‘ব্যক্তি’কে খুঁজতে গেলে ‘ব্যক্তি’র স্বীয় প্রতিভাকে যেমন মূল্য দিতে হয় তেমনি
সেই প্রতিভার উৎস এবং বিকাশের কারণ তালাশ করতে হয়ে সমাজের মধ্যে, যে সমাজে ব্যক্তি তাঁর
দিনযাপন করছেন। জহির রায়হানের প্রতিভা এবং তাঁর কালের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে
অনেক আলাপ হয়েছে, এই
দিকে আমি যাবও না। বরং, ‘মানুষ’ জহির রায়হান কেমন ছিলেন, সেটা দেখব তাঁর সহযোদ্ধা ও
সহকর্মী - চলচ্চিত্র জগতে বাংলাদেশের আরেক দিকপাল - আলমগীর কবিরের বয়ানে ও
দৃষ্টিতে।
আলমগীর কবির ও জহির রায়হানের মধ্যে
অমিলের চেয়ে মিলই ছিল বেশি। দুজনেই চলচ্চিত্র জগতের মানুষ এই মিলের চাইতেও বড় মিল
হচ্ছে দুইজনেই জড়িত ছিলেন একটা রাষ্ট্রের জন্ম-প্রক্রিয়ার সাথে। একাত্তরের সেই
বিশেষ মুহূর্তে দুজনেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্যামেরাকে অস্ত্র বানিয়েছিলেন। সিনেমার বাইরেও
তারা ছিলেন সক্রিয় বিপ্লবী রাজনীতিতে। একজন দেশের ভেতরে, আরেকজন দেশের বাইরেও। আলমগীর
কবির জড়িত ছিলেন কুবা, ফিলিস্তিনের
মুক্তি সংগ্রামের সাথে, জহির
দেশে বসেও কলমকে তলোয়ার বানিয়ে যোগ দিয়েছিলেন সেই মুক্তিসংগ্রামে; এর প্রমাণ তাঁর লেখালেখিতে
দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট! অমিলের চেয়ে মিলের এই দিকটা কবির ও বলেন, ‘জাতীয়তাবাদ, স্বাধিকার যুদ্ধ এবং
সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের মতামতে পার্থক্যের চাইতে মিল ছিল
বেশি।’ অবশ এটাও উল্লেখ করা দরকার
কবির যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিষয়ে কিছু
লিখতেন তখন এর পূর্বে ‘প্রগতিশীল’ শব্দটাও ব্যবহার করতেন।
চলচ্চিত্রকারের পাশাপাশি জহির রায়হানের আরেকটা পরিচয় ছিল, কথাসাহিত্যিক। তেমনি, আলমগীর কবিরেরও আরেকটা পরিচয়
ছিল, চলচ্চিত্র সমালোচক - এই
পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল এবং তা দিয়েই পরিচিতি পেয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে
মাহমুদুল হোসেন বলছিলেন, ‘আলমগীর
কবির প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ড
থেকে ফিরে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি
জোর গলায় বলব আমার পিতা-মাতা, আমার শিক্ষক, আমার গুরুজনেরা আমাকে ভুল জিনিস শিখতে সাহায্য
করেছিলেন, বাজে বই পড়তে উৎসাহ
দিয়েছিলেন এবং ভুল পথে পরিচালিত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।’ বিদ্রোহী আলমগীর কবির কিন্তু
সমাজকে ত্যাগ করেননি, বিবরমুখী
হয়ে পড়েননি। বরং তিনি যা বিশ্বাস করেন তাকে প্রকাশ করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞে মেতে
উঠেছিলেন। ষাটের দশকে তাঁর চলচ্চিত্র-সমালোচনা যেমন ছিল নতুন ধরনের, তেমনি ছিল প্রবলরকম আক্রমণাত্মক’। (হোসেন ২০১৪) সমালোচক হিসেবে কবির নির্দয় ও ক্ষমাহীন। এতটাই ক্ষমাহীন যে তিনি
নিজেই বলতেন, ‘কিছু কড়া চিত্র-সমালোচনা লিখে চিত্রব্যবসায়ীদের
এমন ক্ষেপীয়ে দিলাম যে আমাকে এফডিসিতে ঢোকার সময় সাবধান হয়ে ঢুকতে হয়, পাছে
কেউ অতর্কিত আক্রমণ চালায়’। কবিরের সমালোচনার প্রেক্ষিতে
খান আতারা যেভাবে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন এতেই সমালোচনার ধার বুঝা যায়। অন্যান্য
সমালোচকদের সাথে কবিরের বড় তফাৎ হচ্ছে
তিনি নিজেকেই তাঁর ক্ষমাহীন সমালোচনা থেকে রেহাই দেন নি। সলিমুল্লাহ খান
কবিরের এই গুনকে বলেছেন ‘শৈল্পিক মহত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক
সততার পরম প্রমাণ’। জহির
রায়হান সম্পর্কে কবিরের মূল্যায়ন তাই
আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ।
বিদেশে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে কবির জড়িয়ে পড়েছিলেন ‘মুক্তিসংগ্রামে’। কোন নির্দিষ্ট দেশের নাম উল্লেখ করলাম না কারণ
একদিকে তিনি যেমন লন্ডনে ‘পূর্ব
বাংলা মুক্তিফ্রন্ট’ গঠন
করেন তেমনি ফরাশি উপনিবেশ আলজেরিয়ার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টেও সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৬ সালের
দিকে বাংলায় ফিরে আসেন। তখন পরিচয় হয় জহির রায়হানের সাথে। জহির রায়হানের সাথে
পত্রিকা সম্পাদনা থেকে শুরু করে অনেক কাজই করেন। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানিদের
আক্রমণের পর জহির রায়হান ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর কাজ কারবার
চালিয়ে যেতে থাকেন। আলমগীর কবির ভারতে
প্রবেশ করেছিলেন এপ্রিলে, পরবর্তীতে
তাজউদ্দীনের বার্তাবাহক হয়ে আবারো ঢাকায় পুনঃপ্রবেশ করেন। পরে জুন মাসে কলকাতায়
ফিরে এসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রতিবেদক এবং স্বাধীন বাংলা বেতার
কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের অনুষ্ঠান সংগঠক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। নভেম্বর পর্যন্ত ‘আহমেদ চৌধুরী’ নামে স্বরচিত ইংরেজি কথিকা
পাঠ করেন।
জহির রায়হানও তখন কলকাতাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন; ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল
অব দি ইন্টেলিজেনশিয়া’ নামে
যে সংস্থা গঠন করা হয় তাঁর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। কবির ও জহির একসাথে পরে অনেকগুলো কাজ করেছেন। জহির
রায়হানের ‘স্টপ
জেনোসাইড’ ও ‘এ স্টেইট ইজ বর্ন’ তৈরিতে আলমগীর কবির
সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। নিজেও নির্মাণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’। অর্থাৎ, জহির রায়হানের সাথে আলমগীর কবিরের কাজ
করার যেমন অভিজ্ঞতা আছে, তেমনি দুজনের বন্ধুত্বও অটুট
ছিল সমসময়।
আলমগীর কবিরের লেখালেখি ২০১৮ বইমেলাতে ‘চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি’ নামে বের হয়। তাঁর
লেখালেখিতে বিভিন্নভাবে জহির রায়হানের নাম এসেছে। এর দুইটা কারণ আছে, প্রথমত, বাংলাদেশের সিনেমা সংক্রান্ত
যে কোন আলাপে জহির রায়হানকে উপেক্ষা করা অসম্ভব; দ্বিতীয়ত, যেহেতু জহির রায়হান তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু ছিলেন, তাই তাঁদের বিভিন্ন ঘটনাবলী
ঘটনাপ্রসঙ্গে আসাটাই স্বাভাবিক। যেমন, জুন মাসে কলকাতাতেই পৌছেই তিনি জহির
রায়হান সম্পর্কে একটা ঘটনা শোনেন। তাঁর মুখেই শোনা যাক:
‘স্বাধীন বাংলা বেতারের
ভারপ্রাপ্ত এমএনএ জহিরকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা করে
বেতারে প্রচারের উপযোগী একটি নিবন্ধ তৈরি করতে বলেন। প্রায় সাত-আট দিন ধরে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে জহির একটি বিরাট
খসড়া তৈরি করে ঐ এমএনএর হাতে দেয়। বলা বাহুল্য, খসড়াটির মূল ভিত্তি ছিল সমাজতান্ত্রিক। একদিকে
আওয়ামীলীগ তখনো সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। এমএনএ সাহেব নিবন্ধটি পড়ে এমন ক্ষিপ্ত হন
যে জহিরের কঠোর পরিশ্রমের ফসল ঐ দলিলটি তিনি ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেন।’ (কবির ২০১৮)
তো এই হলো ঘটনা, জহির
রায়হান তো রেগে আগুন। পছন্দ নাই হতে পারে, এত কষ্টের লেখা ফেলে দেবেন কেন? পরে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর
এমএনএ স্বীকার করেন যে তার অন্যায় হয়েছে। এবং, তিনিও চান জহির ফিরে আসুক। কিন্তু জহির রায়হান
অনমনীয়। এই স্থলে কবির জহির রায়হান সম্পর্কে
যে মন্তব্য করেন তাঁতে মানুষ জহিরের সন্ধান মিলে,
‘[...] টাকা
পয়সা যা নিয়ে এসেছিল তা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। অথচ জহির এমন মানুষ যে না খেয়ে মরে
গেলেও নীতিগত আপস করবে না।’ (কবির
২০১৮)
যাই হোক আলমগীর কবিরের বুদ্ধিতে এমএনএ ও জহিরের সাক্ষাৎ হয় এবং দুজনেই দুজনের
কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু, জহির রায়হানের মতো একজনের সাথে কর্তাব্যক্তিরা
এই যে পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন তা, আলমগীর কবিরের
মতে, লজ্জাজনক।
এখানেও কবিরের মন্তব্যে পূর্বে উল্লিখিত
জহিরের আরেক রূপ উন্মোচিত হয়। কবির জানান, ‘ইতিমধ্যে জহিরের জ্বালাময়ী কণ্ঠস্বর স্বাধীন
বাংলা বারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। জহিরই একমাত্র ব্যক্তি যে
নিজের স্ত্রী - পুত্র, ভাই
বোনদের বিপদের ঝুঁকি নিয়েও স্বনামে বেতারে অবতীর্ণ হতে দ্বিধা-বোধ করে নি।’
যুদ্ধকালীন সময়ে জহির রায়হানের কাজের আরও ফিরিস্তি পাওয়া যায় আলমগীর কবিরের
বয়ানে। জহির রায়হান তখন প্রচণ্ড অর্থকষ্টে, আশেপাশের অনেকেই তখন নিজেদের ফিল্ম প্রিন্ট
বিক্রি করে টাকা কামানোর ধান্ধায়, তখনও তিনি ‘জীবন থেকে নেয়া’র
ভারতে বিক্রয়লব্ধ সকল অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে দান করেছেন। টাকার অংক নিয়ে
খানিকটা ভিন্নমত আছে, তবে
আনুমানিক পাঁচ লক্ষ টাকা তিনি তহবিলে জমা দেন। এমনকি যখন ‘স্টপ জেনোসাইড’ তৈরি করছেন তখন স্ত্রী
সুচন্দা অসুস্থ, ছেলে
অপু অসুস্থ। কিন্তু, সব
ছেড়েছুড়ে দিন-রাত মাটি করে তিনি সিনেমা বানানোতেই ব্যস্ত। এই জহির সম্পর্কে
কবিরের মন্তব্য হচ্ছে,
‘সে সময় তো দেখেছি সবাই
নিয়েছে বা নেবার উদ্দেশ্যে থাবা বাড়িয়েছে। জহিরই একমাত্র অনন্য ব্যক্তি যে অত
অভাবেও কেবল দিয়েছে।’ (কবির
২০১৮)
রাজনৈতিক বিশ্বাসে কারণে জহির রায়হানকে অনেক সময় নিজের দেশের মানুষই বাধা
প্রদান করতো কিন্তু, জহিরকে
নিরস্ত করতে পারতো না। করার ক্ষমতাও ছিল না। কেননা মুক্তিসংগ্রামে জড়িয়ে পড়াটা
জহিরের জন্যে আকস্মিক কোন ঘটনা ছিল না, বরং, কবিরের
মতে, জহির
রায়হান যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিতে গিয়েছিলেন ‘আত্মিক তাগিদে’। কবির বলেন, ‘সে জানত দেশকে ভালোবাসা এবং
তাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা তাঁর জন্মগত এবং আদর্শগত [কর্তব্য]।’ কলকাতায় জহির রায়হানের
কর্মময় জীবনের দিকটা ফুটে উঠে কবিরের নিম্নের মন্তব্যে:
‘আমরা জহিরকে দেখেছি এক
বহুমুখী ভূমিকায়। এবেলা সে পাক-মার্কিন সাম্রাজ্যবিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে, ওবেলা দেখতাম সাংস্কৃতিক
দলের অনুশীলনের স্ক্রিপ্ট পুনর্বিন্যাস করছে।’ (কবির ২০১৮)
২
জহির রায়হানের যাবতীয় সৃষ্টিকর্মের মধ্যে লুকিয়ে আছে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের
চেতনা। এই দিকটা আলমগীরের মত তীক্ষ্ণ চোখের সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব, তাই তিনি জহিরকে নিয়ে এক
আলোচনার শুরুতেই বলেন, ‘সত্যিকার
প্রতিভাবান শিল্পী রাজনৈতিক চেতনা বিবর্জিত হতে পারে না।’ সে চেতনা যে বায়ান্ন থেকে
উৎসারিত তা বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন। তাঁর মতে, জহির রায়হানের সাফল্যের পিছনে মূল কারণ ছিল এই ‘গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবজ্ঞান
এবং সমাজচেতনা’। এই সমাজচেতনার গোঁড়াতেই ভাষা আন্দোলনে জহিরের
সক্রিয়তার কথা জানা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন ‘বায়ান্নের চেতনা’ বলতে তাঁরা আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন তা বুঝা। যেহেতু কবির ই এখানে কথা বলছেন তাঁর মুখেই এই চেতনার কথা শুনে নেই,
‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
বাংলা ভাষাকে তদানীন্তন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য একটি নিছক
রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না - এটা ছিল মূলত এবং বস্তুত বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের
জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি এবং তাঁর ভেতর দিয়ে তাদের সত্যিকারের জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক
সত্তা খুঁজে পাবার সংগ্রাম।’ (কবির
২০১৮)
এই যে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের কথা বলা হচ্ছে তাঁর জন্যে একজন শিল্পীর কি
ধরণের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা দরকার সে সম্পর্কে জহির ছিলেন সচেতন। তিনি জানতেন
এই সমাজ এখনো ‘আধা-সামন্ততান্ত্রিক আর
আধা-উপনিবেশিক’। এই
শ্রেণিবিভক্ত সমাজেই তৈরি হয়
সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা
ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতা। তাই, মূল
লক্ষ্য হবে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। একজন শিল্পী হিসেবে জহির রায়হানকে ‘বিপ্লবী’ আখ্যা দিচ্ছেন কবির । কেননা
কবির বলছেন, ‘সে বিশ্বাস করত যে শিল্পীর মহান দায়িত্ব হল
আপামর জনসাধারণকে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন
করে তোলা, যাতে করে একদিন সত্যিকারের
ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠের সত্যিকারের প্রতিনিধিদের হাতে আসতে পারে বিপ্লবের মাধ্যমে।
এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই জহির এসেছিল চলচ্চিত্রাঙ্গনে।’ এখানে কবিরের মন্তব্যে একজন বিপ্লবীর সন্ধান পাওয়া যায় যার
সিনেমা জগতে আসার উদ্দেশ্যই ছিল ‘ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠের সত্যিকারের প্রতিনিধিদের
হাতে’ তুলে দেয়ার পথ সুগম
করা।
জহির রায়হান নির্মিত প্রথম সিনেমা হচ্ছে ‘কখনো আসেনি’। ১৯৬১ সালে নির্মিত এই সিনেমা সম্পর্কে
সমালোচক কবিরের মন্তব্য হচ্ছে, ‘অনভিজ্ঞতা প্রসূত নানাবিধ
কারিগরি ভুলত্রুটি সত্ত্বেও’ এই
ছবি ‘দেশের বাংলা ভাষার
বক্তব্যপ্রধান শিল্পিত চলচ্চিত্রের প্রথম উদাহরণ।’ তবে, এই নির্দয় সমালোচকও পাশ মার্ক দিয়েছেন ‘কাচের দেয়াল’ সিনেমার বেলায়। তাঁর মতে, এই ছবির মাধ্যমেই জহিরের ‘চালচ্চিত্রিক কারিগরি
প্রতিভা সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা পেল’। তৎকালীন পূর্ববাংলায় যে সুস্থ সিনেমার ধারা শুরু হয়েছিল হঠাৎ করেই তাতে যেন
বাধা পড়ল। জহির রায়হানকে আর্থিক কারণে কয়টা বাণিজ্যিক সিনেমাও বানালেন। একসময়
বললেন, আর না! সকল কিছু থেকে মুক্ত
হয়ে একেবারে নিজের মনের মতো করে সিনেমা বানাবেন। দেশীয় পরিস্থিতি তখন উত্তাল।
পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আলমগীর
কবির জহিরের যে তিনটি গুনের কথা উল্লেখ
করেছিলেন -গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবজ্ঞান এবং সমাজচেতনা - সবই
যেন প্রখর হয়ে উঠলো। এমতাবস্থায় শাসকচক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জহির রায়হান
নির্মাণ করলেন ‘জীবন
থেকে নেয়া’। তাঁর বাস্তবজ্ঞান দিয়েই যেন পেয়ে গিয়েছিলেন ‘মুক্তি’র বার্তা। আলমগীর কবিরও বলেন,
‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সফল
বিপ্লবের পরে বিপ্লবভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ একমাত্র উদাহরণ যেটি
বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতিতে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়েও বিপ্লবের ছবি নির্মাণ করার মত
দুঃসাহস দেখিয়েছে।’ (কবির
২০১৮)
অবশ্য, এই
ছবিও কবিরের ক্ষমাহীন বিশ্লেষণের হাত থেকে রেহাই পায় নি।
৩
জহির রায়হানের সাথে চিন্তাভাবনায় যে ‘মিলে’র কথা আলমগীর কবির বলছিলেন সেটা আর ভালভাবে
ফুটে উঠে তাদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সমস্যা সংক্রান্ত আলাপে। যদিও জহির এ নিয়ে
আলাপ করেছেন দু এক জায়গায় কিন্তু সে তুলনায় কবির গেছেন অনেক গভীরে, তবু মূল সুর একই। যে সমাজে
তাদের দুজনকেই সিনেমা বানাতে হচ্ছে সেটা যে উপনিবেশিক ও শ্রেণি-বিভক্ত তা দুজনেই
একমত; বিশেষ করে অশিক্ষা ও
অর্ধশিক্ষাজনিত সামাজিক কুসংস্কার ও অনাচারের বিরুদ্ধে লড়েই চলচ্চিত্র নির্মাণ
করতে হয়। কবির মতে, এমন
সমাজের জন্যে ধনতান্ত্রিক সংস্কৃতি নয়, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিই কল্যাণকর হতে
পারে।
চলচ্চিত্র বানানোর জন্যে একজন চলচ্চিত্রকারে প্রথমেই প্রয়োজন টাকার। সেই টাকা
যে প্রযোজক দিবে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জহির ও কবির দুজনেই সজাগ। এই
প্রযোজকরা, ‘অশিক্ষিত
ও অর্ধশিক্ষিত’ এবং
‘মুনাফাখোর’। তাদের আসল কাজ হচ্ছে যেভাবেই হোক, যত শীঘ্রই সম্ভব মুনাফা তুলে
নেয়া; তাই তাদের আগ্রহ দর্শকদের ‘অসৎ বাসনা’গুলোর দিকে। কবির তাঁর
ধারালো বিশ্লেষণে বিষয়টা হাজির করেন এভাবে, ‘সাধারণ মানুষের সরল মন এবং ধর্মভীরুতার সুযোগ
নিয়ে আমাদের শতকরা ৯৭টি ছবিই দর্শকের মানসিকতাকে নিম্নতম পর্যায়ে, অপসংস্কৃতির আফিম খাইয়ে, তাদের সমাজ সচেতনতাকে যতদূর
সম্ভব ভোঁতা করে দেবার জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।’
অন্য আরেক আলোচনাতেও এ ধরণের জৈবিক বিনোদনসর্বস্ব ছবির এই রাজনৈতিক দিকটার কথা
বলেন,
‘সার্বিক নৈরাজ্য এবং হতাশার
প্রেক্ষাপটে এ জাতীয় ছবি গন-আফিমের কাজ করে। তাই প্রত্যেক গনবিরোধি সরকার এসব
ছবিকে রাজনৈতিক দোসর ভেবে পর্যাপ্ত নির্মাণ ও প্রচারের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে।’ (কবির ২০১৮)
তাঁদের দুজনের ক্ষোভ ‘সেন্সরের’ প্রতি। জহির রায়হানের মতে
শাসকশ্রেণী তাদের পুরনো নিয়মকানুন আঁকড়ে ধরে রাখার কৌশল হিসেবে এই পরিখা – সেন্সর বোর্ড - খনন করেন।
আইনের বেড়াজালে শাসকেরা সৎ চলচ্চিত্রের বক্তব্যকে কাটছাঁট করে দেন। (রায়হান n.d.) জহির
রায়হান যখন সিনেমা বানাচ্ছিলেন তখন পাকিস্তানি শাসনামল; বিভিন্ন ধরণের নিষেধাজ্ঞা
মাথায় নিয়ে তাকে একেকটা ছবি বানাতে হতো। এই ‘সেন্সর’কে কবির আমলাদের দৌরাত্ম্য হিসেবে চিহ্নিত
করেছেন। তাঁর মতে এর কোন প্রয়োজন নেই, এবং বিশেষ করে একটা ‘টিপিকাল মধ্যবিত্ত’ সংস্থা নির্ধারণ করবে কি
দেখা উচিৎ আর কি দেখা উচিৎ না, এটা অন্যায়। কড়া ভাষায় তিনি লিখেন,
‘কয়েকজন হাতে গোনা আমলা এবং
তাঁদের দ্বারা নির্বাচিত কয়েকজন শিক্ষিত কিন্তু আধুনিক চলচ্চিত্রজ্ঞান বিবর্জিত
ব্যক্তিবর্গ দ্বারা দেশের পাঁচ কোটি চলচ্চিত্র দর্শকের কি দেখা উচিৎ বা উচিৎ নয় তা
নির্ধারণ করা কেবল অসম্ভবই নয় – এই মুষ্টিমেয়ের চালচ্চিত্রিক অক্ষমতাকে চাপিয়ে
দিতে সারা জাতির সাংস্কৃতিক বীর্যকে নিঃস্পৃহ করারই শামিল’। (কবির ২০১৮)
আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্র ইতিহাস নিয়ে যে আলোচনা করেন সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ
প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকালীন সময়ে বেশ ভালো কিছু চলচ্চিত্র
নির্মিত হয়েছিল; এর
কারণ হিসেবে কবির নির্ণয় করেছে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে। তৎকালীন যে ভালো ভালো সিনেমাগুলো
নির্মাণ করা হচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চলচ্চিত্র কর্মী সরাসরি ভাষা আন্দোলনের
সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; তাঁর
জলজ্যান্ত প্রমাণ জহির রায়হান। এই দৃষ্টান্ত তার আরেকটা সিদ্ধান্তকেই প্রমাণ করে।
১৯৭৭ সালে লিখিত ‘চলার
পথে কিছু ভাবনা’ প্রবন্ধে
তিনি শুরুর লাইনেই একটা সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন, ‘যে কোন সত্যিকারের চলচ্চিত্রে নির্মাতার
আত্মজীবনীর প্রভাব না থেকে পারে না।’ কবিরের এই সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেন ভালো
চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যাচ্ছে না এই প্রশ্নেরও উত্তর পেতে আমাদের সাহায্য
করে। কবিরের মতে, যারা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী
সময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের
অজ্ঞতাই এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ। মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি তারা কেউ ধরতে পারেন
নাই। উদাহরণস্বরূপ সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘অক্টোবর’ ও ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ নিয়ে কথা বলেছেন। কবির বলেন, ‘তিনি যে কেবল অক্টোবর
বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন একাধারে শিল্পী ও বিপ্লবী
চলচ্চিত্রকার। রাজনৈতিক ট্রেনিং ছিল এ ধরনের ছবি করার প্রধান গুন। আমার ধারণা
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকারদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ তাঁদের রাজনৈতিক
প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার অভাব।’
তৎকালীন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকারদের নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা শেষে কবির রায় দেন, ‘এতে করে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসহ
ছবি করার জন্য মাত্র একজন চলচ্চিত্রকার রইলেন: জহির রায়হান’।
জহির রায়হানের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার
পর যে মাস দেড়েক বেঁচে ছিলেন, তখন কর্মব্যস্ততায় দিন কাটছিল জহিরের। তেমনি এক
সময়ে আলমগীর কবির এক লেখায় আমাদের জানাচ্ছেন, ‘বর্তমানে জহির রায়হান এবং লেখক [কবির]
বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় করে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র নির্মাণে কাজ
করে চলেছেন। ছবিটি ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে আশা রাখি’। কবিরের এই ‘আশা’র কথা শুনে বুকটা হু হু করে, কেননা স্বাধীন দেশেই
কিছুদিনের মধ্যে বিহারিদের হাতে জহির নিহত হন। এই জহিরকে হারানো যে কতবড় ক্ষতির
ছিল সেটা আমাদের চলচ্চিত্রের দিকে তাকালেই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। কবিরও বলতেন, ‘আজকে আমাদের দুর্দশা দেখে
বারবার মনে হয় জহিরের কাছে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প কতটা পেতে পারত...’।
এই আলোচনার সবচেয়ে বিষাদের বিষয় হচ্ছে, যাকে নিয়ে আলোচনা এবং যার জবানে আলোচনা দুজনেই
দুর্ঘটনায় নিহত হন। চলচ্চিত্রে বলেন, সাহিত্যে বলেন কিংবা চলচ্চিত্র-সমালোচনায় বলেন
তাঁদের দুজনেরই অনেক কিছু দেয়ার ছিল। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তাঁদের আরেক যোগ্য
উত্তরসূরিও – তারেক
মাসুদ - মারা যান দুর্ঘটনাতেই। বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের এ এক কালো অধ্যায়।
আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, মানুষ জহিরকে খুঁজছি। ‘মানুষ’ জহির তাঁর প্রতিভা, সৃষ্টি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সবকিছু
মিলিয়েই তৈরি। এবং, আমরা
যে শিল্পী জহিরকে চিনি তাঁর সম্পর্কে কবিরের মুখের কথা দিয়েই লেখাটার ইতি টানি, ‘উন্নত মানুষ জহিরই সৃষ্টি
করেছিল শিল্পী জহিরকে।’
তথ্যসূত্র:
কবির, আলমগীর, ২০১৮ , চলচ্চিত্র ও
জাতীয় মুক্তি , আগামী প্রকাশনী।
রায়হান, জহির,
n.d. "বাংলাদেশের
চলচ্চিত্র ও সৎ চলচ্চিত্র নির্মাতার দুর্গতি." সংস্কৃতি ডটকম, http://sangskriti.com/bangladesher-cholochitro-jahir-raihan/।
হোসেন, মাহমুদুল,
২০১৪, "সমাজ ও চলচ্চিত্র আলমগীর কবিরের সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা," শিল্প ও
শিল্পী , ০৩ ১৮।
No comments:
Post a Comment