অফিসের কাজের জন্যই ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ‘দেশ’ পত্রিকার সংখ্যাগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম, গবেষকের দৃষ্টিতে নয়, নিখাদ ‘অমনযোগী’ পাঠক হিসাবে। একাত্তরে ‘দেশ’ -এর প্রধান মনযোগ ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ ও পূর্ববাংলা’; প্রতিটি সংখ্যার সূচিতে চোখ বুলালেই এই কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বিবিধ প্রবন্ধ, প্রতিবেদন, কার্টুন, সাহিত্য-সমালোচনা, কবিতা, গল্প ছাপাচ্ছিল। মূলধারার মূখচেনা বহু লেখক-কবিদের লেখাপত্র নিয়মিত প্রকাশিত হতো: তারা সকলেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন। বিশ্লেষণধর্মী লেখাগুলোতে পূর্ববাংলার সমাজ- সাহিত্য- রাজনীতি- অর্থনীতি- আন্দোলন- মুক্তিযুদ্ধের গতিপথ- শরণার্থী সমস্যা এই সবই স্থান পেয়েছে। সুলিখিত প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো পড়তেও আরামদায়ক।
তবে ‘দেশ’ পত্রিকার একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। তাদের ‘আলোচনা’ নামে একটা অংশ থাকে, সেখানে প্রকাশিত প্রবন্ধের সমালোচনা-আলোচনা ছাপানো হয়। প্রায় যে কেউই এই আলোচনায় অংশ নিতে পারতেন। এটা কিন্তু খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো, কারণ মূল লেখকরা কখনো কখনো ‘অখ্যাত’ কারো সমালোচনার জবাবও খুব গুরুত্বসহকারে দিতেন। ফলে, কোনো একটা বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে সমাজে ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে কি ধরণের আলাপ-আলোচনা চালু আছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায় তাতে। অন্তত আমার মনে হয়।
প্রকাশিত লেখাপত্রে, প্রায় সকল বিশ্লেষণমূলক লেখাতেই, ঘুরেফিরে দুটো প্রসঙ্গ বারেবারে এসেছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। প্রথমত, তারা সকলেই মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন বা দেখতে চেয়েছেন দ্বি-জাতিতত্ত্বের অসারতার প্রমাণস্বরূপ এবং সেই ‘ভ্রম-সংশোধন’স্বরূপ। দ্বিতীয়ত, সকলের লেখায় ঘুরেফিরে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বা সেকুলারিজম প্রসঙ্গ এসেছে। এই প্রসঙ্গে ‘আলোচনা’ অংশে বেশ জোরদার তর্ক জমে উঠতে দেখা গিয়েছে কয়েকবার। তর্কে এই দুইটো প্রসঙ্গই বারেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতো। দুটো উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
আবু সায়ীদ আইয়ুব ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ শীর্ষক এক লেখায় দাবি করেন যে, বাঙ্গালি মুসলমানের ‘চিত্ত আজ মধ্যযুগীয় ধর্মভাবনা থেকে মুক্ত’, এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ ধর্মনিরপেক্ষতায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু, এর জবাবে একজন পাঠক খুব কড়া ভাষায় লিখেন, কিসের ভিত্তিতে লেখক এমন দাবি করতে পারলেন? বাংলাদেশের জনগণ যদি ধর্মনিরপেক্ষতায় প্রবেশ করেছে বলে দাবি করে এবং ‘সত্যিই মধ্যযুগীয় ধর্মভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে থাকেন’ তাহলে জনগণকে দুটো বিষয় পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করতে হবে: এক, দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল ছিল এবং দুই পাকিস্তান সৃষ্টি গোড়া থেকেই ‘ভুল’ ও ‘অন্যায়’ হয়েছিল। পাঠকের এই প্রতিক্রিয়ার উত্তর দেন লেখক। তিনি পাঠকের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশকে ভারতের মতোন দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার সমালোচনা করেন, এবং ভারত ও বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির ফারাক তুলে ধরেন। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্র; অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে ধর্মের অজুহাতে শোষিত হওয়ার দরুন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি একেবারে সমাজের তল থেকে উঠেছে, ‘মধ্যযুগীয় ধর্মভাবনা থেকে মুক্ত হতে চাইছে তাদের মন’। পাঠকের এই প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের কর্মকাণ্ডের জায়েজিকরণে ব্যবহার করতে পারে বলেও লেখক আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
'দেশ', ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ |
অন্য এক সংখ্যায় পাঠকদের আরেকটা ‘প্রতিক্রিয়া’ পড়েছিলাম। কিন্তু পাঠক যে লেখার প্রেক্ষিতে সেটা লিখেছেন সেই মূল লেখাটা খুঁজে পাইনি। কিন্তু পাঠকের জবাব দেখে আন্দাজ করা যায় মূল লেখকের লেখায় কি ছিল। লেখক দাবি করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মানুষ ঊনসত্তরে আওয়ামীলীগকে ভোট দিলেও দেশের অভ্যন্তরে ‘অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত’ জনগণ কার্যত মুসলিমলীগপন্থী। ‘পূর্ববঙ্গে ধর্মান্ধতার বিষ কতখানি সক্রিয় তার প্রমাণ’ হিসাবে তিনি শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্যের কথা উল্লেখ করেন। এই লেখার জবাব যে পাঠক দিয়েছিলেন তিনি নিজেও, তার ভাষায়, ‘শরণার্থী’, ‘ধর্ম ও জাতীয়তার বিচারে হিন্দু’, এবং ‘ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ কর্মী’। পাঠক লেখকের এই মন্তব্যগুলোকে ‘অজ্ঞতাপ্রসূত উক্তি’ ও ‘মর্মান্তিক’ বলে উল্লেখ করেন। ‘আমার মনে হয় কোনো লজিক্যাল ফরমই উক্তিটির স্বারবত্তা প্রমাণ করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, মুসলমান সমাজকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেখাতে চাওয়াটা লেখকের ‘ভুল ব্যাখ্যা’।
এপারে এতো বড়ো ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ে ওপারের জ্ঞানজগতে চালু থাকা আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কগুলো পড়া ও জানাটা কৌতুলহলীদ্দোপক। একটা বিষয়ে সামগ্রিকভাবে মতৈক্য খেয়াল করা যায়, সেটা হলো পাকিস্তান সৃষ্টি বা পাকিস্তান আন্দোলন ভুল ছিল। কেবল ভুলই ছিল না, অন্যায়ও ছিল, এবং ‘মধ্যযুগীয়’ ছিল। এটা কেউ নিচু স্বরে বলেছিলেন, কেউবা খুব উচু স্বরে বলেছেন। পাশাপাশি, প্রায় সকলের লেখাতেই আরেকটা সুর পাওয়া যায় [বক্তব্য কিছুটা সিদ্ধান্তমূলক], পূর্ব বাংলা ভুল পথ থেকে সরে এসে যে সহি রাস্তায় হাটা শুরু করেছে, তার কারণ হচ্ছে তারা ভারতের পথেই চলছে। মানে, আমাদের [ভারতের] পথে চলছে বলেই রাস্তাটা সহি - এমন একটা সুর লেখাগুলোতে কেউ খুজে পেলে দোষ দেয়া যাবে না। কিছুদিন পূর্বে তারাশংকরের একাত্তর সালে লিখিত কয়েকটা প্রবন্ধ/নিবন্ধ পড়েছিলাম। তার লেখাতেও ভাসাভাসা এই সুর ছিল।
এটা হচ্ছে ওপারে চালু থাকা ভাবনা। সেই ভাবনার সাথে এপারের ভাবনাকে মিলিয়ে পড়া যায়। এপারে, মানে যেখানে মুক্তিসংগ্রাম চলছে এবং যারা পাকিস্তান আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিল তারা কি ভাবছিলেন? তারাও কি পাকিস্তান আন্দোলনকে ভুল বলে ভাবছিলেন? কামরুদ্দিন আহমদের জবানিতে এপারের মানুষের এই প্রশ্নের একটা উত্তর পাওয়া যায়। কামরুদ্দিন আহমদ একাত্তরে কারাগারে বসে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেছিলেন, পাকিস্তান আন্দোলন কি ভুল ছিল? তার বা তার সময়ের চরিত্রদের জন্য এই প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল। এত আন্দোলন করে একটা রাষ্ট্রগঠন করলেন, মাত্র পঁচিশ বছরের মাথায় সেই রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আবারো মরণপণ লড়াই শুরু করলেন! তাহলে কি পূর্বেকার আন্দোলন ভুল ছিল? কামরুদ্দিনের উত্তর ছিল, না পাকিস্তান আন্দোলন ভুল ছিল না। এমনকি, বাংলাদেশে আন্দোলনকে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের ভুলের সংশোধন হিসাবেও দেখেন নি। তার কাছ দুটোকেই মনে হয়েছে ‘ইতিহাসের প্রয়োজনে’। পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে ছফার সাথে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের কথোপকথনেও এই প্রশ্নের অনেকটা সম-উত্তর পাঠক পেতে পারেন।
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, যাপিত জীবনের আর্থ-সামাজিক পাটাতন, এবং রাজনৈতিক অবস্থান - এই একই প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন বয়ান হাজির করেছিল, একই সময়ে। তবে, ওপারে পাকিস্তান আন্দোলনকে এইভাবে দেখার যে প্রবণতা সেটা একধরণের ‘কংগ্রেসি’ ইতিহাস বয়ান বলা যায়। অবশ্যই, একইরকম বয়ান বাংলাদেশেও বিদ্যমান, বেশ শক্তিশালীই। আকবর আলী খান বলেছিলেন যে, পাকিস্তান আন্দোলন বা পাকিস্তান সৃষ্টি ইতিহাস থেকে একধরণের বিচ্যুতি। বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে আবারো সহি কক্ষে প্রবেশ করে। বাংলাদেশ আন্দোলনকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুল সংশোধন হিসাবে ব্যাখ্যা করার ‘কংগ্রেসি’ বয়ানের কিছু কড়া সমালোচনাও করেছিলেন আহমদ ছফা। ছফার মতে, ‘বাংলাদেশের জাতীয়তাকে কিছুতেই মুহম্মদ আলি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুল সংশোধন বলা যাবে না। বরঞ্চ একথা বলাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত যে বাংলাদেশের জাতীয়তার সংগ্রাম ভারতবর্ষের বহু জাতীয়তার সংগ্রামের পূর্বাভাষ মাত্র।’ ছফা এটাও উল্লেখ করেছিলেন, কংগ্রেসি তাত্ত্বিকেরা বাংলাদেশের জাতীয় সংগ্রামের যে ‘ন্যারেটিভ’ একাত্তরে চালু করেছিলেন সেটাই আওয়ামীলীগের চিন্তাধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। অবশ্য, আমরা মনে করি, ইতিহাসের বহু বয়ান একত্রে থাকাটাই স্বাভাবিক।
'দেশ', ২২ মে ১৯৭১ |
যাক, ‘দেশ’ পত্রিকা উল্টাতে গিয়ে দীপেশ চক্রবর্তীর একটা লেখার কথা মনে পড়ে গেলো। সেটা দিয়েই শেষ করি।
দীপেশ চক্রবর্তী একবার এজাজ আহমদের একটা গ্রন্থের ক্রিটিক করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, দরবারি মার্কসবাদের বয়ানের সাথে কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদের বয়ানের গভীর মিল রয়েছে। দরবারি মার্কসবাদ বলতে দীপেশ কী বোঝাচ্ছেন সেটা জানার জন্য আগ্রহী পাঠক তার ‘মনোরথের ঠিকানা’য় চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।
দীপেশের এই সমালোচনার পরে বেশ তর্ক উঠে, আরো দুটো জবাব এবং কিছু তীর্যক প্রশ্ন আসে দীপেশের প্রতি। দীপেশ আবারো সেগুলোর উত্তর দেন। সেখানে পরে আসছি। তার পূর্বে আমাদের প্রসঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দীপেশের একটা মন্তব্য সম্পর্কে বলি। এজাজ আহমদ যে জাতীয়তাবাদের কথা বলছেন সেটার সমালোচনা করে মূল লেখায় দীপেশ বলেছিলেন যে, ‘... এই প্রয়োগ পরোক্ষে পাকিস্তানি কি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ‘বৈধ’ বলে অস্বীকার করার মনোভাবই প্রকাশ করে।’
এর জবাবে সবস্যাচী দেব খুব জোরের সাথে তীর্যকভাবেই প্রশ্ন করেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনের দাবিকে বৈধ বলে মানা হবে কোন যুক্তিতে? পাকিস্তানের দাবিতে আদৌ কোনো সংগ্রাম হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন না হয় বাদই দিচ্ছি, এই রাষ্ট্রগঠনের বৈধতার প্রশ্নটিই জরুরি। স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা বড়ো অংশে হিন্দুত্বের প্রভাব, দীর্ঘকাল ধরে মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের নানা ইতিহাস ইত্যাদি সত্ত্বেও ধর্মের ভিত্তিতে জাতিপরিচয় নির্ধারণ ও তারই জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠনের দাবি কি সত্যি যুক্তিসংগত? …ধর্ম তাহলে জাতির বিকল্প, সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিচয় হিসেবে- জাতি রাষ্ট্রের বিকল্প তাহলে ধর্মরাষ্ট্র। সেই ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির বৈধতা মেনে নিলে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ তৈরির বৈধতা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? আর বাংলাদেশের জন্য সংগ্রামকে বৈধ বলে মেনে নিলে পাকিস্তান সৃষ্টির বৈধতা কি সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে যায় না?’ আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, সব্যাসাচী দেবের মন্তব্য সেই একাত্তরের ‘দেশ’ পত্রিকার তর্ক-বিতর্কেরই সমরূপ।
দীপেশ তার উত্তর দিতে গিয়ে প্রথমেই বলে নেন, তিনি আসলে মূল লেখাতে কি বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, এবং প্রায় সকল ইতিহাস-ছাত্র এই বিষয় জানেন বলেও দাবি করেন যে, পাকিস্তান উপমহাদেশীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদের কোনো অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল না। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদের মূল ধারার বাইরে তাদের নিজস্ব জাতিরূপ নির্ধারণ করতে চেয়েছিল। যে কোনো ঐতিহাসিক জাতীয়বাদের যেমন বিভাজ্যতার দোষ থাকে সেই প্রচেষ্টার মধ্যেও সেটা ছিল। কিন্তু, তার কাছে, কংগ্রেসি ধারার বাইরে তৈরি হওয়া এই প্রচেষ্টাও ‘বৈধ’। তিনি মনে করেন, কংগ্রেসি ইতিহাসচর্চায় এই প্রচেষ্টাকে ‘মুসলিম সেপারেটিজম’ বলে খাটো করা হয়েছে, এবং এজাজ আহমদও একই কাজ করেছেন বলে তিনি এর সমালোচনা করেছেন।
সব্যসাচীর আরেকটা প্রশ্ন ছিল, ধর্মের ভিত্তিতে জাতিপরিচয় নির্ধারণ … কি বৈধ? দীপেশ জানাচ্ছেন যে, তার কাছে বৈধতার প্রশ্নটি ‘গণতান্ত্রিক বিচারের প্রশ্ন’। সেটা তার নিজের ব্যক্তিমানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। বহু রাষ্ট্র আছে যার জাতিরূপ নির্ধারণের প্রচেষ্টার সঙ্গে তিনি তিনি একমত না, তাই বলে সেই রাষ্ট্র ‘অবৈধ’? ফলে তিনি বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে বেশিরভাগ মুসলাম মানুষ যদি ‘মুসলমান’ হিসেবেই কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদ থেকে দূরে থাকতে চেয়ে থাকেন, তাদের সেই সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষাকে একজন গণতান্ত্রিক মানুষ হিসেবে আমি ‘বৈধ’ বলেই মনে করি।
এরপরেই দীপেশ আসেন বাংলাদেশের প্রসঙ্গে। সব্যসাচীর কথানুযায়ী, বাংলাদেশ যদি বৈধ হয় তাহলে পাকিস্তানগঠন কীভাবে বৈধতা পায়? সেটার উত্তরে দীপেশ বলেন, “জাতিপরিচয় নির্ধারণের ভিত্তি সময়ে বদলাতে পারে। কোনো রাষ্ট্রই অনন্ত বৈধতার গ্যারান্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। ১৯৭১ সালে ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রটি বাংলাদেশে আর বৈধ ছিল না। তার মানে এই নয় যে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ‘পাকিস্তান’-এর কোনো বৈধতা ছিল না। ‘বাংলার জনগণ… পাকিস্তান সৃষ্টির বিষয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সাড়া দিয়েছিল এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল’ - এ মন্তব্যে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে, কিন্তু মন্তব্যটি করেছেন শেখ মুজিবের জীবনীকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম স্বয়ং।”
দীপেশ এই আলাপকে ‘কূট-কচাল’ বলে এখানেই শেষ করতে চেয়েছেন। আমিও আসলে এটা নিয়ে আলাপ করতে চাচ্ছি না। কিন্তু, আমার মূল আগ্রহ আসলে ‘দেশ’ পত্রিকা নিয়ে। বাংলাদেশ আন্দোলন ও পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বয়ানগুলোর হদিস একেবারে একাত্তরেই খোঁজে পাওয়া সম্ভব। নানান তর্কেবিতর্কের মাধ্যমে হলেও যে বয়ানটা সেখানে পাওয়া যাচ্ছে সেটা হচ্ছে, দীপেশ যাকে বলছেন ‘কংগ্রেসি’, সেই বয়ানই। পাশাপাশি, ‘দেশ’ পত্রিকায় যেহেতু একধরণের গণতান্ত্রিকতা ছিল বলে আন্দাজ করা যাচ্ছে (কারণ, আলাপে পাঠকদের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ) ফলে, বাংলাদেশ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে কলকাতার বুদ্ধিবৃত্তিক জগত কীভাবে দেখছিল, কোনো রাস্তায় আলাপ অগ্রসর হচ্ছিল তার একটা সুলুকসন্ধান করার জন্য এটা সহায়ক হতে পারে। আবার, দীপেশের সাথে সব্যাসাচী দেবের তর্ক হয়েছিল ১৯৯৪ সাল নাগাদ। তখনো যে ‘দেশ’ পত্রিকায় চালু থাকা বয়ানই খুব শক্তপোক্ত অবস্থানে ছিল সেটা সব্যসাচী দেবের মন্তব্যে বোঝা যাচ্ছে।
[ছবি কৃতজ্ঞতা: ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর]
প্রিয় আর্টিকেল ওনার প্রথমে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই কারণ আপনার এই আর্টিকেলটি পরে আমি মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি আন্দোলনের বিষয়ে না জানা অনেক তথ্য জানতে পারলাম। যা আমরা বাঙালী হয়ে এই বিষয় গুলো না জানলে এটি একটি লজ্বার কারণ হয়ে দাড়ায় আর আপনি এত সুন্দর ও পরিপাটি করে লিখেছেন যা যে কোন বয়সের ব্যাক্তি এই আর্টিকেলটি পড়তে সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে আপনাকে আর একবার ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না।
ReplyDelete