Saturday, April 14, 2018

সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন ও সরকারের ফ্যাসিবাদি আচরণ

লেখক: সহুল আহমদ ও সারোয়ার তুষার


জর্জ অরওয়েল ১৯৪৪ সালে 'ফ্যাসিবাদ কী' নামে ছোট্ট এক প্রবন্ধে ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা নির্ধারন করতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন, রক্ষণশীল, কমিউনিস্ট, সোশালিস্ট, ক্যাথলিক, জাতীয়তাবাদী সকলেই কোন না কোনভাবে একে অপরকে ফ্যাসিস্ট বলে গালি দিচ্ছেন; তারা সবাই ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছিলেন, but not by the same people। মূলত, ফ্যাসিবাদের কোন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন নেই, একেক সমাজে একেক দেশে একেক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একেক রূপ ধারন করে । একনায়কত্বের বেশেও ফ্যাসিবাদ যেমন ঢুকতে পারে তেমনি সেটা গণতান্ত্রিক মুখোশেও ঢুকতে পারে। ফ্যাসিবাদ যেমন দমন-পীড়ন করে, তেমনি প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যমে জনগণকে নিজের দিকে টেনে আনার নীতিও মেনে চলে এবং অর্ধসত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণে জনগণকে কৌশলে নিজেদের দিকে নিয়ে আসাটাকেই বেশি ব্যবহার করা হয় সাধারণত। তাই, ফ্যাসিবাদ একটি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঠামো কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনকে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের মতবাদ হওয়া সত্ত্বেও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সাথে এর কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায় - সামরিক স্বৈরতন্ত্রের কোন জনসমর্থন থাকেনা, অপরদিকে ফ্যাসিবাদের বৈধতা চেতন কিংবা অবচেতনভাবে জনগণের কাছ থেকেই আসে। ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করার জন্যে নির্দিষ্ট কোন চারিত্রিক লক্ষণ না থাকলেও জাতীয়তাবাদের উগ্রতা, ধর্মের ব্যবহার, একটা কল্পিত শত্রু তৈরি করা ও প্রোপাগান্ডার চূড়ান্ত রকমের ব্যবহার সহ কিছু কমন বৈশিষ্টের দেখা মেলে। এ প্রসঙ্গে বামতাত্ত্বিক শিবদাষ ঘোষের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য, ‘একদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষে মানুষকে ফ্যানাটিক (অতিশয় উগ্র) করা, অন্যদিকে পুরনো ঐতিহ্যবাদ এবং ভাসাভাসা সমাজতন্ত্র, বিপ্লব আর প্রগতির স্লোগান-এই তিনটিকে যদি একত্রে মেলানো যায় তাহলেই একটা দেশে ফ্যাসিবাদের জমি তৈরি হয়’। মূলত যেকোন ফ্যাসিবাদই কোন না কোন আশ্বাসে পরিচালিত, তা সে কোন রাষ্ট্রকে 'গ্রেইট' কিংবা 'শাইনিং' কিংবা 'ডিজিটাল' বানানোর নামেই হোক।



সুন্দরবনের রামপাল প্রকল্পের বিষয়ে কথা বলার পূর্বে ‘কয়লা’ নিয়ে বিশ্বের বর্তমান অবস্থানটা একটু পরিষ্কার করে নিতে চাই। এটা ঠিক যে দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ জ্বালানি চাহিদার একটা বড় অংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ দিয়েই মিটিয়েছে, তবুও বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দরুণ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় এখন আর কোন গোপন বিষয় নয়। ফলে খোদ পুঁজিবাদের সেন্টাররাষ্ট্রসমূহ পরিবেশের উপর কয়লার ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৫ সালে কয়লা নিয়ে অক্সফামের করা এক প্রতিবেদনে দেখা যায় , বর্তমান পৃথিবীর জলবায়ুর সর্বনাশা বিপর্যয়ের জন্য সর্বাধিক দায়ী কালো কয়লা - এমনকি শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ের কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের এক তৃতীয়াংশের জন্যে দায়ী এই কালো কয়লা। কয়লা বিশ্ব শক্তির ৪১ শতাংশ যেমন প্রদান করে, তেমনি নির্গমনেরও ৭২ শতাংশ প্রদান করে। এমনকি আধুনিক তথাকথিত ‘পরিচ্ছন্ন’ কয়লা প্লান্টগুলোও গড়পড়তা মানের গ্যাস প্লান্টের চেয়ে অধিক কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে ; এবং নবায়নযোগ্য শক্তির চেয়েতো অসীম পরিমাণ বেশি । [Oxfam, Let them eat coal, 2015] তবে এর চেয়ে চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে সম্প্রতি 'Think Progress' এ প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকে । সেখানে আমেরিকার বৃহত্তম ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়লা উত্তোলন কোম্পানি 'Murray Energy'র সিইও এবং "American Coalition for Clean Coal Electricity" এর সদস্য রবার্ট মুর্যে বলেছেন 'ক্লিন কয়লা' বলতে কিছু নেই এবং এটি সম্পূর্ণই রাজনীতিবিদদের একটি মিথ্যা প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয় । তাঁর মতে কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্রে কয়লা পোড়ানোর সময় যে কার্বন ক্যাপচার ও সংরক্ষণের কথা বলা হয় তা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানীশক্তির যুগে বাস্তবোচিত কোন সিদ্ধান্ত নয়। (Coal CEO admits that 'clean coal is a myth, Jul 6, 2017) মুর্যেনর এই কথাটি ভয়াবহ তাৎপর্যপূর্ণ যখন খোদ আমেরিকাতেই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে জনগণকে বোঝানোর জন্য যে বৈশ্বিক উষ্ণতার একমাত্র সমাধান 'যৌক্তিক' উপায়ে কয়লা ব্যবহারের মধ্যেই রয়েছে ।

পরিবেশ জনিত এসব কারণেই মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়শীল দেশ বর্তমানে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন থেকে সরে আসছে এবং কয়লার ব্যবহারও কমিয়ে দিচ্ছে । যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি চাহিদার বড় অংশ মেটাতো এই কয়লা, অথচ, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তাদের জ্বালানি খাতে কয়লার ব্যবহার কমেছে ৩৫ শতাংশ । বিগত ৩৩ বছরের মধ্যে গতবছর সবচেয়ে কম কয়লা ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে। (বণিক বার্তা, জুন ০৪, ২০১৭) ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানাচ্ছে যে, গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি  ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে তিনটিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে । কয়লার এই স্থান বর্তমানে দখল করে নিচ্ছে গ্যাস, বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো, পূর্বে যেখানে এগুলো জ্বালানি চাহিদার ২২ ভাগ মেটাতো, বর্তমানে সেগুলো চাহিদার ৪০ ভাগ মেটাচ্ছে । (বণিক বার্তা, জুলাই ০৬, ২০১৭)

একই অবস্থা আমাদের পাশের দেশে ভারতে । একসময় যেখানে ভারতে কয়লার অত্যধিক ব্যবহার দেখে শঙ্কিত হচ্ছিল সবাই, সেখানে বর্তমানে ভারতও ঝুঁকছে সৌর বিদ্যুতের দিকে । উদাহরণস্বরূপ, কোল ইন্ডিয়া, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়লা উত্তোলকদের একটি, সম্প্রতি তারা ৩৭টি কয়লা খনি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে । এর পাশাপাশি এ ঘোষণাও দিয়েছে যে, ২০২০ সালের পর তারা নতুন করে আর কোন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান করবে না । এমনকি ধারণা করা হচ্ছে, ভারত ২০৫০ সাল নাগাদ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পুরোপুরি সরে দাঁড়াবে । (বণিক বার্তা, জুন ২৩, ২০১৭) দেশটির তৃতীয় জাতীয় বিদ্যুৎ পরিকল্পনায় (এনইপি-৩) ২০২৭ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের প্রায় ৬০ শতাংশ নবায়নযোগ্য ও দূষণমুক্ত জ্বালানি উত্স থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নেয়া হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির এ পরিকল্পনায় নেতৃত্বে থাকবে ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেড (এনটিপিসি) । হ্যাঁ, পাঠক বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, রামপালে কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণকারী ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এনটিপিসিই ভারতের নবায়নযোগ্য জ্বালানীর অগ্রদূত হতে যাচ্ছে । (বণিক বার্তা, জুন ২১, ২০১৭ ) । আদতে, ভারতে কয়লা বাণিজ্যে যে বিপুল ধস নেমেছে তা পুষিয়ে নিতেই ভারত উপযুক্ত একটি ডাম্পিং জোন খুঁজছিল এবং বাংলাদেশ সরকারের অতি উৎসাহ  এই প্রক্রিয়াকে আরো তরান্বিত করেছে । [কয়লাশিল্পের ক্ষতি ও মোদী সরকারের পরিকল্পনার জন্য দেখা যেতে পারে  Bloomberg এর তিনটি রিপোর্ট, 'Modi's plan to clean up world's worst air resisted by Indian power generators', 'Modi Eyes $3 billion Coal India Sale to Reach Deficit target', 'Coal India Net Rises as Modi Electricity Plan Boosts Growth' ]। উল্লেখ্য, ভারতে উৎপাদিত কয়লার মান অন্যান্য দেশের তুলনায় নিম্নমানের (বণিক বার্তা, মে ১১, ২০১৭) ।

চীনেও কমছে কয়লার ব্যবহার। ২০১৬ সালে চীনে কয়লার ব্যবহার কমার মধ্য দিয়ে দেশটিতে টানা তিন বছর কয়লা ব্যবহারে নিম্নমুখী প্রবণতা বিরাজ করছে । (বণিক বার্তা, জুন ১৫, ২০১৭) মূলত, একমাত্র আফ্রিকা ছাড়া ইউরোপ আমেরিকার প্রায় সবগুলো দেশেই কয়লার ব্যবহার কমতে শুরু করেছে । (বণিক বার্তা, জুন ২৩, ২০১৭) । কয়লার ব্যবহারের এই নিম্নমুখী প্রবণতার কারণ গবেষকরা বলছেন দুটো, প্রথমত, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার তাগিদ এবং দ্বিতীয়ত, কয়লার তুলনায় প্রাকৃতিক গ্যাসের সস্তা হয়ে ওঠা । (বণিক বার্তা, জুন ১৫, ২০১৭) অন্যদিকে ব্লুমবার্গ নিউ এনার্জি ফিন্যান্স আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, দ্রুতগতিতেই সৌরবিদ্যুতের দাম কমবে এবং দামের এ আকস্মিক পতনের কারণে অচিরেই বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসকে হটিয়ে বাজার দখল করবে সৌরবিদ্যুৎ । (বণিক বার্তা,জুন ২৯, ২০১৭)



৩.
এবার নজর দেয়া যাক সুন্দরবন সংলগ্ন রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের দিকে । সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক প্ল্যান্ট নির্মিত হলে কি কি ক্ষতি হবে, বিশেষ করে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পরিবেশ, জীবন-জীবিকা, বাস্তুসংস্থান এর উপর কিরকম ভয়ংকর প্রভাব পড়বে তা নিয়ে দেশি বিদেশি গবেষক, বিজ্ঞানী ও পরিবেশ আন্দোলনকারীরা গত কয়েকবছর যাবত প্রচুর কথাবার্তা-আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন । একদিকে কয়লাভিত্তিক প্ল্যান্ট যে কোন পরিবেশের জন্যেই হুমকিস্বরূপ, আবার অন্যদিকে এর পাশেই রয়েছে সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর জায়গা । স্পর্শকাতর এই কারণে যে, সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে যেমন গড়ে উঠেছে বিরাটকায় জীববৈচিত্র্য , তেমনি এই ম্যানগ্রোভ বন বাংলাদেশের জন্যে নিরাপত্তা-প্রাচীর হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে; পাশাপাশি এর সাথে জড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা । রামপালের এই প্ল্যান্ট থেকে বর্জ্য হিসেবে প্রতি বছর হাজার হাজার টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন-মনো-অক্সাইড, ফ্লাই এশ ও পারদ সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর দ্রব্য উৎপাদিত হবে যা কিনা একদিকে যেমন বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখবে তেমনি সে এলাকার মানুষের বিভিন্ন মারাত্মক রোগ সৃষ্টিও করবে; সুন্দরবনের উদ্ভিদের প্রাণও ধ্বংস করবে । সেই সাথে পানি দূষণ ও বায়ু দূষণতো আছেই । বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্রের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় । বিদ্যুতকেন্দ্রে কয়লা পোড়ানোর ফলে যে ফ্লাই অ্যাশ তথা ছাই জমা হয়েছে গত দশবছর ধরে তা এখনো সরানো হয়নি । প্রায় ১০ বছর ধরে জমানো ছাই জায়গার অভাবে আশপাশের জমিতেও ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে, যা মাছ, পানি ও পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। (বণিক বার্তা , ২৫ এপ্রিল , ২০১৭ ) । এছাড়াও , বড়পুকুরিয়ার দূষণে বাড়ছে অ্যাজমা-নিউমোনিয়া , ছাই পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আম, কাঁঠাল, লিচুর মতো ফলদ বৃক্ষ। ( বণিক বার্তা , মার্চ ১০, ২০১৭ ) । অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা, কিন্তু সবচেয়ে ভালো প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও এই প্ল্যান্ট থেকে প্রায় ৬৫ কেজি পারদ প্রতি বছর সুন্দরবনে ছেড়ে দেয়া হবে । (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১৬) । পরিবেশ বিষয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংস্থা গ্রিনপিস এর কয়লা ও বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞ লরি মাইলিভিরতা-র রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে করা গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য জানান দিচ্ছে , রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে তা হবে দেশের বায়ু দূষণের একক বৃহত্তম উৎস। কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নরসিংদী থেকে শুরু করে ভারতের বসিরহাট-কলকাতা পর্যন্ত ছড়াবে। এই দূষণের কবলে পড়ে বছরে ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হবে। বছরে ৬০০ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মাবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে অতি উচ্চমাত্রায় ‘স্নায়ুবিষ’ পারদ বের হবে। যা শিশুদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পারদের দূষণের কারণে সুন্দরবনের চারপাশের ৭০ কিলোমিটার এলাকার মাছ খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। কেউ যদি ওই মাছ খায় তাহলে সে স্নায়ুজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হবে। (প্রথম আলো , ০৫ মে ২০১৭)। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ প্রকৌশলী চার্লস টি ড্রিসকল, রামপালের প্ল্যান্ট হতে নির্গত কয়লা সম্পর্কে, তাঁর গবেষণা প্রতিবেদনে বলেন যে, এটা জলে-স্থলে মিশে সুন্দরবন এলাকার প্রতিটি জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলবে। পাখি, সরীসৃপ, বাঘসহ এ অঞ্চলের সব বন্যপ্রাণী পারদ দূষণের শিকার হবে। (সমকাল,১৮ জুন ২০১৭) এছাড়া, রামপালে কয়লা পরিবহনের জন্যে পশুর নদীতে ড্রেজিং করতে হবে যা কিনা সেখানকার মাছসহ জলজ প্রাণীর বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকাকে হুমকির মুখে ফেলে দিবে; এমনকি দ্রুত বিলুপ্তির মুখে। এই তথ্য দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. উইলিয়াম লেনডিল ও অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক ইউনিভার্সিটির ড. জন ব্রডি তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনে। (বণিক বার্তা, জুন ১১, ২০১৭) এছাড়াও স্বাধীন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে সেখানে বিভিন্ন রকমের দূষণ নিয়ন্ত্রণে উন্নত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে প্রায় ২ থেকে ৩.৮ টন পর্যন্ত কয়লার গুড়া বাতাস ও পানিতে ছড়িয়ে পড়বে; গবেষনায় দেখা গিয়েছে যে, কয়লার গুড়ার শিকার হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কোন কোন প্রজাতির মাছের পোণা শতভাগ মারা যায়। কয়লা পোড়ানো ছাইও পানির সাথে মিশে বিষাক্ত দূষিত পদার্থ তৈরি করবে, যা পরিবেশের জন্যে হুমকিস্বরূপ। এছাড়া রয়েছে জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি। (সর্বজনকথা, নভে, ২০১৬) রামপাল বিদ্যুৎপ্রকল্পে যে শুধু পরিবেশের ঝুঁকি আছে তা না, এর সাথে জড়িয়ে আছে আর্থিক ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা । মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ভারতীয় এনটিপিসি ৫০ শতাংশ মালিকানা পাবে এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ওই কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। অর্থাৎ আমাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমাদের পরিবেশ ও জনপদ নষ্ট করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্যের কাছ থেকে আমাদের কিনতে হবে । বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েব সাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ প্রকল্পের নাম বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লি.। এর সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং এনটিপিসি লি. ইন্ডিয়া। প্রকল্প ব্যয় (এফ আর) ১.৬৮ বিলিয়ন ডলার (১৪,৫১০ কোটি টাকা) অর্থ যোগান: ঋণ: ৭০ শতাংশ (ইসিএ লোন), ইকুইটি: ৩০ শতাংশ (বিপিডিবি ১৫ শতাংশ ও এনটিপিসি ১৫ শতাংশ ) - এই প্রজেক্ট একটি কোম্পানি আইনে চলবে। এই কোম্পানির মালিকানা বিপিডিবি ৫০ শতাংশ ও এনটিপিসি ৫০ শতাংশ)। যার অর্থ দাড়ায় এই কোম্পানির লাভ দুটি প্রতিষ্ঠানই সমান ভাগে পাবে। এছাড়াও , বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হয়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে তার চেয়ে ৬২ শতাংশ বেশি খরচ হবে। রামপাল প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ১৫ বছরের জন্য কর মওকুফ করেছে, যার আর্থিক মূল্য ৯৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বিদ্যুৎ প্রকল্পটিতে কয়লা আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে নদী খনন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হবে । ( বাংলা ট্রিবিউন , আগস্ট ০১, ২০১৬ ) ইন্সটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস এন্ড ফিন্যানশিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) রামপাল প্রকল্পের ১০টি আর্থিক সমস্যা চিহ্নিত করে বলেছে, এই প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং এটা স্থাপন মানে সময়ের উল্টো দিকে যাত্রা যা বাংলাদেশকে পিছনে নিয়ে যাবে। সেই সাথে এই প্রকল্প বাতিলেরও উপদেশ দিয়েছে সংস্থাটি। (সর্বজনকথা, নভে, ২০১৬) ।

২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও তৎসংলগ্ন সুন্দরবন এলাকা পরিদর্শন করে এসে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের মতামত জানিয়েছিলেন। হাসান আজিজুল হক, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সুলতানা কামাল, সৈয়দ আবুল মকসুদ সহ আরো অনেকেই ছিলেন সেই দলে। ‘রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পে কেন আপত্তি’ শিরোনামের সেই লেখাতে রামপাল হলে সুন্দরবনের কি কি ক্ষতি হবে তা সংক্ষেপে তুলে ধরে বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিক ভিত্তি আছে। (প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)



উপরোক্ত দুটো আলোচনা থেকে ধরে নেয়া যায়, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে যে আন্দোলন সেটা দু’টি মৌলিক প্রশ্নকে ঘিরেই গড়ে উঠবে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেখানে পরিবেশ ও আর্থিক কারণে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে সরে এসে সবুজের দিকে ঝুঁকছে সেখানে আমরা কেন উল্টো দিকে যাত্রা করবো ? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেই যে আমাদের প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন এবং তজ্জন্যে কয়লা ভিত্তিক প্ল্যান্ট স্থাপন করতেও হবে, তাহলে সেটা কেন সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর জায়গার পাশেই স্থাপন করতে হবে ? এই দুই প্রশ্নকে ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলন সপ্তম বছরে পদার্পণ করেছে এবং সেটা বর্তমানে পুরোদমে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন রূপেই হাজির হয়েছে। ‘সুন্দরবন’ এর নিরাপত্তাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, মানে রামপালের বিরোধিতার প্রধান কারণ।

সুন্দরবন রক্ষার এই আন্দোলনে তরুণদের অংশগ্রহণ আন্দোলনটাকে করে তুলেছে সৃজনশীল; প্রথাগত লিফলেট, পোস্টার, মিছিল-সভা-সমাবেশের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে পথনাটক, বাহাস, গানের আসর, সাইকেল র্যাকলির মতো নিত্যনতুন উপাদান। এই আন্দোলনকে ঠেকানোর জন্যে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টাগুলো সরকারের ফ্যাসিবাদী রূপ উন্মোচন করে দিচ্ছে। পূর্বেই উল্লেখিত ফ্যাসিবাদের লক্ষণসমূহের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের ব্যবহার ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। পাহাড়িদের উপর নির্যাতন, সাঁওতাল বাড়িতে পুলিশ দিয়ে আগুন ধরানো সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশই করছে। আবার, দাঙ্গার পরিবেশের মতো না হলেও বর্তমানে রাজনীতিতে ধর্মকে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করা হচ্ছে, উদাহরণস্বরূপ, হাইকোর্টের সামনে ভাষ্কর্যকে কেন্দ্র করে হেফাজতের সাথে ক্ষমতাসীন দলের যোগসাজশ সবাই প্রত্যক্ষ করেছে। নিজেদের স্বার্থে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে আগুন দেয়া ,পরিকল্পিত হামলার মতো ঘটনাগুলোতো আছেই। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ নাসিরনগর । সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের প্রগতিশীল সমাজ সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ নিয়ে বিচলিত হলেও নিওলিবারাল যুগে বেসরকারীকরণ, বিশ্বায়ন আর মৌলবাদের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণে ব্যর্থ হন প্রায়শই


সরকার পুলিশ ও নিজেদের গুণ্ডা বাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর বিভিন্ন উপায়েই দমন-পীড়ণ চালিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র গতবছর (২০১৬) জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই চার মাসের মধ্যে ঘটিত ‘দমন-পীড়ন-হুমকি’র যে তালিকা করা হয় সেখানে ১৯টি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। (সর্বজনকথা, নভে, ২০১৬) । তীরন্দাজ ‘কন্ঠনালীতে সূর্য’ নামক নাটক মঞ্চায়ন করতে চেয়েছিল গত বছর ২০ জুলাই; মঞ্চনাটক শুরুর আগে ‘সুন্দরবনের ওপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরূপ প্রভাব’ নিয়ে আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমি সেটার অনুমতি দেননি।(প্রথম আলো, ২২ জুলাই ২০১৬) এর কিছুদিন পর ২৮ জুলাই জাতীয় কমিটি বিক্ষোভ মিছিল করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি দিতে গেলে পুলিশ বাধা দেয় এবং লাঠি চার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। আগস্টের ২০ তারিখ খুলনায় সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন হিসেবে শিক্ষার্থীরা ‘কয়লা রাজার দেশে’ নামক পথনাটক করতে চাইলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়, পরবর্তীতে মাইক ছাড়াই পথনাটকটি মঞ্চস্থ করতে হয়েছে তাঁদের। (বাংলা ট্রিবিউন, আগস্ট ২০, ২০১৬) সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ তরুণরা ‘সুন্দরবনের জন্যে দুই চাক্কার ডাক’ শ্লোগানে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে সাইকেল র্যাধলি করতে চাইলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ দফায় দফায় সাইকেল র্যা লিতে হামলা চালায়। এতে প্রায় অর্ধশতাধিক আহতও হয়েছে। পুলিশ বাধা দেয়ার এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার বলেই ফেলেন,‘ছাত্রলীগের পাঁচটা ছেলের সঙ্গে পারো না, আবার কিসের আন্দোলন।’ (বাংলা ট্রিবিউন, সেপ্টে ৩০, ২০১৬) গত বছর (২৫ অক্টোবর) সিলেটের মদনমোহন কলেজে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট সুন্দরবনের জন্যে চিত্র প্রদর্শনী করতে গেলে ছাত্রলীগের কর্মীরা সেখানে অতর্কিত হামলা চালায়; এতে ৫-৬ জন কর্মী আহতও হন। এইতো কিছুদিন আগে (১২ জুলাই, ২০১৭) নারায়নগঞ্জে রামপাল বিরোধী এক সমাবেশ শেষে হামলা করা হয়, এতে কবি আরিফ বুলবুল সহ আরো অনেকেই আহত হন। (সিলেটটুডে, জুলাই ১২, ২০১৭) এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রামপাল বিরোধী সভা-সমাবেশ করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতে বাধা দিয়েছে, কোন কোন জায়গায় বলা হয়েছে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় সরকারী প্রতিষ্ঠান, তাই এখানে কোন সরকার বিরোধী কাজ করা যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার থাকলে 'সরকার বিরোধী' কথা থাকবে না কেন ?

খেয়াল করলে দেখা যাবে, আন্দোলনকারীরা আন্দোলন করে চলেছেন পুরো সৃজনশীল ও গণতান্ত্রিক উপায়ে, কিন্তু সরকার সেখানে দমন-পীড়ন-হুমকির আশ্রয় নিয়েছে। তবে, শুধুমাত্র দমন-পীড়ন-হুমকির মধ্যেই সরকারের কাজ সীমাবদ্ধ নেই , মিথ্যে তথ্য মিশিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে প্রোপ্যাগান্ডা মেশিনকেও ব্যবহার করেছে ও করে যাচ্ছে নিয়মিতভাবেই – যা কিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রকেই পরিষ্কার করেছে। সরকার বারেবারে গবেষকদের আলোচনাকে প্রত্যাখান করে বলে যাচ্ছে, সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ‘আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল’ প্রযুক্তির কথা, অথচ এই প্রযুক্তিতে পরিবেশ দূষণ কমবে মাত্র শতকরা ৮-১০ ভাগ। এও শোনা যাচ্ছে যে ‘আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল’ প্রযুক্তি বলতে কোন প্রযুক্তিই নেই , সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তিকেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে হাজির করা হয়েছে । কিছুদিন আগে একটা অবিশ্বাস্য অবর্ণনীয় মিথ্যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচার করেছে যে ইউনিস্কো রামপাল প্রকল্প থেকে তার আপত্তি তুলে নিয়েছে । কিন্তু সত্য হচ্ছে গত ৩ জুলাইয়ে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ২১ সদস্যের ৪১ তম সভায় সুন্দরবনকে ডেঞ্জার লিস্টে নেয়া হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে থেকে সরকারকে সুপারিশ করে যে , সরকারকে স্ট্রেটেজিক এনভায়রন্মেন্টাল এসেস্মেন্ট করে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এই রিপোর্টে যদি সরকার (সুন্দরবনের সুরক্ষায়) যথেষ্ট প্রগতি না দেখাতে পারে এবং এই প্রস্তাব গুলো সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহন না করতে পারে তবে সুন্দরবনকে আগামীতে 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ইন ডেঞ্জার' লিস্টে তোলা হবে। সেটিকেই সরকার প্রচার করেছে ইউনেস্কোর অনুমোদন হিসেবে।

তবে সরকার যতই অপ্রচার করুক, আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে তার জবাবও দেয়া হচ্ছে নিয়মিতভাবে। তাই দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী এই আন্দোলনকারীদের প্রতি কটাক্ষ করেন ‘রামপাল বিরোধীতাকারিদের রয়েল বেঙ্গল এর সঙ্গে দেখা করা উচিত’ বলে। (বাংলাট্রিবিউন,জানুয়ারি ২৮, ২০১৭) সরকারী আরেক সাংসদ বলেই ফেলেন, ‘সুন্দরবন যে দেশে নাই, সে দেশ কি চলে না?’ (বাংলা ট্রিবিউন, মার্চ ১৬, ২০১৭) । সরকারী দলের কথাবার্তাতেই অসহিষ্ণুতা লক্ষ করা যায়। অবশ্য রামপাল নিয়ে সরকারী দলের একগুয়েমিটা লক্ষ করার মতো যখন তাঁদের অর্থমন্ত্রী বলেন, ক্ষতি হলেও সরবে না রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। (ইত্তেফাক,১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬) ।

ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা সবসময় একটা কমন শত্রু তৈরি করতে চায়, এখানেও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। সরকারের কোন সমালোচনা করলেই তাকে ‘উন্নয়ন বিরোধী’ ট্যাগ দেয়া হয়েছে ও হচ্ছে, যদিও এটা পরিষ্কার না যে উন্নয়ন বলতে কি বোঝানো হচ্ছে এবং কাদের উন্নয়ন বোঝানো হচ্ছে ! অবশ্য ‘উন্নয়ন বিরোধী’ নামক এই কমন শত্রুতে কাউকে পরিণত করলে তার বিরুদ্ধে বিষাদগার করাও সহজতর ! শুধুমাত্র উন্নয়ন বিরোধী ট্যাগ দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো এই আন্দোলনকারীদের এবং জঙ্গিদের উদ্দেশ্য অভিন্ন বলেও মন্তব্য করেছেন। (সিলেটটুডে, আগস্ট২৭, ২০১৬)। সেই সাথে প্রধানমন্ত্রী যতই দাবি করুন যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবন হুমকিতে পড়বে না তবু নিজেদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র লুকিয়ে রাখতে পারেন না যখন বলেন, বেশি কথা বলবেন না, বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিবো, হারিকেন জ্বালিয়ে চলতে হবে । (সিলেটটুডে, আগস্ট ২৮, ২০১৬) । কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান এই সুরে কথা বলতে পারেন সেটা এক অপর বিস্ময়!

যখন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে দমন-পীড়ন-নির্যাতন-গ্রেফতার করেও আন্দলোন দমানো যাচ্ছেনা , তখন মিথ্যা ও ফাঁপা আবেগপূর্ণ ‘আস্থা রাখুন’ কিংবা ‘ভরসা রাখুন’ ধরণের অদ্ভুত প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা চলছে । সরকারী মোসাহেবদের কেন্দ্রীয় যুক্তি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বাংলাদেশকে কে বেশি ভালবাসে ! তাঁর চেয়ে কে বেশি বাংলাদেশের মঙ্গল চায় ! তিনি তো আর জেনেশুনে ভুল করবেন না, অতঃপর তাঁর উপর আস্থা রাখুন। প্রথমত, একক ব্যক্তির ( তা তিনি যত মহানই হোন না কেন ) শুভ ইচ্ছার উপর রাষ্ট্রের মঙ্গলামঙ্গল নির্ভর করার পক্ষে যারা ওকালতি করে , তারা সেই ব্যক্তির স্বৈরতান্ত্রিক শুভবোধ ও জনগণের চিন্তাদাসত্বের পথকে সুগম করার মাধ্যমে দুঃসহ ফ্যাসিবাদের পাটাতনকে দৃঢ় করে । দ্বিতীয়ত, তাত্ত্বিকদের মতে, ‘ফ্যাসিবাদ কখনো অতিমানবের ধারনার প্রচার করে, যে অতিমানব হচ্ছে জাতীয় ইচ্ছা ও স্বার্থের মূর্তরূপ’। প্রধানমন্ত্রী জেনেশুনে ভুল করতে পারেন না কিংবা প্রধানমন্ত্রী দেশকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন – এই ধারণার মধ্যেই নিহিত আছে ফ্যাসিবাদের সেই ‘অতিমানব’ এর ধারণা যার মধ্যে জাতীয় ইচ্ছা ও স্বার্থ মূর্ত হয়ে ওঠে।



সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন বামপন্থীদের আন্দোলন, একটি নাগরিক আন্দোলনকে হরতালের (আধাবেলা) মত কর্মসূচী দিয়ে রাজনৈতিক করে ফেলা হয়েছে এমন অভিযোগের কথা শোনা যায়। বলা বাহুল্য, এই ধরণের অভিযোগ নিজেদের অপারগতা লুকোতে অরাজনৈতিক মানসিকতার লোকেদের মুখেই শোনা যায়। কারণ রাজনীতির বাইরে মানুষ হয় না। মানুষের অস্তিত্বই তার রাজনীতির মূর্ত প্রকাশ। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক যিনি রাষ্ট্রের সাথে নানাবিধ চুক্তিতে আবদ্ধ থেকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করেন, তিনি কী করে রাজনীতির বাইরে হন? এছাড়া, এই আন্দোলন তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। জাতীয় কমিটি বামপন্থী দলগুলো ছাড়াও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যক্তি-বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ও পরিচালিত। জাতীয় কমিটির প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে দেশের সম্পদের উপর জনগণের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত করা । ফলে জাতীয় কমিটি পরিচালিত আন্দোলনে অন্তর্গতভাবে রাজনৈতিক চেতনা থাকতে বাধ্য। তবে সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনে প্রধান শক্তি এখনো পর্যন্ত রাজনীতি ও রাজনীতির বাইরে থাকা দেশপ্রেমিক তরুণপ্রজন্ম। রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিকবৃন্দ এক হয়ে কোন নাগরিক আন্দোলন গড়ে তুললে জাতীয় কমিটির আপত্তির কোন কারণ নেই। সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকের ।

সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে কেন ২০০৬ সালে হওয়া ফুলবাড়ি আন্দোলনের মত গণবিস্ফোরণে পরিণত হচ্ছেনা , ফুলবাড়িতে যেমন করে স্থানীয় জনগনের অংশগ্রহণে আন্দোলন গড়ে তোলা গিয়েছিল রামপালে কেন সেটা সম্ভব হলো না কিংবা হচ্ছে না? এই জিজ্ঞাসা অনেকের। এ প্রসঙ্গে গবেষক মাহা মির্জা রামপালের ডেমোগ্রাফিটাকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন ‘রামপাল এলাকার ডেমোগ্রাফিটা আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক ছিল না। ফুলবাড়িতে যেমন ফসলের মাঠের ওপর হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘদিনের আদি বসতবাড়ি। এখানে তেমন নয়... প্ল্যান্টের জন্যে অধিগ্রহণ করা ১৮৩৪ একর জমিতে বসবাস ছিল মূলত তিন ধরণের মানুষের – এক, ঐ এলাকায় দীর্ঘ ধরে বসবাস করা হতদরিদ্র জেলে কমিউনিটি, যারা মূলত নিম্নবর্গের হিন্দু। জমি অধিগ্রহনের সময় কিছু ক্ষতিপূরণ তারা পেয়েছে, কিন্তু আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি সঞ্চয় করে ওঠতে পারে নি। দুই, কিছুটা সচ্ছল ব্যবসায়ী, যারা একাধারে রামপালের বিভিন্ন জায়গায় চিংড়িঘরের মালিক, অধিগ্রহনকৃত এলাকায় স্থায়ীভাবে থাকত না তারা। ... তিনি, দরিদ্র দিনমজুর জেলে, যারা ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নয়। ... এমন পাঁচমেশালি ডেমোগ্রাফিতে আন্দোলন গড়ে উঠবে না, সেটাই স্বাভাবিক।’ (সর্বজনকথা, নভে, ২০১৬)

কিন্তু রামপালে সরাসরি বসতভিটা কিংবা কৃষিজজমি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবার ভয়াবহ যে আশঙ্কা রয়েছে তাকে কোনভাবেই তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। এর সাথে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জড়িত। তাই রামপাল চুক্তি বাতিল করতে প্রত্যেক শ্রেণী পেশার মানুষের সক্রিয়তা জরুরি। অজস্রে উপায়ে। সরকারী প্রচারণায় বিভ্রান্ত হবার কোন সুযোগ নেই । সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা অনন্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এই বনকে ধবংস করে কৃত্রিম উপায়ে লাখ লাখ গাছ লাগিয়েও কোন লাভ নেই। ভারতকে স্রেফ এটা মনে রাখতে হবে যে যদি সত্যিই বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্র পরস্পরের বন্ধু হয়ে থাকে তাহলে ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের চেয়ে ১.৬৮ বিলিয়ন ডলারের একটি বিদ্যুত প্রকল্প বড় হতে পারেনা। এই কথাগুলো ভারতের বুদ্ধিজীবী মহলেই বলাবলি হচ্ছে। (ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলি, মে ০৬, ২০১৭ )  শ্রীলংকার জনগণের চাপে সে দেশের সরকার এনটিপিসির সাথে কয়লাবিদ্যুত কেন্দ্র করার পরিকল্পনা বাতিল করেছে। (দ্য হিন্দু, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৬) সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে (নয়াচর) সে দেশের রাজ্য সরকার বিদ্যুতকেন্দ্র করতে পারেনি পরিবেশ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় (দ্য ইন্ডিয়ান টাইমস, অক্টোবর ১১, ২০১৪)। দুই ক্ষেত্রেই পরিবেশ দূষণের কথা বিবেচনায় রাখা হয়েছে ।

যে দেশের উত্থান একটি জনযুদ্ধের মাধ্যমে, সেই দেশের মানুষ কি তার প্রাকৃতিক সম্পদকে এভাবে বিনষ্ট হতে দিতে পারে ? দিতে পারেনা । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অর্থ হচ্ছে সক্রিয়তা, দেশের জন্য দশের জন্য লড়াই করা । সুন্দরবন না বাঁচলে সমস্ত উন্নয়নের গালগল্প মুহুর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে । তাই আমাদেরকে ভাবতে হবে । আমাদের দেশকে রক্ষা করতেই হবে । এটাই মুক্তিযুদ্ধের উত্তরপ্রজন্ম হিসেবে আমাদের কর্তব্য । বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মহান তাত্ত্বিক ফ্রাঞ্জ ফানোর একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি , - "Each generation must, out of relative obscurity, discover its mission, fulfill it, or betray it. " অজস্র সৃজনশীলতায় মুখর হোক সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন। 




No comments:

Post a Comment