Thursday, July 12, 2018

শাহবাগ থেকে কোটা: আন্দোলন দমানো, আন্দোলন কমানো এবং ইতিহাসের বোঝা



২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ চলাকালীন সময়ে অনেকেই এর কিছু কিছু সমালোচনা করেছিলেন, কিংবা কোন কোন বিষয়ে বিরুদ্ধ-মত প্রকাশ করেছিলেন। সমালোচনা করা মানে কেউ শত্রু হয়ে গেলো এই ভাবনার মধ্যে আর যাই হোক কোন ‘চিন্তা’ নাই। জামায়াত-শিবিরও ভারতের সমালোচনা করে, আবার বামপন্থী/লীগের চিন্তাশীলের একাংশও ভারতের আধিপত্য-বাদের সমালোচনা করেন; দুটোই ভারতের সমালোচনা কিন্তু দুইটাকে আপনি এক কাতারে ফেলতে পারবেন না। জামায়াত-শিবির যখন সমালোচনা করে তখন স্পষ্টত ‘সাম্প্রদায়িকতা’র গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। সব সমালোচনাকে এক করে দেখার প্রবণতা ভয়ঙ্কর, এবং এই কাজটাই ২০১৩তে ঘটেছিল। মঞ্চের সাথে যখনই কেউ দ্বিমত পোষণ করছিলেন, আমরা তার মত বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে খারিজ করতে পারতাম, (কখনো কখনো করাও হয়েছে) কিন্তু, আমরা তাদের সবাইকে ঢালাওভাবে ‘নব্য রাজাকার’ বা ‘পাকিস্তানপন্থী’ ট্যাগ দিয়েছি। এই সময়ে আওয়ামীলীগ সরকার যেভাবে যারে তারে ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী’ ট্যাগ দিচ্ছে তার প্রচলন শুরু হয়েছিল আমাদের হাতেই, মানে মঞ্চের হাতে।

যে কোন আন্দোলনের ইতিবাচক/নেতিবাচক প্রভাব থাকাটা স্বাভাবিক এবং তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা যত হবে ভবিষ্যতের জন্যে ততই ভাল হবে। যে সময়ে আমরা বসবাস করি সেখান থেকে দাঁড়িয়ে সেই প্রভাব বিচার করা হয়ে থাকে। মঞ্চের প্রচুর ইতিবাচক প্রভাব যেমন আছে, তেমনি নেতিবাচক প্রভাবও আছে। বর্তমানে আওয়ামীলীগ সরকারের যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা তার অনেককিছুর গোঁড়া মঞ্চেই। এই দায় মঞ্চের নিতে হবে, যেমন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জন্যে মানুষকে একত্র করে রাস্তায় নেমে পড়ার কৃতিত্বটা মঞ্চকেও দিতে হবে।


হুমায়ূন আহমদ কোন একটা উপন্যাসের ফুটনোটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে একটা মন্তব্য করেছিলেন। হুবহু মনে না থাকলেও অনেক এরকম ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাব নেই, কিন্তু সাহসের অভাব আছে’। এই মন্তব্যে উল্লিখিত শিক্ষকদের বাইরেও অনেকে আছেন – তা আমরা দেখেছি – কিন্তু হুমায়ূন যাদের ব্যাপারে মন্তব্য করছেন তাদের সংখ্যাই বেশি। ফ্যাসিস্ট আমলে দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা যেভাবে ফ্যাসিনেশনের মধ্যে পড়ে গেছেন সেটা অভূতপূর্ব। একজন তো আন্দোলনকারীদের ছাত্রদের মধ্যে মোল্লা ওমর-লাদেনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। তিনি মন্তব্য করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চিন্তা করতে পারি নাই কেউ এমন মন্তব্য করতে পারে! তিনি আমাদের কল্পনাকে হার মানিয়ে দিয়েছেন তাঁকে সাধুবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভিন্ন জায়গায়। আপনি যখন জনগণের কোন ন্যায্য দাবি দাওয়াকে এভাবে ‘ট্যাগ’ করবেন, তখন জনগণ এই ‘ট্যাগ’ দিয়েই পাল্টা জবাব দেয়। আন্দোলনের নিয়মই এমন। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু গন্ধ খুঁজে তাঁকে যতই নিষিদ্ধ করছিল তিনি যেন ততই শক্তিশালী হয়ে আমাদের আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। উদাহরণ বোধহয় যুতসই হলো না, তবু যা বলতে চাচ্ছি তা হল শব্দের ডিসকোর্স কিভাবে বদলায় সেটা বুঝতে পারা জরুরী। আমাদের ভিসি মহোদয় আন্দোলনকারীদের ‘জঙ্গি’ বলা শুরু করতে যাচ্ছেন, পরে এই শব্দ যদি তার ডিসকোর্স বদলায়ে ফেলে তখন তিনি কি বলবেন?


পত্রিকাওয়ালার খুব সুন্দর। তাঁরা বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের মুখপাত্র। ‘আন্দোলন-ফান্দোলন’ যত কম হবে ব্যবসার জন্য ততই মঙ্গল। আন্দোলনকারীরা রাস্তা বন্ধ করবে, জ্যাম বাড়াবে এসব ক্ষতিকর জিনিসপত্র। তাই দেশে যদি ফ্যাসিবাদ চলে কিংবা সামরিক শাসন চলে এবং তাদের ব্যবসাপাতি যদি ঠিকঠাক মতো চলে, তাহলে তাদের প্রধান কর্তব্য হয় সেই শাসনের গুণগান গাওয়া, মাঝেমধ্যে একটু কান্নার অভিনয় করা যেন এমন নির্বিঘ্ন শাসন চলতে থাকে আরও অনেক দিন। ফখরুদ্দীন আমলে বিভিন্ন পত্রিকা কিভাবে সামরিক শাসনের বৈধতা দান করেছিল সেটা মনে আছে। আমাদের তখন বয়স কম, কলেজের ছাত্র। পত্রিকা যা বলে তাই পড়ি, তাই বিশ্বাস করি, তাদের কথামতো সম্মতিও প্রদান করি। এইজন্যে ফখরুদ্দীন আমলের ভক্তও হয়েছিলাম। দেশের ছাত্ররা আন্দোলন করছেন, শিক্ষকরাও আন্দোলন করছে। ছাত্ররা মার খাচ্ছে, হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না। তাদের জন্যে বড়জোর দুই কলাম জায়গা বরাদ্দ থাকে, কিন্তু বিশ্বকাপ নিয়ে বরাদ্দ থাকে চার পৃষ্ঠা। খেলাধুলাকে আমি ঢালাওভাবে আফিম বলি না। খেলাধুলার মাধ্যমে জনগণ শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানায়। কিন্তু এই মূহুর্তে বাংলাদেশের পত্রিকাওয়ালারা যা করছে সেটা আফিম খাওয়ানোর সমতুল্য।

No comments:

Post a Comment