Thursday, February 13, 2020

ইসলামিকরণে 'সেকুলার' সরকারি দলের দায়


সেকুলার দলগুলো কেনো ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ে তার একটা বাংলাদেশী নমুনা জাসমিন লর্চ ২০১৮ সালের গবেষণায় দেখিয়েছিলেন। জাসমিন 'সেকুলার' শব্দের সংজ্ঞা, মানে কীভাবে সেকুলার বা সেকুলাইরেজশনকে সংজ্ঞায়িত করা উচিৎ, তা নিয়ে কোনো বাতচিৎ করেন নি, করার দরকারও পড়েনি। তার আগ্রহের জায়গাটা ছিল অন্য। সেকুলার বলতে যা আমরা 'সাধারণত' বুঝি, তা-ই তিনি ধরে কথাবার্তা আগাইছেন। এতে একটা সুবিধা হয়েছে অবশ্য, কোনো 'সংজ্ঞা'জনিত তর্ক-বিতর্কে না গিয়েই তিনি আমাদের প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্ন করতে পেরেছেন।

বাংলাদেশের আপামর বুদ্ধিজীবী-জনসাধারণ আওয়ামীলীগকে সেকুলার দলই মনে করেন, বা করতে চান, লর্চও একইভাবে আওয়ামীলীগকে সেকুলার দল বলে মেনে নিয়েই অগ্রসর হয়েছেন। তার মূল প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো একটা সেকুলার দল ইসলামিকরণে উদ্বুদ্ধ হয়। তিনি তিনটা উপাদানের মেলবন্ধনের কথা বলেছেন, মানে এই তিনটা উপাদানের মিশেল হলেই সেকুলার দল বা রাষ্ট্র ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে। 

প্রথম উপাদান হচ্ছে, ইসলামি পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন বা ইসলামি সামাজিক আন্দোলন। সমাজে ধর্মীয় ও সেকুলার উপাদানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলেও রাষ্ট্র ইসলামিরকরণের দিকে ঝুঁকে। সেকুলার সরকার যখন বেসরকারি মসজিদ-মাদ্রাসার প্রভাবের মুখে পড়ে তখন রাষ্ট্রের ধর্মীয় অবকাঠামো ধীরে ধীরে শক্তিশালী করা হয়। এতটুকু বলে লর্চ সাবধানবাণী উচ্চারণ করে জানাচ্ছেন, এইটাই একমাত্র বা কেবল দায়ী নয়। বরঞ্চ, মূল প্রশ্ন হচ্ছে, কোন রাজনৈতিক পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে সেকুলার সরকার ইসলামি আন্দোলনের সাথে আপোষ করে, বা সাড়া দেয়! 

এইখানে তাই এসে পড়ে দ্বিতীয় উপাদান: তীব্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা । ইসলামি আন্দোলন কখনো তীব্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করতে পারে। বা কোনো শক্তিশালী ধর্মীয় বিরোধী দল থাকতে পারে। এই ক্ষেত্রে সরকারী সেকুলার দল ইসলামিকরণের মাধ্যমে নিজেদের ভোট বা জনপ্রিয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু, এই রাষ্ট্রীয় ইসলামিকরণের পৃষ্ঠপোষকতা ইসলামি দলগুলোকে আরো গোঁড়াকে আঁকড়ে ধরতে প্রলুব্ধ করে, কেননা এতে তারা সরকারি সেকুলারদের সাথে নিজেদের 'ফারাক'টা যেন আরও বেশি করে চিহ্নিত করতে পারে। পাশাপাশি, এই ঘটনা দুই সেকুলার দলের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার বেলাতেও সত্য। দুই সেকুলার দলই একে অপরকে ঘায়েল করতে এবং নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে। এটা মূলত কোনো ধর্মীয় আন্দোলনের ফসল নয়, বরঞ্চ আসলে অনেকটা দলগুলোর নিজেদের রাজনৈতিক 'বাচা মরার' প্রশ্নের সাথে জড়িত! 

এরপরেই আসে তৃতীয় উপাদান: (সেমি-) অথোরিটেরিয়ানিজম। আধা- স্বৈরতন্ত্র। যখন সেকুলার শাসকদের গণতান্ত্রিক বৈধতার অভাব পড়ে তখনই স্বৈরাচারীরা ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে নিজেদের বৈধতা হাসিলের প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। এই পয়েন্টটা প্রায় যে কোনো স্বৈরাচারী শাসকদের সাথে মিলে যায়, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে বা অন্য কোনোখানে। কেননা, আমরা দেখেছি যে, এখানকার মিলিটারি স্বৈরাচারী শাসকরা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় বিধি-বিধান মানতে যতটা অনাগ্রহী ছিলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মীয় তোড়জোড়ে ততই যেনো আগ্রহী ছিলেন। যেখানে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি রয়েছে বা স্বৈরতন্ত্র রয়েছে, (লর্চ বারেবারে মুসলমান-অধ্যুষিত দেশগুলোর কথা বলছেন) সেখানেই সেকুলার সরকার কর্তৃক ব্যাপক ইসলামিকরণ সাধিত হয়েছে। লর্চ এরশাদ ও জিয়ার আমল নিয়েও কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করছেন যে, কোনো শক্তিশালী ইসলামি আন্দোলন না থাকলেও সেই 'অ-গণতান্ত্রিক সেকুলার' শাসকরা ক্রমাগত রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ করে গিয়েছেন। এই ঘটনাকে আসলে তিনি (আধা-)স্বৈরতন্ত্র যে সেকুলার সরকার কর্তৃক ইসলামিকরণের শক্তিশালী উপাদান তার একটা নমুনা হিসেবে হাজির করছেন। 

লর্চ যা দেখানোর চেষ্টা করছেন বা যে দিকে ইঙ্গিত করছেন তা উপরোক্ত হালকা ইশারা থেকেই আমরা বুঝতে পারি। বাংলাদেশে সেকুলার সরকার কর্তৃক কেনো ইসলামিকরণ ঘটে থাকে তার মূল কারণ হিসেবে তিনি এই তিনটার মিশেলকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন যে, এখানে হেফাজতে ইসলামীর মতো দলগুলো ইসলামি আন্দোলন করেছে, কিন্তু কেবল এই আন্দোলনগুলো সেকুলার শাসককে ইসলামিকরণের দিকে প্ররোচিত করে নি। বরঞ্চ, এটি তখনই করেছে যখন রাজনৈতিক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং আধা-স্বৈরতান্ত্রিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনগুলো সেকুলার শাসকদের রাজনৈতিক 'টিকে থাকা'কে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর একটা দুর্দান্ত উদাহরণ হিসেবে তিনি হাজির করছেন আওয়ামীলীগের সাথে হেফাজত ইসলামের সম্পর্কের বিবর্তনকে। হেফাজত যখন 'সেকুলার পদক্ষেপ'সমূহের বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম শুরু করে তখন আওয়ামীলীগ প্রথমে কোনধরনের ছাড় দেয় নি। কিন্তু যখন ২০১৩ সালে রাস্তায় নেমে এলো এবং বিএনপি তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করলো বা এটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলো, তখনই 'সেকুলার' আওয়ামীলীগ সরকার হেফাজত ইসলামকে ছাড় দেয়া শুরু করলো। এবং, ২০১৪ সালের 'নির্বাচনে'র পর যখন একেবারে (আধা-)স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়ে গেলো তখন হেফাজতের সাথে সম্পর্ক আরো ভালো হলো। 'কওমী জননী' উপাধির কথা আমরা সকলেই জানি। লর্চের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর। এর তিন মাস পর ভয়াবহ '৩১ ডিসেম্বরের নির্বাচন' অনুষ্ঠিত হলো। পরের ইতিহাস সবার জানা। 

এত কথা বললাম এই কারণে যে, 'মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলবে', 'হযরত ডাকার বাসনা', 'আওলাদে ওলী ঘোষণা দেয়া', 'আল্লার বানাইছেনই তাকে অমুক-তমুক কাজের জন্য', 'কোরআন-হাদিস মেনে সবার চলাফেরা করা উচিৎ',- এমনতর বক্তৃতা-বিবৃতি যার/যেসবের আলামত হিসেবে আমাদের চতুর্দিকে আজকার চলাফেরা করে, তার কিছুটার হদিস লর্চের এই গবেষণায় পাওয়া যায়। এমনকি যারা আওয়ামীলীগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সেকুলার রাষ্ট্র বানানোর বাসনা মনে পুষে রাখেন (বাসনা থাকাটা খারাপ নয়, রাখতেই পারেন), এবং আওয়ামীলীগ না থাকলে রাষ্ট্র 'ধর্মওয়ালাদের খপ্পরে' পড়ে যাবে এমন আশঙ্কা যারা বারেবারে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে থাকেন তাদের জন্য লর্চের গবেষণা চিন্তার খোরাক দিতে পারে। কেনো বা কোন পরিস্থিতির কারণে এমন বহু-আকাঙ্ক্ষার 'সেকুলার' সরকার মনের এই বাসনা পূরণ করতে ব্যর্থ হলো বা হচ্ছে, সেটাও তলিয়ে দেখার দিশা পাইতে পারেন। গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকলে কোনো 'বিশুদ্ধ' দল দিয়েও খুব একটা কামনা-বাসনা পূরণ হবে না, হওয়ারও নয়। 


আলাপের সূত্র: Islamization by Secular Ruling Parties: The Case of Bangladesh/ Jasmin Lorch

No comments:

Post a Comment