Sunday, December 13, 2020

ইবনে খালদুন: জীবন, চিন্তা ও সৃজন।। লেখকের ভূমিকা

বইয়ের নাম: ইবনে খালদুন: জীবন, চিন্তা ও সৃজন  

মূল বইয়ের  নাম: Ibn Khaldun: An Intellectual Biography

মূল লেখক: রবার্ট আরউইন

অনুবাদক: সহুল আহমদ 

প্রকাশক: দিব্য প্রকাশ

প্রকাশকাল ২০২০ 

 

লেখকের ভূমিকা

ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি, যিনি সভ্যতার উত্থান-পতন নিয়ে বারো খণ্ডের একটি বই লিখেছিলেন, তিনি ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমা সম্পর্কে বলছেন যে, ‘নিঃসন্দেহে এটি এখন পর্যন্ত যে কোনো সময়ে বা স্থানে কারো দ্বারা প্রণীত এই ঘরণার শ্রেষ্ঠ কর্ম যদিও ইতিহাসবিদ হিউজ ট্রেভর-রোপার সভ্যতার চক্রীয় উত্থান-পতন সম্পর্কিত টয়েনবির তত্ত্বের একজন কড়া সমালোচক ছিলেন, তবু তিনি ইবনে খালদুনের যোগ্যতার ব্যাপারে টয়েনবির সাথে একমত ছিলেন:এই মহতি খণ্ডগুলো পড়া এক সুখকর অভিজ্ঞতা, যেমন সমৃদ্ধ তেমন বাহারি, সমূদ্রের ন্যায় গভীর ও নিরাকার, নয়া ও পুরান চিন্তার সন্ধান পাওয়া যায় মুসলমান সমাজের সংস্কৃতির ইতিহাসবিদ মার্শাল হজসন মুকাদ্দিমা সম্পর্কে বলছেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই, ইসলামি সভ্যতার উপর এখন পর্যন্ত লিখিত শ্রেষ্ঠ সাধারণ ভূমিকা দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানী আর্নেস্ট গেলনার ইবনে খালদুনকেএকজন দূর্দান্ত আদর্শ সমাজবিজ্ঞানী ও চর্চাকারীহিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা দেখি যে, ইবনে খালদুনের চিন্তাগুলো ব্রুস চাটউইনের উপন্যাস Songlines এ উদ্ধৃত হয়েছে, ফ্রাংক হার্বার্টের সাইন্স ফিকশন Dune এ্রর তলায় লুকিয়ে আছে, পাশপাশি নাগিব মাহফুজের দূর্দান্ত উপন্যাস The Harafish-এ পাওয়া যায়। ইবনে খালদুন যা লিখছেন তার মূল্য সম্পর্কে তাঁর নিজেরও কোন সন্দেহ ছিল না:এটা জানা উচিৎ যে, এই বিষয়ের আলোচনা কিছুটা নতুন, অসামান্য এবং খুবই দরকারি। তীক্ষ্ম গবেষণা এর রাস্তা দেখিয়েছেএকভাবে এটি সম্পূর্ণরূপে মৌলিক বিজ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে, আমি কাউকেই এই ধারায় আলোচনা করতে দেখিনি।আমরাআল্লাহ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তিনি আমাদেরকে এমন বিজ্ঞানের দিকে নিয়ে গিয়েছেন যার সত্য আমরা নির্মমভাবে ব্যাখ্যা করবো 

 

ওয়ালি আল দ্বীন আব্দ আল রাহমান ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিউনিসে। জীবনের প্রথম অর্ধেকে তিনি ফেজের মেরিনিড শাসক, তিউনিসের হাফসিদ, টলেমসেন আব্দ আল-ওয়াদিদ এবং গ্রানাডার নাসরিদ শাসকদের অধীনে বিভিন্ন উপদেষ্টা ও আমলাতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৩৭৫ সালে তিনি নিজেকে এসব থেকে দূরে সরিয়ে পশ্চিম আলজেরিয়ার এক দুর্গম দূর্গে বসবাস করা শুরু করেন যেখানে পরবর্তী চার বছরের মধ্যে মুকাদ্দিমার প্রথম খসড়া নিয়ে কাজ করেন। মুকাদ্দিমা হচ্ছে ইতিহাস এবং সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের নীতি সম্পর্কিত গ্রন্থ। ১৩৭৮ সালে তিনি সভ্যতায় পুনরায় প্রবেশ করেন, এবং তিউনিসে কিছু পাঠদান এবং এর গ্রন্থাগারগুলোতে পরামর্শকারী হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর ইতিহাসের নীতি সম্পর্কিত গ্রন্থকে অনুসরণ করে একটি দীর্ঘ ঘটনাপঞ্জির (chronicle) কাজও করেন। ১৩৮২ সালে তিনি মামলুক মিসরের উদ্দেশ্যে রওয়ান দেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন সময়ে মালেকী মাজহাবের প্রধান কাজী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, এবং তিনি ইতোমধ্যে যা লিখেছেন তার সম্প্রসারণ ও সংশোধনের চালিয়ে যান। ১৪০০ সালে দামেস্কের প্রাচীরের বাইরে বিশ্বজয়ী তৈমুরের সাথে তাঁর এক স্মরণীয় মোলাকাত হয়। ইবনে খালদুন কায়রোতে মারা যান এবং এক সুফি গোরস্থানে তাকে কবর দেয়া হয়। 

 

মুকাদ্দিমা হচ্ছে ইতিহাসের সাধারণ নিয়মাবলীর এক দীর্ঘ তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা, পাশাপাশি এটি ইসলামি সমাজ এবং এর কলা ও বিজ্ঞানের এক সাধারণ সমীক্ষা। মুকাদ্দিমা ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে সাধারণ মানব সমাজ; দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে যাযাবরীয় সমাজ; তৃতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্র, খলিফা এবং রাজা-বাদশা; চতুর্থ অধ্যায়ে সভ্য সমাজ ও নগর; পঞ্চম অধ্যায়ে বাণিজ্য ও জীবিকা নির্বাহের উপায়সমূহ; ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিজ্ঞান ও কলা। যদিও এটা অনুসৃত ঘটনাপঞ্জি কিতাব আল-ইবার ওয়া দিওয়ান আল-মুবতদা ওয়াল-খবার (দ্যা বুক অফ ওয়ার্নিং অ্যান্ড দ্যা কালেকশন অফ বিগিনিংস অ্যান্ড হিস্টরিকআল ইনফরমেশন) রচনা করা হয়েছিল বোধহয় উত্তর আফ্রিকার বার্বার ও আরব গোত্রগুলো এবং তারা যে রাজবংশগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল সেগুলোর ইতিহাস তৈরির উদ্দেশ্যে; যেমন করে তিনি লিখেছিলেন, তাঁর ইতিহাসের পরিধি বড়ো হয়ে বিশাল আঁকার ধারণ করেছে। মুকাদ্দিমা, মানে ইতিহাসের তত্ত্বীয় ভূমিকা, ইংরেজি অনুবাদে মোটা মোটা তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে ইবার এর আরবি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল সাত খন্ডে। মুকাদ্দিমার প্রথম খসড়া ১৩৭৭ সালে পাঁচ মাসের মাথায় শেষ হয়েছিল, এবং ইবনে খালদুনের এতো সুখ্যাতি মূলত এই কাজের উপর নির্ভরশীল।

 

মুকাদ্দিমায় প্রথম যে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল সেটা হচ্ছে ইতিহাসবিদরা কেনো ভুল করেন? তাঁর মতে, তিনটা বিষয় ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদকে ভুল দিকে পরিচালিত করে। প্রথমত, পক্ষপাতিত্ব; দ্বিতীয়ত, সহজেই কোনো কিছুকে সত্য বলে মেনে নেয়ার ঝোঁক; তৃতীয়ত অন্তর্নিহিত জ্ঞানকে ধরতে ব্যার্থ হওয়া। এই তৃতীয় বিষয়টি তাঁর কাছে প্রথম ও মুখ্য বিষয়, কারণ পূর্বের কোনো ইতিহাসবিদ বা ঘটনাপঞ্জি-লেখকই মানব সমাজের গঠন ও ভাঙ্গন পরিচালনাকারী সাধারণ নিয়মাবলীকে গুরত্ব সহকারে বিবেচনায় নেন নি। তারা ইতিহাসের বাতেনি বিষয় অধ্যয়ন করেন নি, কেবল জাহেরি বিষয়াদি সংকলনের দিকে নজর দিয়েছেন। ইবনে খালদুন অতীতের ঘটনাবলীর বিবরণসমূহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং আপাত-গ্রাহ্যতার ভিত্তিতে এগুলোর মূল্যায়ন করেছেন। যে কাউকেই কারণ ও প্রভাবকে বিবেচনায় নিতে হবে, তারপর বিবেচনায় নিতে হবে সমান পরিস্থিতিতে বিষয়গুলো কীভাবে কাজ করে, এবং অসমান পরিস্থিতিতে বিষয়গুলো কীভাবে কাজ করে। একজন ইসলামি ইতিহাসবিদের জন্য এটি অস্বাভাবিক ছিল। ইবার আরো দীর্ঘ কাজ, মুকাদ্দিমায় বর্ণিত তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই এটি রচিত। ছোট আরেকটি গ্রন্থ, আল-তারিফ বি ইবনে খালদুন ওয়া রিহলাতিহি শারক্বান ওয়া ঘারবান (প্রেজেন্টিং ইবনে খালদুন অ্যান্ড হিজ জার্নিস ইন দ্যা ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট)-কে ভুলভাবে তাঁর আত্মজীবনী বলে মনে হতে পারে, যদি এটি আত্ম-প্রকাশের জন্য কিছুটা সংক্ষিপ্ত, কারণ, ইবনে খালদুনের এক দুঃসাহসী জীবন ছিল, কিন্তু সেখানে এমন কিছুই তিনি তুলে ধরেন নি।

 

ইবনে খালদুন যা লিখেছেন তার অর্থ ও গুরুত্ব নিয়ে গত দুই শতক ধরে উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক চলছে। তিনি কি দুনিয়ার প্রথম সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন? তিনি কি আদৌ সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন? তাঁর ইতিহাস বিষয়ক তত্ত্ব গ্রিক দর্শনের নীতির কাছে বেশি বা আদৌ কি ঋণী? তার মৌলিকত্ব কি অতিরঞ্জিত? ইসলাম তাঁর ইতিহাস-চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে হয়, তবে ঠিক কোন পথে? বা তিনি কি গোপনে আসলেই একজন যুক্তিবাদী এবং নাস্তিক ছিলেন? তিনি কি সুফি ছিলেন? মাঘরেব ও মিসরে তিনি কেন এতো শত্রু তৈরি করেছিলেন? সাম্রাজ্যের চক্রীয় উত্থান-পতন বিষয়ক তাঁর মডেলটি কি মাঘরেবের বাইরে প্রয়োগ করা যায়? তিনি কি ভেবেছিলেন এটি করা যাবে? যাযাবররা কি ভালো ছিল নাকি খারাপ ছিল? তিনি একজন ভবিষ্যতত্ত্ববিদের পাশপাশি ইতিহাসবিদও ছিলেন, তবে কি তিনি ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা বা প্রফেটের মতোই ছিলেন?  

 

কিছু কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলো নিয়ে আধুনিক ব্যাখ্যাকারীরা মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছেন। ইবনে খালদুনের এতো বেশি ব্যাখ্যা রয়েছে যে, মনে হতে পারে তিনি নিজেকে খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন নি। তাঁর উপর প্রচুর গ্রন্থপঞ্জি রয়েছে। আজিজ আল আজমেহের ইবনে খালদুন ইন মডার্ন স্কলারশিপ গ্রন্থে প্রায় ৮৫০ এর অধিক গ্রন্থ তালিকভুক্ত হয়েছে, এবং সময়ের সাথে সাথে এটা বোধহয় ইতোমধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার কথা। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনের মামলুক গ্রন্থপঞ্জিতে ইবনে খালদুনের সম্পর্কে ৮৫৪টি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ তালিকাভুক্ত রয়েছে, যদি এটি মাঘরিবি ও আন্দালুসিয়ান জিনিসপত্র বাদ দিয়েই। আপনি যদি ইবনে খালদুনের উপর লিখিত যাবতীয় সবকিছু পড়ে ফেলতে চান, তাহলে এক জনমেও শেষ হবে না। উনিশ শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইউরোপের জ্ঞানজগতে কেবল খালদুনের উপর জিনিসপাতি অনুসরণ করলেই যে কেউই প্রাচ্যবাদের অর্ধেক ইতিহাস জেনে যাবেন। তারপরও, ইউরোপীয় পণ্ডিতরা তাঁকে আবিষ্কার করতে প্রচুর সময় নিয়েছেন, কারণ তিনি এমন এক শতকে লিখছিলেন যখন ইউরোপীয়রা আরবি অনুবাদ করা ছেড়ে দিয়েছিল।

 

ইবনে খালদুনকে নিয়ে এতো বেশি বই রয়েছে যে, আমি এই তালিকায় নতুন কিছু যুক্ত করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। যেমন করে ইবনে খালদুন নিজেই লিখেছিলেন:পাঠক, জেনে রাখুন, জ্ঞানার্জন ও তার উদ্দেশ্য অবগতির ক্ষেত্রে মানুষের জন্য সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর বিষয় হল, অত্যধিক গ্রন্থ, শিক্ষণীয় বিষয়ে পরিভাষার বৈচিত্র্য ও শিক্ষা-পদ্ধতির বিভিন্নতা এবং তারপর শিক্ষার্থী ও শিষ্যকে সেসব উপস্থাপনে বাধ্য করা। আপাতত এই নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, ইতোমধ্যে চতুর্দশ শতকের উত্তর আফ্রিকায় প্রচুর বই লেখা হয়ে গিয়েছে। 

 

উপরোক্ত কথাগুলো ইবনে খালদুনের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে খুব চটপটে ও গতানুগতিক বিবরণ। কিন্তু, এটি কেবল আংশিক সত্য। কারণ, আমার কাছে মনে হয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পণ্ডিতরা ইবনে খালদুনের উপর শুধু চোখ বুলিয়ে গেছেন, আর আমার ধারণা যে মুকাদ্দিমার শেষ অধ্যায়ে আসতে আসতে পাঠকরা এতটাই ক্লান্ত হয়ে যান যে ততক্ষণে তারা আর ঠিকঠাক দিশা খুঁজে পান না। কারণ, এটি খুবই দীর্ঘ, এবং এটি নির্বাচিতভাবে সংক্ষেপিত করা হয়েছে। এর বক্তব্যগুলোকে আধুনিকীকরণ এবং যৌক্তিকীকরণ (rationalized) করা হয়েছে। উনিশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত তার চিন্তাগুলোকে পশ্চিমীকরণ করে ম্যাকিয়াভেলি, হবস, মন্টেসক্যূ, ভিকো, মার্ক্স, ওয়েভার এবং দুর্খেমের মতো পশ্চিমা চিন্তকদের পূর্বসূরী হিসেবে তুলে ধরার একটা সচেতন বা অসচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তাঁকে উত্তেজনাপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক করে তোলার এই তাগিদটা বোধগম্য। কিন্তু ইবনে খালদুনের জগত যতটা আধুনিক হিস্টোরিওগ্রাফি বা সমাজবিজ্ঞানের সাথে মিলে, তাঁর চেয়ে বেশি মিলে কোরআন এবং আরব্য রজনীর জগতের সাথে। ইবনে খালদুন হয়তোবা সত্তার ধারাবাহিক শ্রেণিবিভাগে বানরকে মানুষের ঠিক নিচে স্থান দিয়েছেন, কিন্তু এটা চার্লস ডারউইনের অরিজিন অফ দ্যা স্পেসিস থেকে অনেক দূরের জিনিস। একই কথা ইবনে খালদুনের সাথে মার্ক্স তুলনার ব্যাপারেও খাটে। 

 

যেমন করে প্যাট্রিসিয়া ক্রোন পর্যবেক্ষণ করছেন:অতীতের সভ্য সমাজগুলোর সাথে আধুনিক সময়ের প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই সাদৃশ্যতা প্রতারণামূলক। কেউই আধুনিকতার কথা চিন্তা না করে এবং এর অনুপস্থিতির পরিণতি বিষয়ে হিসাব না করে এসবের খপ্পরে পড়তে পারেন না যদিও উত্তর আফ্রিকার সাম্রাজ্যসমূহের উত্থান-পতন এবং ট্রাইবাল বা আদিবাসী অভিজাতদের আসা-যাওয়া নিয়ে ইবনে খালদুন যা বলেন তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক, তবু আধুনিক বিষয়াদির সাথে এগুলো প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, বর্তমান দুনিয়াতে খুব কম জায়গাই রয়েছে যেখানে শহর ও প্রান্তিক অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে এমন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মিথোজীবিতা রয়েছে। আমি মনে করি, বর্তমানে কোনো শাসনামলই যাযাবরদের সামরিক সমর্থনের উপর নির্ভরশীল নয়। বর্তমানের বিশ্বায়ন, ডিজিটাইজেশন, জাতি-রাষ্ট্র, গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারতন্ত্রের যুগে ইবনে খালদুন কতটা প্রাসঙ্গিক? সুতরাং, ইবনে খালদুনের লেখাপত্রকে বর্তমান দুনিয়ার সাথে প্রাসঙ্গিক করে তোলার কোনো আগ্রহ আমার নেই। (বরং, আমার আগ্রহ উল্টো- আধুনিক জমানার লেখাপত্র তাঁর ও তাঁর দুনিয়ার সাথে প্রাসঙ্গিক করে তোলা এবং এই লেখাপত্র ব্যবহার করে তাঁর চিন্তাভাবনাকে স্পষ্ট করা।) স্পষ্টত আধুনিক জমানায় ইবনে খালদুনের অপ্রাসঙ্গিকতাই তাঁকে এতো কৌতূহলোদ্দীপক ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আমি যখন মুকাদ্দিমা পড়ছিলাম তখন আমার মনে হয়েছে আমি আরেক গ্রহের কারো সাথে মোলাকাত করছি, এবং এটা রোমাঞ্চকর ছিল। আমরা যেভাবে দুনিয়াকে দেখতে অভ্যস্থ তার বাইরেও দুনিয়াকে দেখার আরো অনেক উপায় আছে।

 

ইবনে খালদুনের ভাবনার পথে ডুবে যাওয়া আধুনিক পাঠক সমাজ ও ইতিহাস বোঝার প্রাক-আধুনিক এবং আমূল ভিন্ন এক পদ্ধতির দেখা পাবেন; যেখানে আল্লাহর ইচ্ছাই কার্যকারনের মূলে নিহিত রয়েছে এবং সামাজিক সংগঠনের প্রাথমিক উদ্দশ্যই হচ্ছে ধর্মীয় মুক্তি বা নাজাত। যুদ্ধের ফলাফল, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্বাভাসে ফেরেশতা ও শয়তানের ভূমিকা রয়েছে। তদপুরি, আধুনিক পশ্চিমা অর্থে ভাবাদর্শগত দলীয় রাজনীতি চতুর্দশ শতকের মাঘরেব এবং মিসর ও সিরিয়ার মামলুক সুলতানদের আমলে একেবারেই অজানা ছিল। এই অদ্ভুত দুনিয়ায় নিজেকে নিমজ্জিত করে কেউ চাইলে তাঁর নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক জগতকে এক নতুন, এবং সম্ভবত পর্যালোচনামূলক চোখে বিবেচনা করতে পারেন। তুলনার চেয়ে বৈপরীত্যগুলোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

 

যদিও আরবি ভাষায় মুকাদ্দিমার কোনো সঠিক সংশোধিত সংস্করণ নেই, তবু ১৯৫৮ সালে বলিঞ্জেন ফাউন্ডেশন তিন খণ্ডে দ্যা মুকাদ্দিমা: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু হিস্টোরি প্রকাশ করে। এই অনুবাদের দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৬৭ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে সংশোধিত ও বিশদ গ্রন্থপঞ্জি সহ প্রকাশিত হয়। অনুবাদক প্রফেসর ফ্রাঞ্জ রোজেন্থাল একজন আশ্চর্যজনক পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি সতর্কভাবে মুকাদ্দিমার এখনপর্যন্ত টিকে থাকা সকল পাণ্ডুলিপিকে মিলিয়ে একটা পূর্ণাংগ সংস্করণ দাঁড় করান। সময়ে সময়ে রোজান্থালের এই কাজ প্রচুর প্রশংসা ও কিছু সমালোচনা কুড়িয়েছে। রোজান্থালের অনুবাদ নিয়ে পঞ্চম ও দশম অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা করা হবে। (একইভাবে আব্দেসসালাম চেদ্দাদি কর্তৃক মুকাদ্দিমাসহ ইবারের একটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ  অনুবাদ ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।)১০ 

 

পরবর্তীতে একটা প্রবন্ধে রোজেন্থাল ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, অল্প বয়সে ইবনে খালদুন সম্পর্কে লেখা ঠিক না।১১  মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসবিদ আলবার্ট হউরানি তাঁর শিক্ষার্থীদের ইবনে খালদুনের উপর পিএইচডি শুরু করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন। আমি নিজের জন্য রোজেন্থালের অনুবাদ কিনেছিলাম ১৯৬০ এর দশকে, এবং লম্বা সময় ধরে এটা নিয়ে বসবাস করছি। 



ঘটনাপঞ্জি

 

১৩৩২: ২৭ মে ইবনে খালদুন জন্মগ্রহণ করেন।

১৩৪৭: মেরিন আবুল হাসান তিউনিস দখল করেন। সফরসঙ্গী হিসেবে ইবনে খালদুনের শিক্ষক, পণ্ডিত আল আবিলির আগমন।

১৯৪৮-৪৯: উত্তর আফ্রিকায় মহামারি বা ব্ল্যাক ডেথ ছড়িয়ে পড়ে।

১৩৫৩: ইবনে খালদুন টলেমসেনে মেরিনিড আবু ইনানের সাথে প্রথম সাক্ষাত করেন।

১৩৫৪: ইবনে খালদুন আবু ইনান কর্তৃক ফেজে আমন্ত্রিত হন।

১৩৫৫: আবু ইনানের সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।

১৩৫৯: ইবনে খালদুন মেরিনিড আবু সালিমের উত্তরাধিকারত্বকে সমর্থন দেন এবং কিতাব আল-সির হিসেবে নিযুক্ত হন।

১৩৫৯-৬২: গ্রানাডার নাসরিদ শাসক মুহাম্মদ পঞ্চম, এবং তাঁর উজির ইবনে আল খাতিব মরক্কোতে নির্বাসনে আসেন, সেখানে তাদের সাথে ইবনে খালদুনের প্রথম সাক্ষাত।

১৩৬১: ইবনে খালদুনকে মাজালিম হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে এই বছরেই আবু সালিমকে খুন হন এবং ইবনে খালদুন রোষানলে পড়ে যান।

১৩৬২: তাঁকে আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে মরক্কো ত্যাগ করার অনুমতি দেয়া হয়। ডিসেম্বরে গ্রানাডার মুহাম্মদ পঞ্চম তাঁকে গ্রহণ করেন।

১৩৬৪: মুহাম্মদ পঞ্চম ইবনে খালদুনকে সফল মিশনে পাঠান।

১৩৬৫: ইবনে খালদুন আন্দালুসিয়া ত্যাগ করেন আলজেরিয়াতে বুজির হাফসিদ আমির আবু আবদাল্লাহ এর প্রধান মন্ত্রী (হাজিব) হওয়ার জন্য। তাঁকে বার্বারদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার জন্য পাহাড়ে পাঠানো হয়।

১৩৬৬: আবু আব্দাল্লাহের মৃত্যুর পর তাঁকে বদলি করা হয় কনস্ট্যন্টাইনের হাফিসদ শাসক আবু আল আব্বাদের কাছে। সেখানে তাঁকে হাজিব বানানো হয়, কিন্তু শীঘ্রই তিনি আনুকূল্য হারান। প্রথমে দাওয়াউইদা আরবদের সাথে এবং পরে বিস্ক্রাতে শরণার্থী হন।

১৩৬৮: টলেমসেনের আব্দ আল-ওয়াদিদ শাসক আবু হাম্মু কর্তৃক রিয়া আরব ট্রাইব বা গোত্রদের সাথে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ পান।

১৩৭০: ইবনে খালদুন গ্রানাডায় পৌঁছানোর চেষ্টা করার সময় মেরিনিড আব্দ আল আজিজ কর্তৃক বন্দি হন

১৩৭০-৭৪: ইবনে খালদুন মেরিনিড শাসক কর্তৃক রিয়াহ আরব গোত্রদের সাথে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিযুক্ত হন। এবং, মেরিনিড ফেজে রাজসভাসদ হিসেবে সময় পার করেন।  

১৩৭৪: গ্রানাডায় পালিয়ে যান।

১৩৭৫: তাঁকে হস্তান্তরিত করা হয়। তিনি আবারো আরব আদিবাসীদের সাথে চুক্তি করার জন্য আবু হাম্মু কর্তৃক নিযুক্ত হন। তারপর তিনি পশ্চিম আলজেরিয়ার একটি দুর্গম দুর্গ ক্বালাত বানু সালামাতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, যেখানে মুকাদ্দিমা এবং ইবার লেখা শুরু করেন। 

১৩৭৭: নভেম্বর মাসে ক্বালাত বানু সালামাতে মুকাদ্দিমার প্রথম খসড়া লেখা শেষ করেন।

১৩৭৮: ইবনে খালদুন তিউনিসে ফিরে যান, এবং হাফসিদ আবু আল-আব্বাসের সাথে সমঝোতা করেন। কিন্তু, তিউনিসের প্রধান কাজী ইবনে আরাফা আল ওয়ারঘানির আক্রমণের শিকার হন। মুকাদ্দিমার প্রথম সংস্করণ হাফসিদ শাসককে উৎসর্গ করেন। 

১৩৮২: ইবনে খালদুন হজ্জে যাওয়ার অনুমতি লাভ করেন। আলেক্সন্ড্রিয়াতে পৌঁছান।

১৩৮৩: তিনি কায়রোতে স্থিত হন এবং মামলুক সুলতান আল জাহির বারকুকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।

১৩৮৪: ইবনে খালদুনকে ক্বামহিয়া মাদ্রাসার মালেকি ফিকাহের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আগস্টে তাঁকে মিসরের মালেকি মাজহাবের প্রধান কাজী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আলেক্সান্ড্রিয়ার উপকূলে তাঁর স্ত্রী-কন্যা এবং গ্রন্থাদি সহ জাহাজ ডুবে যায়।

১৩৮৫: প্রধান কাজীর পদ থেকে বরখাস্ত হন।

১৩৮৭: জাহিরিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। হজ্জ করতে যান।

১৩৮৯: সারঘিতমিশিয়া মাদ্রাসায় হাদিসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। বায়বারদের খানকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী আমিরদের দ্বারা বারকুককে অস্থায়ীভাবে সরিয়ে দেয়া হয়। বারকুকের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়ার জন্য যারা সম্মতি দিয়েছিলেন ইবনে খালদুন তাদের অন্যতম ছিলেন। বারকুক পুনরায় ক্ষমতা দখলের পর জাহিরিয়া মাদ্রাসা এবং বায়বারদের খানকার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

১৩৯৯: তিনি আবারো মালেকি প্রধান কাজী হিসেবে নিয়োগ পান। বারকুক মারা যান, তাঁর পুত্র আল নাসির ফরজ উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতায় আসেন।

১৪০০: ইবনে খালদুন ফরজের সাথে দামেস্কে গমন করেন। পরে, মিসরে ফিরে আসার তাঁকে কাজী পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তৈমুর সিরিয়ায় আক্রমণ করেন এবং ফরজ দামেস্ককে রক্ষা করার জন্য মিসর থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ইবনে খালদুনও তাঁর সাথে ছিলেন। 

১৪০১: জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ফরজ মিসরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ইবনে খালদুন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তৈমুরের সাথে নিয়মিত সাক্ষাত করেন। ১৪০১ সালের মার্চে মিসরে ফিরে আসেন। মালেকি প্রধান কাজী হিসেবে নিয়োগ পান। 

১৪০২: কাজীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এই বছরেই পুনরায় নিয়োগ দেয়া হয়।

১৪০৩: কাজীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

১৪০৫: মালেকী প্রধান কাজী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, এবং কয়েকমাস পর আবারো সরিয়ে দেয়া হয়। 

১৪০৬: মালেকী প্রধান কাজী হিসেবে আবারো নিয়োগ দেয়া হয়, এবং মার্চের ১৭ তারিখ মৃত্যুবরণ করেন।  


তথ্যসূত্র: 

1. Arnold Toynbee, A Study of History (London, 1935), vol. 3, p. 322.

2. Hugh Trevor-Roper, “Ibn Khaldoun and the Decline of Barbary,” in Trevor-Roper, Historical Essays (London, 1957), p. 28.

3. Marshall Hodgson, The Venture of Islam: Conscience and History in a World Civilization (Chicago and London, 1977), vol. 2, p. 55n.

4. Ernest Gellner, Muslim Society (Cambridge, 1981), p. 88.

5. Ibn Khaldûn, The Muqaddimah: An Introduction to History (1967, London; reprinted Princeton, NJ, 1980), vol. 1, pp. 77–78 (hereinafter cited as Muq.).

6. Muq., vol. 1, p. 83.

7. Aziz al-Azmeh, Ibn Khaldun in Modern Scholarship: A Study in Orientalism (London, 1981).

8. Muq., vol. 3, p. 288.

9. Patricia Crone, Pre-Industrial Societies (Oxford, 1989), p. 1.

10. Ibn Khaldun, Le Livre des exemples (Paris, 2002).

11. Franz Rosenthal, “Ibn Khaldun in His Time,” in Bruce B. Lawrence, ed., Ibn Khaldun and Islamic Ideology (Leiden, 1984), p. 14. 


No comments:

Post a Comment