Saturday, February 22, 2020

রাফিনের 'এক অসাধারন অন্ধ সময়ের স্মৃতি': আমাদের সময়ের প্রতিবেদন



রাফিনের 'এক অসাধারণ অন্ধ সময়ের স্মৃতি' শুরু হয়েছে তিনজন বিখ্যাত ব্যক্তির তিনটা উদ্ধৃতি দিয়ে। আমি যেভাবে এই তিনটা উদ্ধৃতি পাঠ করছি তা এরকম: কোনো পরাজয়ই শেষ পরাজয় নয়, মরণেরও হৃদয় আছে, এবং ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম আসলে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতিরক্ষার সংগ্রাম। এই তিন উদ্ধৃতির একটা মিশেল হচ্ছে রাফিনের এই 'উপন্যাস'। উপন্যাস শব্দকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখার কারণ আছে, পরে বলা হবে।

রাফিনের উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম শহিদ। শহিদ শব্দের একটা অর্থ হচ্ছে সাক্ষী। এই শহিদ আক্ষরিক অর্থে সাক্ষীই বটে, তবে নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার সাক্ষী নয়, বরঞ্চ পুরো একটা সময়ের সাক্ষী। এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উপন্যাসে হালকা চোখ বুলালে টের পাওয়া যাবে শহিদ যে সময়ের সাক্ষী বহন করছে, সেই সময় আমাদের প্রজন্মের বেড়ে উঠার ও জীবনযাপনের সময়। বিশেষ করে গত শতকের শেষ দশকের যাদের জন্ম তারা এই সময়ের সাথে পরিচিত। কেউ না বলে দিলেও রাফিনের সাথে শহিদের মিল অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যায়। কখনো কখনো, পাঠক যদি রাফিনের প্রজন্মের একজন হয়ে থাকেন, যেমন আমি, তাহলে নিজেকেও খুঁজে পেতে পারেন শহিদের মধ্যে।

এই সময়ে আমাদের প্রজন্ম যা দেখেছে, তার এক বিস্তর বিবরণ রয়েছে এই আখ্যানে। আমরা যেমন করে বেড়ে উঠছি, যা দেখেছি, যেমন, নাইন-ইলেভেনকে প্রত্যক্ষ করছি, তত্ত্বাবধায়ক দেখেছি, শাহবাগ দেখেছি, শাপলা দেখেছি- সবকিছুই এতে আছে। বাংলাদেশের পাশে ভারতের ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠাকে রাফিন বা আমাদের প্রজন্ম প্রত্যক্ষ করেছি, ব্লগার হত্যাকাণ্ড দেখেছি, ব্লগার গ্রেফতার হওয়া দেখেছি- এইসবই এই আখ্যানে এসেছে। শহিদ আমাদের আরো পরিচিত হয়ে উঠে যখন দেখি, সে ইমতিয়াজ আহমদ, সাইদ ফেরদৌস, অরুন্ধতী, মাহমুদুল হক, আলতাফ পারভেজদের লেখাপত্র পড়ে। সে চিরকুটের গান শুনে, শহীদ কাপুরের সিনেমা দেখে, মাহিনের ঘোড়াগুলি শুনে। এই শহিদ হাসান মান্টোর সাথে সুর মেলায়, 'লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়'।

এই সময়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক ময়দানে যেভাবে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিটি রাষ্ট্র ভয়ঙ্কর কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠে সেটা তুলে ধরা রাফিনের অন্যতম লক্ষ্য। দেশের ভেতর পার্টি-রাজনীতির ভয়াবহ কর্তৃত্ববাদী রূপ দেখে তাঁর আখ্যানের চরিত্র,শহিদ, যেমন ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠে, তেমনি সুনীলের 'ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ' পড়ে বহুদিন ধরে গড়ে উঠা স্বপ্নও ভেঙ্গে যায়। এমন একটা টালমাটাল সময়ে শহিদের জীবন ও যাপন। এই সময়টা আসলে অন্ধ হয় নি, অন্ধ 'হয়ে উঠছে' মাত্র। এই আখ্যানের শহিদ আসলে এই 'হয়ে উঠার'ই শহিদ বা সাক্ষী। সে কেবল সাক্ষী নয়, শিকারও বটে। তামান্নার সাথে তার যে ব্যক্তি-সম্পর্ক, সেইটাও এই কর্তৃত্ববাদী সমাজ ও রাষ্ট্র কোনো পরিণতির দিকে যেতে দেয় না, বরঞ্চ, ক্রমশ হতাশার আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতেই সাহায্য করে। এই নিক্ষেপ হওয়াটা কোনো যান্ত্রিক বিষয় না, মানুষই তো, মরণ-প্রক্রিয়াতেও হৃদয় রক্তাক্ত হতে বাধ্য।

শহিদ যে কর্তৃত্ববাদ দেখে আঁতকে উঠে, সেই কর্তৃত্ববাদের ভয়াবহ ফসল হচ্ছে 'গণহত্যা'। বিংশ শতাব্দীকে অনেকে গবেষকই বলেছেন সেঞ্চুরি অফ জেনোসাইড। আর্মেনিয়া থেকে শুরু করে কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা সবখানেই শতকজুড়ে বিভিন্ন সময়ে জেনোসাইডের ভয়াবহতা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করেছে। বাঙালিদের অভিজ্ঞতা দুই ধরণের। একাত্তরে নিজে গণহত্যার শিকার হয়েছে, এই শতাব্দীতে এসে আরেক গণহত্যার পরোক্ষ শিকার হয়েছে। রাফিনের আখ্যানের একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে গণহত্যার ভয়াবহতা ও নৃশংতার বিবরণ, এসেছে গণহত্যার ফলে সৃষ্ট শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবন-যাপন। উপরের সবকিছুই হচ্ছে রাফিনের উপন্যাসের উপাদান। এইসব উপাদান জড়ো করে তিনি উপস্থাপন করছেন তাঁর 'সময়'কে, যে সময় সম্পর্কে তাঁর চরিত্রের শেষ মন্তব্য:

'আরো অনেক গল্পের মতোই, শহিদ হাসানের গল্পটাও অসমাপ্ত রয়ে গেলো, অসমাপ্ততাই এই অসাধারণ অন্ধ সময়ের সাইলেট সিগনেচার। কিন্তু এই জায়গাটাকে আমার কবর মনে হচ্ছে, এখানে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।'

একটা বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে রাফিন কি আসলে 'উপন্যাস' লিখেছেন? বা, এটি কি 'উপন্যাস' হয়ে উঠেছে? ছোটকালে পড়েছি, উপন্যাস গদ্যে লিখিত এমন এক বিবরণ বা কাহিনী যার ভেতর দিয়ে মানব-মানবীর জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়। এটাকে আরো বিস্তৃত করে বলা হয়েছে উপন্যাসের প্লট থাকতে হবে, চরিত্রগুলো একটা পরিণতির দিকে যাবে, সংলাপ থাকবে, ইত্যাদি ইত্যাদি ... । আমাদের চিরচেনা কোনো কাঠামোয় রাফিনের 'এক অসাধারণ অন্ধ সময়ের স্মৃতি'কে আটকানো যাবে না। আমার মনে হয়েছে, রাফিন উপন্যাস লিখতেও চান নি। বরঞ্চ মনে হয়েছে, রাফিন যে সময় যেভাবে পার করেছেন, যেভাবে দেখছেন, দেখতে বাধ্য হয়েছেন, সেই সময়ের স্মৃতিকে সেভাবে কেবল লিপিবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছেন। শুরুতে তাঁর দেয়া মিলান কুন্ডেরার উদ্ধৃতি এইটাই ইঙ্গিত করছে বলে মনে হয়। তিনি কেবল চেয়েছেন তাঁর সময়ের প্রতিবেদন তৈরি করতে। ব্যাস, এর চেয়ে বেশি কিছু না। ভেতরে সেই প্রতিবেদন তাই কখনো কখনো প্রবন্ধের আকারও নিয়েছে। রাফিন কবিতা লিখেন, কবিতায় পুরো সময়টা ধরা সম্ভব হয় নি, কেবল খণ্ডাংশ তুলে ধরতে পেরেছেন। রাফিন প্রবন্ধ সাহিত্যের সাথে জড়িত আছেন, সেখানেও পুরো সময়ের প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন নি। প্রবন্ধ সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারতেন, কিন্তু সেখানে তথ্য-উপাত্ত-তত্ত্ব থাকতো; মানুষের (বা তাঁর নিজের) আবেগের সন্ধান পাওয়া যেত না। যেমনটা তিনি জুযাকের উদ্ধৃতি দিয়ে বোধহয় বলার চেষ্টা করছেন। ফলে, পড়তে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, তাঁর প্রত্যক্ষ করা সময়ের প্রতিবেদন তৈরি করতেই তিনি শহিদ-তামান্নার আশ্রয় নিয়েছেন। অর্থ্যাৎ, আখ্যানের উছিলায় তিনি আসলে এই 'সময়ে'র একটা প্রতিবেদন নির্মাণ করেছেন।

উপন্যাস হিসেবে 'এক অসাধারণ অন্ধ সময়ের স্মৃতি' কতটা উৎরাতে পারবে বলা কঠিন, কিন্তু যদি বলি সময়কে ধরতে পারার প্রয়াস, তাহলে এটা ভীষণ কাজের। এই উপন্যাস আসলে রাফিনেরই বিবরণ। রাফিনের মাধ্যমে রাফিনের চারপাশ বা পুরো প্রজন্মকে বোঝার জন্য এক দুর্দান্ত উপকরণ এই গ্রন্থ। বিশেষ করে প্রতিটি অধ্যায়ের নামকরণে রাফিন যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন সেও এক সুখকর পাঠ-অভিজ্ঞতা। রাফিনের এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। ফলে এখনো দেশের পাঠকদের হাতে পৌছায় নি। বলেছি পূর্বেই, রাফিন একজন কবিও বটে, আমার প্রিয় একজন কবি। রাফিনের জন্য দোয়া রইলো। তাঁর সাহিত্য-যাত্রা ও চিন্তা-যাত্রা শুভ হোক।

No comments:

Post a Comment