যদি বলি, আপনি -
আমি প্রতিদিন যে মতামত দিচ্ছি, যে রুচির পরিচয়
দেখাচ্ছি, যে কাপড়-চোপড় পরছি তার কোনটাই আমার আপনার একান্ত নিজস্ব
সিদ্ধান্ত না, কোন না কোনোভাবে বিষয়গুলো অধিকাংশ সময় মাথায় কেউ
চাপিয়ে দিচ্ছে, তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে?
অবশ্য কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন অনেকেই। বলবেন যে, আমি পোশাক পরিধান করছি একান্ত আমার রুচির উপর নির্ভর করে। এই রুচির ব্যাপারটা , মানে এই চিন্তা চেতনা ব্যাপারটাকেই আরও একটু তলিয়ে দেখতে বলবো তখন। একটা ঐতিহাসিক উদাহরণ দেয়া যাক শুরুতেই। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে মার্কিন পোশাক নির্মাতারা অন্যান্য শিল্পের তুলনায় তাদের শিল্পের শ্লথ গতিটা খেয়াল করেন। এবং এর একটা বড় কারণ ছিল এই যে, পোশাক বিষয়ে মার্কিন পুরুষরা তত সচেতন নয়। অতঃপর, শুরুতেই পুরুষদেরকে ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে, তাই শুরু বিজ্ঞাপনের ঢেউ। ‘ড্রেস ওয়েল, ইউ কান্ট এফোর্ড নট টু’ – ধরনের আকর্ষণীয় শ্লোগান তোলা হল। সেই সাথে মেয়েদের কাছেও পুরুষদের কাপড় সংক্রান্ত আবেদন তুলে ধরা হল বিজ্ঞাপন দ্বারা, বলা হল, ‘Does your husband look as smart as he is?’ পুরুষ-নারীদের মনোজগতে ফ্যাশনের এই তীব্র তাগিদ তৈরি করা হল শুধুমাত্র বাজারের স্বার্থে। ফ্যাশনের কারণে আপনি কিছুদিন পরপর পোশাক পরিবর্তন করে নতুন পণ্যের দিকে মনকে ধাবিত করার মাধ্যমে বাজারকে তুঙ্গে রাখছেন। উদাহরণ শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলাম; কিন্তু এভাবে বিজ্ঞাপন, সিনেমা দিয়ে এবং তথ্য ও সংবাদের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আমাদের চিন্তা জগতকে শাসন করাটাকে মফিদুল হক, ‘মনোজগতে উপনিবেশ তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত’ বইতে, নাম দিয়েছেন, ‘মনোজগতে উপনিবেশ’।
অবশ্য কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন অনেকেই। বলবেন যে, আমি পোশাক পরিধান করছি একান্ত আমার রুচির উপর নির্ভর করে। এই রুচির ব্যাপারটা , মানে এই চিন্তা চেতনা ব্যাপারটাকেই আরও একটু তলিয়ে দেখতে বলবো তখন। একটা ঐতিহাসিক উদাহরণ দেয়া যাক শুরুতেই। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে মার্কিন পোশাক নির্মাতারা অন্যান্য শিল্পের তুলনায় তাদের শিল্পের শ্লথ গতিটা খেয়াল করেন। এবং এর একটা বড় কারণ ছিল এই যে, পোশাক বিষয়ে মার্কিন পুরুষরা তত সচেতন নয়। অতঃপর, শুরুতেই পুরুষদেরকে ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে, তাই শুরু বিজ্ঞাপনের ঢেউ। ‘ড্রেস ওয়েল, ইউ কান্ট এফোর্ড নট টু’ – ধরনের আকর্ষণীয় শ্লোগান তোলা হল। সেই সাথে মেয়েদের কাছেও পুরুষদের কাপড় সংক্রান্ত আবেদন তুলে ধরা হল বিজ্ঞাপন দ্বারা, বলা হল, ‘Does your husband look as smart as he is?’ পুরুষ-নারীদের মনোজগতে ফ্যাশনের এই তীব্র তাগিদ তৈরি করা হল শুধুমাত্র বাজারের স্বার্থে। ফ্যাশনের কারণে আপনি কিছুদিন পরপর পোশাক পরিবর্তন করে নতুন পণ্যের দিকে মনকে ধাবিত করার মাধ্যমে বাজারকে তুঙ্গে রাখছেন। উদাহরণ শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলাম; কিন্তু এভাবে বিজ্ঞাপন, সিনেমা দিয়ে এবং তথ্য ও সংবাদের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আমাদের চিন্তা জগতকে শাসন করাটাকে মফিদুল হক, ‘মনোজগতে উপনিবেশ তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত’ বইতে, নাম দিয়েছেন, ‘মনোজগতে উপনিবেশ’।
এই বিষয়টাকে নোয়াম চমস্কি বলেছেন
‘সম্মতি
উৎপাদন’, অর্থাৎ, মিডিয়াকে ব্যবহার করে
প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সম্মতি আদায় করে নেয়া। এমন না যে,
মিডিয়া আপনাকে ভুল তথ্য দিচ্ছে, বরং সে আপনাকে
সঠিক তথ্যই দিবে। কিন্তু, কোনটাকে আপনি গুরুত্ব দিবেন আর কোনটাকে
গুরুত্ব দিবেন না, সেটা আপনাকে ঠিক করে দেয়া হবে। পত্রিকার কোন
অংশে কতটা জায়গা জুড়ে খবর প্রকাশিত হবে, হেডলাইন কেমন হবে,
ঘটনার বর্ণনা কেমন হবে, এসব দিয়েই ‘গুরুত্ব’র মাত্রা ফুটিয়ে তোলা হয় সাধারণত। টুইন টাওয়ারে কবে হামলা হয়েছে সেটা
আমরা মনে রাখি, কেননা, মিডিয়া ‘৯/১১’ নামে শব্দবন্ধ আমাদের জন্যে তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা,
যেমন আমেরিকা কর্তৃক ইরাকে হামলা, আমরা মনে রাখি
না, কারণ এখানে মিডিয়া আমার আপনার সামনে এমন কোন শব্দবন্ধ তৈরি
করে দেয় নি। আমেরিকার সংবাদপত্রের কিছু খবর বিশ্লেষণ করে চমস্কি দেখিয়েছিলেন কিভাবে
শুধুমাত্র খবর পরিবেশনে ভাষা ব্যবহার করে লঘু সংবাদকে গুরুত্বপূর্ণ করা হচ্ছে। আমাদের
সামনে পরিবেশিত সংবাদগুলো, চমস্কির মতে, পাঁচটা ফিল্টার পাড়ি দিয়ে আসে। ‘সংবাদের কাঁচামালকে অনিবার্যভাবেই,
প্রকাশযোগ্য হওয়ার জন্যে, একে একে ফিলটারগুলো অতিক্রম
করতে হয়’। এই ফিল্টারগুলো আবার সরকারি
ভাষ্য ও সমাজের এলিট শ্রেণির মুনাফার দিকে দৃষ্টি রেখেই ‘filtration’ প্রক্রিয়া
সম্পন্ন করে। (CHOMSKY & HERMAN, 2002)
মূল যে বই নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম, সেখানেই চলে যাই।
বইয়ের শুরুতেই ‘প্রযুক্তি’র সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে,
অর্থাৎ, কোন প্রেক্ষাপটে কিভাবে রেডিও-টেলিভিশনের
উদ্ভব হয়েছিল, সংবাদ সংস্থার কার্যক্রম কিভাবে শুরু হয়েছিল এবং
কোন খাতে এই বিষয়াদি ব্যবহৃত হচ্ছিল এ সংক্রান্ত বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর
সময়কালে যে ‘তথ্যবিষ্ফোরণ’ ঘটে তার পটভূমি ও গতিপ্রকৃতি বুঝতে
উপনিবেশায়নকে আলোচনায় রাখতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উপনিবেশায়ন ভেঙে নতুন জাতি
রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা হাসিল করলেও
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পায় নি। অর্থনৈতিক মুক্তি দিকে ইঙ্গিত করে মুক্তি আন্দোলনের
একজন নেতা বলেছিলেন, গাইবার মতো একটি গান ও দোলাবার মতো একটি
পতাকার জন্যে স্বাধীনতা চাই না। অতীতে উপনিবেশিক শেকলে তৃতীয় বিশ্বকে (অবশ্য উপনিবেশায়নের
জন্যেই এরা ‘তৃতীয় বিশ্ব’) বেঁধে রাখার জন্যে অর্থনৈতিক আধিপত্যের
পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, নয়া-উপনিবেশিক যুগে অর্থনৈতিক আধিপত্যের
জন্যে দরকার পড়ে ‘ভাবাদর্শগত আধিপত্য’। লেখক বলেন, ‘নয়া উপনিবেশবাদী
শাসন ও শোষণ বিশ্বব্যাপী যে পুঁজির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সে জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ
ও তথ্যের প্রচারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন’।
উপনিবেশিক যুগ কিভাবে আমাদের মন
মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল, নিজ দেশ ও নিজ জাতির প্রতি তুচ্ছভাব সঞ্চার
করেছিল এবং হীনমন্যতাবোধের তৈরি করেছিল তা আমরা জানি এবং এখনো দেখে আসছি। নয়া-উপনিবেশ
যুগে আসলে শোষণের কাঠামো বজায় রেখে একই ভাবে মন-মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রিত রাখার গুরুদায়িত্ব
পালন করছেন পশ্চিমী সংবাদসংস্থাগুলো।
এটা বুঝতে পারলে আমাদের জন্যে
বোধগম্য হবে পরিবেশিত সংবাদের প্রবাহ কেন একমুখী। যদিও মফিদুল হকের বই অনেক পুরনো এবং
তথ্যাবলিও পুরনো তবু তাঁর দেয়া তথ্যই হাজির করি, ‘বিশ্বের সংবাদ প্রবাহের ৮০ শতাংশেরও
বেশি যেমন আসছে তিনটি পশ্চিমী দেশের রাজধানী তথা, লন্ডন,
প্যারিস, নিউ ইয়র্ক থেকে পাশাপাশি এই প্রবাহে গোটা
তৃতীয় দুনিয়া, যেখানে বাস করে বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ,
সেখান থেকে উৎসারিত সংবাদের অংশভাগ মাত্র ২০-৩০ শতাংশ। তৃতীয় দুনিয়ার
মানুষ পরস্পরের সংবাদ জানছে পশ্চিমী সংবাদদাতাদের কল্যাণে, তাদের
চোখ দিয়ে’। এর উদাহরণ পাওয়া যায় আমাদের
আশেপাশেই। সোমালিয়াতে দুর্ভিক্ষের খবর আমাদের পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না, হলেও চোখে পড়ে
না এমন স্থানে থাকে, কিন্তু মেসি কিংবা ব্রিটিশ প্রিন্সের বিয়ের
খবর প্রকাশিত হয় প্রথম পাতাতে। এমনসব খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে যার কোন সংযোগ নাই। এখানে, মার্কিন সংবাদপত্র জগতের অন্যতম একচেটিয়া অধিপতি উওইলিয়াম র্যানডলফ ফার্স্ট এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য,
‘যা গুরুত্বপূর্ণ সেটা সংবাদ নয়, যা আগ্রহোদ্দীপক
তাই সংবাদ।’
প্রশ্ন হতে পারে, মিডিয়া কিভাবে
মনোজগত শাসন করে? কিংবা মিডিয়া গুরুত্ব সহকারে কি প্রকাশ করলো
আর কি করলো না তা দ্বারা কি আমরা আসলেই প্রভাবিত? শুরুতেই একটা
উদাহরণ দিয়েছি, যদিও সেটা বিজ্ঞাপন কেন্দ্রিক। ভিন্ন এক উদাহরণ
দেয়া যাক মফিদুল হকের বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়, ‘ধরা পড়েছি টেলি-বন্ধনে’,
থেকে।
মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে একটা
জরিপ হয়েছিল দুটো দলকে নিয়ে। একদল দৈনিক চারঘন্টা টিভি দেখে, অন্যদল দুঘন্টা
বা তারচেয়ে কম সময় টিভি দেখে। দু দলকে কিছু প্রশ্ন করা হয়, তন্মধ্যে
একটা ছিল, ‘কোন সপ্তাহে আপনার ভায়োলেন্সের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা
কিরূপ?’ এর উত্তরে, দীর্ঘ সময়ের দর্শক বলেন
ভায়োলেন্সে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা ৫২ শতাংশ এবং,
অল্প সময়ের দর্শক বলেন এ সংখ্যা ৩৯ শতাংশ। এই জরীপকে বিশ্লেষণ করে গবেষকরা
বলেন, টেলিভিশন বেশি দেখার ফলে জগত যতটা না ভায়োলেন্সপূর্ণ তার
চেয়ে অধিকতর প্রতীয়মান হয় দর্শকদের কাছে’। এ বিষয়ে আবার লেখক বলেন, ‘ভায়োলেন্স দেখতে দেখতে মন-মানস অভ্যস্ত
হয়ে যায় ভায়োলেন্সে, ফলে বাস্তব জীবনের সন্ত্রাস-পীড়নের বিরোধী
না হয়ে মন হয়ে ওঠে আপোষমূলক অথবা অনুভূতিহীন’। দেখা যায়, টেলিভিশনে প্রদর্শিত
ভায়োলেন্স মাত্রা দিনে দিনে বেড়েই চলছে, বর্বরতা ও নৃশংসতার চিত্রায়ন
আরও সুন্দরভাবে ঘটছে। ভায়োলেন্সের এই প্রসার ঘটার কারণ হিসেবে এক চলচ্চিত্র নির্মাতা
কোম্পানি প্রধান বলেছিলেন, ‘নিশ্চিতভাবেই ভায়োলেন্সের প্রসার
ঘটে চলবে, কেননা, মানুষ সবসময়ই সর্বশেষ
যা দেখেছে তার চেয়ে বেশি দেখতে চায়’।
এ প্রসঙ্গে এক বাস্তব অভিজ্ঞতার
কথা বলি। বর্তমানে আমাদের পত্রিকায় ‘ধর্ষণ’ সংক্রান্ত যে খবর আসে সেখানে মূল সমস্যা,
ধর্ষণের বিচারহীনতার দিকে লক্ষ্য না দিয়ে ধর্ষণের রগরগে বর্ণনার দিকেই
বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। কেননা, যে সমাজে যৌনতা নিয়ে আলাপ-আলোচনাই
নিষিদ্ধ, মানে অবদমিত করে রাখা হয়, সে সমাজে
ধর্ষণের রগরগে বর্ণনা দিয়ে বাজার (পাঠক) ধরাটা সহজ। ধর্ষণ সংক্রান্ত খবরের এমনতর বর্ণনার
কারণে ভীতসন্ত্রস্ত আমার এক বান্ধবী বলেছিল, আমার যেন কোন মেয়ে
না হয়, নাইলে, তো আমি দুশ্চিন্তায় মারা
যাবো!
‘মনোজগতে উপনিবেশ’ বইয়ে, আমার মতে,
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত চতুর্থ অধ্যায়,
‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। বর্তমানে আমরা যে ভোগবাদী সমাজে
বাস করছি তার হৃৎপিণ্ড হিসেবে সেখানে কাজ করছে বিজ্ঞাপন। অবশ্য, আজকাল আধুনিক
শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেই ‘ভোগবাদী’ লেভেলে বিরক্ত হয়ে যান, হওয়াটাই
স্বাভাবিক। কেননা, ভোগের নেশায় মত্ত এই ভোগবাদী সমাজে you
work in a job you hate, to buy staff you
don’t need, to impress people that you don’t like। সহজ কথা, এই ভোগবাদ সকল অপ্রয়োজনীয় জিনিসকে করে তুলেছে
মূল্যবান, আর ব্যক্তি, সমাজ ও নীতি-নৈতিকতাকে
করে তুলেছে মূল্যহীন। কিউবান সমাজবিজ্ঞানী খুব সুন্দর করে এই সমাজ সম্পর্কে বলেছিলেন,
‘অপ্রয়োজনীয় ভোগ মানসিকতা জাগ্রত করার জন্যে প্রয়োজন ও বিলাসের কৃত্রিম
চাহিদা সৃষ্টির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে এই সমাজ’। এই যে ‘কৃত্রিম’ চাহিদার
কথা বলা হচ্ছে সেটাকে কিন্তু সবার আগে উৎপাদন করতে হবে আপনার-আমার মনোজগতে। অর্থাৎ,
পণ্যের উৎপাদনের পূর্বেই পণ্য আপনার মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। বিজ্ঞাপনের
প্রয়োজন এখানেই। সে আপনার কল্পনায় পণ্যের ইমেজ ও চাহিদা তৈরি করবে বিভিন্ন ধাপে ধাপে
এবং একসময় আপনি আচ্ছন্ন হয়ে কিনতে বাধ্য হবেন পণ্যটি, মানে বাধ্য
হয়ে আত্মসমর্পণ করবেন এই ভোগবাদে। বিজ্ঞাপনের কর্মপ্রণালী নিয়ে সুন্দর একখান কথা আছে,
I can imagine it, therefore I want it. I want it, therefore I should have it.
Because I should have it, I need it. Because I need it, I deserve it. Because I
deserve it, I will do anything necessary to get it. এই যে শেষধাপে
পণ্যের জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি হয়ে যাওয়া, তার শুরুটা কিন্তু
পণ্যের কল্পনার (imagine) মাধ্যমে, মানে
বিজ্ঞাপন দিয়ে। (ইসলাম এবং দেওয়ারী, ২০০৬)
লেখক যে শিরোনাম দিয়েছেন অধ্যায়ের, সে নামে শঙ্খ
ঘোষের একটা কবিতাও আছে; ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। বিজ্ঞাপনে এখন আর শুধু
পণ্যের বিপণন চলে না, বরং, মানুষই এখন হয়ে গিয়েছে পণ্য। বিশেষ
করে, নারী ও যৌনতাকে যেভাবে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং
আমরাও যেভাবে গোগ্রাসে গিলছি সেগুলো, তা সত্যই আতঙ্কের। আজ আমার
আপনার ব্যক্তিগত সকল আবেগ, অনুভূতি, প্রেম,
ভালোবাসা, মাতৃস্নেহ সবই পণ্য উৎপাদনের হাতিয়ার
হিসেবে কাজ করছে। অর্থাৎ, নিজের খেয়ালেই হোক কিংবা বে খেয়ালেই
হোক পণ্য উৎপাদনে উদ্দেশ্যে আমি ব্যক্তিই হয়ে উঠছি আরেক পণ্য। তাই, বিজ্ঞাপন মূলত পণ্যভোগী মানুষ উৎপাদন করে চলছে প্রতিনিয়ত। শঙ্খ ঘোষের কবিতার
ভাষায়,
‘বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হল
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত’।
মফিদুল হক বইয়ের এই অধ্যায়ে ভোগবাদ
ও পুঁজিবাদের সাথে বিজ্ঞাপনের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। শুরুতেই পরিষ্কার
করেছেন বিজ্ঞাপন কিভাবে কেবল পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশকেই সহায়তা করে না, বরং, পুঁজিবাদের সহায়ক মন মানসিকতার বিস্তার ঘটায়। তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরীণ গঠন কাঠামোর মধ্য থেকেই পণ্য বিপণনের জন্য বিজ্ঞাপন
ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ’। মূলত, পুঁজিবাদী সমাজে প্রয়োজনের চাহিদা পূরণের ক্ষমতা অর্জনের পর উৎপাদনের
অব্যাহত বিকাশের জন্যে দরকার অপ্রয়োজনের চাহিদা তৈয়ার করা, বিজ্ঞাপন
দিয়ে সে সেই কর্মটাই সম্পাদন করে থাকে। শুরুতেই প্রদত্ত উদাহরণের কথা এখানে স্মরণ করা
যেতে পারে।
অতঃপর কথা বলেছেন বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন
কর্মপদ্ধতি ও প্রভাব নিয়ে। যেমন, বিজ্ঞাপন যেমন মানুষের মধ্যে ‘বিরামহীন ক্ষুধা’ সৃষ্টি করে, তেমনি বিজ্ঞাপনের উপর অত্যধিক
নির্ভরশীলতার ফলে গণমাধ্যম/সংবাদমাধ্যমের উপর পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের প্রভাবও বাড়ছে
ক্রমাগতভাবে। এখানে, চমস্কি প্রদত্ত ফিল্টারগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়টার
কথা উল্লেখ করা যেতে পারে: ‘বিজ্ঞাপন ব্যবসা করার লাইসেন্স’। বিজ্ঞাপনদাতারা একদিকে
যেমন সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করে থাকেন, তেমনি, অন্যদিকে বিভিন্ন
‘শ্রমজীবী অ প্রগতিবাদী-পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপনদাতাদের রাজনৈতিক
পক্ষপাতিত্বের শিকার হয়’। (CHOMSKY & HERMAN, 2002)
লেখক, বিজ্ঞাপন সম্পর্কে,
আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। বিজ্ঞাপন, তাঁর মতে, শুধুমাত্র জনচিত্তকেই আকর্ষণ করে না,
বরং, আমাদেরকে মানসিকভাবেও বিকৃত করে তুলে। নারীর
দেহকে ‘পণ্য’ বানিয়ে একধরণের অসুস্থ যৌন আবেদনমূলক বিজ্ঞাপন যেমন কামবিকার করে
ফেলছে মানুষকে, তেমনি নারীকেও করছে চরম অবমাননা। যেমন,
আমাদের দেশের এপেক্স ফোন তাদের বিজ্ঞাপনে লিখেছিল, ‘মেঘের মত কোমল আর মোহিনী নারীর মত কমনীয় এপেক্স ফোম’। দ্বিতীয়ত, লেখকের মতে,
‘বিজ্ঞাপনের চাকচিক্যময় জগত, শুধু মনোহরণই করে
না, প্রচারমাধ্যম সমূহে একই সঙ্গে জীবন-বাস্তবতা ও বিজ্ঞাপন-অবাস্তবতার
উপস্থিতি বাস্তবের রূঢ় প্রকাশকে ঢেকে ফেলে অবাস্তবতার দ্বারা’।
শেষ অধ্যায়ের নাম আশা-উদ্দীপক, ‘চাই তথ্যের নতুন
ব্যবস্থা’। তথ্য প্রবাহের একমুখিতা বন্ধ করে নতুন তথ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান
তিনি। তিনি জানেন, প্রবাহের বৈষম্য শুধু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই নয়, দেশের ভেতরেও তা বিদ্যমান। বলেন, ‘আন্তর্জাতিক তথ্য প্রবাহে
আধিপত্য-কারীরা দেশের ভেতরের আধিপত্যবাদীদের উপর নির্ভর করেই সক্রিয় থাকে’। এরও মুক্তি চান তিনি।
তথ্য প্রবাহের সমতার জন্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সংগ্রাম এবং এর প্রতিপক্ষ হিসেবে
পশ্চিমা ‘উন্নত’ বিশ্বের ‘রুখে দাঁড়ানো’ নিয়েই শেষ অধ্যায়ের আলোচনা। দুনিয়ার মুক্তিচঞ্চল মানুষ একদিন তথ্য জগতের ‘সবরকম আধিপত্য, নির্ভরতা ও বিকৃতির’ অবসান ঘটাবে,
এ আশা নিয়ে আলোচনার ইতি টানেন লেখক।
‘মনোজগতে উপনিবেশ তথ্য সাম্রাজ্যবাদের
ইতিবৃত্ত’ বইটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। পুরনো এই বইটা হঠাৎ করেই হাতে পেলাম, এবং যাকে বলে
‘গোগ্রাসে গিলে ফেলা’ ঠিক তাই ঘটেছে এর বেলায়। বইয়ের লেখক মফিদুল
হক বিখ্যাত লেখক ও সমালোচক; সেই সাথে প্রকাশক এবং সক্রিয় সাংস্কৃতিক
সংগঠক হিসেবেও খ্যাতিমান। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি,
জাদুঘরের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রবর্তিত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী
ভাষ্যসংগ্রহ প্রকল্পের প্রণেতা ও পরিচালক। ২০১৪ সালে প্রবন্ধসাহিত্যের জন্য তিনি পেয়েছেন
বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
বই নিয়ে এ আলোচনার ইতি এখানেই
টানবো। পরিশেষে,
এটাই বলবো যে, বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক ময়দানে,
গণমাধ্যম কিভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং তাদের বর্তমান হালহকিকত
কি তা বুঝার জন্যে একেবারে সহজপাঠ্য এই বই।
সহায়িকা:
CHOMSKY, NOAM, and EDWARD S. HERMAN. MANUFACTURING
CONSENT the Political Economy of the Mass Media. New York: Pantheon Books,
2002.
ইসলাম, মোহাম্মদ মোরশেদুল,
এবং এ্যান্ডরু অলক কুমার দেওয়ারী. "ভোগবাদ বিকাশে গণমাধ্যম."
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা (বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ) চতুর্বিংশ খণ্ড ,
২য় সংখ্যা (২০০৬ ): ১৬৫-১৭৮ .
No comments:
Post a Comment