Saturday, December 7, 2019

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হালহকিকত: প্রসঙ্গ শ্রমিকের লাশ হয়ে ফেরা



তো, আমাদের হালহকিকত কেমন? মানে, 'রাষ্ট্র' হিসেবে আমাদের হালহকিকত কেমন?

কয়েকবছর আগে যখন হঠাৎ করে হিড়িক পড়েছিল মিডল-ইস্টে, সৌদিআরবে নারী শ্রমিক 'রপ্তানি'র তখন এটাকেও অনেকে 'নারী'র ক্ষমতায়ন হিসেবে দেখেছিলেন। 



আমার বাপ-চাচা অনেকেই সৌদিতে ছিলেন, কেউ কেউ এখনো আছেন। কিছুদিন আগে এক কাজিন গিয়েছে। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে নক করে বলে, ভাই আমাদের প্রবাসীদের নিয়ে কিছু লিখেন না কেন? আমার গ্রামের একটা বড়ো অংশ সৌদি তথা মিডল-ইস্টে আছেন, গ্রামে গেলেই শোনা যায় যে, পাঁচ-ছয় মাস বেতন পাচ্ছেন না, বেতন দিচ্ছে না ইত্যাদি হাজার রকম সমস্যা। আবার তারা এটাও বলেন, অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের হালত তাদের চেয়ে ঢের ভালো। হতে পারে, এই 'ভালো' আপেক্ষিক, কিন্তু তাদের 'মনে হওয়া'টাই তো আসল। তো, আমাদের গ্রামের কয়েকজন নারী যখন শ্রমিক হিসেবে মিডল-ইস্টে যেতে চাইলেন, তখন আমার মনে আছে, আমার চাচারা মিলে হাতে পায়ে ধরে এদেরকে বোঝাচ্ছেন, যা করো, দেশে থাইক্কা করো। মান-ইজ্জতটা অন্তত থাকবো। দয়া করে সৌদিতে যাইয়ো না। ঐখানে পরিবেশ তোমরা আন্দাজও করতে পারবা না। সত্য কথা, চাচারা যখন বোঝাতেন তার বাস্তবে যে আরো নির্মম ও কঠোর তা আন্দাজ কতে পারি নাই।

সৌদি মালোয়শিয়া সবখান হতে আমাদের নারী-পুরুষদের 'লাশ' হয়ে ফিরাটা ক্রমাগত বাড়ছে। কোন এক রিপোর্টে পড়েছিলাম যে, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের আত্মহত্যার হার মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে অন্তত ১৭ গুণ বেড়েছে। যারা অসুখ-বিসুখে মারা যাচ্ছেন তাদের একটা বড়ো অংশ মারা যাচ্ছেন স্ট্রোকে। আমরা জানি ও বুঝি কোন পরিস্থিতিতে কেনো 'স্ট্রোক' হচ্ছে।

এখন, প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে শ্রমিকরা যাচ্ছেন তারা একটা রাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। সেই রাষ্ট্র তাদের থেকে রেমিট্যান্স আয় করছে, সেই আয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কর্তা-ব্যক্তিরা নামী-ধামী গাড়ি দৌড়াচ্ছেন, বিলবোর্ডে উন্নয়নের শ্লোগান দিচ্ছেন। এই শ্রমিকরা যে রাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী তাদের তো মিডল-ইস্ট, সৌদিসহ সবখানে 'দূতাবাস' নামক বস্তুও আছে। যদ্দুর জানি, সৌদি জোটেও বোধহয় আমরা যোগ দিয়েছিলাম (এই তথ্য আমি শিউর না)। এখন, আমাদের রাষ্ট্র তো রকেট নাকি স্যাটেলাইট আসমানে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই 'রাষ্ট্র' কি তার নাগরিকদের 'লাশ' হয়ে ফিরে আসার কারণটা জোর গলায় জিজ্ঞেস করতে বা পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছে? নাকি,আমাদের রাষ্ট্র 'ইচ্ছুক' নয়?

এই শ্রমিকরা মন-প্রাণ-দেহ সব বিকিয়ে যে টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন সেই টাকা কিন্তু আরেকদল খুব সুন্দর করে লুট করে আবারো দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই যে যারা দেশের বাইরে টাকা নিয়ে যাচ্ছে, তারা আবার 'নিবেশ' গড়ছে ঐ 'বিলেতে'র মাটিতে। এই টাকা যারা বাইরে নিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র কিন্তু তাদেরকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, কিংবা বলা যায়, তারাই রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তা। এই শ্রেণিটার নতুন নাম দেয়া দরকার। উপনিবেশ আমলে বিদেশি উপনিবেশিকরা বাংলাকে 'উপ'-নিবাস বানিয়ে এখানকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যেতো তাদের 'মূল'-নিবাসে। আর, বর্তমানে এরা মূল-নিবাস থেকে টাকা লুট করে পাড়ি জমাচ্ছে অন্য-নিবাসে। এদের আলাদা চরিত্রায়ন দরকার।

আমাদের রাষ্ট্রের হাল-হকিকত বোঝার জন্য এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে 'লাশ' হওয়া ফেরা শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে 'সুইস'ব্যাংকে আমাদের টাকার একাউন্টও বাড়ছে। পুরানা ব্রিটিশ আমলে দেখা যেতো, যে বছর দুর্ভিক্ষে এলাকার পর এলাকা উজাড় হয়ে যাচ্ছে, মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, ঐ বছরে খাজনা আদায়ে কিন্তু কোনো ছাড় দেয়া হতো না, কখনো বেশিও আদায় করা হয়েছে। এই দুই আমলের কার্যকরণ ভিন্ন ভিন্ন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের হাল হয়েছে এমনই। আমরা দুনিয়া-ফাটানো উন্নতি করতে পারি, কিন্তু কৃষকের ন্যায্য মূল্য দিতে পারি না। আমরা মধ্যম-আয়ের দেশ হয়ে উঠতে পারি, কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের 'লাশ' হওয়া, 'যৌনদাসী' হওয়া ঠেকাতে পারি না।

ফেসবুক: অক্টোবর ২৯, ২০১৯ 

No comments:

Post a Comment