সংজ্ঞার খোঁজে
জেনোসাইড শব্দের ব্যবহার
তুলনামূলকভাবে নতুন, পোলিশ আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন এই শব্দ প্রথবারের মতো ১৯৪৪ সালে
ব্যবহার করেন।[1] এই শব্দের জন্মের পূর্বেই পৃথিবী অসংখ্যবার এই অপরাধ দেখে
ফেলে। তাই, লিও কুপার বলেছিলেন যে, শব্দ নতুন হলেও অপরাধ পুরাতন। প্রাচীনকালের মহাকাব্য
বা বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস খুজলেও জেনোসাইডের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যায়, তবে আধুনিক
কালে এসে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে এই অপরাধের নতুন মাত্রা সংযোজন হয়েছে। মাত্রা
ও তীব্রতার নতুনত্ব এত বেশি যে, অনেক সমাজবিজ্ঞানী জেনোসাইডকে
‘মডার্নিজম’ ও ‘রাষ্ট্রে’র সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে থাকেন। মানে আধুনিক যুগের
জেনোসাইডের সাথে পূর্বের জেনোসাইডের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। ইউরোপে নাৎসিবাদের
হালচাল দেখে উইনস্টন চার্চিল একে বলেছিলেন ‘We are in the presence of a crime
without a name!’[2] তাই ‘নামহীন এই অপরাধে’র নাম কি হবে সে সময় প্রশ্নটা
জোরেশোরেই আলোচনায় চলে আসে। রাফায়েল লেমকিনের Axis Rule in Occupied Europe বইটা প্রকাশিত
হয় ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে। সেখানেই তিনি ‘জেনোসাইড’ শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন, এবং পরবর্তীতে
এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাফায়েল লেমকিন প্রাচীন
গ্রিক শব্দ genos এবং ল্যাটিন শব্দ cide এই দুটো মিলিয়ে জেনোসাইড শব্দের উদ্ভব ঘটান।
genos মানে হচ্ছে, জাতি বা গোষ্ঠী এবং cide মানে হচ্ছে হত্যা, দুটো মিলে genocide,
সহজ মানে হচ্ছে পুরো একটা গোষ্ঠীকে হত্যা করা। তবে রাফায়েলের কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি শুধু
শব্দটা চালুই করেন নি, বরং ব্যাখ্যাসহ এর সংজ্ঞাও দিয়েছেন। তিনি যখন বইটা লিখছেন, বা
শব্দটা চালু করছেন তখন হিটলার বা নাৎসি বাহিনীর আমল, তাই তৎকালীন নাৎসী বাহিনীর বিবিধ
কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতেই তাঁর ব্যাখা-বিশ্লেষণ হাজির হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে জেনোসাইড মানে যে শুধু একটা গোষ্ঠীর মানুষকে শারিরীকভাবে
হত্যা করাই বোঝায় না, বরং, পরিকল্পিতভাবে একটা গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার নিমিত্তে আরো বিবিধ
কার্যবলীও যে জেনোসাইডের অন্তর্ভুক্ত সেটাও রাফায়েল চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন। তাঁর কথা
হচ্ছে, শারীরিকভাবে হত্যা করা ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কিন্তু একমাত্র অংশ নয়। তাই রাফায়েল
তাঁর বইতে লিখেন,
‘By
"genocide" we mean the destruction of a nation or of an ethnic group.
… Generally speaking, genocide does not necessarily mean the immediate
destruction of a nation, except when accomplished by mass killings of all
members of a nation. It is intended rather to signify a coordinated plan of
different actions aiming at the destruction of essential foundations of the
life of national groups, with the aim of annihilating the groups themselves.
The objectives of such a plan would be disintegration of the political and
social institutions, of culture, language, national feelings, religion, and the
economic existence of national groups, and the destruction of the personal
security, liberty, health, dignity, and even the lives of the individuals
belonging to such groups. Genocide is directed against the national group as an
entity, and the actions involved are directed against individuals, not in their
individual capacity, but as members of the national group…. Genocide has two
phases: one, destruction of the national pattern of the oppressed group; the
other, the imposition of the national pattern of the oppressor. This
imposition, in turn, may be made upon the oppressed population which is allowed
to remain or upon the territory alone, after removal of the population and the
colonization by the oppressor's own nationals.’[3]
১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘের
অধিবেশন জেনোসাইড শব্দের একটা পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা প্রদান করা হয়। সেখানে জেনোসাইডের সংজ্ঞা
প্রদানের পাশপাশি কোন কোন কাজকে জেনোসাইড বলা যাবে, কে কে এর শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হবে
ইত্যাদি টেকনিক্যাল দিক নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে অনেক তর্ক-বিতর্কের
পর এই সংজ্ঞা নির্ধারণ হয়। এই ‘detailed and technical’ সংজ্ঞাটা নিম্নরূপ:
Article 2
In the present
Convention, genocide means any of the following acts committed with intent to
destroy, in whole or in part, a national, ethnical, racial or religious group,
as such:
(a) Killing
members of the group;
(b) Causing
serious bodily or mental harm to members of the group;
(c) Deliberately
inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its
physical destruction in whole or in part;
(d) Imposing
measures intended to prevent births within the group;
(e) Forcibly
transferring children of the group to another group.
Article 3
The following acts
shall be punishable:
(a) Genocide;
(b) Conspiracy to
commit genocide;
(c) Direct and
public incitement to commit genocide;
(d) Attempt to
commit genocide;
(e) Complicity in
genocide.[4]
লেমকিন যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন
তাঁর সাথে জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনের এই সংজ্ঞার যেমন মিল আছে তেমনি অমিলও আছে। আবার, জাতিসঙ্ঘের
অধিবেশনের এই সংজ্ঞাকে সমালোচনার উর্ধ্বে রাখা হয় নি। বিশেষ করে, জেনোসাইড স্টাডিজ
নামক বিষয় নিয়ে যখন সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আলোচনা শুরু করেন
তখন উপরোক্ত এই সংজ্ঞার বিবিধ পর্যালোচনা হাজির হতে থাকে। সকলেই প্রথমত একটা সংজ্ঞা
দেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং দ্বিতীয়ত কীভাবে জেনোসাইড রোধ করা যায় তার একটা উপায় বাতলে
দিয়েছেন। আইনি সংজ্ঞার সাথে একাডেমিয়ানদের সংজ্ঞার কিছু ফারাকও ঘটতে থাকে বিভিন্ন সময়ে।
লিও কুপার বলছেন যে, উপরোক্ত সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেটা মেনে নিচ্ছেন,
এবং বলছেন যে জেনোসাইডের নতুন কোনো সংজ্ঞা দেয়ার দরকার নেই।[5] বিপরীতে
ফ্রাংক চক ও কুর্ত জোনাশন বলছেন যে, যদিও আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞা মাইলফলকস্বরূপ
তবু গবেষকদের এটা খুব একটা কাজে লাগে না।[6] কেউ কেউ এই দুই মতের মধ্যে
সেতুবন্ধনের চেষ্টাও করেছেন।[7]
অধিবেশনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে
জেনোসাইডের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে সেখানে কয়েকটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বা বলা যায়
এই বিষয়গুলোর কারণেই জেনোসাইড অন্যান্য cide থেকে ব্যতিক্রম। প্রথমত, intent থাকা লাগবে,
মানে কোনো নিয়ত থেকে কর্মসম্পাদন করা হচ্ছে (ধ্বংস করা হচ্ছে)। দ্বিতীয়ত সেই ধ্বংসের
মাত্রা কেমন হবে তা in whole or in part বাক্যাংশের মধ্যে আভাস দেয়া হয়েছে। তৃতীয়ত,
কারা কারা ‘ভিকটিম’ বলে বিবেচিত হবেন; মানে কাদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালালে
সেটাকে জেনোসাইড বলা যাবে সেটা বলে দেয়া আছে। এখানে চারটা গোষ্ঠীকে (national,
ethnical, racial or religious) ভিকটিম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চতুর্থত, কোন কোন
কাজ (acts) জেনোসাইড বলে স্বীকৃত হবে সেটা বলে দেয়া হয়েছে। কোনো গোষ্ঠীকে মেরে ফেলা
(killing), গোষ্ঠীর সদস্যদের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন করা, ইচ্ছাকৃতভাবে
কোনো গোষ্ঠির ওপর এমন কিছু চাপিয়ে দেয়া যা তাদেরকে শারীরিকভাবে (physical) ধ্বংস করতে
পারে, গোষ্ঠীর মধ্যে জন্ম রোধ করার লক্ষ্যে কোনো ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, এবং, জোরপূর্বক
এক গোষ্ঠীর শিশুদের আরেক গোষ্ঠীতে স্থানন্তর করা এই সবকিছুকেই genocidal act হিসেবে
বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, এই সংজ্ঞানুযায়ী, যখন কোনো একটা গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা
আংশিক ধ্বংস করার নিয়তে উপরোক্ত কাজ (act) সম্পাদিত হবে তখনই সেটা জেনোসাইড হবে।
উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমি
অভিধানে genocide এর পরিভাষা হিসেবে ‘গণহত্যা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘গণহত্যা’ শব্দের
আক্ষরিক অর্থ যেহেতু শুধু গণকে হত্যা করা বোঝায়, সেহেতু বাংলাদেশের অনেক গবেষকই জেনোসাইডের
পরিভাষা হিসেবে ‘গণহত্যা’ শব্দটা পরিহার করেন।[8] তবে, জেনোসাইড শব্দটা
যে অর্থে ব্যবহৃত হয় (সংজ্ঞানুযায়ী) বাংলায় প্রচলিত বই-পত্র-দলিলাদিতে ঠিক সেই অর্থে
গণহত্যা শব্দটাও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আলোচ্য প্রবন্ধের যেসকল স্থানে ‘গণহত্যা’ শব্দটা
ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে জেনোসাইড ও ‘গণহত্যা’ সমান-অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে; ‘জেনোসাইড’
এর সংজ্ঞার যে বিস্তৃত ব্যবহার রয়েছে, তা জেনোসাইড শব্দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ধরে নিয়ে
আলোচনা করা হয়েছে। তবে, যেহেতু ‘গণহত্যা’ শব্দ ঠিক-ঠাকভাবে পুরো প্রক্রিয়াটাকে ‘যথার্থ’রূপে
ফুটিয়ে তুলে না, সেহেতু আমরা চেষ্টা করেছি ‘জেনোসাইড’ই ব্যবহার করতে।
জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে তৃতীয়
অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কারা কারা গণহত্যার জন্যে শাস্তির আওতায় পড়বে। জেনোসাইড করা, জেনোসাইডের
ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করা, জেনোসাইডে উষ্কানি দেয়া, জেনোসাইডের চেষ্টা করা এবং জেনোসাইডে
সাহায্য করা - এইসব কিছুই, জাতিসঙ্ঘের অধিবেশন অনুযায়ী, শাস্তির আওতায় পড়বে। জেনোসাইডের
বিচারের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদ বেশ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোনো সন্দেহ নেই এই
সংজ্ঞা নির্ধারণ পৃথিবীর আইনি ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা, তবু বিভিন্ন সময়ে জেনোসাইড
স্টাডিজের গবেষকরা এই সংজ্ঞাকে ক্রিটিকালি বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এই সংজ্ঞার তিনটা
বিষয় গবেষকদের আলোচনায় ঘুরে ফিরে এসেছে। প্রথমেই আসে যে চারটা গোষ্ঠীকে(national,
ethnical, racial or religious) এই সংজ্ঞা রক্ষা করেছে সেই ‘গোষ্ঠী’কে নিয়ে। জাতিসঙ্ঘ
অধিবেশনে খসড়া নিয়ে আলোচনার সময় এই চারটা গোষ্ঠীর সাথে রাজনৈতিক (political) গোষ্ঠীও
অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবল আপত্তির মুখে এই গোষ্ঠীকে বাদ দেয়া
হয়। সোভিয়েত মুখপাত্রের এই যুক্তি দেখানোর কারণ হচ্ছে স্ট্যালিন আমলে রাজনৈতিক শত্রু
আখ্যা দিয়ে দিয়ে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় সেটা যেন সংজ্ঞানুযায়ী ‘জেনোসাইডে’র অন্তর্ভুক্ত
না হয়।[9] আবার হাইতির মুখপাত্র বিপরীতে যুক্তি দিয়েছিলেন, বর্তমান সময়ে
যে কোনো সরকার যে কোনো গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে ‘রাজনৈতিক’ বিবেচনার কথা
বলে।[10] রাফায়েল লেমকিনও তাঁর সংজ্ঞায় রাজনৈতিক দলকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
কিন্তু পরিশেষে রাজনৈতিক দলকে বাদ দেয়া হয় ‘because of the widespread fear that
this might lead to intervention in the domestic affairs of states.’[11]
পরবর্তীতে ‘politicide’ বলে আরেকটা শব্দ উদ্ভবের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করার
অপরাধকে genocide থেকে আলাদা করা হয়। তবে, একাডেমিয়ানদের প্রায় প্রত্যেকেই জেনোসাইডের
যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন বা সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন তারা সবাই জেনোসাইডের সংজ্ঞায়
‘রাজনৈতিক দল’কে (political group) অন্তর্ভূক্ত
করেছেন। স্টিভেন কাতজ বলছিলেন, ‘Genocide is the actualization of the intent,
however successfully carried out, to murder in its totality any national,
ethnic, racial religious, political, social, gender or economic group, as these
groups are defined by the perpetrator, by whatever means’[12] তবে সবচেয়ে
বিস্তৃত সংজ্ঞা দিয়েছেন ফ্র্যাংক চক ও কুর্ত জোনাসন। তারা বলছেন, ‘genocide is a
form of one-sided mass killing in which a state or other authority intends to
destroy a group, as that group and membership in it are defined by the
perpetrator.’[13] তারা জেনোসাইডের সংজ্ঞায় কোনো ‘রক্ষিত গোষ্ঠী’কে চিহ্নিত
করেন নি, বরং সেটা খোলা রেখে দিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনের সংজ্ঞায় যে সীমাবদ্ধতা ছিল
তা গবেষকরা তাদের সংজ্ঞাতে অনেকটাই ঘুচিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়াও, জেনোসাইডকে
আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের সাথে জড়িয়ে দেখার প্রবণতাও আছে। প্রাচীন কালের জেনোসাইডের
সাথে এই যুগের জেনোসাইডের একটা মুল পার্থক্যের জায়গা হচ্ছে এই রাষ্ট্রের উদ্ভব। রাষ্ট্রের
বৈশিষ্ট্যই এমন, তা গণতন্ত্রী হোক বা সৈরতন্ত্রী হোক, সে জেনোসাইড করবেই।[14]
গবেষক রামেল গত শতাব্দীর বিবেচনায় আরেকটা নতুন শব্দের উদ্ভব ঘটিয়েছেন, ‘democide’।
ডেমোসাইড হচ্ছে রাষ্ট্র-কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যা। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন গত একশবছরে
(১৯০০-১৯৯৯) পৃথিবীর বিভিন্ন সরকারের হাতে নিহত মানুষের সংখ্যা ২৬২ ০০০ ০০০। সেই সাথে
তিনি এটাও জানাচ্ছেন, যে সরকার যত কর্তৃত্ববাদী জেনোসাইড চালাতে সে সরকারের প্রবণতা
তত বেশি।[15] কোনো কোনো গবেষক যখন জেনোসাইডের সংজ্ঞা দিয়েছেন তখন আক্রমণকারী
হিসেবে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহকেই চিহ্নিত করেছেন। আরভিং লুইস বলছেন জেনোসাইড
হচ্ছে ‘a structural and systematic destruction of innocent people by state
bureaucratic apparatus’.[16]
জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনের
উপরোক্ত সংজ্ঞার আরেকটা আলোচিত বিষয় হচ্ছে ‘হত্যার মাত্রা’। কি পরিমাণ মানুষ মারা গেলে
একে জেনোসাইড বলা যাবে? মূল সংজ্ঞায় খোদাইকৃত in whole or in part বাক্যাংশ মাত্রাকে
অস্পষ্ট করে তুলছে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।[17] ফরাসী দার্শনিক জ্যা
পাল সাত্রে উপনিবেশায়নকেও জেনোসাইড বলেছেন কারণ, পরিকল্পনা ব্যতীত উপনিবেশায়ন কায়েম
করা সম্ভব না।[18] কিন্তু, লিও কুপার সাত্রের এই বিস্তৃত সংজ্ঞার সমালোচনা
করে বলেছেন, উপনিবেশায়ন আর হিটলারের গ্যাস চেম্বারে কোটি কোটি নিহত এই দুটোকে এক পাল্লায়
মাপা কি সম্ভব?[19] অবশ্য লিও কুপারও উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার নিষ্ঠুরতা ও
নির্মমতাকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেননি, যতটা সাত্রে দিয়েছেন। জেনোসাইড স্টাডিজের গবেষক ইসরায়েল
চার্নি বেশ বিস্তৃত সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি কোনো ধরনের মাত্রাকে বিবেচনায় আনেন নি, তাঁর
মতে, ‘whenever large numbers of unarmed human beings are put to dart at the
hands of their fellow human beings, we are talking about genocide’.[20]
মাত্রা দিয়ে জেনোসাইডকে বিবেচনা করার দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি নৈতিকভাবে অযৌক্তিক ও মানব
জীবনের জন্যে অপমানসূচক বলে মনে করেন। অন্যদিকে লিও কুপার বলছেন যে জেনোসাইড হওয়ার
জন্যে নূন্যতম একটা ‘substantial’ এবং ‘appreciable’ সংখ্যক ভিকটিমের প্রয়োজন আছে।
কুপারের মতো অনেকেই বলছেন যে, সব হত্যাযজ্ঞকেই জেনোসাইডের অন্তর্ভুক্তি আসলে কোনো সমাধান
দিবে না। কিন্তু বারবারা হার্ফ লিও কুপারের মতকে প্রায় উড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন যে,
‘As long as one can identify victims as members of deliberately targeted group
whose existence of survival is at stake, numbers of victims are irrelevant’.[21]
জেনোসাইডের সংজ্ঞার
তৃতীয় বিষয়, অনেকের মতে এটাই মূল বিষয়, হচ্ছে নিয়ত (intent)। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
আবার এটা সর্বাধিক অস্পষ্ট। গ্রেগরি এইচ স্ট্যান্টন বলছেন যে, এই সংজ্ঞার মূলত দুইটা
দিক আছে, এক intent, দুই actions. তাঁর মতে, ‘Intent can be proven directly from
statements or orders…. it must be inferred from a systematic pattern of
coordinated acts’।[22] আবার, intent ও motive এর মধ্যে স্ট্যান্টন একটা
ফারাকও টেনেছেন[23] লিও কুপারও এই নিয়তকে (intent) জেনোসাইডের গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান বলে মন্তব্য করেছেন। ধ্বংস করাই জেনোসাইডের জন্যে যথেষ্ট নয়, নিয়তও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু নিয়তের বিষয়টার সমাধান এখনো কেউ হাজির করতে পারেন নি। কেউ কেউ আইনের প্রেক্ষিতে
ফার্স্ট ডিগ্রি ও সেকেণ্ড ডিগ্রি মার্ডার ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে এর সমাধান করতে
চেয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন যে জাতিসঙ্ঘ প্রদত্ত সংজ্ঞার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ ব্যবহার
করেই এর সমাধান করা যাবে। কারণ, মেরে ফেলা, শারীরিকভাবে ক্ষতি করা, জন্ম নিরোধ করা,
বাচ্চাদের গোষ্ঠী স্থানান্তর করা ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃতভাবে বা এক্সিডেন্টালি সম্ভব না।
অবশ্যই সেটা পরিকল্পিতভাবেই হতে হবে, ধ্বংস করার নিয়ত থাকতে হবে। চক ও জোনাসনের মন্তব্য
এই দিক থেকে খুবই যথার্থ, ‘it is not plausible that a group of some considerable
size is victimized by man-made means without anyone meaning to do it!’[24]
এই নিয়ত (intent) আসলে জেনোসাইডারের বিবিধ কর্মকাণ্ড, জেনোসাইড সংগঠনের প্রক্রিয়া ইত্যাদির
মধ্যেই লুকিয়ে থাকে।
উপরোক্ত আলোচনা একটা
বিষয় পরিষ্কার করে, জেনোসাইড কোনো সরল বিষয় না, হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এক্সিডেন্টাল কোনো
ঘটনা না, বরং এটা বেশ জটিল একটা প্রক্রিয়া। এর ভিত্তি লুকিয়ে থাকে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক
প্রেক্ষাপটে। বিচিত্র থাকে এর গতিপথ। বিচিত্র এর কর্মকাণ্ডের ধারা। কোনো জেনোসাইডকে
সরলীকরণ খোদ জেনোসাইডকেই কখনো কখনো আড়াল করে ফেলে। জেনোসাইডের সংজ্ঞাকে ক্রিটিকালি
দেখার দৃষ্টিভঙ্গি জেনোসাইড সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া জোরদার করতে সাহায্য করবে।
পলিটিক্স অফ ফরগেটিং
জেনোসাইড ভয়াবহ স্মৃতি
রেখে যায়। আমরা তো অতীত ভুলতে পারি না, তবুও অনেকসময় সেই অতীতের স্মৃতি ভুলে থাকতে
চাই। কোনটা ভুলবো আর কোনটা মনে রাখবো সেটা রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। এই ভুলে যাওয়া ও মনে
রাখা যেমন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘটে তেমনি সামষ্টিগত পর্যায়েও ঘটে। ব্যক্তি যে কোনো ঘটনা
ভুলতে চেষ্টা করে দুই কারণে। হয়তো এই ঘটনা মনে রাখা পীড়াদায়ক, নয়তো ব্যক্তি নিশ্চিত
যে, কেউই সম্মানের সহিত তাঁর দুঃখের ঘটনা শুনবে না।[25] এই কারণে আর্মেনিয়ান
ও হলোকাস্টের অনেক বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি তাদের ঐতিহাসিক অতীত চেপে রেখে বরং নতুন জীবন
গড়তে ব্যস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এডাম জোন্স বলছিলেন যে, ভুলে যাওয়া (Forgetting) পরিমার্জনা
ও পুনঃব্যাখার (revision and reinterpretation) চূড়ান্ত পর্যায়টা তুলে ধরতে পারে। এই
ভুলে যাওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজস্ব ভাবমূর্তির অসঙ্গতিগুলোকে বাতিল করে দিতে পারে।
তখন অবশ্য এই ভুলে যাওয়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে না থেকে সামষ্টিক পর্যায়ে চলে যায়। জাতি
সমষ্টিগতভাবে কিছু কিছু বিষয় মনে রাখে, কিছু কিছু বিষয় ভুলে যায়। মনে রাখা হয় যা অতীতকে
মহিমান্বিত করে, ভুলে যাওয়া হয় অতীতের অস্বস্তিকর ঘটনা। কখনো অতীতের কোনো অপরাধের প্রতি
পুরো সমাজ উদাসীন হয়ে পড়ে কারণ, এতে সমাজের খুব বড় একটা অংশগ্রহণ করেছিল বলে। এটা কখনো
কখনো রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগেও করে থাকে, রাষ্ট্র তাঁর অতীতের অপরাধ লুকিয়ে রাখতে চায় বা
বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে চেপে রাখতে চায়। কিন্তু, এই লুকিয়ে রাখা কোনো মঙ্গল বয়ে আনে
না, বরং চেপে রাখার কারণে একই অপরাধ বারবার সঙ্ঘটিত হতে পারে। ৫০ বছরের মধ্যে রাশিয়া
কর্তৃক দুইবার চেচেন আক্রমণ এই ভুলে যাওয়ার যে বিপদ তার একটা উদাহরণ হতে পারে।[26]
পাশাপাশি এই ভুলে যাওয়া সামাজিকভাবে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন স্মৃতির জন্ম দেয়। তখন এই
ঝামেলাপূর্ণ ও অসঙ্গত নিদর্শন ব্যক্তি ও সমাজ দুইয়ের ক্ষেত্রেই বিপদজনক। এটা অন্য কোনো
সময়ে সহিংসতায় উষ্কানি দিতে পারে, আবার পরিকল্পিত ‘জেনোসাইড ডিনাইয়েল’ এর সুযোগও করে
দিতে পারে। জর্জ সান্টিয়ানার উক্তিটাই যথার্থ, those who forget the past are
doomed to repeat it. এটা জেনোসাইডের ক্ষেত্রে সর্বাংশে সত্য কথা। অতীতের গণহত্যাগুলোর
কথা স্মরণ করে আমরা আরো মানবিক হয়ে উঠি, আরো বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠি। একজন গবেষকের
উক্তি,
‘...by remembering
past genocides, we might all become more human, more caring and therefore less
likely to walk away when called upon to risk lives and commit resources to
protect strangers in danger.’[27]
‘জেনোসাইড ডিনায়েল’
এর রাজনীতি
জেনোসাইড স্টাডিজের
গবেষক গ্রেগরি এইচ স্ট্যান্টন জেনোসাইড কীভাবে ধাপ ধাপে সংগঠিত হয় তাঁর একটা কার্যকরী
ছক একেছেন। জেনোসাইড সংগঠনে তিনি ৮ টা ধাপ (পরবর্তীতে ১০ টা ধাপ) এর কথা বলেছেন। একটা
সমাজ ও রাষ্ট্রে কীভাবে জেনোসাইডের জমিন তৈরি হয় তারও একটা আভাস এতে পাওয়া যায়। গ্রেগরি
জেনোসাইডকে একটা প্রক্রিয়া হিসেবেই বিশ্লেষণ করেন। তিনি যে ৮ টা ধাপের কথা বলেছেন সেখানে
সবশেষ ধাপ হচ্ছে ‘অস্বীকার’ (ডিনায়েল) করা, মানে খোদ জেনোসাইডকে অস্বীকার করতে হবে।
‘Every genocide is followed by denial’।[28] জেনোসাইডকারীরা জেনোসাইডের
যাবতীয় নিদর্শন মুছে ফেলার চেষ্টা করে, যেমন, গণকবরের চিহ্ন মুছে ফেলা, লাশ পুড়িয়ে
ফেলা, দলিলাদি নষ্ট করে ফেলা ইত্যাদি। তারা যে শুধু অস্বীকারই করে তা না, উল্টো ভিকটিমকেই
দোষারূপ করে। রিচার্ড হোভানিসিয়ান বলছেন যে, একটা জাতিগোষ্ঠির মানুষকে হত্যা ও তাদের
সাংস্কৃতিক উপাদান ধ্বংসের পর শুধু স্মৃতিটুকুই রয়ে যায়। এরপর এই স্মৃতিটুকুও আক্রমণের
শিকার হয়। তাঁর মতে, মানুষকে পুরোপুরি নির্মূল করতে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা দরকার
পড়ে।[29] পৃথিবীর প্রায় সকল জেনোসাইডকে কেউ না কেউ কোনো না কোন ভাবে অস্বীকার
করার চেষ্টা করেছেন। আর্মেনিয়ান জেনোসাইড ও হলোকাস্ট সেই ‘ডিনায়েলে’র ক্লাসিক উদাহরণ।
এডাম জোন্স জেনোসাইড
অস্বীকারের প্রায় নয়টা কমন ডিসকোর্সের নমুনা দিয়েছেন। যেমন, প্রথমেই নিহতের সংখ্যা
নিয়ে একধরণের আলোচনা তোলা হবে, দাবি করা হবে, ‘hardly anybody died’. জেনোসাইডের সময়কার
ছবি ভিডিও এইসবকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দেয়া হবে। রিপোর্টসমূহকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হবে।
তথ্যের কিছু অসংলগ্নতা দেখিয়ে পুরো জেনোসাইডকে অস্বীকার করা হবে, বলা হবে, এত মানুষ
যদি মারা যায়, তাহলে এদের লাশ কই? জেনোসাইড যত অতীতের বিষয় হয়, এই ধরণের ডিসকোর্সের
মাত্রাও তত বাড়তে থাকে।
অস্বীকারের দ্বিতীয়
উপায় হচ্ছে ‘It was a self-defense’ তত্ত্ব প্রচার করা। নিহতদের বিদ্রোহী, সন্ত্রাসী
ইত্যকার নামে চিত্রায়িত করে দাবি করা হবে যে, জেনোসাইডকারীরা নিজেদের রক্ষা করার জন্যে
আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছে। প্রায় প্রতিটা রাষ্ট্রই তাদের কৃতকর্মকে এই উপায়ে জায়েজ করার
চেষ্টা চালিয়ে থাকে। অস্বীকার করার এই পদ্ধতির সাথে হাতে হাত ধরে আসে আরো দুটো পদ্ধতি।
দাবি করা হয় যে, এই জেনোসাইড বা এই সহিংসতা ইচ্ছাকৃত ছিল না (not intentional) এবং
সহিংসতাটা পারষ্পরিক (mutual)। জেনোসাইডের সংজ্ঞাতেই আমরা দেখেছি যে, হত্যা করার নিয়ত
(intent) বিষয়ে কিছু অস্পষ্টতা আছে। কোনো সন্দেহ নেই, বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে এই নিয়ত
(intent) এর উপস্থিতি প্রমাণ করাও কষ্টসাধ্য বিষয়। বিশেষ করে, রাষ্ট্রীয় জেনোসাইডের
ফলে আদিবাসীদের ক্রমাগত হারিয়ে যাওয়াটাকে এই পদ্ধতিতে জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়। একই
সাথে এটাও দাবি করা হয় There was no central direction. আধুনিক সময়ে রাষ্ট্র ও আমলাতান্ত্রিক
যন্ত্র ব্যবহার করে যেখানে নিখুত উপায়ে জেনোসাইড চালানো সম্ভব, সেখানে এই যুক্তি খুবই
কার্যকরী। আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কিত অস্পষ্ট ধারণা এই যুক্তিকে বেশ জনপ্রিয় করে তুলে।
আরেকটা জনপ্রিয় পদ্ধতি
হচ্ছে, ডেমগ্রাফিকেই অস্বীকার করা। যে এলাকায় জেনোসাইড সংগঠিত হয়েছিল সেই এলাকার জনসংখ্যার
পরিমাণ কম দেখানো হয়। মূল জনসংখ্যা যদি কম দেখানো সম্ভব হয় তাহলে গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা
নিয়ে রাজনীতি করা সহজ হয়ে পড়ে। আদিবাসী এবং আর্মানিয়ান জেনোসাইড অস্বীকারে এই পদ্ধতি
খুব বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এর বাইরে জেনোসাইডের
সংজ্ঞায় যে সীমাবদ্ধতা বা অস্পষ্টতা রয়েছে তা দিয়েও জেনোসাইড অস্বীকার করার প্রবণতা
লক্ষনীয়। আবার, জাতীয়তাবাদী চেতনা এই অস্বীকারে জ্বালানী দেয়। আমরা (বা আমাদের দেশ
বা আমদের জাতি) এমন কাজ করতেই পারে না। এই অস্বীকার করার বোধহয় সবচেয়ে ভয়াবহ পদ্ধতি
হচ্ছে, জেনোসাইড অস্বীকাররীরা দাবি করে বসেন ‘we are the real victims. মানে, যারা
নিহত হয়েছে তারা নয়, বরং জেনোসাইডকারী তখন নিজেকেই ভিকটিম হিসেবে চিত্রায়ন করেন।
জেনোসাইড ডিনায়েল বা
জেনোসাইড অস্বীকার যেমন রাষ্ট্রীয় বিষয়াদির সাথে জড়িত তেমনি মতাদর্শিক কারণেও তা হতে
পারে। গ্রেগরি স্টেনটন দেখাচ্ছেন তুরষ্কের সাথে আমেরিকার অর্থনৈতিক-সামরিক সম্পর্কের
কারণেই আমেরিকা কখনো আর্মেনিয়ান জেনোসাইডের স্বীকৃতি দেয় নি।[30] আবার কেউ
কেউ মতাদর্শের প্রতি অন্ধ আবেগ-মোহের কারণে জেনোসাইড অস্বীকার করেন। যে কোনো মতাদর্শের
প্রতি অন্ধ আবেগ বা এমন প্রবণতাকে জর্জ অরওয়েল নাম দিয়েছিলেন ‘জাতীয়বাদী মন’। তিনি
তাঁর বিখ্যাত Notes on Nationalism প্রবন্ধে এমন প্রবণতার কিছু নিদর্শন আমাদের সামনে
হাজির করেছেন। অনেক বুদ্ধিজীবীই যারা হিটলারের জেনোসাইড নিয়ে সরব ছিলেন তারা আবার স্ট্যালিনের
জেনোসাইড নিয়ে নিরব ভূমিকা পালন করেছিলেন, আবার, অনেক বুদ্ধিজীবীই হিটলারের জেনোসাইড
নিয়েও নিরব ছিলেন। অরওয়েলের ভাষায়্, ‘জাতীয়তাবাদীরা শুধুমাত্র নিজেদের নৃশংসতাকে অস্বীকারই
করে না, বরং, এগুলো শুনতে না পারার মত একটা দারুণ ক্ষমতাও আছে। ছয় বছর যাবত হিটলারের ইংরেজ সমর্থকরা ড্যাচাউ এবং
বুচেনওয়াল্ডের অস্তিত্ব সম্পর্কে না জানার মতলব করেছিলেন। এবং যারা জার্মান কনসেন্ট্রেশন
ক্যাম্পের জোরালো সমালোচনা করছিলেন, তারা প্রায়শই অজ্ঞাত ছিলেন, অথবা এমনকি খুব অল্প
পরিমাণে জ্ঞাত ছিলেন যে রাশিয়াতেও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আছে। ১৯৩৩ সালের ইউক্রেনের
দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুও ইংরেজ রুশোফিলদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। বর্তমান যুদ্ধের
সময় জার্মান ও পোলিশ ইহুদিদের ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনা অনেক ইংরেজই জানতেন না। তাঁদের
ইহুদিবিদ্বেষ এত বড় অপরাধকেও তাঁদের চেতনার আড়াল করে রেখে দিয়েছিল।’[31]
জেনোসাইড অস্বীকারের
তিনটা নেতিবাচক প্রভাব চিহ্নিত করেছেন গ্রেগরি স্ট্যান্টন।[32] প্রথম প্রভাব
পড়ে ভিকটিম ও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ওপর। সারা দুনিয়াতেই জেনোসাইডের ভিকটিমরা
প্রথমত ও প্রধাণত তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত এই অপরাধের স্বীকৃতি চায়। দ্বিতীয় প্রভাব পড়ে
খোদ জেনোসাইডকারীর ওপর। অস্বীকার কখনো কখনো ভবিষ্যত জেনোসাইডে উষ্কানি দিয়ে থাকে।
‘Genocide Deniers are three times more likely to commit genocide again than
other governments.’ তৃতীয় প্রভাব পড়ে প্রত্যক্ষদর্শী বা জেনোসাইডের নীরব সাক্ষীদের
ওপর।
জেনোসাইড অস্বীকার রোধ
করার জন্যে বিভিন্ন দেশে আইন করা হয়েছে। অনেক দেশে জেনোসাইড অস্বীকারকারীদের বিভিন্ন
মাত্রার শাস্তিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু, এই আইন আরেকটা বড়ো প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে, এই
আইন কি বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে! এই আইনের একজন কঠোর সমালোচক হচ্ছে নোয়াম চমস্কি।[33]
যারা এই আইনের বিরোধিতা করেন তাদের মূল কথা হচ্ছে, অস্বীকারকারীদের উত্তর দিতে হলে
সেটা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ও একাডেমিকভাবে দিতে হবে, এখানে রাষ্ট্রীয় আইনের হস্তক্ষেপ
কাম্য নয়। বরং, রাষ্ট্র ও আইনের হস্তক্ষেপ গবেষণার পথ রুদ্ধ করতে পারে। পাশপাশি এমন
আইন বিভিন্ন ধরণের ফায়দা হাসিলের পথও সুগম করে দিবে। মূল কথা হচ্ছে, ইতিহাসের বিষয়বস্তু
গবেষণা ও একাডেমির বিষয়, সেটা কখনো আইন-আদালতের বিষয়বস্তু হতে পারে না। এডাম জোন্স
এই আইনের বিরোধিতা করে অস্বীকারের একটি ইতিবাচকের দিকের কথাও উল্লেখ করেন। তার মতে,
এই ধরণের বিরোধিতা আসলে গবেষকদের সামনে গবেষণার নতুন নতুন বিষয় হাজির করে। তিনি বলেন,
While genocide
denial in the public sphere may be destructive, for genocide scholars and
students its consequences may actually be productive. Professional deniers have
spurred scholarship in areas that otherwise might not have attracted in.[34]
________________________________________
[1] Adam Jones, Genocide A comprehensive
Introduction, Routledge, London, 2006
[2] See PreventGenocide.org, “A Crime without a
Name,” http://www.preventgenocide.org/genocide/crimewithoutaname.htm
[3] Raphael Lemkin, Axis Rrule in Occupied
Europe, The Lawbook Exchange, Ltd. USA, 1944
[4] UNO, 1948, Convention on the Prevention and
Punishment of the Crime of Genocide
[5] Leo Kuper, Genocide: Its Political Use in
the Twentieth Century, Pelican Books, UK, 1981
[6] Tim Dunne & Daniela Kroslak (2002);
Genocide: Knowing what it is that we want to remember, or forget, or forgive,
The International Journal of Human Rights, 4:3-4, 26-46.
[7] Ibid.
[8] মফিদুল হক, জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয়, বিদ্যাপ্রকাশ,
ঢাকা, ২০১৭
[9] Leo Kuper, 1981, Ibid
[10] Tim Dunne & Daniela Kroslak, 2002, Ibid
[11] Ibid
[12] Adam Jones, 2006, Ibid
[13] Ibid
[14] Anton Wess-Wendt, The State and Genocide,
The Oxford Handbook of Genocide Studies (2010), Edited by Donald Bloxham and A.
Dirk Moses, UK, 2010.
[15] R.J. Rummel, DEATH BY GOVERNMENT, Online
Version, https://www.hawaii.edu/powerkills/NOTE1.HTM
[16] Adam Jones, 2006, Ibid
[17] Tim Dunne & Daniela Kroslak, 2002, Ibid
[18] Jean-Paul Sartre, ‘On Genocide’, Beacon
Press, Boston, 1968
[19] Leo Kuper, 1981, Ibid
[20] Israel W. Charny, ‘Toward a Generic
Definition of Genocide’ in George J. Andreopoulos, Genocide: Conceptual and
Historical Dimensions, 1994
[21] Barbara Harff, ‘Recognizing Genocides and
Politicides’ in Helen Fein (ed.), Genocide Watch, 1992
[22] Gregory H Stanton, What is Genocide,
genocidewatch, http://genocidewatch.net/genocide-2/what-is-genocide/
[23] Whatever may be the motive for the crime
(land expropriation, national security, territorial integrity, etc.,) if the
perpetrators commit acts intended to destroy a group, even part of a group, it
is genocide. Gregory H Stanton.
[24] Tim Dunne & Daniela Kroslak, 2002, Ibid
[25] Adam Jones, 2006, Ibid
[26] Adam Jones, 2006, Ibid
[27] Tim Dunne & Daniela Kroslak, 2002, Ibid
[28] Gregory H Stanton, Eight stage of genocide,
genocidewatch, http://www.genocidewatch.org/images/8StagesBriefingpaper.pdf
[29] Richard G. Hovannisian, “Denial of the
Armenian Genocide in comparison with Holocaust Denial,” in Hovannisian, ed.,
Remembrance and Denial: The Case of the Armenian Genocide, 1999
[30] Gregory H Stanton, The Cost of Denial,
2008, genocidewatch
http://www.genocidewatch.org/images/Cost_of_Denial_Stanton_23_April_2008.pdf
[31] George Orwell, Notes on Nationalism, 1945 [জাতীয়তাবাদী
মন, অনুবাদ সহুল আহমদ, সময়ের ব্যবচ্ছেদ, ২০১৯]
[32] Gregory H Stanton, 2008, Ibid
[33] Noam Chomsky, “Some Elementary Comments on
The Rights of Freedom of Expression”, 1980, https://chomsky.info/19801011/
[34] Adam Jones, 2006, Ibid
No comments:
Post a Comment