Friday, April 3, 2020

‘নারীবাদী প্রস্তাবনা’ : একটি খসড়া পাঠ প্রতিক্রিয়া


২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল যে, সুইডেনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একটি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দেশের ১৬ বছর বয়সী সকল নাগরিকের (বলা যায় কিশোর-কিশোরী, বা শিক্ষার্থী) কাছে একটি বই বিতরণ করবে। ক্যাম্পেইনের কর্তাব্যক্তিরা আশা করেছিলেন যে, এই বই জেন্ডার ও নারী-পুরুষের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা শুরু করতে, এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সাহায্য করবে। বইটির নাম হচ্ছে উই শুড অল বি ফেমিনিস্ট, বাংলায় বললে দাড়ায়, আমাদের সকলের নারীবাদী হওয়া উচিৎ। লেখকের নাম চিমামান্দা এনগোজি অ্যাদিচে; একজন নাইজেরিয়ান লেখক। উপরোক্ত ক্যাম্পেইনের একজন (নারী) এই বই সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আফসোস সহকারে বলেছিলেন, আহা, আমি যখন ১৬ বছর বয়সী ছিলাম তখন যদি আমার ছেলে বন্ধুদের এই বইখানা পড়াতে পারতাম!

আমাদের সৌভাগ্যের বিষয়, বীথি সপ্তর্ষির হাত ধরে অ্যাদিচে এর লেখাপত্র বাংলা ভাষায় হাজির হওয়া শুরু হয়েছে। ‘নারীবাদী প্রস্তাবনা’ নামে সদ্য প্রকাশিত হওয়া অনূদিত গ্রন্থে অ্যাদিচে এর দুটো ছোট পুস্তিকা জায়গা করে নিয়েছে, ‘আমাদের সকলের নারীবাদী হওয়া উচিৎ’, এবং ‘১৫টি সাজেশনে নারীবাদী ইশতেহার’। 

‘আমাদের সকলের নারীবাদী হওয়া উচিৎ’ এই লেখাটা কোনো নারীবাদী গবেষণা প্রবন্ধ না, বরঞ্চ, একান্তই অ্যাদিচে এর নিজের প্রাত্যহিক জীবন যাপনের অভিজ্ঞতার সমারোহ। তাঁর অভিজ্ঞতাই তাঁকে নারীবাদী বানিয়ে দিয়েছে; তিনি দাবি করছেন, তাঁর যখন ষোল বছর বয়স তখন নারীবাদী কি তার সংজ্ঞাও জানতেন না। এক বন্ধুর সাথে তর্ক করতে গিয়ে প্রথমবারের মতো 'নারীবাদী'র তকমা পেয়েছিলেন, তাও খানিকটা ‘খোঁচা’ হিসাবে। এরপর যখন শুনলেন নারীবাদীরা সুখী নারী হয় না, তখন নিজেকে সুখী নারীবাদী হিসেবে গড়ে তুললেন। যখন শুনলেন নারীবাদ আফ্রিকার নিজস্ব জিনিস নয়, তখন নিজেকে সুখী আফ্রিকান নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অর্থাৎ, তিনি যে সমাজে বসবাস করেছিলেন সেই বসবাসজনিত অভিজ্ঞতাই তাঁর ‘নারীবাদ’কে আলোকিত করেছিল।

অ্যাদিচে তাঁর বেড়ে উঠার অভিজ্ঞতা থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, এই সমাজ ভয়াবহ জেন্ডার-ভিত্তিক। তিনি যে স্কুলে পড়াশোনা করতেন সেখানে ক্লাস মনিটর হওয়ার জন্য পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেতে হতো, মানে যে সর্বোচ্চ নাম্বার পাবে সেই মনিটর হবে। অ্যাদিচে এর শখ ছিল মনিটর হওয়ার, নাম্বার সর্বোচ্চও পেয়েছিলেন, কিন্তু, যেহেতু তিনি ‘মেয়ে’ সেহেতু তাঁকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে যে ‘ছেলে’ ছিল তাকে মনিটর করা হয়। নেতৃত্ব বিষয়টা কেবল পুরুষের, নারীর সাথে বিষয়টা ঠিক যায় না - সমাজে নারী-পুরুষের এমন জেন্ডার ভিত্তিক ভূমিকা অ্যাদিচে এর মনে যে গভীর রেখাপাত করেছিল তা বোঝা যায়। তিনি একইসাথে অর্থনৈতিক ক্ষমতার জেন্ডারভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের কথাও তুলে ধরেন। একই কাজ নারী পুরুষ দুজনে করলেও, পুরুষ নারীর চেয়ে বেশি সম্মানী পান। কম সম্মানীতে সমান কাজ করো, কিন্তু কোনো অভিযোগ করো না - প্রতিনিয়ত সমাজ এই ধারণাগুলো উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করে, বিভিন্ন ভাবে। অ্যাদিচে তাই যখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে নারীবাদী হওয়ার আহ্বান জানান তখন তাঁকে কোনো কঠিন তত্ত্বের আশ্রয় নিতে হয় না, বরঞ্চ দিন-রাত যাপনের ঘাত-প্রতিঘাত থেকেই তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর নারীবাদী হওয়ার প্রেরণা ও তাগিদ একান্তই তাঁর সমাজকে বোঝাপড়ার জায়গা থেকে উদ্ভূত। 

নাইজেরিয়ান এই নারীবাদী আধুনিক জমানার মর্দানির (masculinity) সমালোচনাও করেছেন। তিনি বলছেন, মর্দানি স্বভাব আসলে একটি ‘কঠিন, ও ক্ষুদ্র খাঁচা’। আমরা আমাদের ছেলেদের কেবল শিখিয়েছি এই ক্ষুদ্র খাঁচার মধ্যে নিজেদের আবেগকে আটকে রাখতে। বলা হয়েছে, পুরুষ মানুষের সাথে ভয়, দুর্বলতা, কান্না, আত্মপ্রকাশ ইত্যাদি ‘ঠিক যায় না’, এগুলোকে এড়িয়ে যেতে হবে। ফলে, ছেলেরা ‘কঠোর’ পুরুষালি চেহারা হাজির করতে বারেবারে নিজেদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। 

কে নারীবাদী আর কে নারীবাদী না, কে কোন ধারার নারীবাদী - এমন কোনো তাত্ত্বিক এবং বর্জনমূলক রাস্তায় অ্যাদিচে হাঁটেন নি। তাঁর যাত্রা বরং প্রচণ্ড ‘ইনক্লুসিভ’। তাঁর কথা হচ্ছে, যে নারী বা পুরুষ মনে করেন যে, বিদ্যমান জমানা ও ব্যবস্থা ত্রুটিসম্পন্ন এবং সেখানে লিঙ্গভিত্তিক সমস্যা প্রচণ্ড-ভাবে বিরাজ করছে, এবং সে জন্য এর থেকে মুক্তি পেয়ে আরো ভালো এক দুনিয়ার জন্য একসাথে আমাদের লড়াই করা উচিৎ, তিনিই আসলে নারীবাদী। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তিনি মানবাধিকারের (human rights) পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন না, কেন আলাদা করে ‘নারীবাদী’ হওয়া লাগছে? এই প্রশ্নের মোকাবিলায় তিনি বলেন, নারীবাদ অবশ্যই মানবাধিকারের অঙ্গ, কিন্তু ‘মানবাধিকার’ এর অস্পষ্ট অভিব্যক্তিটি বাছাই করার মাধ্যমে এটা অস্বীকার করে ফেলা হয় যে, সমাজে নির্দিষ্ট ও বিশেষভাবে লিঙ্গ-সমস্যা বিদ্যমান। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে নারীকে সবকিছু থেকে বাদ দেয়া হয়েছে এটি আসলে তা লুকানোর একটি ভান। 

চিমামান্দা এনগোজি অ্যাদিচে এর কাছে নারীবাদ আসলে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে হাতিয়ার। তাঁর একেবারে সহজ সরল স্বীকারোক্তি হচ্ছে, ‘আমি নারীবাদী কেবল এই কারণে যে, আমি এমন এক দুনিয়া গঠন করতে চাই যেখানে কেউ যেন বলতে না পারে, তুমি এই কাজ করতে পারবে না, কারণ তুমি নারী’। নারীবাদী ইশতেহারে অ্যাদিচে যে পনেরটি পরামর্শ দেন, সেগুলোর একেবারে গোড়ার কথা হচ্ছে তাঁর উপরোক্ত স্বীকারোক্তি। বন্ধুর এক চিঠির প্রতিক্রিয়ায় তিনি এই চিঠি লিখেছিলেন, মূল তাগিদ হচ্ছে, ‘শিশুদের আলাদাভাবে গড়ে তোলার আলাপ নৈতিকভাবে জরুরি, নারী ও পুরুষের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী তৈরি করার চেষ্টা সম্পর্কিত সৎ আলোচনা প্রয়োজন’। এই চিঠিটাই প্রকাশিত হয়েছিল ‘Dear Ijeawele, Or a Feminist Manifesto in Fifteen Suggestions’ নামে। শিশুর সাথে পিতা-মাতার (এখানে মাতা) জীবন-যাপনের জার্নিটা কেমন হওয়া দরকার, সন্তানের সাথে কোন কোন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করে উচিৎ, (যেমন, যৌনতা, প্রেম ইত্যাদি), মানুষের বিচিত্রতাকে ধারণের শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নিয়ে অ্যাদিচে পনেরটি পরামর্শ দিয়েছেন। এই আলোচনাগুলো এতই স্থান-কাল-নিরপেক্ষ হয়ে উঠেছে তা পাঠক পড়া মাত্রই বুঝতে পারবেন। 

আমাদের মনে রাখা দরকার, অ্যাদিচে ঔপনিবেশিক অঞ্চলের বাসিন্দা, ভৌগলিক দিক থেকে আমাদের চেয়ে অনেক দূরের, আবার মানসিক দিক থেকে আমাদের খুব পরিচিত ভুবনের। তাঁর মতো আমরাও এক ঔপনিবেশিক অঞ্চলের বাসিন্দা, যাদের গায়ে উপনিবেশের থকথকে দাগ লেগে আছে। তাঁকে পড়ার আগ্রহ এই কারণেই বেশি ছিল। কালো, বাদামি, তথা উপনিবেশিত নারীরা যেন শোষিতের হাতেও শোষিত। যেমন, তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পড়াশোনা করতে আসার পর একবার শ্রেণিকক্ষে একটি প্রবন্ধের প্রশংসা করে শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন এটা কার লেখা? অ্যাদিচে হাত তোলায় শিক্ষক অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ‘কালো’ ও ‘আফ্রিকান’ কেউ এভাবে লিখবে এটা যেন শিক্ষককে মানতে কষ্ট হচ্ছিল। এই বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই বোধহয় অনুবাদক, বীথি সপ্তর্ষি, ভূমিকাতেই ঘোষণা দেন, “প্রায় ছয় হাজার মাইল দূর দেশে থেকে কালো নাইজেরিয়ান নারীরা যে পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে তা এই আপাত ‘উন্নয়নশীল’, নারী অগ্রযাত্রার দেশে বসেও উপলব্ধি করা যায়।”  

আমাদের দেশে, মানে বাংলাদেশে, কদ্দিন পরপর অনলাইনে, কে সহি নারীবাদ চর্চা করেন আর কে অ-সহি, এইসংক্রান্ত বিতর্কের ঢেউ উঠে। আবার নিও-লিবারেল দুনিয়াতে বসবাসকারী অনেকের দাবি হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়নই মুক্তি একমাত্র পথ। তারা অদ্ভুতভাবে ‘ক্ষমতা’কে প্রশ্নের বাইরে রেখে ‘ক্ষমতায়িত’ নারীকে দিয়ে মুক্তি কামনা করেন। আবার, অনেকেই উপনিবেশিত সমাজের অন্যান্য খাসলতের মতো নারীবাদী তত্ত্বকেও বাইরে থেকে আমদানি করে জনগণের মাথায় জোর করে চাপিয়ে দিতে চান, কিন্তু যেহেতু সামাজিক চর্চা থেকে এইসব তত্ত্ব উত্থিত হয় নি, ফলে জনগোষ্ঠীর চালচলন তাদের তত্ত্বের নিরিখে হয় না। ফলস্বরূপ, কখনো কখনো তাদের তত্ত্ব ও চর্চা জনগোষ্ঠীর প্রতি ‘বিদ্বেষ’ বা হালকা ‘বর্ণবাদে’ গিয়ে ঠেকে। বীথি সপ্তর্ষি সহি ও অ-সহি নারীবাদের বাইনারীর বাইরে গিয়ে আলাপ শুরু করার চেষ্টা করেছেন, এবং কোনো তাত্ত্বিক মারপ্যাঁচের মধ্যে পা না দিয়ে আলোচনা সেরেছেন। ভূমিকাতেই তিনি বলেন, নারীর প্রতি ব্যক্তি, সমাজ, ও রাষ্ট্রের মনোভাব বোঝার জন্য আলাদা কোনো ‘রাষ্ট্র’ প্রশ্নের দরকার নেই। সকল রাষ্ট্রেই নারী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হয়। 

বীথি যে নারীবাদী প্রস্তাবনা বইয়ের শুরুতেই হাজির করেছেন, তা কলেবরে ছোট এবং অংশত অপূর্ণাঙ্গ বলে মনে হলেও, এর আবেদনের দিকটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অ্যাদিচে তার লেখালেখিতে যেমন করে প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের অংশ হিসাবে নারীবাদকে গড়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, বা নারীবাদী হয়ে উঠার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, বীথির প্রস্তাবনাতেও তারই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। লেখাটার ইতি আপাতত বীথি সপ্তর্ষির ‘চাওয়া’ দিয়েই টানি: 

'এটাই সময়, নারীবাদকে রিক্লেইম করার। শুধু মতাদর্শ, শুধু বড়োলোকের, শুধু শিক্ষিতের, শুধু দর্শন হিসেবে নারীবাদ না থাকুক। নারীবাদ প্রাত্যহিকতায়, দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ, নিজের বাবা-মা থেকে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি, রান্নাঘর থেকে অফিসের ছাদ সবখানে ব্যাপ্ত হোক। নারীবাদ লিখিত আসমানি কিতাবের মতো শেলফের ওপরে তাকে পবিত্র গ্রন্থের মর্যাদায় সমাহিত না থেকে ব্যক্তির আচরণ, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পরিসরে স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠুক।'

প্রথম প্রকাশ: সাম্প্রতিক দেশকাল, ২৬ মার্চ ২০২০



No comments:

Post a Comment