এটা আসলে এঞ্জেলা দেবনাথের ‘Bangladesh Genocide: Plight of Women’ শিরোনামের গবেষণামূলক প্রবন্ধের অনুবাদ। অনুবাদ
না বলে রূপান্তর বলাই শ্রেয় হবে। মূলত এটা গবেষণা পেপার, কিন্তু দাড় করানো হয়েছে সাধারণ প্রবন্ধ আকারেই।
লেখায় ব্যবহৃত পাদটীকাগুলো মূল লেখকের নয়, অনুবাদকের। উল্লেখ্য, স্যামুয়েল টোটেনের সম্পাদনায় 'Plight and Fate of Women During and
Following Genocide' নামে যে বই প্রকাশিত হয়, তার তৃতীয় অধ্যায় ছিল বাংলাদেশ বিষয়ক এই আর্টিকেলটি।
উনিশ’ একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে
পাকিস্তান সরকার বাঙালি জাতীয়তাবাদ রুখে দেয়ার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে
গণহত্যা শুরু করে। গোষ্ঠী-গত ও ভাষাগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান ও
পশ্চিম পাকিস্তানকে শুধুমাত্র ধর্মের অজুহাতে একত্রিত করতে পঁচিশ বছর ধরে চেষ্টা
করা হলেও কার্যত তা ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশীয় দলালদের সহায়তায়
পরিকল্পিত উপায়ে যে ব্যাপক সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তাতে প্রায় ৩ কোটি লোক দেশের
ভেতরেই বাস্তু চ্যুত হোন এবং প্রায় ১ কোটি লোক পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নেন।
সহিংসতার ফলস্বরূপ প্রায় ১০ লক্ষ[১] বাঙালি প্রাণ হারান।
মূলত বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং হিন্দু
সংখ্যালঘুরাই ছিলেন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ, বিদ্রোহী বাঙালিরা ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠন করে লড়তে থাকে। ১৯৭১
সালের ৪ ডিসেম্বর ভারত যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে এবং ভারতীয় ও বাঙালি গেরিলাদের দু
সপ্তাহের মিলিত যুদ্ধ পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। অতঃপর শীঘ্রই পূর্ব
পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে যায়।
নারীদের সঙ্কটাপন্ন দশা
বাংলাদেশের জন্মের ঊষালগ্নে
সংঘটিত এই ঘটনা, ভয়াবহ
ও সিস্টেমেটিক সহিংসতা হওয়া সত্ত্বেও, গণহত্যা গবেষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। বিনা ডি
কস্তার[২] মতে, বাংলাদেশ
ভূ - রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থান ও আর্থিকভাবে নিঃস্ব দেশ হওয়াতে উন্নয়ন
কর্মসূচি ব্যতীত অন্যান্য বিষয়াদির দিকে মনোযোগ কমই দিতে পেরেছে। তাই তিনি বলেন, একাত্তরের যুদ্ধ
পৃথিবীর সবচেয়ে কম-অন্বেষিত যুদ্ধ হিসেবে
গবেষকদের কাছে রয়ে যায় এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে, জাতীয়তাবাদ ও জাতিগত সহিংসতার বৃদ্ধি স্বত্বেও, জনসাধারণের কষ্টের
অভিজ্ঞতাগুলো কার্যত অজানা থেকে যায়। বস্তুত, এত কম সময়ে এত বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যান যে, প্রকৃতিগত ভাবে এটা যে
গণহত্যা তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। একাত্তরে বাংলাদেশে যে সহিংসতার মাত্রা
ছিল তা আসলেই দুর্লভ!
এই প্রবন্ধ, মূলত, পাকিস্তানি কর্তৃক সহিংসতা
বাংলাদেশের নারীদের জীবনের কি প্রভাব পড়েছিল সেদিকে নজর দিবে। সেটা শুধুমাত্র
সহিংসতার সময়েই না, বরং, একাত্তর পরবর্তী সময়ে
আক্রান্ত নারীদের নিজ রাষ্ট্র ও সমাজ কিভাবে আঘাত করেছিল তাও আলোচনা করা হবে; অবশ্য এ আঘাত যতটা না ছিল
শারীরিক তার চেয়ে বেশি ছিল সামাজিক। এটাও দেখা হবে, যুদ্ধের সহিংসতা কিভাবে, প্রত্যক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রের
অংশ হিসেবে, নারীর
সত্ত্বাকে ‘যুদ্ধক্ষেত্র’তে রূপান্তরিত করে। পরিশেষে
নারীদের এই অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ, জাতীয়তাবাদ ও জাতি-গঠনের আদর্শ এবং গণহত্যাকে দেখার চেষ্টা
করা হবে।
তথ্যের বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের
অনুপস্থিতির দরুন আলোচনাটা মোটেই সহজ ছিল না। ইয়াসমিন সাইকিয়া[3] বলেন, ১৯৭১’কে যদিও বিংশ শতাব্দীর
অন্যতম নৃশংস নারী নিগ্রহের ঘটনা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে, তবু, এই সহিংসতার কোন ইতিহাস নেই।
গবেষকরা, এমনকি জেন্ডার স্টাডিজরাও, আন্তর্জাতিকভাবেই ভুলে
গিয়েছেন একাত্তরকে।
নারীর প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ
অংশগ্রহণ
নারীদের খুব ক্ষুদ্র একটা
সংখ্যা ‘যোদ্ধা’ হিসবে যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি
লড়েছেন, এবং আরও অল্প সংখ্যক নারী
প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার, যুদ্ধের সময় হাসপাতাল এবং শরণার্থী শিবিরের
সেবিকা ও শিক্ষক হিসেবেও সীমিত সংখ্যক নারী কর্মরত ছিলেন। নারীদের সবচেয়ে বিশাল
অংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন পরোক্ষভাবে, সাহায্যকারী মা, স্ত্রী এবং বোন হিসেবে যারা তাদের সন্তান, স্বামী ও ভাইকে হারিয়েছেন, যোদ্ধাদের খাবার তুলে
দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন এবং বাড়ির
বাচ্চাদের ও বৃদ্ধদের দেখভাল করেছেন। এই নারীদের অনেকেই তাদের পরিবার, সম্পদ, জীবিকা – সবই হারিয়েছেন যুদ্ধের সময়।
প্রকৃতপক্ষে, যুদ্ধ
পরবর্তী সময়ে ‘নারী
প্রধান’ পরিবারের সংখ্যা বেড়ে
গিয়েছিল নাটকীয়ভাবে। তাই দেশের ভেতরে থাকা নারীদের এই ‘পরোক্ষ’ অংশগ্রহণের সবচেয়ে ভয়াবহ ফল
হয় দারিদ্র্যতার কষ্টভোগ।
নিগ্রহের শিকার [৪]
নির্যাতনের শিকার হওয়াই ছিল
মূলত একাত্তরে নারীদের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। শ্রেণি, গোত্র, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সব বয়সের
নারীরাই ছিলেন পুরুষ আগ্রাসনের প্রধান টার্গেট; এবং বিভিন্ন উপায়ে নারীকে নির্যাতন করা - ঐ
সময়ের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। হত্যা, নির্যাতন, প্রহার, অপহরণ সবই এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে পরিকল্পিত ধর্ষণই ছিল মূলত পাকিস্তানিদের
পাশবিক অভিযানের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। আনুমানিক ২-৪ লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন।
সুসান ব্রাউনমিলার, যিনি
এই ঘটনার প্রথম বিশ্লেষকদের একজন, বলেন, বাংলাদেশে ধর্ষণ সৌন্দর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল
না। আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন
এই নয় মাসে। পাকিস্তানিরা শুধু স্পট ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হতো না, জোর করে সামরিক ব্যারাকে
তুলে নিয়ে যেত রাতের ব্যবহারের জন্যে। তাদেরকে সেখানে উলঙ্গ করে রাখা হতো যেন
পালিয়ে যেতে না পারে।
তবে, এই ধর্ষণ, গণধর্ষণ , তুলে নিয়ে কমফোর্ট গার্ল
হিসেবে ব্যবহার করা, বন্দি
অবস্থায় অপুষ্টিতে ভোগা সবই ছিল নারীদের অগ্নিপরীক্ষার প্রথম ধাপ। পরবর্তীকালে এই
নারীরা মুখোমুখি হয়েছেন ‘দ্বিতীয়’ ধর্ষণের – অর্থাৎ, বিভিন্ন ধরণের যৌন রোগে
আক্রান্ত হয়েছেন, লজ্জা
এবং অপমানের তীব্রতায় মানসিক সমস্যাতে ভুগেছেন, এবং
পারিবারিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়াতে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে
পড়েছেন। এই বিভীষিকাময় আতংক ও নিদারুণ যন্ত্রণায় অনেকেই একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে
নিয়েছিলেন।
পাকিস্তানিদের যৌন সহিংসতার
কারণে প্রচুর নারী গর্ভবতী হয়ে পড়েন, এবং অনেক সময় গর্ভপাতের দুর্বল পদ্ধতির কারণে
চিকিৎসা জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। একাত্তরে মোট কতজন নারী ধর্ষিত নারী হয়েছিলেন তার
সঠিক সংখ্যা জানা যায় না, তবে
ব্রাউনমিলার জানিয়েছেন ২৫০০০ নারী গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন; অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের মতে
সে সংখ্যাটা ৭০, ০০০।
The International commission of Jurist তাদের বিশ্লেষণে সমাপ্তি টানে এই বলে যে, সংখ্যাটা যাই হোক না কেন, গর্ভপাত করানোর জন্যে
আমেরিকান ও ব্রিটিশ সার্জনদের দল এবং আক্রান্ত নারীদেরকে সমাজে সুষ্ঠুভাবে
পুনর্বাসন করার জন্যে সরকারি তৎপরতার ব্যাপকতাই প্রমাণ করে এখানকার ধর্ষণের
মাত্রা।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত এই দেশ ঘুরে
গিয়ে ভারতীয় সাংবাদিক আমিতা মালিক বলেছিলেন, বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা মৃত্যুর চেয়েও
শোচনীয়। এটা মানবেতিহাসের অন্যতম নির্মম, হিংস্র এবং পরিকল্পিত ধর্ষণের গল্প: দেশীয় সশস্ত্র দালালদের সহায়তায় পেশাদার
সৈনিকদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে এই ঘটনা।
এমন সরাসরি আক্রান্তদের
পাশাপাশি বিরাট সংখ্যক নারী শরণার্থী হিসেবে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলে। অপুষ্টি ও অবাঞ্ছিত গর্ভাবস্থার শিকার হয়ে, এবং কখনো কখনো
ঘর-বাড়ি-স্বামী-সন্তান-পরিবার-পরিজন সব হারিয়ে যখন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন, তখন তাদের অবস্থা কতটা
শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায় সেটা শিবিরের একজন নার্সের জবানীতে ফুটে উঠে। তিনি বলেন, তারা এতই অসুস্থ থাকে যে
প্রত্যেক দিন প্রত্যেক মুহূর্তে তাদেরকে
মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়। পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, যেভাবেই হোক না কেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশি মেয়ে ও
নারীরা এক অবর্ণনীয় হিংস্রতা ও নিদারুণ যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন।
জাতীয় তৎপরতা
১৯৭১-১৯৭৩
বাংলাদেশের নতুন সরকার
নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের জন্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রথমত, দেশের জন্যে তাদের ত্যাগকে
আপাতদৃষ্টিতে স্বীকৃতি দিয়ে এবং সমাজে মিশে যাওয়া সহজতর করে তুলতে তাদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেয়া হয়। এছাড়াও, বিবাহের মাধ্যমে তাদেরকে
সামাজিকভাবে পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করা হয় – সেটা কখনো তাদের স্বামীর
কাছে ফিরিয়ে দিয়ে, কিংবা
মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সাথে বিয়ে দিয়ে। এতদসত্ত্বেও, এই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় নি।
ব্রাউনমিলার বলেন, এই
বিবাহ কর্মসূচি কখনোই সফলতার মুখ দেখেনি। যারা এগিয়ে এসেছিলেন বিয়ে করতে তাদের
প্রত্যাশা ছিল মোটা অংকের যৌতুক।
অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্যে
বাংলাদেশ সরকার, নবপ্রতিষ্ঠিত
‘কেন্দ্রীয় নারী পুনর্বাসন
বোর্ড’র মাধ্যমে, দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন
সংস্থার সহায়তায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সেখানে যেমন গর্ভপাত করানোর জন্যে
পদক্ষেপ নেয়া হয়, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে
নারীদের পুনর্বাসনের প্রকল্পও নেয়া হয়। পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে আক্রান্ত নারীদেরকে
বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, কেননা, অন্যান্যদের তুলনায় অর্থ-উপার্জনকারী নারীর
বিয়ের সম্ভাবনা বেশি।
ঠিক কতজন নারীকে গর্ভপাত
করানো হয় কিংবা এই প্রকল্পের সাহায্যের পুনর্বাসিত করা হয় তা জানা যায় না। কেননা, তাদের সম্পর্কে কোন তথ্য
রাখা হয় নি, রাখলেও
প্রকাশ করা হয় নি। আমিতা মালিকের মতে, ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের নাম রাখা হয় নি, কারণ, সেটা তাদের বিয়ে এবং
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিতে পারে। যে কোন রক্ষণশীল
সমাজে যেখানে কোন সমস্যার – যার
দ্বারা কিনা প্রায় প্রত্যেক পরিবার আক্রান্ত - সমাধানের চেষ্টা করাই কষ্টসাধ্য, সেখানে নারীদের সম্মান ও
ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্যে সকলের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকাই স্বাভাবিক।
১৯৭৩- বর্তমান
যুদ্ধের পরপরই আক্রান্ত
নারীদের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের আপাত উদ্বেগ, খুব শীঘ্রই হারিয়ে যায়। ১৯৭৩ এর পর থেকে, এ বিষয়ে প্রবল নীরবতার কারণে
‘নারী ধর্ষণ’ আলোচনার টেবিল হতে পুরোপুরি
নির্বাসিত হয়ে যায়, হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে। ১৯৯০ এর
শুরুতেই, বিভিন্ন রাজনৈতিক অগ্রগতির
কারণে, এই ইস্যুর পূনর্জাগরণ হয়। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদেরকে আবারো ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চে ঢাকায়
অনুষ্ঠিত গণআদালতে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে ‘বীরাঙ্গনা’ নিয়ে আবারো খোঁড়াখুঁড়ি করা
শুরু হয়। তবু, ডি
কস্তার মতে, দুর্বল রিপোর্ট ও পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবের জন্যে
এটা খুব একটা কার্যকর ছিল না। এছাড়া, আক্রান্ত নারীদের প্রচারণা তাদের জীবনে
নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যা অন্যদেরও এই বিষয়ে কথা বলতে নিরুৎসাহিত করে। তাই, ‘গণআদালত’ এর মতো কিছু প্রচেষ্টা ছাড়া
বাংলাদেশ তার নির্যাতিত নারীদের জন্যে খুবই কম করতে পেরেছে।
নারী কণ্ঠস্বরের নীরবতা
সমাজ
অনেকেই ভাবতে পারেন, যে দেশের নারীদের সাথে এমন
অকল্পনীয় বর্বরতা করা হয়েছে সে দেশই বা কেন এ
বিষয়ে নীরব! এর একটা উত্তর হচ্ছে, এটাই আসলে বাংলাদেশি সমাজের ধরণ। পূর্বে বলা
হয়েছে, ৭১’র আক্রান্ত নারীদেরকে
পরবর্তীতে তাদের পরিবার ও সমাজ পরিত্যাগ করে, নির্বাসিত করে
কিংবা সে ঘটনা পুরো লুকিয়ে রাখে, অর্থাৎ, তারা ‘সেকেন্ড রেপ’ এর শিকার হন। এমনকি, অনেকেই সমাজে সম্মান হারানোর
ভয়ে নিজের নির্যাতিত স্ত্রী বা মেয়েকেও গ্রহণ করেন নি। তাই, একজন গবেষক বলেছিলেন, যখন বাংলাদেশে একজন নারী যৌন
নির্যাতনের শিকার হন, তার
পরিবার তখন আক্রান্ত নারীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের চেয়ে সামাজিক মর্যাদা
নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে। দীর্ঘায়ত এই নির্যাতনের কারণেই আক্রান্ত নারীরা সমাজের
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হন। একাত্তরে নির্যাতনের শিকার এই নারীরা এখনো তাদের
উপর নির্যাতনের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করে যাচ্ছেন! এই অত্যাচারের
যেন কোন সীমা নেই!
নব্বইর দশকে নয়নিকা মুখার্জি এনায়েতপুরের তিনজন বীরাঙ্গনার
সাথে দেখা করেন, যারা
গণআদালতে সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে যেমন জাতীয়ভাবে নন্দিত হয়েছিলেন, তেমনি স্থানীয়ভাবে নিন্দিতও
হয়েছিলেন। এই তিনজন বীরাঙ্গনা সমাজে বিভিন্ন উপায়ে নির্যাতিত হয়েছিলেন, যেমন, পুরনো ঘটনা মনে করিয়ে খোঁটা
দেয়া, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং
অবজ্ঞা প্রদর্শন করা। গ্রামের লোকেরা যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত নারীর প্রতি এই সহিংসতা
নিয়ে কখনো খোলামেলা আলোচনা করেনা। এখানে মূলত দুটো বিষয় কাজ করে; অবজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে ‘উদঘাটন প্রক্রিয়া’ এবং প্রত্যক্ষ নীরবতার
মাধ্যমে ‘গোপনীয়তার প্রক্রিয়া’। উন্মোচন ও গুপ্ত করণের এই দুই প্রক্রিয়ার
কারণেই, ধর্ষণ, গ্রামের মানুষদের কাছে
পাবলিক সিক্রেট কিংবা ‘known but not articulated’ ঘটনা হিসেবেই থেকে যায়।
এছাড়াও, এখানে গরীব ও ভূমিহীন
বীরাঙ্গনাদের জাতীয় স্বীকৃতি বাংলাদেশের গ্রামের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোকে
সরাসরি আঘাত করেছে। তাই, উপরোক্ত
‘উন্মোচন’ ও ‘গুপ্ত করণ’ প্রক্রিয়া ক্ষমতার সক্রিয়তা
বজায় রাখার জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়ে, কেননা, সামাজিক রীতিনীতি দৃঢ়করনের
মাধ্যমে এটা ‘নিয়ন্ত্রণকারী
পদ্ধতি’ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। এবং, পরিশেষে এভাবেই তা সমাজে
নারীর অধীনতা নিশ্চিত করে।
সেই সাথে যুক্ত হয়েছে
বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিত ইসলামিক মূল্যবোধ; মুসলিম সমাজে, শালীন পোশাক ও আচার-আচরণের মাধ্যমে ‘লুকিয়ে রাখা, ঢেকে রাখা’র মতবাদ চালু আছে। মানে, পর্দাপ্রথা চালু আছে। কেউ
যদি যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে ‘সম্মানিত নারী’ হলে তিনি সেটা গোপন করে যাবেন। তার মানে, নীরবতাই হল ‘ধর্ষিতা এবং আদর্শ নারী’র পরিচায়ক। আর তাই, গ্রামে ধর্ষণ না যত বড় অপরাধ, তার চেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে
ধর্ষণের কথা প্রকাশ করা। এনায়েতপুরের ‘নারীর সামাজিক কোড’ এই বিষয়টার সাথেই সম্পর্কিত; যেখানে নারীর সম্মান সরাসরি
তার যৌন আচরণ (যেমন, স্বামী
ছাড়া কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না) এর সাথে জড়িত, যার সাথে কিনা আবার, অন্যদিকে, তার পরিবার ও সম্প্রদায়ের
সম্মানও জড়িত থাকে। তাই, এখানে
ধর্ষণ শুধু আক্রান্ত নারীর জীবনেই অসম্মান বয়ে আনে না, তার পরিবার ও সম্প্রদায়ের
জন্যেও এটা অসম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বশেষ আরেকটা কারণ
নির্যাতিত নারীদেরকে সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখার পিছনে কাজ করে থাকে। সেটা হচ্ছে, গ্রামে প্রচলিত গোপনীয়তা
রক্ষার ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়া। গবেষকরা বলেন, গ্রামের লোকেরা ১৯৭১’র ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সাধারণত
কথা বলে না – গ্রামের
বাইরে যেগুলো ঘটেছে সেগুলো ছাড়া। স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতি এড়ানোর
উদ্দেশ্য থেকেই এই ধরনের সিলেক্টিভ বা বিচ্ছিন্ন স্মৃতির প্রতি প্রবণতা দেখা দেয়।
তাই, গ্রামীণ লোকদের জন্যে, ধর্ষণ বিষয়ে খোলামেলাভাবে
কথা বলা নেতিবাচক ফল বয়ে আনে। এর ফলে, দীর্ঘদিনের সামাজিক রীতিগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে
রক্ষার জন্যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘remember what to
forget; they know what not to know’।
গবেষকরা, তাই, সামাজিক বিশ্লেষণ করে বলেন, আক্রান্ত নারীর আর্থ সামাজিক
অবস্থান, প্রচলিত ইসলামিক মূল্যবোধ, সম্মান ও যৌনতা বিষয়ক নীতি, এবং ‘গণ নীরবতা (public secrecy)’ – এই
সকল কারণেই একাত্তরে সংঘটিত নারীর প্রতি যৌন সহিংসতাটা আড়ালে চলে যায়।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপে একসময় নারীরা তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে চাপা দিতে বাধ্য
হয়েছেন যেন পরবর্তীতে আর কোন সমস্যায় পড়তে না হয়।
রাষ্ট্র
১৯৭১ এ নারীদের উপর সংঘটিত
যৌন নির্যাতনকে এড়িয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা বাংলাদেশি সমাজে বিদ্যমান তার সাথে এ
বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের গভীর সংযোগ রয়েছে। যদিও প্রথম সরকার নির্যাতিত
নারীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে পুনর্বাসন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রগতিশীল ও
সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তবু, এ বিষয়ে গবেষকরা ভিন্নমত পোষণ করেন। যেমন, ডি কস্তা জানান, নির্যাতিত নারীদের ত্যাগকে
স্বীকৃতি প্রদান করে সমাজে আবারো পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেয়া হয়। কিন্তু, বাস্তবে দেখা যায়, সমাজ এই শব্দকে বিকৃত করে
নির্যাতিত নারীদের ‘বারাঙ্গনা’ বলে অবিহিত করছে; যা কিনা আক্রান্তদেরকে আরও
বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এমনকি, অনেকেই
তখন এই ‘লেভেল’ ব্যবহার করতে চাননি কেননা, এটার ব্যবহার ‘সামাজিক মৃত্যু’কে আরও বেগবান করে তুলত।
ডি কস্তা আরও বলেন, নির্যাতনের শিকার নারীদের
গর্ভপাত কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে পুনর্বাসন করার যে পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়, সেখানে নির্যাতিতাদের
অবস্থার উন্নতির দিকে যতটা মনোযোগ দেয়া হয়, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল বাংলাদেশি পুরুষদের
অপমান মুছে ফেলার দিকে। এই ‘অপমান’ হচ্ছে, যুদ্ধের সময়ে নিজেদের
নারীদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়া। তাই, বাংলাদেশের চিন্তা ছিল, নতুন রাষ্ট্রের সম্মান
রক্ষার্থে ‘অপবিত্র’ পাকিস্তানি রক্তকে চিরদিনের
জন্যে যেন মুছে ফেলা হয়। এভাবে, যৌন নির্যাতনের কারণে ‘বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী এবং
পুরুষ জাতির পরিচয়’ যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন যাবতীয় অভিযান ছিল
তারই প্রতিক্রিয়া; এমন
না যে, শুধুমাত্র নির্যাতিত নারীদের
সাহায্যের তাগিদেই বাংলাদেশ সরকার এগিয়ে এসেছিল।
ইয়াসমিন সাইকিয়া বলেন যে, একাত্তর পরবর্তী সময়ে
ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের সাথে যেভাবে আচরণ করা হয়, তা আমাদেরকে ‘politics of active national forgetting’ এর কথাই মনে করিয়ে দেয়। একাত্তরে নারীদের
অভিজ্ঞতার কোন ধরণের নথিপত্র সরকারী কোন প্রতিষ্ঠানের কাছেই নেই, যা একাত্তরে সংঘটিত যৌন
নির্যাতনের ঘটনাকে মুছে ফেলার রাজনীতির অস্তিত্বকেই জানান দেয়। এভাবেই, ইতিহাস তৈরির উৎসস্থলেই
নীরবতা প্রবেশ করে এবং, আমাদের
মনে করিয়ে দেয় কিভাবে ‘Power works even before narrative is made’.
বাহ্যত, জাতীয়ভাবে ‘বিবাহ কর্মসূচি’ নারীদেরকে নীরব করে private sphere এর
দিকে ঠেলে দেয়ার আরেকটি চাল ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের সামগ্রিক অংশগ্রহণ
রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের জন্যেই সম্ভব ছিল না এবং গৃহস্থালিতে পুরুষের সাথে
সম্পর্কিত অবস্থানের মধ্যেই সেটা সীমাবদ্ধ ছিল। তাই, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে আদর্শ নারীর
ভাবমূর্তির আদলে গড়ে তোলা হয়, যেখানে তিনি একজন সম্মানিত ও আত্মোৎসর্গকারী মা
কিংবা স্ত্রী। এবং, যৌন
নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীরা এই আদর্শ নারীদের তালিকা হতে যেহেতু বাদ পড়ে গিয়েছেন, সেহেতু তাদেরকেও বিবাহ
কর্মসূচির মাধ্যমে আদর্শ আকারেই গড়ে তুলতে হবে, প্রচলিত গৃহস্থালিতে ফিরিয়ে দিতে হবে। আসলে, এর মাধ্যমে নাগরিকদের রক্ষা
করতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকেই অস্বীকার করা হয়। এটাই আসলে দেখিয়ে দেয় কিভাবে রাষ্ট্র
আমাদের সামনে জেন্ডার পরিচয় গড়ে তুলে। এবং, সেই সাথে এটা প্রদর্শিত হয় যে, সার্বভৌমত্ব সংহতকরণ ও জাতি
গঠন প্রকল্পকে বিধিসম্মত করতে কিভাবে যান্ত্রিক উপায়ে নারীকে ব্যবহার করা হয়ে
থাকে।
সরকারের ‘পুনর্বাসন’ প্রকল্পের পাশাপাশি, গবেষকরা এটাও বলেন, একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের
সম্পর্কে কখনো নীরবতা আবার কখনো এর পুনরুত্থান বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির
দুরবস্থারই ফল। অর্থাৎ, কোন
সরকার ক্ষমতায় আছে – মুক্তিযুদ্ধে
নেতৃত্বদানকারী দল নাকি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া দালাল গোষ্ঠীর দল – সেটার উপর নির্ভর করে
বাংলাদেশের ইতিহাসের বয়ান। তবে, কোন বয়ানেই ১৯৭১ – এ আক্রান্ত নারীদের
ব্যাপারে আসল চিত্র ফুটে উঠে না। অনেক
গবেষকই বলেন, বাংলাদেশে
আসলে ‘পৃথক এবং সমান্তরাল’ দুটো ইতিহাসের অস্তিত্ব আছে:
একটা ‘বৃহৎ আখ্যান’ অথবা রাষ্ট্র
সমর্থিত/অনুমোদিত ইতিহাস, এবং
অন্যটা ‘ক্ষুদ্র আখ্যান’ যার ভিত্তি ব্যক্তির স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র – যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন
– একাত্তরের নারীদের প্রকৃত
অভিজ্ঞতাটুকু তুলে আনে না? কিছু কারণ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়
প্রকল্পের আওতায় ‘আদর্শ
নারী’র ভাবমূর্তি গড়ে তুলে নারীকে
নিয়ন্ত্রণ করার সাথে জড়িত। এর পাশাপাশি আরও কিছু জটিলতাকে অস্বীকার করার বিষয়ও
আছে। একাত্তরের নারীরা শুধুমাত্র পাকিস্তানিদের হাতেই নির্যাতিত হন নি, অনেকসময় স্থানীয় শত্রুদের
দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এই রাষ্ট্র যখন শুধুমাত্র ‘পাকিস্তানি’দেরকে আক্রমণকারী হিসেবে
চিহ্নিত করে তখন বিষয়টা খুবই সহজ সরল হিসেবেই ধরা পড়ে, কিন্তু, কিছুটা খোঁড়াখুঁড়ি করলেই
সহজ-সরল ছবিটা হয়ে পড়ে প্যাঁচানো, ধোঁয়াটে ও ঘোলাটে। এভাবে বাংলাদেশ এমন এক
ইতিহাস চাপা দিচ্ছে, যেখানে
ক্ষমতাবান পুরুষ রাষ্ট্রের নামে ক্ষমতাহীন নারীর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। ১৯৭১ তাই
এক দুঃস্বপ্ন, যেখানে
সহিংসতার ইতিহাস বড়ই নির্মম! শত্রু শুধু বাইরেই ছিল না, ভেতরেও ছিল। তাই নারীদেরকে
নীরব থাকতে বাধ্য করা হয়েছে।
উপসংহার
একাত্তরে বাংলাদেশি নারীদের
অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দেয় কিভাবে যুদ্ধ ও গণহত্যাকালীন সময়ে নারীদের উপরে সহিংসতা
চালানো হয়ে থাকে। এবং এটা যেমন শুধু ‘শত্রু’তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তেমনি যুদ্ধকালীন সময়ের
মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকে না। কখনো কখনো তাদের
কষ্ট ও যন্ত্রণা নিজেদের মানুষদের কারণে বেড়ে যায়: হতে পারে সেটা সরাসরি আঘাতের
মাধ্যমে, কিংবা হতে পারে সামাজিকভাবে
একঘরে করার মাধ্যমে, কিংবা
হতে পারে নারীদের অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করার মাধ্যমে, কিংবা হতে পারে নিপীড়নকারী ক্ষমতা কাঠামোর
কারণে। এটাও দেখা যায়, রাষ্ট্র
কিভাবে একচেটিয়াভাবে নারীর দেহকে ব্যবহার করে মিথ তৈরি করতে, ঐতিহাসিক উপাদান চাপা দিতে, অভিজ্ঞতার বহুরূপকে ফেলে
দিতে এবং, পরিশেষে বিপরীত জেন্ডারের
প্রতি আক্রমণ চালাতে।
একাত্তরের নারী নিগ্রহ
আমাদেরকে গণহত্যার প্রকৃতি এবং এক্ষেত্রে ধর্ষণের ভূমিকার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৭১
এর ধর্ষণ শুধুমাত্র যৌন তুষ্টি কিংবা act of random desire এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটার একটা নির্দিষ্ট
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে, যেখানে
সন্ত্রাস, ভয় ও জাতিগত নৃশংসতা উৎপাদনে
ও শত্রু নিয়ন্ত্রণে নারীর শরীরকে রাজনৈতিক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অন্যভাবে
বলতে গেলে, বিষয়টা
ক্যাথেরিন ম্যাকিনন[৫] এর মতে, Rape as a method of
extermination: It is also rape unto death, rape as massacres, rape to kill and
to make the victims wish they were dead. It is rape as an instrument of forced
exile, rape to make you leave your home and never want to go back. It is rape
to be seen and heard and watched and told to others: rape as spectacle, it rape
to drive a wedge through a community, to shatter a society, to destroy a
people. It rape as genocide.
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে সংঘটিত এই ঘটনা
পরিকল্পিত সহিংসতার সবধরনের চিহ্ন প্রকাশ করে থাকলেও, এখন পর্যন্ত, বিভিন্ন গবেষকদের কাছে
উপেক্ষিতই রয়ে গিয়েছে।
ফুটনোট
________________________________________
[১] বিদেশি গবেষকরা সাধারণত
শহিদের সংখ্যা ১০-৩০ লক্ষের কথা বলেন। কারো কারো মতে ১০ লক্ষ, কারো মতে ১৫ লক্ষ, কারো মতে ২০ লক্ষ এবং কারো
মতে ৩০ লক্ষ। তবে বাংলাদেশে সেটা রাষ্ট্রীয়ভাবে ৩০ লক্ষের কথাই উল্লেখ করা হয়। বিস্তারিত জানার
জন্যে দেখতে পারেন আরিফ রহমানের ‘ত্রিশ লক্ষ শহিদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা’ বইটা।
[২] বিনা ডি কস্তা অস্ট্রেলিয়ান
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং সিনিয়র
ফেলো।
[৩] ইয়াসমিন সাইকিয়া এরিজোনা
স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। ২০১১ সালে Women, War, and the Making of Bangladesh: Remembering 1971 নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়।
[৪] এই বিষয়ে বিস্তারিত
আলোচনা আছে ডা এম এ হাসানের ‘যুদ্ধ ও নারী’ বইতে।
[৫] ক্যাথেরিন ম্যাকিনন
ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ল স্কুল এর আইনের অধ্যাপক।
মুন্না, দুর্দান্ত একটা কাজ হয়েছে।
ReplyDelete