... আমি বলিব ঢাকা শহরে তারেক মাসুদ নাই বলিয়া এই শহরকে বসবাসের আরো অযোগ্য মনে হইতেছে।’
- সলিমুল্লাহ খান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যে (বিশেষত গল্প, সিনেমা, উপন্যাসে) কোনো সন্দেহ নেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয়জয়কার; এই জাতীয়তাবাদ তার ‘সেকুলার’ চরিত্র ধারণ করার জন্য অদ্ভুতভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে একধরনের বিপরীত মেরুতে ঠেলে দিয়েছে, অথবা বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে বিপরীত হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের অধিকাংশ সিনেমা-নাটকে-উপন্যাসে রাজাকারের একটা সাধারণ চিত্রায়ন থাকে: রাজাকারের দাড়ি থাকে, পাঞ্জাবি-পাজামা পরে, মাথায় টুপি থাকে, মাদ্রাসা বা মসজিদে ইমামতি করে, নিয়মিত যায়। ‘দাড়ি-টুপি’ দিয়ে রাজাকারের এই চিত্রায়ন কতটা সত্য আর কতটা আত্মপরিচয়ের রাজনীতির খাতিরে ‘নির্মিত’ তা খুব একটা বিচার করে দেখা হয় নি। বরঞ্চ, এই চিত্রায়ন আমাদের মাথার এতো গভীরে ঢুকে গিয়েছে যে, প্রতিদিনকার জীবন-যাপনে বন্ধুবান্ধবদের কেউ যদি দাড়ি-টুপি পরেছে তখন অন্যদের বলতে শুনেছি, ‘আরে শালা তোরে তো রাজাকার লাগে’। কিন্তু, এই ‘দাড়ি-টুপিওয়ালা’দের রাজাকার বা ভিলেন হিসেবে একরৈখিক উপস্থাপন এখানে যে কালচারাল হেজিমনে তৈরি করেছে তার ফলাফল হয়েছে ভয়ঙ্কর; শাহবাগের সময় জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম প্রশ্নে এমনভাবে পুরো দেশের একধরনের আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাওয়ার একটা কারণ বোধহয় আমাদের এই চলমান সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে।
তারেক মাসুদকে নিয়ে
আলোচনার জন্য এই কথাগুলো টেনে আনার একটা বড়ো কারণ হচ্ছে, তারেক
মাসুদ বোধহয় অতি-অল্পকজন ব্যক্তিদের মধ্য অন্যতম যারা সাংস্কৃতিক ময়দানের এই ‘ডমিন্যান্ট
ডিসকোর্স’ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। আরো একটু খোলাসা করা যাক।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে দুই ধরনের জাতীয়বাদের প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়,
এক দিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ (ভাষা ভিত্তিক বলেই ধরা হয়), এবং অন্যদিকে রয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ (ধর্মভিত্তিক বলে ধরা হয়)। এই
দুই ধারাকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন,
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ একেবারে দুই মেরুতে অবস্থান করে: হয় তারা
বাঙালি জাতীয়তাবাদী, আর না হয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী। আমাদের
এখানে যারা প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চা করেন বলে দাবি করেন তারা মূলত এই বাঙালি
জাতীয়তাবাদকেই কবুল করে নেন, এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে
প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবেই উপস্থাপন করে থাকেন। মূলত এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই
আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ঘুরপাক খায়। ফলে, এক পক্ষ ধর্মের
উপস্থিতি পেলেই নাকচ করে দেয়, অন্য পক্ষ ধর্মকেই সম্বল করে
রাজনীতিকে গড়ে তোলে। নাইন-ইলেভেন পরবর্তী বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই অবস্থা আরো
ঘোলাটে হয়। কিন্তু, এই দুই ধারাই আরেকটা বড়ো সত্যকে আমলে নেয়
না, বা অস্বীকার করে, বা স্বীকার করলেও
জোর দেয় না, তা হলো তাদের দুই ধারার বাইরেও আরেকটা ধারা
রয়েছে, যার বিকাশ এই মাটিতে গত কয়েকশত বছর ধরে হয়েছে,
লৌকিক ধর্ম নামে। বৈষ্ণব ধর্ম, সুফিবাদ থেকে
শুরু করে একেবারে বাউল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে এই ধারা এই ভূখণ্ডের জনগণের মধ্যে
বিরাজমান।
বাংলাদেশের যে কয়জন
সৃষ্টিশীল মানুষ বিদ্যমান ‘কালচারাল হেজিমনি’কে এড়িয়ে এই তিনটা ধারাকে চিহ্নিত
করতে, এবং সমাজে এগুলোর ক্রিয়াশীলতা সৃষ্টিশীল মাধ্যমে উপস্থাপন করতে সক্ষম
হয়েছিলেন তাদের মধ্যে তারেক মাসুদ অন্যতম। আমরা মাটির ময়নাতে এই তিন ধারার
প্রতিনিধিদের উপস্থিতি খুঁজে পাই, এবং তারেক মাসুদ যে তৃতীয়
ধারা বা লৌকিক ধর্মেরই বিশেষ ওকালতি করেছেন সেটাও সহজে অনুমেয়। বাজারে প্রতিষ্ঠিত
প্রথম দুই ধারার পাশাপাশি এই তৃতীয় ধারাকে দূর্দান্তরূপে বুঝতে পারা ও এর পক্ষে
ওকালতি করা কীভাবে সম্ভব হয়েছে, তারেক মাসুদের জীবন ও
অন্যান্য কাজকে একত্রে পাঠ (সিনেমাকে পাঠ অর্থে) করলে তার কিছুটা খোঁজ পাওয়া যাবে
বলে মনে করি। আদম সুরত - এ কাজ করতে গিয়ে সুলতান যে তার মধ্যে একটা বিরাট প্রভাব
ফেলেছিলেন সেটা বিভিন্ন জায়গায় তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। পরবর্তীতে, দেশজুড়ে মুক্তির গান দেখাতে গিয়ে মুক্তির কথা নির্মাণ করে প্রথমবারের মতো
বোধহয় নিম্নবর্গের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধ ও জেনোসাইডকে তুলে এনেছিলেন। ফলে, তিনি যে এই মাটি থেকে গড়ে উঠা লৌকিক ধারার সন্ধান ও ওকালতি করবেন সেটাই
বোধহয় স্বাভাবিক ছিল।
২
কিছুদিন পূর্বে ‘শূন্যের
ভিতরে এতো ঢেউ’ নামে একটা ছোট পুস্তিকার সন্ধান পেয়েছিলাম; তারেক
মাসুদকে নিয়ে তার জননী নুরুন্নাহার মাসুদ এবং তারেক মাসুদের বন্ধু আলম খোরশেদের
স্মৃতিচারন। প্রিয় মানুষকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করা বেদনাদায়ক, এবং
পাঠক হিসেবে সেই স্মৃতিচারণমূলক রচনা পড়াও একইভাবে বেদনাদায়ক; খানিকটা আনন্দেরও বটে। তারেক মাসুদকে আরো একটু নিবিড়ভাবে জানলাম এই বোধ
যেমন পুলকিত করে, তেমনি খুব অবেলাতেই তাকে হারিয়ে ফেলেছি এই
বোধ শোকাভিভূত করে।
নুরুন্নাহার মাসুদ ছেলের
কথা বলতে গিয়ে অনেক পিছনে শুরু করেছেন, একেবারে ‘আমার জন্ম ঠিক কবে,
সেটা মনে নেই’ থেকেই শুরু করেছেন। কথা বলেছেন তাঁর শিক্ষাজীবন,
সেই সময়ের সমাজে নারীর পরিস্থিতি, দেশভাগ,
দাঙ্গা, শ্বশুর বাড়ির পরিবেশ, স্বামীর শর্তারোপনসহ অনেক কিছু নিয়েই। এসবের মাঝেই ঘুরে ফিরে এসেছেন তারেক
মাসুদ। নুরুন্নাহার ছোটকালে কলকাতায় কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন, বোনের বাড়িতে, তাতেই ৪৭’র দাঙ্গার স্মৃতি এখনো তার
মনে অটুট রয়েছে। দাঙ্গার সময় তাকে নিরাপত্তার স্বার্থে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তার
মনে আছে, ‘একদিন বাড়ির ছাদ থেকে আমরা বোন তাকিয়ে দেখে
রাস্তায় বেশ কয়েকজন মানুষকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে, পাশ
দিয়ে রক্তের স্রোত বইছে। এই দৃশ্য দেখে আমার বোন অজ্ঞান হয়ে যায়।’ তার যখন ১৫ বছর
বয়স তখন ৩৫ বছর বয়সী তারেকের বাবার সাথে তার বিয়ে হয়।
মোটামুটি আমরা প্রায়
সকলেই জানি যে,
মাটির ময়না সিনেমা মূলত তারেক মাসুদের নিজের জীবন থেকেই নেয়া;
সিনেমার ‘কাজী মাজহারুল ইসলাম’ চরিত্র তারেকের পিতার চরিত্রায়ন।
সিনেমাতে আমরা যেমন দেখি, কাজী মাজহারুল ইসলাম প্রথম জীবনে
এমন গোড়া ধার্মিক ছিলেন না, পরবর্তীতে হঠাৎ করে বদলে যান,
তা প্রায় হুবুহুই তারেক মাসুদের পিতার সাথেই মিলে। সেই বদলে যাওয়ার
ঘটনা নুরুন্নাহার মাসুদ জানাচ্ছেন: ‘আমার বিয়ের ছয় মাস পর আমার মা মারা যান। তিনি
মারা যাওয়ার পরই তারেকের বাবা কেমন জানি পালটে গেলেন- পুরোপুরি হুজুর হয়ে গেলেন।
গান বাজনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-, কী
করেন নি তারেকের বাবা! বন্ধুদের নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন, এলাকার তার বেশ জনপ্রিয়তাও ছিল সংস্কৃতিমনা হওয়ায়। এলাকার বিভিন্ন মানুষ
তাকে ভীষণ ভালোবাসতো। শার্ট প্যান্ট পরতেন। ... বলতে গেলেই সাংস্কৃতিক পরিবেশেই
গড়ে উঠেছিলেন তারেকের বাবা।’
তারেক মাসুদের পিতার এই
পরিবর্তনের ফলেই তারেক মাসুদ মাদ্রাসায় ভর্তি হোন। নুরুন্নাহার মাসুদের বরাতে জানা
যাচ্ছে, তারেক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছেন। যুদ্ধের পর তারেক
মাসুদ ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে নটরডেমে ভর্তি হোন, পরে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারেক মাসুদ যখন তার সিনেমায় মাদ্রাসার পরিবেশ চিত্রায়ন করেন, তখনও বাংলাদেশের ‘মূলধারা’র সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে বের হয়ে সেখানে ‘বড়ো
হুজুর’ ও ‘ইব্রাহিম হুজুরে’র মধ্যকার দ্বন্দ্বের মাধ্যমে মৌলবাদী ইসলাম ও লৌকিক
ইসলামের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেন। বড়ো হুজুর এখানে মৌলবাদী ইসলামের প্রতিনিধি করেন,
যিনি ধর্মকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে চান, বিপরীতে
ইব্রাহিম হুজুর বারেবারে বলতে চান, রাজনীতি করা কখনো ধর্মের
উদ্দেশ্য হতে পারে না, বরঞ্চ ধর্মের মূল কাজ হচ্ছে
শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। ইব্রাহিম হুজুরের ইঙ্গিত সুফিবাদের
ভাব-ভালোবাসার দিকে।
সিনেমার মতন বাস্তবেও
তারেক মাসুদের পিতা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। হোমিওপ্যাথি ওষুদের তার অগাধ
আস্থার খেসারতও তাকে দিতে হয়েছিল; আলসারে ভোগে তারেক মাসুদের বোন মারা যান।
মাটির ময়নাতে এই বোনও এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র; অমিল কেবল
এটাই যে, সিনেমার বোন আনুর ছোট ছিল, বাস্তবে
সে বোন তারেকের বড়ো ছিলেন। মাটির ময়না দেখে নাকি তারেক মাসুদের পিতা খুব কষ্ট
পেয়েছিলেন, বলেছিলে, ‘তারেক, আগেকার ডাক্তাররা কিন্তু ওই রকমই চিকিৎসা করেছে। তখন রক্ত আমাশয় হলে ছানা
আর বার্লির পানিই খাওয়ানো হতো। আর একবেলা ভাত খেতে দিতো।’ তারেক মাসুদ কোনো উত্তর
দেন নি। নুরুন্নাহার মাসুদের জবানিতে জানা যায়, তারেক মাসুদ
ও তার ভাই-বোনেরা পিতার খুব বাধ্যগত সন্তানই ছিলেন, কোনো
প্রতিবাদ ছাড়াই পিতার অনুশাসন মেনে নিতেন। নুরুন্নাহার মাসুদের নিজের কাছেও এ এক
বিষ্ময় যে, এমন বাপের সন্তান কীভাবে সিনেমার লাইনে এলো!
তারেক মাসুদের জীবনের
সাথে মাটির ময়নাকে মিলিয়ে পড়ার মৌজেজা অনেক; একটা উদাহরণ হতে পারে সিনেমার
একেবারে শেষে কাজী মাজহারুল ইসলামের হতভম্ব হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। আমাদের ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতা থেকেই জানি যে, কাজী মাজহারুল ইসলামের মতো অনেকেই
বিশ্বাস করতেন, ‘পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের পক্ষে। ওরা
মুসলমান আমরাও মুসলমান। তাই ওরা আমাদের কিছুই করবে না’। মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই এমন নিরীহ ভাবনাটা মোটেও
অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক চালিত জেনোসাইড তাদের আমূল
বিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছিল। শাসকের মুসলমানিত্ব ও শাসিতের মুসলমানিত্ব যে ‘ভাই-ভাই’
তত্ত্বে কাজ করে না, বরঞ্চ ‘জালিম-মজলুমে’র লড়াইও হতে যেতে পারে এই বোধই
তাদেরকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। বাস্তবে এমন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা দেখে অনেকেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। সচেতন
দর্শক ও পাঠকমাত্রই খেয়াল করবেন যে, কাজী মাজহারুল ইসলামের
এই ‘হতভম্ব’ হয়ে যাওয়ার আগের জীবন ও পরের জীবন নিশ্চয় আর এক থাকবে না। মাটির ময়না
সিনেমা মাজহারুল ইসলামকে ‘হতভম্ব’ করে রেখে শেষ হয়ে গেলো, নুরুন্নাহার
মাসুদের জবানিতে বাস্তব চরিত্রের ‘বদলে যাওয়া’র প্রসঙ্গ একের অধিক স্থানেই এসেছে।
একাত্তরের পর পাকিস্তানি বাহিনীর এই নির্মমতা তারেক মাসুদের পিতাকে তার কট্টর
অবস্থান থেকে কিছুটা সরিয়ে এনেছিল। যেমন বলছেন, ‘যুদ্ধের পর
তারেকের বাবা আগের চেয়ে কেনো জানি বেশ নরম হয়ে গিয়েছিলেন। তার সবকিছু মানতে হবে
এমন বাধ্যবাধকতাও ছিলো না।’ তারকে মাসুদের বাবাও নাকি পরে বলতেন, ‘আমি তো মনে করেছিলাম, ওরাও মুসলমান, আমরাও মুসলমান। আমাদের দেশে ওরা শান্তি দিবে। কিন্তু ওরা তো তা করেনি।’
তারেক মাসুদের একটা বড়ো কৃতিত্ব হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে
বাঙ্গালী মুসলমানের যে বিচিত্র টানাপোড়ন তার একটা নির্মোহ চিত্রায়ন করতে সক্ষম
হওয়া। সিনেমার শুরুতে কাজী মাজহারুল ইসলামের চিত্রায়ন দেখে একজন সাধারণ দর্শক
হিসেবে আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম যে, তিনি ‘রাজাকার’ হিসেবে
আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন। কিন্তু, তারেক মাসুদ এমন কোনো পথে
হাঁটেননি। উল্লেখ্য, নুরুন্নাহার মাসুদের স্মৃতিচারণে,
খুব ছোট কলেবরে হলেও, একাত্তরের বহুমাত্রিক
ঘটনার সন্ধান পাওয়া; যে কোনো গবেষকের জন্য সেটা খোরাক হতে
পারে।
তারেক মাসুদ তার পিতার
জীবনের দ্বিতীয় অংশকে মাটির ময়নায় তুলে এনেছিলেন; প্রথম জীবন নিয়ে বানাতে চেয়েছিলেন ‘কাগজের
ফুল’ সিনেমা। নুরুন্নাহার মাসুদের মতে এই ‘সিনেমাটাই তারেকের জন্য অশুভ ছিল। কারণ
কাগজের ফুল সিনেমা করতে গিয়ে তারেক যে কতো বাঁধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে সেটা বলা
যাবে না। ... শেষ পর্যন্ত তাকে চলেই যেতে হলো’। নুরুন্নাহার মাসুদ তার সন্তানের মৃত্যুকে (সড়ক
দূর্ঘটনায়) দূর্ঘটনা বলে মানতেই চান না। মায়ের অবোধ মন মনেপ্রানে বিশ্বাস করে, ‘এই
রানওয়ে সিনেমার জন্যই আমার তারেককে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি একথা আমার জন্য অন্য
ছেলেদের বেশ কয়েকবার বলেছিও। কিন্তু তারা আমার কথা কর্ণপাত করেনি।’
পৃথিবীর যে কোনো মায়ের
জন্য সবচেয়ে কষ্টের কাজ বোধহয় সন্তানের মৃত্যুর বর্ণনা দেয়া। নুরুন্নাহার মাসুদের
জন্য এই কষ্ট আরো বেশি ছিল। তারেক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট, মাত্র
৫৪ বছর বয়সে। তারেকের মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন পূর্বে তার বাবা মারা যান।
নুরুন্নাহার মাসুদের জবানে তার সে সময়ের এক করুণ বর্ণনা পাওয়া যায়: ‘তারেকের
মৃত্যুর দিনেই ওর মরদেহ দেখানোর জন্য আমাকে গ্রাম থেকে গাড়িতে করে ঢাকা নিয়ে যাওয়া
হলো। আমি ঢাকায় ওর বাসায় গিয়ে দেখি সেখান থেকে অনেক মানুষ বের হচ্ছে। আমার তখন কথা
বলার শক্তিও নেই। কী হচ্ছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
কিছুক্ষণ পর আমার ছোট ছেলে আর মেয়ে এসে আমাকে বললো, চলো
আম্মা নিষাদকে দেখে আসি। ক্যাথরিন আর নিষাদ তখন ড. কামাল হোসেনের বাসায়। সেখানে
গিয়ে দেখি ক্যাথরিনের মাথায় লোকজন পানি ঢালছে। আমি তখন ক্যাথরিনকে জিজ্ঞেস করলাম,
ক্যাথরিন আমার বাবা কোথায়? ক্যাথরিন বলে,
‘আপনার ছেলেকে ভালো জায়গায় রেখেছি’, বলেই সে
হাউমাউ করে কেদে উঠলো। পরে সেখান থেকে আমাকে পি জী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তারেকের
মরদেহ দেখানোর জন্য। হাসপাতালের হিমঘরে ওর মরদেহ রাখা ছিলো। ওর মরদেহটা বাক্স থেকে
বের করাহলো, আমি তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, আমার
কলিজার টুকরাটা কতো কষ্ট পেয়ে মারা গেলো! ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।’ মায়ের
অবোধ মন এখনো মনে করে করে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সিনেমা
বানানোই ছেলের জন্য কাল হয়েছে। মা তার সন্তানকে হারিয়েছেন, তবু
দৃঢ় আস্থা রাখেন প্রজন্মের প্রতি। বলেন, ‘আমার প্রায়ই মনে হয়,
আমি হয়তো তারেকের জন্যই বেঁচে আছি। তাছাড়া আমার বেঁচে থাকার কথা নয়।
আমি এক তারেকের জন্য শত শত সন্তানেরর মা হয়েছি।’
নুরুন্নাহার মাসুদের
কথোপকথনে চিত্রপরিচালক তারেকের চাইতে ব্যক্তি তারেক, সন্তান তারেক, স্বজন তারেককে বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু শূন্যের ভেতরকার সকল ঢেউয়েই পরিচালক
তারেককে খুঁজে পেতে কোনো শ্রোতা বা পাঠকের কষ্ট হবে না। তারেকের সাথে ক্যাথরিনের
সম্পর্ক, তারেকের সাতে তার পিতা মাতার সম্পর্ক, তারেকের সাথে তার স্বজনের সম্পর্ক, তারেকের বিচিত্র
অঙ্গনে বেড়ে উঠা সবকিছুর হদিস পাওয়া যায় এই কথোপকথনে। ক্রমাগত একটা হাহাকারের মধ্য
দিয়ে এই স্মৃতিচারণ শেষ হয়, মনে হয় তারেক আমাদের খুব আপন
ছিলেন। মূলত, উপরোক্ত কথাগুলোর প্রেক্ষিতে এবং তারেকের
জীবনের সাথে তার সিনেমাকে মিলিয়ে দেখলে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, তারেক মাসুদ তার নিজের জীবনকে কেবল একটা ‘থিসিসে’ রূপান্তরিতই করেননি,
একে রূপালি পর্দাতেও হাজির করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানে চিত্রপরিচালক
হিসেবে তারেক মাসুদ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমার কাছে ঠিক ততটাই
গুরুত্বপূর্ণ একজন সমাজতাত্ত্বিক হিসেবেও।
৩
আলম খোরশেদের ছোট
স্মৃতিচারণে তারেক মাসুদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের একটা চিত্র পাওয়া যায়। তারেক
মাসুদ শুরুর জীবনে সোনার বেড়ি নামে নারী মুক্তি নিয়ে একটা সিনেমা
বানিয়েছিলেন;
সোনার গহনাকে সোনার শিকল হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। আলম খোরশেদ
এটাকে ‘হাত মকশো করার প্রক্রিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করলেও, এটাও
কিন্তু তারেক মাসুদের নিজের জীবন থেকে নেয়া। নুরুন্নাহার মাসুদ জানাচ্ছেন, এই সিনেমা প্রদর্শনী শেষে নাকি তারেককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নারী না হয়েও তারেক কীভাবে নারী এই বেদনা বুঝলেন? তারেক
নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি ছোটোবেলায় দেখেছি আমার মা ঘর
থেকে কখনো বের হন নি, তার ইচ্ছেমতো কোথাও যেতে পারেননি।
অধিকাংশ সময় তিনি ঘরেই কাঠিয়েছেন। তার সেই পরিস্থিতি থেকেই আমি এটা শিখেছি।
আদম সুরতের কথা আমরা
প্রায় সকলেই জানি,
তারেক মাসুদ নিজের সাক্ষাৎকারেও এটা নিয়ে বলেছেন। তার মায়ের কথাতেও
এসেছে। আলম খোরশেদ নিউ ইয়র্কে এর প্রদর্শনীর পরে সকলের অভিব্যক্তি সম্পর্কে বলতে
গিয়ে মন্তব্য করছেন, ‘সেখনেই আমরা দেখে বিস্মিত হই যে,
এটা কী করে সম্ভব! একটা বাংলাদেশী ছেলে, যার
চাল নেই, চুলো নেই, কোনো রকমের
প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগীতা নেই, তার পরক্ষে এটা বানানো কীভাবে
সম্ভব হলো!’ মুক্তির গান, মুক্তির কথা, নারীর কথা, মাটির ময়না এই চলচ্চিত্রগুলোতে যেভাবে
বিদ্যমান সমাজে দ্বন্দ্ব, আত্মপরিচয়ের রাজনীতির দ্বন্দ্ব
ইত্যাদি বিতর্ক ফুটে উঠেছে তার প্রেক্ষিতে আলম খোরশেদও বলছেন, ‘সিনেমা বলতে আমরা বুঝতাম গল্প। কিন্তু শুধু গল্প নয়, সিনেমায় সে একটা বিষয় নিয়ে আসলো, একটা থিসিস নিয়ে
আসলো।’
তারেক মাসুদ অনেক স্বপ্ন
দেখেছিলেন। জয়নুল আবেদীন, জসিমউদ্দীন ও আব্বাসউদ্দীনকে নিয়ে সিনেমা
বানাতে চেয়েছিলেন। এদেরকে ইতিহাসের নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি যে দিশেহারা ও অস্থিরতার (এবং খানিকটা
সহিংসতারও বটে) পাকে পড়েছে তার একটা সুরাহার লক্ষে এদের দিকে মুখ ফেরাতে
চেয়েছিলেন। আলম খোরশেদ তার বন্ধুজন হিসেবে তারেক মাসুদের রাজনৈতিক চিন্তার বিবর্তন
বিষয়েও কথা বলেছেন। তারেক মাসুদ এক কালে কট্টর বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন,
পরে ধীরে ধীরে পার্টি পলিটিক্স সরে আসেন, এবং
একসময় উদার গণতন্ত্রের দিকে মোড় ফেরান। ‘গণতন্ত্রের ব্যাপারে একদম আপস করতে চাইতেন
না।’ মার্কিন দেশে তারেক মাসুদ, সলিমুল্লাহ খান ও আলম খোরশেদ
নিয়মিত আড্ডা দিতেন। খোরশেদ জানাচ্ছেন, যেদিন নিকারাগুয়ার
বিপ্লবকে সি আই এ ধ্বংস করে দিল, চূড়ান্ত পতন ঘটলো, ‘সেদিন সলিমুল্লাহ খান ও আমার সামনে তারেক রীতিমতো কাঁদছিলো।’ তাদের আড্ডার
স্মৃতিচারণ করার পাশপাশি পরবর্তী কালে তারেক মাসুদ ও সলিমুল্লাহ খানের মধ্যকার
বিতর্ক নিয়েও ছোটখাটো মন্তব্য করেছেন আলম খোরশেদ। তারেক মাসুদ তো এখন আর সব বিতর্কের উর্ধ্বে।
সলিমুল্লাহ খান তারেককে তাঁর ‘শিক্ষক’ ও ‘বন্ধু’ দাবি করে লিখেছেনও বিস্তর।
৪
প্রথমেই যে আলাপ দিয়ে
শুরু করেছিলাম সেটা মনে রেখেই শেষ করি। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে যে বিশেষ ধরনের
‘কালচারেল হেজিমনি’ চালু ছিল (বা এখনো আছে) তারেক মাসুদ তাঁর সিনেমার মাধ্যমে
সেটাকে প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন; মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-চর্চায়
মধ্যবিত্তের একচেটিয়া বয়ানের পাশে (বোধহয় প্রথমবারের মতো) নিম্নবর্গের বয়ান হাজির
করেছিলেন। তারেক মাসুদের কাজ নিয়ে আলাপ আলোচনা যত বেশি হবে তত আমাদের জন্যই মঙ্গল;
এই কাজের জন্য গুরত্বপূর্ণ এক খনি হচ্ছে ‘শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ’। সম্পাদক যেমন করে নুরুন্নাহার মাসুদকে বলতে
চেয়েছিলেন,
‘আপনার তারেক মাসুদ মরে নি, তিনি আজীবন বেঁচে
থাকবেন। আমরা তাকে বাঁচিয়ে রাখবো।’, আমরাও একই আশা ব্যক্ত করে
আপাতত ইতি টানি।
* লেখাটি 'ম্যাজিক লণ্ঠন' পত্রিকার ১৯ তম সংখ্যায় (২০২১) প্রকাশিত হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment