্য যে অরওয়েল কথা বলেছেন ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে, তারা যে বিষয়গুলোর প্রতি মোহাচ্ছন্ন সেই বিষয়গুলোর অধিকাংশের অস্তিত্বই আমাদের দেশে নাই। কিন্তু, আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে না দিলেও আমরা বুঝতে পারি অরওয়েল যে প্রবণতার কথা বলেন সেটার অস্তিত্ব বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে আমাদের পুরো বুদ্ধিজীবী সমাজ যেভাবে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে থাকেন তাতেই তাদের অভিমুখ ধরতে পারা যায়। আমাদের এখানে যারা পত্রিকায় –অফলাইন হোক বা অনলাইন হোক – নিয়মিত লেখালেখি করেন, টকশোতে নিয়মিত বক্তৃতা করেন, সোশিয়াল মিডিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেন তারা সবাই ‘আওয়ামী বুদ্ধিজীবী’, ‘বিএনপি বুদ্ধিজীবী’ ইত্যাদি নামে জনগণের কাছে পরিচিত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এই দলীয় প্যানেলে পরিচিত হোন। ফয়েজ আলমের একটা প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করা যায়।[2] তিনি বলছিলেন যে আমরা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের যুগে বসবাস করছি। আমাদের পুরো বুদ্ধিজীবী সমাজ রাজনৈতিক সমাজের প্রচারকর্মীতে পরিণত হয়েছেন। রাজনৈতিক দলের কাছে মন ও মগজ বর্গা দেয়ার বিরূপ প্রভাব পড়ছে ইতিহাস চর্চাতেও। বাঙালি সংস্কৃতি, জাতিত্ব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের দেশে যে আলোচনা চলে তাকে কোনভাবেই বস্তুনিষ্ঠ আলাপ বলা যায় না, বরং রাজনৈতিক দলের চাওয়ার উপরই আলোচনা নির্ভর করে। এসবের ধারণা রাজনৈতিক দল অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। স্বীকার করি বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য, কিন্তু এখানে যে ভিন্নতা বিদ্যমান সেটা পার্টির চশমার কারণেই তৈরি। আর এসব রাজনৈতিক দলের রসদ যোগান দেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। ফয়েজ আলম তাই বলছিলেন, ‘এর ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সাহিত্যের পরম্পরা, ইতিহাসের ধারা সবকিছুই স্ব স্ব রাজনৈতিক শিবিরের সুবিধা মতো ব্যাখ্যা করেন বুদ্ধিজীবীরা’। এমনকি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা হয় দলীয় অবস্থান থেকে। যদি ঘটনা বা দুর্ঘটনা ‘আমাদের’ দ্বারা সঙ্ঘটিত হয় তখন আমরা এর বৈধতা দেয়ার জন্যে উঠেপড়ে লেগে যাই। এই প্রবন্ধের শেষে অরওয়েল এই প্রবণতা থেকে বের হওয়ার পথ বাতলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, সেটা কতটা কার্যকর তা আলোচনা-সাপেক্ষ। তবে তিনি ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সেই বের হওয়ার চেষ্টাও খুব একটা দেখেন নি বলে হতাশাও ব্যক্ত করেছিলেন। আমাদের অবস্থাও হয়েছে একই। এমন প্রবণতার ছেড়ে বের হওয়ার কোন চেষ্টাও আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখতে পাই না।
সব আলোচনা শেষে অরওয়েল স্বীকার করেন যে তিনি কোন কোন স্থানে অতি সরলীকরণ করেছেন। মনে রাখতে হবে তার মূল অবস্থান হচ্ছে ঐ চিন্তা প্রবণতার বিরুদ্ধে যা কিনা আমাদের মূল্যবোধকেও বিকৃত করে তোলে। তিনি জানান, কোন কিছুর প্রতি জাতীয়তাবাদী আনুগত্য বা আবেগ থাকাটা স্বাভাবিক, এমনকি জাতীয়তাবাদী আদর্শ অ-জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে এই আনুগত্য যেন আমাদের চিন্তা-চেতনাকে বিকৃত করে না তুলে। সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ সমস্যাকে সমস্যা বলে চিহ্নিত করা। অরওয়েল এই দিকটাতেই গুরুত্ব দেন।
যেহেতু চিন্তাপ্রবণতা নিয়েই কথা বলা হচ্ছে সেহেতু বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে শিরোনামের খানিক উলটপালটও করেছি। অরওয়েল নাম দিয়েছেন ‘নোটস অন ন্যাশনালিজম’; আর আমি নাম দিয়েছি ‘জাতীয়তাবাদী মন’। পুরো প্রবন্ধজুড়ে সেই মন নিয়েই নাড়াচাড়া করা হয়েছে। মূল প্রবন্ধে যে সকল টীকা লেখক যুক্ত করেছিলেন তার সব অনুবাদ করা হয় নি। যে টীকা গুরুত্বপূর্ণ বলে অনুবাদকের মনে হয়েছে সেগুলোই নেয়া হয়েছে। কিছু কিছু টীকা অনুবাদক যুক্ত করেছেন, প্রয়োজন মোতাবেক। অনুবাদে ভুলত্রুটি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আশা করি ভুল ধরিয়ে দিয়ে আলোকিত করবেন।
মূল প্রবন্ধ
বায়রন ফরাসি শব্দ ‘longeur’[3] ব্যবহার করে মন্তব্য করেছিলেন, ইংল্যান্ডে যদিও এই শব্দটা নেই, কিন্তু এই জিনিসটা আছে প্রচুর পরিমাণে। ঠিক একইভাবে আমাদের মনেরও একটা অভ্যাস আছে যা বর্তমানে এতই প্রচলিত যে, এটা আমাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোন নাম দেয়া হয় নাই। বিদ্যমান নিকটতম সমতুল্য শব্দ হিসেবেই ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটা আমি ব্যবহার করছি, যদিও কিছু পরে দেখা যাবে প্রচলিত অর্থে আমি এটা ব্যবহার করছি না। আমি যে আবেগের কথা বলছি সেটা আমরা যাকে ‘ন্যাশন’ বলি, মানে কোন একক রেস বা ভৌগলিক এলাকা, শুধুমাত্র সে অর্থে ব্যবহার করছি না। এই আবেগ যে কোন চার্চ, বা শ্রেণির সাথেও নিজেকে যুক্ত করতে পারে অথবা এটা নেতিবাচক (negative) অর্থেও কাজ করতে পারে। যেকোনো কিছু বা যে কারো বিরুদ্ধেও সেটা হতে পারে এবং সেটা হতে পারে কোন কিছুর প্রতি আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই।
‘জাতীয়তাবাদ’ দিয়ে আমি প্রথমেই সকল অনুমানের অভ্যাসকে (habit of assuming) বুঝাতে চাচ্ছি; যেখানে অনুমান করে নেয়া হয় যে, মানবজাতিকে পোকামাকড়ের মতো শ্রেণীকরণ করা যাবে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের সে গোষ্ঠীগুলোকে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ লেভেল দিয়ে ভাগ করা যাবে।[4] কিন্তু দ্বিতীয়ত - এবং এটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ - আমি কোন একক জাতি বা ইউনিটের সাথে যুক্ত করে নিজেকে চিহ্নিত করার অভ্যাসকে বুঝাচ্ছি; যেখানে নিজের ইউনিটকে সকল ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে রেখে শুধু নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া ছাড়া আর কোন দায়-দায়িত্ব স্বীকার করা হয় না। জাতীয়তাবাদকে দেশপ্রেমের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। উভয় শব্দই সাধারণত এতটা অস্পষ্টভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে যে, এদের যে কোন সংজ্ঞাকেই চ্যালেঞ্জ করা যায়। তবু, এদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য টানা জরুরী, কেননা এই দুই শব্দ পুরো ভিন্ন ও বিপরীতমুখী অর্থ বহন করে। ‘দেশপ্রেম’ বলতে আমি বুঝাচ্ছি যে কোন নির্দিষ্ট জায়গা এবং নির্দিষ্ট জীবন-অভ্যাসের প্রতি একনিষ্ঠতা; যা একজন বিশ্বাস করতেই পারেন যে এই জায়গা বা অভ্যাস বিশ্বের সেরা, কিন্তু অন্যের উপর সে বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছা থাকবে না। দেশপ্রেম সাধারণত সামরিক ও সাংস্কৃতিক উভয় দিক হতেই প্রতিরক্ষামূলক। অন্যদিকে ক্ষমতা-লিপ্সার সাথে জাতীয়তাবাদ অবিচ্ছেদ্য। প্রত্যেক জাতীয়তাবাদীর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আরও ক্ষমতা এবং আরও সম্মান অর্জন। কিন্তু, এর কোনটাই নিজের জন্যে না, বরং, জাতি বা কোন নির্দিষ্ট ইউনিটের জন্যে যেখানে সে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ডুবিয়ে দিতে চায়।
যতক্ষণ এটা জার্মান, জাপান এবং অন্যান্য দেশের কুখ্যাত ও চিহ্নিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রয়োগ করা হয়, এর সবকিছুই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। নাৎসিবাদের মুখোমুখি হয়ে আমরা প্রায় সকলেই একই কথা বলবো। কিন্তু আবারো বলছি, আমি উপযুক্ত শব্দের অভাবের কারণে এখানে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটা ব্যবহার করছি। আমি যে অর্থে জাতীয়তাবাদ ব্যবহার করছি তা কমিউনিজম, রাজনৈতিক ক্যাথলিকবাদ, জায়নবাদ, অ্যান্টি-সেমেটিজম, ট্রটস্কিবাদ এবং শান্তিবাদের মতো আন্দোলন এবং প্রবণতাগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এটা শুধু কোন সরকার বা দেশের প্রতি আনুগত্য বুঝাবে তা যেমন জরুরী না, তেমনি সেটা যে শুধু অস্তিত্বশীল কোন কিছুর প্রতি আনুগত্য বুঝাবে তাও জরুরী না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ইহুদি, ইসলাম, খ্রিষ্টান, প্রলেতারিয়াত, সাদা রেস এই সবই প্রগাঢ় জাতীয়তাবাদী অনুভূতি। কিন্তু, এদের অস্তিত্ব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলা যেতে পারে এবং এদের এমন কোন সর্বজন গৃহীত সংজ্ঞাও নাই।
জোর দিয়ে এটা আবারও বলা যায়, জাতীয়তাবাদী অনুভূতি শুধুই নেতিবাচক (negative) হতে পারে। যেমন ট্রটস্কিবাদীরা অন্য কোন ইউনিটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করেও সোভিয়েতের শত্রু হয়েছিলেন। যখন কেউ এই প্রকাশিত চিহ্নগুলো ধরতে পারবে তখনই ‘জাতীয়তাবাদ’ দ্বারা আমি কি বুঝাচ্ছি সেটা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। একজন জাতীয়তাবাদী কেবল, অথবা প্রধানত, প্রতিযোগিতামূলক মর্যাদার কথা চিন্তা করেন। তিনি একজন ইতিবাচক (positive) অথবা নেতিবাচক (negative) জাতীয়তাবাদী হতে পারেন, মানে তিনি তার মানসিক শক্তিকে প্রচার অথবা অপপ্রচারে ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু যে কোন ভাবেই হোক তার চিন্তাভাবনা সর্বদাই হার-জিত, বিজয় এবং অপমান এসব ঘিরেই থাকে। তিনি ইতিহাসকে, বিশেষ করে সমসাময়িক ইতিহাসকে, মহান মহান ক্ষমতার এককদের ক্রমাগত উত্থান ও পতন হিসেবে দেখেন। এবং, চতুর্দিকে যত ঘটনা ঘটে এর সবকিছুই স্বপক্ষের উন্নতি এবং কোন ঘৃণিত প্রতিদ্বন্দ্বীর অবনতি হিসেবে তার কাছে প্রতিভাত হয়। কিন্তু, জাতীয়তাবাদের সাথে নিছক সাফল্যের পূজা করাকে গুলিয়ে না ফেলাটাও গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদীরা শক্তিশালী পক্ষের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হওয়ার মত সাধারণ নীতি গ্রহণ করেন না। বরং, সে আগে পক্ষ নির্বাচন করে, পরে নিজেকে বুঝায় যে তার পক্ষই সবচেয়ে শক্তিশালী। এমনকি বাস্তব ঘটনার সিংহভাগ তার বিপক্ষে থাকলেও সে নিজের বিশ্বাসে অটল থাকে। আত্মপ্রবঞ্চনায় প্রভাবিত ক্ষমতালিপ্সাই হলো জাতীয়তাবাদ। প্রত্যেক জাতীয়তাবাদী ঘোর অসাধুতা করতে সক্ষম, কিন্তু, যেহেতু তিনি নিজের চেয়েও বড় কিছুকে ভজনা করেন, তাই তার সে কাজ সঠিক হওয়ার ব্যাপারে তিনি শতভাগ নিশ্চিত থাকেন।
এই দীর্ঘ সংজ্ঞা দেয়ার পর আমি মনে করি এখন কবুল করে নেয়া যায়, যে অভ্যাসের কথা আমি বলছিলাম সেটা ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান এবং সাধারণ জনগণের তুলনায় তাদের মধ্যেই এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। যারা সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন, কিছু কিছু বিষয় মান-ইজ্জতের ভাবনা দ্বারা এতটাই আক্রান্ত যে, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে কোন যৌক্তিক পথ অবলম্বন করা তাদের জন্যে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। হাজারটা উদাহরণের মধ্যে একটা দেয়া যেতে পারে। ধরেন এই প্রশ্নটা: জার্মানিকে যুদ্ধে পরাজিত করতে সোভিয়েত, ব্রিটেন এবং আমেরিকা এই তিন মিত্রপক্ষীয় শক্তির মধ্যে কার অবদান বেশি ছিল? তত্ত্বগত ভাবে এই প্রশ্নের একটা যৌক্তিক উত্তর দেয়া সম্ভব, এমনকি হয়তোবা চূড়ান্ত একটা উত্তর দেয়া সম্ভব! কিন্তু, বাস্তবে, প্রয়োজনীয় হিসেব নিকেশ করা যাবে না, কারণ যিনি এই প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘাঁটাতে যাবেন তিনি অনিবার্যভাবে এটাকে প্রতিযোগিতামূলক মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা শুরু করবেন। তিনি প্রথমেই রাশিয়া, ব্রিটেন বা আমেরিকার মধ্যে কোন একটাকে বেছে নিবেন এবং পরবর্তীতে শুধুমাত্র এই পূর্বানুমানকে প্রমাণ করার জন্যে তিনি যুক্তি খুঁজতে থাকবেন। এবং এ ধরণের প্রচুর প্রশ্ন আছে যাদের সৎ উত্তর শুধুমাত্র তাদের কাছেই পাওয়া যাবে যারা এই পুরো বিষয় সম্পর্কে উদাসীন এবং, এ বিষয়ে যার মতামত সম্ভবত গুরুত্বহীন মনে করা হয়। একারণেই, আংশিক হলেও, রাজনৈতিক ও সামরিক পূর্বাভাসের সময় আমরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। উল্লেখ করতেই হয়, এমন একজন বিশেষজ্ঞও পাওয়া যায় নি যিনি ১৯৩৯ সালের রুশ-জার্মান চুক্তি সম্পর্কে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।[5] এবং, যখন এই চুক্তির সংবাদ প্রকাশিত হলো, তখন উদ্ভট বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেয়া শুরু হলো। সেই সাথে যে সকল অনুমান করা হয় তা কিছুদিনের মধ্যেই মিথ্যে প্রমাণিত হয়। এই অনুমানগুলো কোন গবেষণার উপর ভিত্তি করে করা হয় নাই, বরং সোভিয়েতকে ভালো বা মন্দ, শক্তিশালী বা দুর্বল দেখানোর মনোবাসনা থেকেই করা হয়েছিল। রাজনৈতিক ও সামরিক ধারাভাষ্যকাররা - জ্যোতিষীদের মতোই - যে কোন ধরণের ভুল করেও রেহাই পেয়ে যান, কেননা সমর্থক-গোষ্ঠী বাস্তবকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার জন্যে তাদের দিকে তাকায় না, বরং, জাতীয়তাবাদী আনুগত্যের উন্মাদনার জন্যে তাকায়। রাজনীতির মতো আমাদের নান্দনিক বিচার, বিশেষ করে সাহিত্যিক বিচারও এতে আক্রান্ত হয়। একজন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীর পক্ষে কিপলিংকে উপভোগ করা অথবা রক্ষণশীলের পক্ষে মায়াকোভস্কির মধ্যে মেধাকে দেখা কষ্টকর। এবং, যে বইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মত-পার্থক্য দেখা দেয় তাকে সাহিত্যিক বিচারে খারাপ বই দাবি করার মতো প্ররোচনা সর্বদাই থাকে। জাতীয়তাবাদী চেহারার লোকেরা এটা দক্ষতার সাথে করে থাকে, তাদের এই অসততার প্রতি সচেতন না হয়েই।
যদি কেবল সংখ্যাকেই বিবেচনায় নেয়া হয় ইংল্যান্ডে হয়তোবা সনাতনী উগ্র দেশপ্রেমটাই জাতীয়তাবাদের প্রভাবশালী রূপ। এটা নিশ্চিত যে এই রূপ এখনো ব্যাপক, এবং কয়েক বছর পূর্বেও পর্যবেক্ষকরা যা বলতেন তার চেয়ে বেশি। তবে, এই নিবন্ধে আমি প্রধানত বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করবো, যাদের কাছে এই উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং এমনকি সনাতনী দেশপ্রেমটাও মৃত; যদিও সংখ্যালঘু একটা অংশের মধ্যে এটাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসও দেখা যায়। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে, দ্বিধাহীন ভাবেই বলা যায়, জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী রূপ হচ্ছে কমিউনিজম। এখানে কমিউনিজম শব্দটা খানিক শিথিল অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে; কেবল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদেরকেই বুঝানো হচ্ছে না বরং, তাদের ‘সহযাত্রী এবং ‘রুশোফাইল’দেরও বুঝানো হচ্ছে। এখানে আমি তাকেই কমিউনিস্ট বলছি, যে/যারা সোভিয়েতকে তাদের পিতৃভূমি মনে করেন এবং রাশিয়ার যে কোন কর্মপন্থার বৈধতা দেয়া ও যে কোন মূল্যে রাশিয়ার স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়াটা নিজেদের দায়িত্ব বলে অনুভব করেন। ইংল্যান্ডে এই ধরণের মানুষের সংখ্যা প্রচুর, এবং তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবও প্রবল। কিন্তু, আরও অনেক ধরণের জাতীয়তাবাদও বেড়ে উঠছে; এবং জাতীয়তাবাদের ভিন্ন ভিন্ন এমনকি কখনো বিপরীতমুখী এই ধরনগুলোর সদৃশতা খেয়াল করলেই যে কেউ আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত ধরতে পারবেন।
দশ বা বিশ বছর পূর্বে আজকের কমিউনিজমের মতো যে ধরণের জাতীয়তাবাদ প্রচলিত ছিল সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক ক্যাথলিকবাদ। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছেন জি কে চেস্টারটন যদিও তিনি হয়তোবা সাধারণের তুলনায় খানিক চরমপন্থি। চেস্টারটন একজন মেধাবী লেখক ছিলেন যিনি রোমান ক্যাথলিক প্রোপাগান্ডার জন্যে তার সংবেদনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। তার জীবনের শে্ষ বিশ বছরের যাবতীয় কাজকর্ম আসলেই একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তার প্রত্যেকটা বইয়ে, ডায়লগে প্যাগান ও প্রটেস্টান্টদের তুলনায় ক্যাথলিকদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শিত হত। কিন্তু চেষ্টারটন যে প্রেক্ষিতে এই শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলতেন, সেটা কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বা আধ্যাত্মিক জায়গা থেকে নয়, বরং এটা ছিল জাতীয় ইজ্জত ও সামরিক শক্তির প্রেক্ষিতে। বিভিন্ন ল্যাটিন দেশের, বিশেষ করে ফ্রান্সের একধরণের অন্ধ আদর্শীকরণ থাকতো তাদের লেখায়। চেষ্টারটন ফ্রান্সে বেশীদিন থাকেন নি, এবং ফ্রান্সের যে ছবি তিনি আঁকেন- যেমন ক্যাথলিক কৃষকরা অনবরত রেডওয়াইনে হাতে নিয়ে Marseillaise[6] গাইছে - সেটা যেন অনেকটা এরকম যে, Chu Chin Chow[7] ই হচ্ছে বাগদাদবাসীর প্রতিদিনের জীবন-যাপনের চিত্র। সেখানে যে শুধু ফ্রেঞ্চ সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত কথাবার্তা থাকত তা না, (১৯১৪-১৮ এর পূর্বে এবং পরে উভয় সময়েই, তার মতে, ফ্রান্স জার্মানির থেকে শক্তিশালী ছিল) এমনকি যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থারও অশ্লীল স্তুতি থাকত। চেষ্টারটনের যুদ্ধের কবিতা, যেমন Lepanto অথবা The Ballad of Saint Barbara’র সামনে The Charge of the Light Brigade[8] কবিতাকে শান্তিবাদী মনে হয়। এদের প্রত্যেকটাই সম্ভবত আমাদের ভাষার সবচেয়ে বাগাড়ম্বর কবিতা। মজার বিষয় হচ্ছে তিনি ফ্রান্স ও ফ্রান্সের আর্মিকে নিয়ে যেসব সস্তা রোমান্টিক জিনিসপত্র লিখেছেন, সেটা যদি কেউ ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ আর্মিকে নিয়ে লিখত তাহলে তিনিই সবার প্রথমে তা নিয়ে ব্যাঙ্গ করতেন। দেশিয় রাজনীতির বেলায় ইংরেজ পরিচয় তাঁর কাছে খুব ছোট, তিনি তখন উগ্র দেশপ্রেম ও সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী, এবং তাঁর ভাষায়, তিনি গণতন্ত্রের একজন খাঁটি বন্ধু। কিন্তু, যখন আন্তর্জাতিক ময়দানে যান, তখন এই নীতিগুলো পরিত্যাগ করেন, এমনকি তাঁর খেয়ালও থাকত না যে তিনি সেটা করছেন। তাই দেখা যায়, গণতন্ত্রের গুণাবলির প্রতি তার প্রায় আধ্যাত্মিক বিশ্বাসও তাঁকে মুসোলিনিকে সমর্থন দেয়া থেকে আটকাতে পারে নি। মুসোলিনি প্রতিনিধিমূলক সরকার ব্যবস্থা ও বাক স্বাধীনতাকে ধ্বংস করছিলেন, যে জিনিসগুলোর জন্যে দেশের মাটিতে চেষ্টারটোনে রীতিমত সংগ্রাম করেছিলেন; কিন্তু মুসোলিনি একজন ইতালিয়ান ছিলেন এবং তিনি ইতালিকে শক্তিশালী করেছিলেন, এবং এটাই পুরো বিষয়টাকে মিটমাট করে দেয়। চেষ্টারটন কখনো সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেন নি যখন সেটা ইতালিয়ান ও ফরাসিরা করেছে। যখনই তাঁর জাতীয়তাবাদী আনুগত্য জড়িয়ে পড়েছিল তখনই বাস্তবমুখী জ্ঞান, সাহিত্যবোধ, এবং এমনকি কখনো কখনো তাঁর নৈতিক মূল্যবোধও স্থানচ্যুত হয়েছিল ।
অবশ্যই রাজনৈতিক ক্যাথলিকবাদ, চেষ্টারটনের মাধ্যমে যার উদাহরণ দেয়া হয়েছে, এবং কমিউনিজমের মধ্যেও বেশ সদৃশতা আছে। যেমন করে আছে এদের সাথে স্কটিশ জাতীয়তাবাদ, জায়নবাদ, এন্টি সেমেটিজিম বা ট্রটস্কিবাদের। এটা অতি-সরলীকরণের দোষে দুষ্ট হবে যদি বলি, এই সব ধরণের জাতীয়তাবাদই সমান, এমনকি তাদের মানসিক পরিবেশও, তবু প্রতিটা ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
আচ্ছন্নতা। কোন জাতীয়তাবাদীই নিজ ইউনিটের শ্রেষ্ঠত্বের গুণকীর্তন ছাড়া যদ্দুর সম্ভব আর কোন কিছু নিয়েই চিন্তা করেন না, আলোচনা করেন না বা লিখেনও না। কোন জাতীয়তাবাদীর পক্ষে এই আনুগত্য লুকিয়ে রাখা অসম্ভব না হলেও কঠিন হয়ে পড়ে। নিজ ইউনিটের উপর সামান্য কলঙ্ক বা প্রতিদ্বন্দ্বী ইউনিটের সামান্য প্রশংসাও তাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়; তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মাধ্যমেই তিনি এর থেকে মুক্তি পান। আর যদি এই ইউনিট ভারত বা আয়ারল্যান্ডের মতো কোন দেশ হয়ে থাকে তাহলে তিনি শুধু যে রাজনৈতিক বা সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্বই দাবি করবেন তা না, বরং শিল্প-সাহিত্য-খেলাধুলা-ভাষা-অধিবাসীদের শারীরিক সৌন্দর্য এবং এমনকি আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দৃশ্য ও রান্নাবান্না নিয়েও শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করবেন। তিনি কিছু কিছু জিনিসের প্রতি প্রচণ্ড সংবেদনশীল, যেমন দেশের পতাকার সঠিক প্রদর্শন, দেশের নামের শিরোনামের আপেক্ষিক আকার ও ক্রম ইত্যাদি। নামকরণ জাতীয়তাবাদীর চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে সকল দেশ তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছে, কিংবা কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে তারা সাধারণত তাদের নাম পরিবর্তন করে ফেলে। কোন দেশ বা কোন ইউনিটকে ঘিরে যে আবেগগুলো ঘুরপাক খায় তারও অনেকগুলো নাম থাকে, প্রতিটা নাম আবার ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ইঙ্গিত করে। স্পেনের গৃহ যুদ্ধের দুই পক্ষের নয়-দশটা নাম ছিল এবং প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা মাত্রার ভালোবাসা বা ঘৃণা প্রকাশ করতো। এর মধ্যে কিছু কিছু নাম (যেমন, ফ্রাঙ্কো সমর্থকদের ‘দেশপ্রেমিক’ কিংবা সরকার সমর্থকদের ‘আনুগত্যবাদী’ বলা) ছিল যেগুলোর সত্যাসত্য সম্পর্কে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও গ্রহণ করা হয়েছে। এবং এমন একটা নামও পাওয়া যায় না যার ব্যাপারে দুই পক্ষই সহমত পোষণ করতে পেরেছিল। সকল জাতীয়তাবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী ভাষার ক্ষতির জন্যে নিজের ভাষা ছড়িয়ে দেয়াটাকে তাঁদের দায়িত্ব মনে করে। এবং, ইংরেজি ভাষাভাষীদের মধ্যে এই সংগ্রাম সূক্ষ্ম রূপে উপভাষাগুলোর মধ্যকার সংগ্রাম হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়। অ্যাংলো আমেরিকানরা এমন স্ল্যাং ব্যবহার করতে অস্বীকার করবে যদি জানা যায় যে এই শব্দের গোঁড়া ব্রিটেনে। লাতিনাইজার ও জার্মানাইজেদেরও প্রায়ই জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্য থাকে। স্কটিশ জাতীয়তাবাদীরা লোল্যান্ড স্কটদের শ্রেষ্ঠত্বের দিকে জোর দেয়, এবং সমাজতন্ত্রীরা যাদের জাতীয়তাবাদ শ্রেণি বিদ্বেষের আকার ধারণ করেছে তারা বিবিসির উচ্চারণ বিরুদ্ধে প্রচণ্ড তিরস্কার করে। এবং প্রায়শই এসবের সাথে ‘সহানুভূতিশীল জাদু’[9] বিশ্বাসের ছাপ লক্ষ করা যায়- যে বিশ্বাসের কারণেই বোধহয় রাজনৈতিক শত্রুদের প্রতিকৃতি আগুনে পোড়ানোর রেওয়াজ চালু আছে, অথবা শুটিং গ্যালারির লক্ষ্যবস্তু হিসেবে তাদের ছবি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
স্তিতিহীনতা। আবেগের যে তীব্রতা জাতীয়তাবাদীকে ধরে রাখে তা তাঁর জাতীয়তাবাদী আনুগত্যের স্থানান্তরকে আটকাতে পারে না। শুরুতেই আমি দেখিয়েছি যে তারা অন্য কোন দেশের প্রতি নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে পারেন, এবং প্রায়শই তা করেও থাকেন। কেউ খোঁজ করলে পেয়ে যাবেন, যে মহান জাতীয় নেতারা, কিংবা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতারা যে দেশকে মহিমান্বিত করছেন তারা সেই দেশেরই অন্তর্গত না। কখনো কখনো তারা সরাসরি বিদেশি, অথবা প্রায়ই তারা এমন প্রান্তিক জায়গা থেকে উঠে আসেন যেখানে জাতীয়তার অস্তিত্ব আছে কি না তাই সন্দেহজনক। যেমন স্ট্যালিন, হিটলার, নেপোলিয়ন, ডি ভালেরা, ডিসরায়েলি, পয়েনকারি, বিভারব্রুক। প্যান-জার্মান আন্দোলন আংশিকভাবে একজন ইংরেজের সৃষ্টি, হুয়োস্টন চ্যাম্বারলেইন। গত পঞ্চাশ বা একশত বছর যাবত বুদ্ধিজীবী মহলে এই ‘স্থানান্তরিত জাতীয়তাবাদ’ খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাফকাদিও হার্ণের ছিল জাপান, কার্লাইল এবং তাঁর সময়ে ছিল জার্মানি এবং আমাদের কালে সাধারণত রাশিয়া। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো যে, পুনরায় পরিবর্তনও সম্ভব। এককালের পূজিত ইউনিট বা দেশ যে কোন মুহূর্তে ঘৃণিত হয়ে যেতে পারে এবং সাথে সাথেই ভালোবাসার এই জায়গাটা অন্য কেউ দখল করে নিতে পারে। এইচ জি ওয়েলসের Outline of History’র প্রথম সংস্করণ বা তাঁর সে সময়কার লেখাগুলোতে আমেরিকার প্রশংসা রাশিয়া সম্পর্কে আজকের কমিউনিস্টদের প্রশংসার মতোই অসংযত। যদিও এই সমালোচনাহীন প্রশংসা কিছুদিনের মধ্যেই বৈরিতায় পরিণত হয়। যে গোঁড়া কমিউনিস্ট সপ্তাহান্তে অথবা দিনান্তে গোঁড়া ট্রটস্কিপন্থিতে পরিবর্তিত হয় তাদের চেহারা আসলে সমানই। ইউরোপ মহাদেশে ফ্যাসিস্ট আন্দোলনগুলোতে মূলত কমিউনিস্টদের মধ্যে থেকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল এবং কিছু বছরের মধ্যেই উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে। যে বিষয়টা জাতীয়তাবাদীর কাছে অপরিবর্তনীয় তা হচ্ছে তাঁর মানসিকতা: অনুভূতির বস্তুটা পরিবর্তনশীল, এবং কাল্পনিকও হতে পারে।
কিন্তু, একজন বুদ্ধিজীবীদের জন্যে এই স্থানান্তরের গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে যা আমি চেষ্টারটনের মাধ্যমে কিছুটা দেখিয়েছি। এই কারণেই তাঁর জন্যে আরও বেশি জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে – যা ছিল অধিকতর অশ্লীল, অধিকতর নির্বুদ্ধিতা, অধিকতর ভয়ংকর এবং অধিকতর অসাধুতা। নিজ দেশ বা নিজ ইউনিটে - যে বিষয়ে নাকি তাঁর বাস্তব জ্ঞান আছে – তার পক্ষে তিনি কখনোই এমন লিখতে পারতেন না। যখন কেউ দেখে কোন বুদ্ধিমান ও সংবেদনশীল লোক স্টালিন, রেড আর্মি ইত্যাদি বিষয়ে আবর্জনা লিখছেন তখনই সে বুঝে ফেলে যে, কোন এক জায়গায় গড়বড় হওয়ার কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে। আমাদের মতো সমাজে, বুদ্ধিজীবী হিসেবে বর্ণিত ব্যক্তির পক্ষে নিজ দেশের প্রতি গভীর আসক্তি অনুভব করা অস্বাভাবিক। জনমত - মানে, জনমতের যে অংশ সম্পর্কে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সচেতন - তাঁকে সেটা করতে অনুমতি দিবে না। তাঁর চারপাশের অধিকাংশ লোকই সন্দেহ-প্রবণ ও অসন্তুষ্ট; তাদের দেখাদেখি কিংবা নিছক কাপুরুষতা থেকে তিনিও একই মনোভাব গ্রহণ করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে তিনি হাতের নাগালে থাকা জাতীয়তাবাদকে পরিত্যাগ করেন, কিন্তু সত্যিকারের আন্তর্জাতিকতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংস্পর্শেও আসতে পারেন না। তখনো তাঁর একটা পিতৃভূমির প্রয়োজন, এবং বিদেশের দিকে তাকানো তাঁর জন্যে খুবই স্বাভাবিক। এটা পাওয়ার পরই, তিনি অবাধে ঐসব আবেগে ডুবে যেতে থাকেন যা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন বলে বিশ্বাস করেন। ঈশ্বর, সম্রাট, সাম্রাজ্য, ইউনিয়ন জ্যাক - বাতিলকৃত সব মূর্তিরা ভিন্ন ভিন্ন নামে পুনরায় আবির্ভূত হতে পারে। এবং, যেহেতু তাদেরকে চেনা যায় না, বিবেকসম্পন্নদের দ্বারাও তারা পূজিত হন। স্থানান্তরিত জাতীয়তাবাদ তাই নিজের আচরণ পরিবর্তন না করেও পরিত্রাণ পাওয়ার একটা উপায়।
বাস্তবতার প্রতি উদাসীনতা। প্রত্যেক জাতীয়তাবাদীরই সদৃশ ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য দেখতে না পাওয়ার ক্ষমতা আছে। একটা ব্রিটিশ রাজনৈতিক দল ইউরোপে আত্মনিয়ন্ত্রণকে রক্ষা করবে, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে কোন ধরণের অসঙ্গতি বোধ ছাড়াই সে এর বিরোধিতা করবে। কাজ ভালো হলো নাকি মন্দ হলো, সেটা কাজের উপর নির্ভর করে না, বরং সেটা নির্ভর করবে কে কার সাথে সেটা করছে। এবং, এমন কোন ধরণের নির্যাতন নাই যার নৈতিক রঙ বদলায় নি যখন সেটা ‘আমাদের’ দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে। Liberal News Chronicle জঘন্য বর্বরতার উদাহরণস্বরূপ জার্মান দ্বারা রাশিয়ানদের ফাঁসি দেয়ার ছবি প্রকাশ করেছিল। এর ঠিক এক বা দুই বছর পরে একই ধরণের ছবি- রাশিয়ান দ্বারা জার্মানদের ফাঁসির ছবি উষ্ণ অনুমোদন দিয়েই প্রকাশ করেছিল। ঐতিহাসিক ঘটনার ক্ষেত্রেও এই বিষয় সমান। ইতিহাসকে প্রধানত জাতীয়তাবাদীর দৃষ্টিতেই চিন্তা করা হয়, এবং, স্টার চেম্বারের নির্যাতন, ইংরেজ দস্যুদের শোষণ, রেইন অব টেরর, সিপাহী বিদ্রোহের নায়কদের বন্দুক দিয়ে শত শত ভারতীয়দের উড়িয়ে দেয়া অথবা ক্রমওয়েলের সৈন্যদের ক্ষুর দিয়ে আইরিশ নারীদের মুখ কেটে দেয়া সহ সকল ঘটনাই নৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ, এমনকি প্রশংসনীয় হয়ে যায় যখন এটা অনুভূত হয় যে এগুলো ‘সঠিক’ কারণে সম্পন্ন হয়েছে। কেউ যদি এই শতকের গত সিকি ভাগের দিকেও তাকায়, তাহলে দেখতে পাবে এমন কোন বছর নাই যেখানে পৃথিবীর কিছু অংশ থেকে নৃশংসতার গল্প আসে নাই। এবং এখন পর্যন্ত, এমন কোন ঘটনা নাই - স্পেন, রাশিয়া, চীন, হাঙ্গেরী, মেক্সিকো, অমৃতসর, স্মূর্ণা যেখানেই হোক না কেন - যে ঘটনা পুরো ইংরেজ বুদ্ধিজীবী সমাজ বিশ্বাস করেছে অথবা অস্বীকার করেছে। এই ঘটনাগুলো নিন্দনীয় ছিল কি না, বা এমনকি এই ঘটনাগুলো আদৌ ঘটেছিল কি না তা সিদ্ধান্ত নেয়া হত রাজনৈতিক পক্ষপাত থেকে।
জাতীয়তাবাদীরা শুধুমাত্র নিজেদের নৃশংসতাকে অস্বীকারই করে না, বরং, এগুলো শুনতে না পারার মত একটা দারুণ ক্ষমতাও আছে। ছয় বছর যাবত হিটলারের ইংরেজ সমর্থকরা ড্যাচাউ এবং বুচেনওয়াল্ডের অস্তিত্ব সম্পর্কে না জানার মতলব করেছিলেন। এবং যারা জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের জোরালো সমালোচনা করছিলেন, তারা প্রায়শই অজ্ঞাত ছিলেন, অথবা এমনকি খুব অল্প পরিমাণে জ্ঞাত ছিলেন যে রাশিয়াতেও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আছে। ১৯৩৩ সালের ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুও ইংরেজ রুশোফিলদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। বর্তমান যুদ্ধের সময় জার্মান ও পোলিশ ইহুদিদের ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনা অনেক ইংরেজই জানতেন না। তাঁদের ইহুদিবিদ্বেষ এত বড় অপরাধকেও তাঁদের চেতনার আড়াল করে রেখে দিয়েছিল। জাতীয়তাবাদীর চিন্তায় এমন কিছু ঘটনা আছে যেগুলো যেমন সত্য তেমনি অসত্য, যেমন জানা তেমনি অজানা। একটা জানা ঘটনা হয়তোবা এতই অসহনীয় হতে পারে যে অভ্যাসবশতই এই ঘটনাকে দূরে সরিয়ে রাখা হবে এবং আমাদের যুক্তির প্রক্রিয়াতেই ঢুকতে দেয়া হবে না। আবার অন্যদিকে, এই ঘটনা যদি প্রতিটা হিসেব নিকেশেও ঢুকে পড়ে তবু একে সত্য বলে স্বীকার করা হবে না, এমনি নিজের মনের কাছেও।
প্রত্যেক জাতীয়তাবাদী এই বিশ্বাস দ্বারা চালিত হয়ে থাকেন যে, অতীত বদলানো যায়। সময়ের একটা অংশ সে কল্পনার জগতেই কাটায় যেখানে ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটা উচিৎ সেভাবেই ঘটে - যেমন, স্প্যানিশ আরমাডা সফল হয়েছে বা ১৯১৮ সালে রুশ বিপ্লব ধসে পড়েছে - এবং তাঁর এই কল্পনা জগতের অংশবিশেষ যখনই সম্ভব হয় সে ইতিহাসের বইয়ে ঢুকিয়ে দেয়। আমাদের সময়ের অধিকাংশ প্রোপ্যাগান্ডামূলক লেখা স্রেফ জালিয়াতি। বস্তুগত তথ্যগুলোকে গোপন করা হয়েছে, তারিখ বদলে দেয়া হয়েছে, উদ্ধৃতিসমূহ প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে অর্থই বদলে গিয়েছে। যে ঘটনাগুলো মনে হয়েছে ঘটা ঠিক হয় নাই, সেই ঘটনাগুলো অনুল্লিখিত রয়ে যায় এবং পরিশেষে অস্বীকারই করা হয়। ১৯২৭ সালে চিয়াং কাই শেক হাজার হাজার কমিউনিস্টদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারলেন, অথচ, ১০ বছরের মধ্যেই তিনি বামদের অন্যতম নায়ক হয়ে গেলেন। বৈশ্বিক রাজনীতির পটপরিবর্তন তাকে অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট দলভুক্ত করে দেয়, এবং তখন এমন ভাব দেখানো হয় যে, কমিউনিস্টদের পুড়িয়ে মারা ‘গণনার’ বিষয় না, বা এমন কিছুই আসলে ঘটে নাই। প্রোপাগান্ডার প্রাথমিক ব্যবহার অবশ্যই সমকালীন মতামতকে প্রভাবিত করা, তবু যারা ইতিহাসের পুনর্লিখন করে তাদের মনের একাংশ সম্ভবত বিশ্বাসও করে যে, ঘটনাগুলোকে তারা অতীতে জোর করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ট্রটস্কি রুশ বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন নাই এটা দেখানোর জন্যে যত মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়েছে সেগুলোকে আমলে নিলে বিশ্বাস করা কঠিন যে, দায়ী ব্যক্তিরা আসলে স্রেফ মিথ্যে কথা বলছেন। তারা খুব সম্ভবত বিশ্বাস করে যে, এই ঘটনাগুলো (মানে ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব সংস্করণ) ঈশ্বরের সামনে ঘটেছিল, এবং সেই অনুসারে এর পুনর্বিন্যাস করাটাও ন্যায্য।
দুনিয়ার একাংশ থেকে আরেক অংশের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে নিরপেক্ষ সত্যের প্রতি উদাসীনতাকে উৎসাহ দেয়া হয় । আসলেই কি ঘটছে তা জানা তখন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায়। বড় বড় ঘটনার বিষয়ে প্রায়শই অকৃত্রিম সন্দেহ থাকতে পারে। যেমন, বর্তমান যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা হিসেব করা অসম্ভব ব্যাপার। যে দুর্যোগের সংবাদ বারে বারে প্রকাশিত হচ্ছে - যেমন, যুদ্ধ, হত্যাযজ্ঞ, দুর্ভিক্ষ, বিপ্লব - সেগুলোকে যে কোন সাধারণ লোকের কাছে অবাস্তব মনে হতে পারে। এই ঘটনাগুলোর সত্যতা যাচাই করার কোন উপায় নাই, কেউই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না যে এটা আসলেই ঘটেছে। এবং তাদের কাছে ঘটনাগুলোকে বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন ব্যাখ্যায় হাজির করা হচ্ছে। ১৯৪৪ সালের ওয়ারসোর উত্থানের কি কি ভুল ছিল এবং কি কি ঠিক ছিল? পোল্যান্ডে জার্মানদের গ্যাস চেম্বারের ঘটনা কি সত্যি? বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্যে আসলেই কে দায়ী? সম্ভবত সত্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব, কিন্তু পত্রিকাগুলো এমন অসৎভাবে ঘটনাকে উপস্থাপন করবে যে, মিথ্যে সংবাদ গিলে ফেলার জন্যে বা কোন মতামত গড়তে ব্যর্থ হওয়ার জন্যে পাঠককে ক্ষমা করা যেতে পারে। আসলেই কি ঘটছে এই অনিশ্চয়তাই তাকে এমন উন্মাদ বিশ্বাসের সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করে। যেহেতু কোন কিছুই পুরোপুরি প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত নয়, সেহেতু সবচেয়ে সন্দেহাতীত ঘটনাকেও নির্লজ্জ ভাবে অস্বীকার করা যেতে পারে। তাছাড়া, যদিও ক্ষমতা, জয়, পরাজয়, প্রতিশোধ এসব নিয়েই তার সীমাহীন চিন্তা, তবু জাতীয়তাবাদীরা প্রায়শই বাস্তব জগতে কি ঘটছে তার প্রতি খানিক উদাসীন থাকেন। তিনি মনে করতে চান যে, অন্য কোন পক্ষের তুলনায় দিনদিন তার পক্ষের উন্নতি হচ্ছে। এবং, প্রকৃত অবস্থা তাকে সমর্থন করছে কি না তা পরীক্ষা করার চেয়ে প্রতিপক্ষকে অপসারণ করে দিয়ে বরং তিনি এটা আরও সহজেই করতে পারেন। সকল জাতীয়তাবাদী বিতর্কই ‘বিতর্ক-ক্লাব’ স্তরের। এটা সবসময় সম্পূর্ণরূপে নিষ্পত্তিহীন, কেননা, প্রত্যেক প্রতিযোগী সবসময় বিশ্বাস করে যে সে যুদ্ধে জিতেছে। কিছু কিছু জাতীয়তাবাদীর অবস্থা ‘সিজোফ্রেনিয়া’র থেকে বেশি দূরে না; যুদ্ধ ও বিজয়ের স্বপ্ন চোখে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন, যার সাথে বাস্তব জগতের কোন সংযোগ নাই।
যেসব মানসিক অভ্যাস সবধরনের জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় সেগুলোকে আমি সতর্কভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছি। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে এই ধরণগুলোকে শ্রেণীকরণ করা, কিন্তু অবশ্য এটা ব্যাপকভাবে করা যাবে না। জাতীয়তাবাদ একটা বিশদ বিষয়। পুরো পৃথিবী অসংখ্য প্রতারণা ও ঘৃণার শিকার হচ্ছে যা একে অপরকে খুব জটিল উপায়ে আড়াআড়ি করে ভাগ করে ফেলছে। এবং, এর মধ্যে কিছু প্রচণ্ড ক্ষতিকারক ঘটনা এখনো ইউরোপিয়ান চেতনাকে আহত করতে পারে নি। এই প্রবন্ধে আমি মূলত জাতীয়তাবাদ নিয়ে চিন্তিত, যেহেতু ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের মাঝে এটাই দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে - সাধারণ জনগণের তুলনায় বরং অনেক বেশী - এই জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম অবিমিশ্রিত অবস্থায় আছে। এবং তাদের মাঝেই এর আসল রূপটা পড়া সম্ভব। যে সকল জাতীয়তাবাদের ধরণ বর্তমান ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে নিম্নে তার একটা তালিকা দেয়া হলো, প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু মন্তব্য সহ। তিনটা শিরোনাম ব্যবহার করাই সুবিধাজনক; ইতিবাচক (positive), রূপান্তরিত, এবং নেতিবাচক (negative), যদিও কিছু কিছু ধরণ একাধিক বর্গের সাথে খাপ খাইতে পারে।
ইতিবাচক জাতীয়তাবাদ (Positive Nationalism)
১) নব্য রক্ষনশীলতাবাদ: উদাহরণস্বরূপ বলা যায় লর্ড এল্টন, এ পি হারবার্ট, জি এম ইয়ুং, প্রফেসর পিকথর্ন, সংরক্ষনশীলদের সংস্কার কমিটির সাহিত্য, এবং নিউ ইংলিশ রিভিউ ও নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি এন্ড আফটার নামক ম্যাগাজিনের কথা। নব্য রক্ষনশীলতাবাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল এটা অস্বীকার করা যে, ব্রিটিশ ক্ষমতা ও প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। এই চাওয়াটাই তাদেরকে জাতীয়তাবাদী চরিত্র দিয়েছিল এবং প্রথাগত রক্ষণশীলদের থেকে আলাদা করেছিল। এমনকি, ব্রিটেনের সামরিক অবস্থান যে আগের মতো না, এটা দেখার মতো যারা যথেষ্ট বাস্তববাদী ছিলেন তারাও দাবি করতেন যে ‘ইংলিশ আইডিয়া’ (সাধারণত এটা অসংজ্ঞায়িত) অবশ্যই পৃথিবীকে শাসক করবে। সকল নব্য রক্ষনশীলরা রাশিয়া-বিরোধী, কিন্তু মাঝেমধ্যে ‘আমেরিকা-বিরোধী’তাই প্রধান হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই চিন্তাধারার স্কুলগুলো অল্পবয়সী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই ভিত্তি লাভ করছে। কখনো কখনো প্রাক্তন-কমিউনিস্টদের মধ্যেও, যারা মোহমুক্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে মোহ থেকে মুক্ত হয়েছেন। একজন এংলোফোবিয়ানের হঠাত করেই কঠোর ব্রিটিশ-সমর্থক হয়ে উঠা খুবই সাধারণ দৃশ্য। যে সকল লেখক এই প্রবণতা দেখিয়েছেন তারা হচ্ছেন এফ এ ভয়েগট, ম্যালকল্ম মাগেরিজ, এভেলিন ভগ, কিংসমিল। একই ধরণের মানসিক বিকাশ লক্ষ্য করা যায় টি এস এলিয়ট, উইন্ডাম লুইস এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে।
২) সেল্টিক জাতীয়তাবাদ: ওয়েলশ, আইরিশ এবং স্কটিশ জাতীয়তাবাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে কিন্তু তাদের ইংরেজ- বিরোধী ঝোঁক একই রকম। এই তিন আন্দোলনের সদস্যরাই নিজেদেরকে রাশিয়ার সমর্থক বর্ণনা করে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এই উন্মাদ প্রত্যয়ের কারণে তারা একাধারে রাশিয়ার-সমর্থক এবং নাৎসি-সমর্থক হতে পেরেছিল। কিন্তু সেল্টিক জাতীয়তাবাদ এবং এংলোফোবিয়া একই জিনিস নয়। এর প্রেরণা শক্তি সেলটিক জনগণের অতীত এবং ভবিষ্যতের মহিমাতে বিশ্বাস করে। এবং এটাতে বর্ণবাদের কড়া আমেজ আছে। সেল্টকে স্যাক্সন থেকে আধ্যাত্মিকভাবে উচ্চতর বলে মনে করা হয় - সরল, বেশী সৃজনশীল, কম অশ্লীল, কম উন্নাসিক ইত্যাদি - কিন্তু উপরিতলের নীচেই লুকিয়ে থাকে ক্ষমতার প্রতি স্বাভাবিক ক্ষুধা। এর একটি উপসর্গ হল এই বিভ্রম যে, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড বা এমনকি ওয়েলসও কোন সহায়তা ছাড়াই নাকি তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে এবং সুরক্ষার জন্যে ব্রিটিশের কোন দরকার নাই । লেখকদের মধ্যে, এই চিন্তাধারার স্কুলগুলির ভালো উদাহরণ হলেন হিউ ম্যাকডিরমিড এবং শন ওসেসি। কোন আধুনিক আইরিশ লেখকই, এমনকি ইয়েটস বা জোয়েসের মতো খ্যাতিমানরাও, জাতীয়তাবাদের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেন নি।
৩) জায়নবাদ: এটি একটি অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তবে এর আমেরিকান রূপটি ব্রিটিশ রূপের তুলনায় বেশি সহিংস এবং মারাত্মক বলে মনে হয়। আমি এটাকে স্থানান্তরিত জাতীয়তাবাদে শ্রেণিবদ্ধ না করে এখানেই শ্রেণিবদ্ধ করি কারণ ইহা কেবলমাত্র ইহুদীদের মধ্যেই বেড়ে উঠে। বেশ কিছু অসঙ্গত কারণেই প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ ইহুদী-সমর্থক, কিন্তু তারা এটাকে দৃঢ়ভাবে অনুভব করেন না। নাৎসি নির্যাতনের কারণে সকল দয়ালু ইংরেজই ইহুদী-সমর্থক। কিন্তু প্রকৃত জাতীয়তাবাদী আনুগত্য, কিংবা ইহুদিদের সহজাত শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস, অ-ইহুদীদের মধ্যে পাওয়া যায় না।
স্থানান্তরিত জাতীয়তাবাদ (Transferred nationalism)
১) সাম্যবাদ
২) রাজনৈতিক ক্যাথলিকবাদ
৩) রঙ অনুভূতি: নেটিভদের প্রতি সনাতনী অবজ্ঞাসূচক মনোভাব ইংল্যান্ডে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, এবং সাদা বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বকে জোর দেয়া বিভিন্ন ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোও পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে, রঙ অনুভূতি কেবলমাত্র পক্ষান্তরিত (transposed) আকারেই ঘটে, অর্থাৎ, রঙিন বর্ণের সহজাত শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যে বিশ্বাস হিসেবে। এটি বর্তমানে ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বেড়েই চলছে, ওরিয়েন্টাল এবং নিগ্রো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে যোগাযোগের তুলনায় মর্ষকামী এবং যৌন হতাশার কারণেই সম্ভবত এটা বেশি ঘটছে। এমনকি যারা রঙ প্রশ্ন দৃঢ়ভাবে অনুভব করেন না, তাদের মধ্যেও দেমাক ও অনুকরণের একটি শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। সাদা বর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব দাবির জন্যে যে কোন বুদ্ধিজীবীরই মানহানি ঘটবে, পক্ষান্তরে বিপরীত দাবীকে তার কাছে সন্দেহাতীত বলে মনে হয় এমনকি তিনি এর সাথে অসম্মতি প্রদান করলেও। রঙিন জাতিগুলির প্রতি এই জাতীয়তাবাদী সংযুক্তির সাথে সাধারণত এই বিশ্বাস মিশে আছে যে, তাদের যৌন জীবন শ্রেষ্ঠ। এবং নিগ্রোদের যৌন প্রতাপ বিষয়ে প্রচুর পৌরাণিক কাহিনীও প্রচলিত আছে।
৪) শ্রেণি অনুভূতি: এই অনুভূতি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শুধুমাত্র পক্ষান্তরিত (transposed) আকারেই থাকে, মানে সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস হিসাবে। এখানে আবার বুদ্ধিজীবীদের ভিতরে জনমতের চাপ অত্যধিক। সর্বহারা শ্রেণীর প্রতি জাতীয়তাবাদী আনুগত্য এবং বুর্জোয়াদের সর্বাধিক বিদ্বেষপূর্ণ তাত্ত্বিক ঘৃণা দুটোর অবস্থানই দৈনন্দিনে জীবনে পাশাপাশি থাকতে পারে।
৫) শান্তিবাদ: সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিবাদীরা কোন অখ্যাত ধর্মীয় গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত থাকেন অথবা তারা স্রেফ মানবতাবাদী যারা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেন এবং এর বাইরে তাদের চিন্তার অনুসরণ পছন্দ করেন না। কিন্তু বুদ্ধিজীবী শান্তিবাদীদের একটা একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে যাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, যদিও অনুল্লেখিত, পশ্চিমা গণতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা এবং একনায়কতন্ত্রের প্রশংসা করা। শান্তিবাদী প্রচারণা সাধারণত বলে থাকে যে, এক দল আরেক দলের মতই খারাপ, কিন্তু যদি কেউ অল্পবয়সী শান্তিবাদী বুদ্ধিজীবীদের লেখাগুলি মনোযোগ দিয়ে দেখেন, তবে খুঁজে পাবেন যে তারা কোন উপায়েই নিরপেক্ষভাবে অসমর্থন প্রকাশ করে না, বরং প্রায় সম্পূর্ণ ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। তাছাড়া তারা যেমন রীতি হিসেবে এই সহিংসতার নিন্দা করে না, বরং পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সহিংসতার ব্যবহারকেই এরা নিন্দা করে। যুদ্ধকালীন সময়ে রাশিয়ান প্রতিরোধের, ব্রিটিশদের মতো করে, নিন্দা করা হয় না। এমনকি এ ধরণের সকল শান্তিবাদী প্রোপ্যাগান্ডা রাশিয়া ও চীনের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকে। আবার এটাও দাবি করা হয় না যে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ভারতীয়দের সহিংসতা পরিত্যাগ করা উচিত। শান্তিবাদী সাহিত্য যেসকল সন্দিগ্ধ মন্তব্যে ভরপুর – যদি এগুলো কিছু বুঝাতে চায় - বুঝিয়ে থাকে যে চার্চিলের চাইতে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে হিটলারই অধিক গ্রহণযোগ্য এবং এই সহিংসতা সম্ভবত মার্জনীয় যদি সেটা পর্যাপ্ত সহিংস হয়। ফ্রান্সের পতনের পর বেশিরভাগ ফরাসি শান্তিবাদীরা, আসল নির্বাচনের মুখোমুখি হয়ে যা তাদের ইংলিশ সহকর্মীদের করতে হয়নি, নাৎসিদের পক্ষে চলে যায় এবং ইংল্যান্ডে পিস প্লেজ ইউনিয়ন এবং ব্ল্যাকশার্টের সদস্যদের মধ্যে ছোটখাটো জড়াজড়ি হয়েছিল। শান্তিবাদী লেখকরা কার্লাইলের গুণকীর্তন করেই লিখেন, যিনি কিনা ফ্যাসিবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জনকদের মধ্যে অন্যতম। সবশেষে এটা অনুভব করা কঠিন নয় যে শান্তিবাদ – যেহেতু বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশের মধ্যেই এটা প্রতীয়মান হয় – গোপনে ক্ষমতা এবং সফল নিষ্ঠুরতার প্রশংসা করে অনুপ্রাণিত হয়। হিটলারের সাথে এই আবেগকে জড়িয়ে ভুলটা করা হয়েছিল, কিন্তু এটা সহজেই পুনরায় স্থানান্তরিত হতে পারে।
নেতিবাচক জাতীয়তাবাদ (Negative nationalism)
১) এংলোফবিয়া: বুদ্ধিজীবীগণের মধ্যে ব্রিটেনের প্রতি হাস্যরসাত্মক এবং মৃদু শত্রুতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কমবেশি বাধ্যতামূলক। তবে এটি অনেকক্ষেত্রে একটি অকৃত্রিম আবেগ। যুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবীদের পরাজিত মনোভাবের মধ্যেই এটি অভিব্যক্ত হয়েছিল। অক্ষ শক্তি জিততে পারবে না এটা পরিষ্কার হওয়ার পরেও এই মনোভাব টিকে ছিল। সিঙ্গাপুরের পতন হলে বা ব্রিটিশরা গ্রীস থেকে বিতাড়িত হলে অনেকেই নির্লজ্জভাবে সন্তুষ্ট হন। এবং সুসংবাদে বিশ্বাস করার উল্লেখযোগ্য অনিচ্ছাও দেখা যায়, যেমন, এল আলামিন, বা ব্রিটেন যুদ্ধে কতগুলো জার্মান বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে। ইংরেজ বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা অবশ্যই চাননি যে জার্মান বা জাপানিরা যুদ্ধে জয়ী হোক, তবে তাদের অনেকেই তাদের নিজের দেশকে অপমানিত হতে দেখে এক ধরণের আমোদও পেয়েছিলেন। তারা চাইতেন যে, চূড়ান্ত বিজয় রাশিয়া অথবা আমেরিকার কল্যাণেই আসবে, এবং ব্রিটেনের জন্যে নয়। বৈদেশিক রাজনীতি বিষয়ে অনেক বুদ্ধিজীবী এই নীতি অনুসরণ করেন যে, ব্রিটেনের মদদপ্রাপ্ত যে কোনও দল অবশ্যই ভুল করবে। ফলস্বরূপ, 'আলোকিত' মতামত মূলত রক্ষণশীল নীতিরই একটি প্রতিচ্ছবি। এংলোফবিয়া সবসময় পরিবর্তন হতে বাধ্য, তাই মোটামুটি সাধারণ দৃশ্য হচ্ছে, এক যুদ্ধে যিনি শান্তিবাদী পরবর্তী যুদ্ধে তিনি হয়ে যান bellicist বা শান্তিবাদ-বিরোধী।
২) এন্টি সেমিটিজম: এই ব্যাপারে প্রমাণ খুব কম আছে, কেননা নাৎসি নির্যাতন যে কোন চিন্তাশীল মানুষের জন্যে ইহুদিদের পক্ষে তাদের অত্যাচারকারীদের বিরুদ্ধে থাকাটা প্রয়োজনীয় করে তুলেছেন। 'এনটিসেমিটিজম' শব্দ শুনেছেন এমন যে কোন শিক্ষিত লোকই দাবি করবেন যে এর মুক্ত আমাদের হতেই হবে, এবং ইহুদি বিদ্বেষী মন্তব্য আমাদের সকল শ্রেণির সাহিত্য থেকেও সতর্কভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এন্টিসেমেটিজম ব্যাপক বলেই মনে হচ্ছে , এমনকি বুদ্ধিজীবী মধ্যেও, এবং নীরবতার সাধারণ ষড়যন্ত্র সম্ভবত এটাকে বাড়তে সাহায্য করছে। বামঘরণার লোকেরাও এর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না, এবং তাদের মনোভাব কখনও কখনও এই তথ্য দ্বারা আক্রান্ত যে, ট্রটস্কিপন্থীরা এবং এনার্কিস্টরা সাধারণত ইহুদি হয়। কিন্তু এন্টিসেমেটিজম রক্ষণশীল প্রবণতার লোকদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই আসে, যারা জাতীয় মনোবলকে দুর্বল এবং জাতীয় সংস্কৃতিকে নমনীয় করে তোলার জন্যে ইহুদিদের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ে দেন। Neo-Tories এবং রাজনৈতিক ক্যাথলিকরা সবসময় এন্টিসেমিটিজমপ্রবণ, অন্তত থেমে থেমে হলেও।
৩) ট্রটস্কিবাদ: এই শব্দটা শিথিলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যেন এনার্কিস্ট, ডেমোক্রেটিক সোশিয়ালিস্ট এবং এমনকি লিবারেলদেরও অন্তর্ভুক্ত করে। আমি এমন একটা মার্ক্সবাদী মতবাদের কথা বুঝাতে এটা ব্যবহার করছি যাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্ট্যালিন আমলের বিরোধিতা করা। ট্রটস্কির নিজের কাজের চেয়ে বিভিন্ন প্যামফ্লেট বা Socialist Appeal এর মতো পত্রিকা দিয়ে ট্রটস্কিবাদ ভালো করে বুঝা যাবে; তিনি তো আর এক আইডিয়ার লোক ছিলেন না। যদিও বিভিন্ন জায়গায়, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে, ট্রটস্কিবাদ বেশ বড় সংখ্যক অনুগামীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের নিজস্ব ছোটখাটো নেতাদের (fuerher) সাথে একটি সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়েছে। এর অনুপ্রেরণা মূলত নেতিবাচক। ট্রটস্কিপন্থীরা স্টালিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, ঠিক যেমন কমিউনিস্টরা তার পক্ষে, এবং অধিকাংশ কমিউনিস্টদের মতোই তিনি বহির্বিশ্বের পরিবর্তন করতে খুব একটা বেশি আগ্রহী নয় যতটা এই ধারণা পোষণ করতে আগ্রহী যে প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার এই যুদ্ধ নিজের অনুকূলেই যাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোন একটি একক বিষয়ের ওপর সেই সমান আবেগপূর্ণ নিশ্চলতা, সম্ভাব্যতার উপর নির্ভর করে খাঁটি যৌক্তিক মতামত তৈরিতে সেই সমান অক্ষমতা। বাস্তবতা হচ্ছে, ট্রটস্কিপন্থিরা সবজায়গাতেই নির্যাতিত সংখ্যালঘু, এবং তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয় - যেমন, ফ্যাসিস্টদের সাথে আঁতাত, স্পষ্টত মিথ্যা - সেটা এই ধারণা তৈরি করে যে, ট্রটস্কিবাদ বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিকভাবে সাম্যবাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; কিন্তু এদের মধ্যে আসলেই বড় কোন তফাৎ আছে কি না সন্দেহ। সবচেয়ে আদর্শ ট্রটস্কিপন্থি, যে কোন ক্ষেত্রে, একজন প্রাক্তন কমিউনিস্ট। এবং, কেউই কোন না কোন বাম-ধারার আন্দোলন ছাড়া ট্রটস্কিবাদে যোগ দেয় না। কোন কমিউনিস্টই - যদি না বছরের পর বছরের অভ্যাসের কারণে পার্টির প্রতি আবদ্ধ হন - ট্রটস্কিবাদে আকস্মিক বিচ্যুতি থেকে নিরাপদ না। বিপরীত প্রক্রিয়াটি সাধারণত সমানভাবে ঘটে না, যদিও এটা কেন ঘটে না এর কোন পরিষ্কার কারণ নেই।
উপরোক্ত শ্রেণীকরণে আমি প্রায়শই অতিরঞ্জিত, অতি সরলীকৃত, অনাকাঙ্ক্ষিত অনুমান তৈরি করেছি এবং সচরাচর শালীন উদ্দেশ্যের অস্তিত্বকে হিসেবের বাইরে রেখেছি। এটি অনিবার্য ছিল, কারণ এই প্রবন্ধে আমি এমন প্রবণতাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ও সনাক্তকরণের চেষ্টা করছি যেগুলো আমাদের সকলের মনে অস্তিত্বশীল এবং আমাদের চিন্তাভাবনাকে বিকৃত করে তোলে। যদিও এগুলো নিখুঁত অবস্থায় এবং ক্রমাগতভাবে সক্রিয় থাকা জরুরী না। এই মুহূর্তে অতি সরলীকৃত ছবিগুলো সনাক্ত করা জরুরি । শুরুতে বলি, সকলেই, অথবা এমনকি প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীই জাতীয়তাবাদ দ্বারা সংক্রামিত এটা অনুমান করে নেয়ার কোন কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদ সবিরাম এবং সীমিত হতে পারে। একজন বুদ্ধিমান মানুষ এমন বিশ্বাসে অর্ধ-নিমজ্জিত হতে পারেন যেটা অযৌক্তিক তিনি জানেন, এবং তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্য তার মন থেকে সেটা দূরে রাখতে পারেন, কেবল রাগের মুহূর্তে বা কোন ভাবালুতায় আক্রান্ত হয়ে অথবা যখন তিনি নিশ্চিত হন যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা জড়িত নেই, তখন সে বিশ্বাসের দিকে ফিরে যেতে পারেন। তৃতীয়ত, জাতীয়তাবাদী মতবাদকে অ-জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্য থেকে সৎ বিশ্বাসে গৃহীত হতে পারে। চতুর্থত, বিভিন্ন ধরণের জাতীয়তাবাদ, এমনকি যেগুলো বাদ দেয়া হয়েছে, একই ব্যক্তির মধ্যে পাশাপাশি থাকতে পারে।
পুরো আলোচনা জুড়ে আমি বলেছি, ‘জাতীয়তাবাদী এটা করেছে’ বা ‘জাতীয়তাবাদী ঐটা করেছে’। এটা করেছি চরমপন্থি ও অপ্রকৃতিস্থ ধরণের জাতীয়তাবাদী, যাদের মনে কোন নিরপেক্ষ জায়গা নেই এবং ক্ষমতার দ্বন্ধ ছাড়া আর কোন কিছুরই প্রতি যাদের আগ্রহ নেই তাদের উদাহরণ তুলে ধরার জন্যেই। আসলে এ ধরনের মানুষ মোটামুটি সর্বত্রই পাওয়া যায়, কিন্তু তারা আলোচনার যোগ্য নয়। বাস্তবে লর্ড এলটন, ডি এন প্রিট, লেডি হিউস্টন, এজ্রা পাউন্ড, লর্ড ভ্যানস্টার্ট, ফাদার কাফলিন এবং তাদের বাদ বাকি সকল বিষণ্ণ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়তে হবে, কিন্তু তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ঘাটতিগুলির দিকে ইঙ্গিত করার খুব একটা দরকার নেই। মনোমানিয়া (একটিমাত্র বিষয় বা ভাবের উপর একাগ্র মনোনিবেশজনিত মানসিক অবস্থা, যা কখনো কখনো পাগলামিতে পর্যবসিত হয় - অনুবাদক) আকর্ষণীয় কিছু নয়, এবং কোন গোঁড়া জাতীয়তাবাদীই এমন কোন বই লিখতে পারে না যা কয়েক বছর পর আর পড়ার যোগ্য থাকে - এই সত্যেরও একটা দুর্গন্ধনাশক প্রভাব আছে। কিন্তু যখন কেউ স্বীকার করে নিচ্ছে যে জাতীয়তাবাদ সবখানে জয়ী হতে পারে নি, এবং এখনো কিছু মানুষ আছে যাদের বিচারবুদ্ধি তাদের ইচ্ছার অধীন নয়, তখন গুরুতর সমস্যাগুলো - ভারত, পোল্যান্ড, ফিলিস্তিন, স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ, মস্কো বিচার, আমেরিকান নিগ্রো, রুশো-জার্মান চুক্তি বা যা যা আছে – একটা যৌক্তিক পর্যায়ে আলোচনা করা যায় না বা কখনোই আলোচনা করা হয় না। এল্টন, প্রিট এবং কাফলিন[10] যারা একই মিথ্যা বারবার চিৎকার করে বলছেন তারা অবশ্যই চরমপন্থি, কিন্তু আমরা নিজেরদেরকেই প্রতারণা করবো যদি উপলব্ধি করতে না পারি যে অসতর্ক মুহূর্তে এদের সবাইকে এক লাইনেই দাড় করানো যাবে। নির্দিষ্ট কোনও সুর বেজে উঠুক, এর ওর আঁতে একটু ঘা লাগুক- যে ঘা’র অস্তিত্ব এযাবতকাল পর্যন্ত টের পাওয়া যায়নি- সবচেয়ে ভালো মনের এবং মিষ্টস্বভাবের মানুষও হঠাৎ করেই দুশ্চরিত্রের দলদাসে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারেন, প্রতিপক্ষকে সমুচিত জবাব দিতে অধীর হয়ে ওঠেন, তা করতে গিয়ে কতগুলো মিথ্যা তাকে বলতে হচ্ছে এবং কতগুলো যৌক্তিক ত্রুটি করতে হচ্ছে সে ব্যাপারে তিনি উদাসীন থেকে যান। লুইড জর্জ, যিনি বোয়্যার যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন, যখন হাউস অফ কমন্সে ঘোষণা করেছিলেন যে ব্রিটিশ প্রজ্ঞাপনগুলো, যদি কেউ এসব একত্রিত করে, পুরো বোয়ার জাতির চেয়ে বেশি বোয়ার হত্যার দাবি করেছিল, তখন এটি রেকর্ড করা হয় যে আর্থার বেলফুর দাঁড়িয়ে ‘ইতর’ বলে চেঁচিয়ে উঠেন। খুব কম লোকই এ ধরণের ভুলের প্রতিরোধক্ষম। একজন নিগ্রো যিনি সাদা নারী কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছেন, একজন ইংরেজে যিনি আমেরিকা কর্তৃক ইংল্যান্ডের অন্ধ সমালোচনা শুনেছেন, স্প্যানিশ আরমাডা স্মরণ স্মরণ করা একজন ক্যাথলিক সমর্থক – সকলেই একইভাবে প্রতিক্রিয়া করবেন। জাতীয়তাবাদী মনে একটু খোঁচা লাগুক, বুদ্ধিবৃত্তিক ভদ্রতাও উবে যেতে পারে, অতীত বদলে যেতে পারে, এবং সরলতম ঘটনাগুলোও অস্বীকার করা যেতে পারে।
যদি কেউ নিজের মনের কোথাও কোন জাতীয়তাবাদী আনুগত্য বা ঘৃণা পুষে রাখে, তবে কিছু কিছু সত্য - যেগুলো সত্য বলেই জানা যায় – তার দ্বারা মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। এখানে কয়েকটা উদাহরণ দিব। পাঁচ ধরণের জাতীয়তাবাদীর তালিকা দেব, বিপরীতে এমন একটা ঘটনা যুক্ত করেছি যা ঐ জাতীয়তাবাদীর পক্ষে গ্রহণ করা অসম্ভব, এমনকি তার কল্পনায়ও।
ব্রিটিশ রক্ষণশীল: এই যুদ্ধের পর ব্রিটেনের ক্ষমতা ও ইজ্জত কমে যাবে।
কমিউনিস্ট: ব্রিটেন ও আমেরিকা সাহায্য না করলে জার্মানির হাতে রাশিয়ার পরাজয় ঘটতো।
আইরিশ জাতীয়তাবাদী: একমাত্র ব্রিটিশ সুরক্ষার কারণেই আয়ারল্যান্ড তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে।
ট্রটস্কিবাদী: স্টালিনের আমল রাশিয়ার জনগণের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল।
শান্তিবাদী: যারা সহিংসতা শপথপূর্বক বর্জন করেছেন, তারা তা করেছেন কেননা অন্যরা তাদের তরফ হতেই সহিংসতা করছেন।
যদি কারো আবেগ জড়িত না থাকে তবে এই ঘটনাগুলো মোটামুটি পরিষ্কার; কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রে যে ধরণের ব্যক্তির কথা উল্লেখ আছে তাদের কাছে এগুলোও অসহ্য, এবং তাই এগুলো অস্বীকার করা হবে, এবং এই অস্বীকারের উপর মিথ্যা তত্ত্ব নির্মাণ করা হবে। আমি বর্তমান যুদ্ধের সামরিক পূর্বাভাসের বিস্ময়কর ব্যর্থতায় ফিরে আসি। আমি মনে করি এটা বলা ঠিক হবে যে, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চেয়েও বেশি ভুল করেছেন, এবং তারা তাদের পক্ষপাতমূলক অনুভূতি দ্বারাই বেশি শাসিত হচ্ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, বামঘরণার সাধারণ বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বাস করতেন যে, যুদ্ধ ১৯৪০ সালেই হেরে গিয়েছে। বিশ্বাস করতেন যে, জার্মানরা ১৯৪২ সালে মিশরকে পদদলিত করতে বাধ্য হয়েছিল। বিশ্বাস করতেন যে, জাপানিজরা যে জায়গাগুলো যুদ্ধে জিতেছে সেগুলো থেকে তাদের তাড়ানো যাবে না। বিশ্বাস করতেন যে, ব্রিটেন-আমেরিকার আক্রমণাত্মক বোমা হামলা জার্মানির উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। তারা এই বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন কারণ ব্রিটিশ শাসক শ্রেণির প্রতি তাদের ঘৃণা এটা কবুল করতে মানা করেছিল যে ব্রিটিশ পরিকল্পনাও সফল হতে পারে। যদি কেউ এই ধরণের আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হোন তাহলে এমন সীমাহীন মূর্খতা তিনি গিলে ফেলতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, আমি আত্মবিশ্বাসের সংগে বলতে শুনেছি যে আমেরিকান বাহিনীকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জার্মানের সাথে যুদ্ধ করতে নয়, বরং ইংরেজ বিপ্লবকে ধ্বংস করতে। বুদ্ধিজীবীরা ওরকম কিছু বিশ্বাস করছেন, অথচ কোন সাদারণ মানুষও এত বোকা হতে পারে না। হিটলার যখন রাশিয়াতে আক্রমণ করলো, MOI এর কর্মকর্তারা ‘পটভূমি হিসেবে’ এই সতর্ক বার্তা জারি করেছিলেন যে, ছয় সপ্তাহের মধ্যেই রাশিয়ার পতন হতে পারে। অন্যদিকে, যুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়কে কমিউনিস্টরা রাশিয়ার জয় হিসেবেই চিহ্নিত করেছিল, এমনকি যখন রাশিয়ানদের প্রায় কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত পিছু হটতে হয়েছিল এবং কয়েক লক্ষ বন্দিকে হারাতে হয়েছিল। উদাহরণের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। মূল কথা হচ্ছে, যখন ভয়, ঘৃণা, ঈর্ষা এবং ক্ষমতা-লিপ্সা জড়িত থাকে তখন আমাদের বাস্তবিক চেতনা বিকৃত হয়ে যায়। এবং, আমি ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি, ন্যায় এবং অন্যায় এই জ্ঞানও বিকৃত হয়ে যায়। এমন কোন অপরাধ নেই, একেবারেই নেই, যেগুলো ক্ষমা করা যায় না যখন সেটা ‘আমাদের পক্ষ’ করে। এমনকি যদি তিনি স্বীকারও করেন যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এমনকি যদি তিনি জানেন যে ঐ একই ধরণের অপরাধ করার জন্যে আরেকজন নিন্দিত হয়েছিল, এমনকি তার বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা থেকে যদি তিনি স্বীকারও করেন যে এটা অযৌক্তিক ছিল, - তবু তিনি অনুভব করবেন না যে এটা ভুল ছিল। আনুগত্য জড়িত, তাই সমবেদনাও কাজ করে না।
জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বিস্তারের কারণ উত্থাপন করা এখানে সম্ভব না। এটা বলা যথেষ্ট যে, যে আকারে এটা ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সেটা আসলে বাস্তব দুনিয়ায় যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে তারই এক বিকৃত প্রতিচ্ছবি। এবং, বলা যায় যে, এই নিকৃষ্ট মূর্খতা সম্ভব হয়েছে দেশপ্রেম এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ভাঙনের ফলে। যদি কেউ চিন্তার এই রেলগাড়ি অনুসরণ করেন, তবে রক্ষণশীল প্রজাতি কিংবা রাজনৈতিক বৈরাগ্যের মধ্যে তার পড়ে যাওয়ার বিপদ আছে। উদাহরণস্বরূপ, এই যুক্তিতর্ক করা যেতে পারে, এমনকি এটা সত্য হতেও পারে যে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমই হচ্ছে প্রতিষেধক, স্বৈরাচারতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজতন্ত্র, এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ধর্ম। অথবা আবার এই যুক্তি দেখানো যেতে পারে যে, কোন পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভব না। প্রতিটি মত এবং কারণের সাথে সমান মিথ্যা, মূর্খতা এবং বর্বরতা জড়িত; এবং এটাকে প্রায়শই বলা হয় রাজনীতির একেবারে বাইরে রাখার কারণ হিসেবে। আমি এই যুক্তি গ্রহণ করিনা, এই আধুনিক বিশ্বে বুদ্ধিজীবী হিসেবে বর্ণিত কেউই নিজেকে রাজনীতির বাইরে রাখতে পারবেন না; এই অর্থে যে এগুলোকে পাত্তা না দিয়ে। আমি মনে করি তাকে অবশ্যই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিৎ - ব্যাপক অর্থে - এবং অবশ্যই তার কিছু পছন্দ থাকা উচিৎ: যেমন, তাকে স্বীকার করতে হবে যে কিছু কিছু কাজের উদ্দেশ্য অন্যগুলোর চেয়ে ভালো, এমনকি যদিও তাদের কর্মপন্থা সমানভাবে খারাপ হতে পারে। আমি যে জাতীয়তাবাদী ভালোবাসা ও ঘৃণা সম্পর্কে বলছিলাম, আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, সেগুলো আমাদের অধিকাংশের মেকাপের অংশ। এটা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব কি না আমি জানি না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সম্ভব। এটা অপরিহার্যভাবে নৈতিক প্রচেষ্টা। আসলেই এটা কি, তার নিজস্ব অনুভূতিগুলো আসলেই কেমন সেটা আবিষ্কার করাই প্রাথমিক প্রশ্ন, এবং এই পক্ষপাতের অপরিহার্যতা বিবেচনা করা পরবর্তী প্রশ্ন। যদি আপনি রাশিয়াকে ঘৃণা করেন এবং ভয় পান, যদি আপনি আমেরিকার ক্ষমতা ও সম্পদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হোন, যদি আপনি ইহুদীদের অবজ্ঞা করেন, যদি আপনি ব্রিটিশ শাসক শ্রেণির কাছে হীনমন্যতায় ভুগেন, আপনি কেবল চিন্তাভাবনা করেই এই অনুভূতিগুলো থেকে মুক্ত হতে পারবেন না। কিন্তু, আপনি অন্তত স্বীকার করতে পারেন যে এগুলো আপনার আছে, এবং এদের প্রতিরোধ করতে পারেন যেন এগুলো আপনার মানসিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত না করে। যে সব আবেগময় প্রেরণা অবশ্যম্ভাবী, এবং সম্ভবত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে প্রয়োজনীয়ও, বাস্তবতাকে স্বীকার করার সাথে সেগুলোকেও পাশাপাশি রাখতে সক্ষম হওয়া উচিৎ। কিন্তু, আমি আবারও বলছি, এই জন্যে দরকার নৈতিক প্রচেষ্টা। এবং সমকালীন ইংরেজি সাহিত্য, যতক্ষণ পর্যন্ত এটি আমাদের সময়ের প্রধান বিষয়গুলোর প্রতি সচেতন, দেখাচ্ছে আমাদের কত কম লোক এটা করার জন্যে প্রস্তুত।
টীকা
[1] Up until our own times men had only received two sorts of teaching in what concerns the relations between politics and morality. One was Plato’s and it said: “Morality decides politics”; and the other was Machiavelli’s, and it said “Politics have nothing to do with morality.” Today we receive a third. M. Maurras teaches: “Politics decide morality.”
[2] বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালীর বুদ্ধিবৃত্তির দাসত্ব, ফয়েজ আলম
[3]কোন বই, সংগীত ইত্যাদির বিরক্তিকর বা ক্লান্তিকর অংশ বুঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। - অনুবাদক
[4] যেমন, ‘The Spaniard is a natural aristocrat’ or ‘Every Englishman is a hypocrite’।– লেখক
[5] রক্ষণশীল প্রবণতার কয়েকজন জার্মান ও রাশিয়ার চুক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। কিন্তু তারাও স্থায়ী জোটের আশা করেছিলেন। কিন্তু এর বাইরে কোন মার্ক্সিস্ট, কোন বামঘরণার লেখক কেউই কোন ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন নাই। - লেখক
[6] ফ্রান্সের জাতীয় সঙ্গীত, ফরাসী বিপ্লবের সময় রচিত। - অনুবাদক
[7] আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত কমেডি। - অনুবাদক
[8] আলফ্রেড টেনিসনের কবিতা; ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময় (১৮৫৪) লেখা হয়েছিল। - অনুবাদক
[9] sympathetic magic এর পিছনে মূল ধারণা হচ্ছে, যে কোন ব্যক্তির ওপর জাদুর প্রভাব ফেলা যাবে যদি ঐ ব্যক্তিকে প্রতিনিধিত্বকারী কোন কিছুর প্রতি নির্দিষ্ট ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করা যায়।
[10] লর্ড এল্টন - Neo-Toryism এর উদাহরণ। ডি এন প্রিট – সোভিয়েত সমর্থকের উদাহরণ। ফাদার কাফলিন – রাজনৈতিক ক্যাথলিকবাদের উদাহরণ। এন্টিসেমেটিক প্রচারণাও চালিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment