A Rohingya refugee boy desperate for aid cries as he climbs on a truck distributing aid for a local NGO near the Balukali refugee camp in Cox's Bazar, Bangladesh (Kevin Frayer/Getty Images) |
[এই লেখাটা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ
করা এক রোহিঙ্গার জবানবন্দী। তাঁর নাম নূর ইলিয়াস। তাঁর লেখা থেকে জানা যাচ্ছে যে
তিনি শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে আছেন জামতলা ক্যাম্পে। তাঁর
কথাগুলো ২৭ আগস্ট গার্ডিয়ান পত্রিকা প্রকাশ করে ‘I am a Rohingya refugee: we will become like animals if we stay in these camps’ শিরোনামে। জবানবন্দীমূলক এই লেখা-জুড়ে আছে তাদের
অতীত পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বর্তমান অবস্থা,
তাদের কষ্টের কথা, তাদের আশার কথা,
তাদের আশঙ্কার কথা। তিনি বলছেন, তারা যে
কোন মূল্যে মায়ানমারে ফিরতে চান, কিন্তু অবশ্যই সেটা
নাগরিকত্ব ও সকল অধিকার সহ।
বিঃ দ্রঃ অনুবাদে মায়ানমারের বিভিন্ন এলাকার নাম বা ক্যাম্পের নামের উচ্চারনে খানিক এদিক-সেদিক হতে পারে, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।]
আমি যে গ্রাম থেকে এসেছি তার নাম Nga Sarkuye; প্রচুর সবুজ বাগান
এবং বিভিন্ন ধরণের গাছ ও ফুলের সমারোহে সে এক মনোরম পরিবেশ। গ্রামের তিন দিকে আছে
ছোট ছোট নদী এবং পূবে আছে উঁচু উঁচু পাহাড়। নির্মল বাতাসের জন্যে এবং বন্ধুদের
সাথে আড্ডা দেয়ার জন্যে আমরা প্রায়ই সেখানে উঠতাম। এর চতুর্দিকে আবার আবাদি জমি।
কিন্তু ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের পর মায়ানমার সরকার এর অধিকাংশই দখল করে নেয়।
কয়েক বছর যাবত আমি নিজের গ্রামেই বন্দি হয়ে
যাচ্ছিলাম। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত আমি অন্যান্য জায়গায় চলাফেরাও করতে পারতাম
না - এবং এটা করতে গিয়ে আমাকে প্রচুর টাকাও খরচ করতে হয়েছে।
পরিস্থিতি ২০১২ সাল থেকেই খারাপ হচ্ছিল। ঐ বছরের
জুন মাসে, রাখাইনের
কিছু লোক টংগু গ্রামের ১০ জন রোহিঙ্গাকে খুন করে। পরে আমরা শুনেছিলাম বিভিন্ন শহর ও জেলায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা
নিধনে এই লোকগুলো এবং সরকার জড়িত ছিল। তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, গুলি করেও মারা হয়। অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়া
হয়, এবং রোহিঙ্গাদের গ্রেফতার করা হয়। অনেকেই জেলে মারা
যান।
চারবছর পর,
আমার বয়স যখন ২৬, মায়ানমারের সামরিক
বাহিনী প্রায় ৩০০ গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। মসজিদ
ও মাদ্রাসাগুলোতেও আগুন দেয়া হয়। অসংখ্য রোহিঙ্গাদের গ্রেফতার করা হয় এবং জেলে
বন্দি করা হয়।
আমি গ্রেফতারের ভয়ে আতঙ্কিত থাকতাম। ২০১৬ সালের
অক্টোবরের নাগাদ আমি নিজের বাড়িতে ঘুমানো বাদ দিয়ে দেই। কখনো কাদায়, কখনো ঝোপঝাড়ে, কখনো পাহাড়ে ঘুমাতে হয়েছে। মায়ানমার সরকার আমাদেরকে আরাকান থেকে বের
করে দিতে চাচ্ছে বহু দিন যাবত। গত বছর তারা সফল হয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসের এক দিনে ভারী অস্ত্রশস্ত্র
নিয়ে সশস্ত্র লোকেরা এসে পৌছায়। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্বিচারে গ্রামে গুলাগুলি
করলো। অন্যান্য জায়গা কি হচ্ছিল সেই গল্পও আমরা শুনেছিলাম। আমরা জানতাম আমাদের
যেতে হবে।
আমি আমার প্রিয় গ্রাম ছেড়ে আসি আগস্টের ৩১ তারিখ।
তখন সকাল ৮.১০ - একেবারে সঠিক সময়টাই লিখলাম। আমি আমার পরিবার, প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সাথে
ছিলাম। আমাদের চোখ অশ্রুতে টলমল, হৃদয় জুড়ে শুধু ভয়।
সারাদিন হেঁটে আমরা সিংগ্রি পাড়া গ্রামে পৌছাই। আমরা অনেকেই সেখানে সপ্তাহ খানেক
বিশ্রাম নিলাম; নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করলাম যে আশা করি
পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশে হয়তোবা আর যাওয়া লাগবে না।
A Rohingya refugee woman walks through the Kutupalong camp in Cox’s Bazar in Bangladesh. Photograph: Mohammad Ponir Hossain/Reuters |
প্রতিদিন আমরা রেডিও শুনতাম মায়ানমার সরকারের ভালো
কোন সংবাদ শোনার জন্যে। কিন্তু, কিছুই পেতাম না। যখন নৃশংস সামরিক বাহিনী দুদেন ও লাম্বাগুনা গ্রামে
আগুন দেয়, যেটা সিংগ্রি পাড়ার পাশেই ছিল, আমরা ধোঁয়া দেখতে পাই। শেষমেশ আমরা সীমান্তের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
নেই। এই যাত্রা খুবই কঠিন ছিল। আমাদের নদী পার হতে হয়েছে, কর্দমাক্ত দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিতে হয়েছে। বৃদ্ধ লোকেরা আমাদের চোখের
সামনেই মারা যাচ্ছিলেন, এবং বহু দুর্বল লোকদের তাদের
পরিবার ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছে, কেননা তারা এদের বহন করতে
পারছিল না। শিলহালি গ্রামের এক মসজিদে এক রাত কাটতে হয়। কোন খাবারও ছিল না তখন।
আমরা যখন সীমান্তে পৌঁছলাম, নৌকায় করে বাংলাদেশে প্রবেশ
করি। বাংলাদেশের কিনারা দেখামাত্রই আমার সকল ভয় চলে যায়। বাংলাদেশিরা আমাদের খাবার
দেয় - আমরা তখন ভীষণ ক্ষুধার্ত!
আমি প্রথম রাত উন্সিপারাগ ক্যাম্পে কাটাই, এক আত্মীয়ের কুটিরে, সে আমার পূর্বেই এসেছিল। এটা পুরো কাদায় মাখামাখি ছিল। সারারাত ঘুমাতে
পারি নি। কর্দমাক্ত মাটিতে কোনরকম শুয়ে ছিলাম।
পরের দিন আমি নিজের কুঠির তৈরি করি, প্লাস্টিকের শিট ব্যবহার করে
ছাদ ও দেয়াল বানাই। এখানে আমি পরিবার নিয়ে সপ্তাহ দুয়েক ছিলাম, তারপর ময়নাঘুনা ক্যাম্পে চলে আসি। সেখানে কর্দমাক্ত ধানক্ষেতে আরেকটা
কুঠির তৈরি করি। আমাদের পান করার কিছু ছিল না, এবং
ঘুমানোর কোন ভালো জায়গাও ছিল না।
বাংলাদেশে আসার দুই মাসের মাথায় আমি বিয়ে করি। বিয়ে
মায়ানমারে থাকতেই ঠিক করা ছিল। যে কুঠিরে থাকতাম সেখানেই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কোন
অনুষ্ঠানাদি ছিল না, কোন সুখও ছিল না।
মানবাধিকার সঙ্ঘটনগুলো আমাদেরকে চাল, তেল, ডাল
দিচ্ছে। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, কিন্তু এটা আমাদের
জন্যে পর্যাপ্ত নয়, এবং ফ্রেশ পানি ও মাথার উপর ছাদের
অভাব এখনো রয়ে গেছে। এই ক্যাম্পে এমনকি একটাও গাছ নেই। আপনি কোন গাছ পাবেন না,
যতই খোঁজ করেন। ১২ জন সদস্যের এই পরিবার চালাতে আমি হিমশিম
খাচ্ছি। একবেলার খাবার পেলে আমাকে চিন্তা করতে হয় পরের বেলার খাবার কিভাবে সংগ্রহ
করবো। যখন মায়ানমারে ছিলাম, এই পরিবার চালানো আমার জন্যে
খুবই সহজ ছিল, কেননা আমি শিক্ষকতা করতাম এবং বেতন পেতাম।
আমরা যদি লম্বা সময় ধরে এই ক্যাম্পগুলোতে থাকি, আমাদের কমিউনিটি তাঁর ধর্ম ও
ঐক্য হারিয়ে ফেলবে। আমাদের সন্তানেরা শিক্ষিত হবে না। তাই সবকিছুর পরেও, আমরা মায়ানমারে ফেরত যেতে যাই - কিন্তু একমাত্র নাগরিকত্ব ও আমাদের
অধিকার সহ। বহু দিন পূর্বে মায়ানমার সরকার আমাদের যে অধিকার কেড়ে নিয়েছে, সে অধিকার ছাড়া প্রত্যাবাসনে আমরা কখনো রাজি হবো না।
আমি প্রায়ই সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি, এমনকি আমার ভবিষ্যৎ নিয়েও।
এখানে আমাদের কোন শিক্ষা নেই, স্কুল নেই। ভয় হয়, যদি এভাবে শরণার্থীর জীবন কাটাতে হয় তাহলে আমাদের ও আমাদের সন্তানদের
জীবন পশুর মতো হয়ে যাবে।
No comments:
Post a Comment