মওলানা ভাসানীকে নিয়ে আলোচনা করা, বিশেষ করে যে ধারার আলোচনায় আমরা অভ্যস্ত, সেই ধারায় তাকে বিচার-বিশ্লেষণ করা খুব মুশকিলের কারণ, বিদ্যামান কোনো ছকে ফেলে তাকে যেমন কাবু করা যায় না, তেমনি ধরাও যায় না। আর পার্টিজান সাহিত্যে মওলানাকে আবদ্ধ করা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। আবার, বাংলাদেশের রাজনীতির যত ধারা বর্তমান, সেই ধারাগুলোর ঐতিহাসিক আলোচনা মওলানার উল্লেখ ব্যতীত সম্ভবও নয়। যার ফলে, ডান-বাম-মধ্য সকল পন্থীওয়ালার কাছে মওলানা থাকেন, তবে সেটা খণ্ডিত আকারে। মওলানার কিছু অংশ লীগ গ্রহণ করে, কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে তারা রীতিমতো গালাগালি শুরু করে দেন। আবার, কমিউনিস্টরা মওলানাকে নেন, কিন্তু এই মওলানা নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন। তাই বিপত্তি ঘটে যায় তাদের বেলাতেও। মওলানার নামাজ-রোজা দেখে ধর্মীয় রাজনীতির মানুষেরা আবেগে আপ্লুত হয়ে তার কাছে যায়, কিন্তু যখন জমির মালিকানার বিষয়ক সবক শোনে তখন তারাও ধরা পড়ে যায়। ‘পন্থী’ওয়ালাদে বাইরে জনসাধারণের ভেতর আরেক মওলানার অস্তিত্বও খোঁজে পাওয়া যায়, যিনি পীর, যিনি সবকিছু উজাড় করে দিয়ে সবাইকে ভালোবাসেন। খণ্ডিত এই মওলানাকে কেউ কেউ আসমানে তুলে ফেলেন, আবার কেউ কেউ মিশিয়ে দিতে চান মাটির সাথে। তবে মওলানার রাজনীতির রাজনৈতিক তাৎপর্য আমাদের আলোচনার টেবিলে খুব একটা আসে না।
মওলানা ভাসানী অস্থির
চিত্তের। দল ভাঙেন, দল গড়েন। আবার
ভাঙেন,
আবার গড়েন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যথার্থ মন্তব্যই করেছেন, তিনি এগিয়ে যান, দল পিছিয়ে পড়ে। কোনো
হিসেব নিকেশে তাকে ফেলা যায় না, দলের সর্বোচ্চ নেতা
হয়েও দলের সমালোচনা করেন, কঠোর ভাষায়। বিরোধীদলের
নেতাকেও পরামর্শ দেন প্রয়োজনমতো। যথার্থ বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় যেন তিনি হাজির। মূলত,
মওলানার চিন্তা ও কর্ম তৎপরতার মূল সুর ধরতে পারলে তারে চেনা সহজতর হয়। তিনি ‘না’ বলতে পারতেন। নুরুল কবির ‘রেড মওলানা’ বইতে দেখিয়েছেন মওলানা ভাসানী ‘না’ বলার এক অস্বাভাবিক অসাধারণ
ক্ষমতা
নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা,
উগ্র জাতীয়তাবাদ – সবকিছুকে তিনি ‘না’ বলেছেন। যে
কোনো সময় যে কোনো অবস্থাতেই জনসাধারণের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেও ‘না’ বলতে পারাটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে খুব বিরল একটি ঘটনা। মওলানার
অবস্থান তাই কখনো ক্ষমতার ঘরে নয়, বরং ক্ষমতার
‘বিরোধী’ শিবিরে। নুরুল
কবিরের ভাষায় ‘এভার অপোজিশনাল স্পিরিট’। নিজেদের
দল ক্ষমতায় গেলেও তিনি অবস্থান নেন ‘বিরোধী শিবিরে’;
তাঁর সেই চেতনার কারণেই গণমানুষের ‘মুখপাত্র’র দায়িত্ব তিনি নিজেই তুলে নেন নিজের কাঁধে।
মওলানার এই ‘বিরোধী’ শিবিরে অবস্থানের একটা প্রমাণ হচ্ছে কাগমারী
সম্মেলন ও এর ঘটনাপ্রবাহ। কাগমারী সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হয় তখন মওলানার নিজের দল, মানে আওয়ামীলীগ, কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ক্ষমতার
কেন্দ্রে থাকা সত্ত্বেও দলের দুই প্রধান নেতা সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী
স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে তর্ক-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তাঁদের
এই অনৈক্য মওলানার চিন্তাভাবনা আরো স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। ১৯৫৬ সালের আওয়ামীলীগের কাউন্সিল
অধিবেশনে সবধরনের যুদ্ধজোটের বিরোধিতা করা হয়েছিল, এবং
বাগদাদ বা সিয়েটার মতো চুক্তিসমূহ বাতিলের দাবিও করা হয়েছিল। কিন্তু
ক্ষমতা গ্রহণের পর সোহরাওয়ার্দী দলীয় ঐ নীতি থেকে সরে আসেন; প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কমিউনিস্ট বিরোধী তৎপরতায় যুক্ত হোন। সোহরাওয়ার্দী
ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার এক যুক্ত ইশতেহারে সাক্ষর করেন, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘স্বাধীন বিশ্বের
নিরাপত্তার পথে আন্তর্জাতিক কমিউনিজম এক বিরাট হুমকি’। ফলে
মওলানা নিজ দলের প্রধানের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কাগমারী
সম্মেলনের দুজনেই এই বিষয়ে বক্তৃতা – পালটা বক্তৃতা দেন। পাকিস্তানের
রাজনীতিতে এই দুই নেতার তর্ক-বিতর্ক এক কৌতূহল
জাগানিয়া বিষয়ে পরিণত হয়। পত্র-পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা
চলতেই থাকে। অবশ্য সমালোচনার তীর বেশি ছুড়ে দেয়া হয়েছিল মওলানার দিকে। কোন ঐতিহাসিক পটভূমিতে কাগমারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল
তা মওলনা যেমন তাঁর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে তুলে ধরছিলেন, আমরাও তেমনি তাঁর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে
সে পটভূমিকে খোঁজে পাব। আমাদের আলোচনার নজর ঘটনাপ্রবাহের দিকে নয়, বা মওলানার সমগ্র জীবনও নয়, বরং শুধু কাগমারী
সম্মেলনের মাধ্যমে মওলানার রাজনীতিটাকে উন্মোচন করার চেষ্টা করবো।
মওলানার ভাষণ ও ‘আসসালামু আলাইকুমে’র ইতিহাসবোধ
১৯৫৭ সালে কাগমারী
সম্মেলনে মওলানা যে ভাষণ দেন সেটা বেশ কিছু কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একে
তো চলমান রাজনীতি নিয়ে তাঁর সাহসী মন্তব্য, অন্যদিকে ছিল তাঁর
প্রখর ইতিহাসবোধের পরিচয়। পাকিস্তান আন্দোলনের যৌক্তিকতা, পাকিস্তান
আন্দোলনে মুসলিম লীগের নেতৃত্বদান এবং পাকিস্তানের প্রথম দশকের মধ্যেই মুসলিম
লীগের পতনের কারণ তিনি খুঁজেছেন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক
ভূমিতে। এই সরলরেখায় চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কি হতে পারে তা পরিষ্কারভাবে
চিহ্নিত করা তাঁর সেই ইতিহাস-চেতনার প্রখরতারই এক
উদাহরণ। আবার, মওলানার রাজনৈতিক দর্শন বোঝার জন্যে কাগমারী
সম্মেলনের ভাষণ এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
৭ ফেব্রুয়ারি মওলানার
সভাপতিত্বে কাগমারী সম্মেলন শুরু হয়। সভাপতির ‘কিছুটা লিখিত,
কিছুটা তাৎক্ষনিক’ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান
কালে ‘তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল স্বভাবসুলভ কঠোর’। অনেকদিনের
সংগ্রাম শেষে প্রথমবারের মতো আওয়ামীলীগ কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানে তখন ক্ষমতা
পেয়েছে। তাই বলে যদি মনে করা হয় আন্দোলন সংগ্রামের দরকার শেষ হয়ে
গিয়েছে তাহলে যে বিরাট ভুল করা হবে সে বিষয়ে ভাসানী নিজে যেমন সতর্ক তেমনি অন্যকেও
সতর্ক করে দেন। ভাসানী তাই বক্তৃতার শুরুতেই
বলেন,
‘তবু অনেকের মনে হতে পারে, আমরা বিরাট জয়লাভ করেছি,
মন্ত্রীরা দেশ শাসন করুক, আমরা বাড়ীতে বিশ্রাম
নেই। যদি কারও এরূপ ধারণা হয়ে থাকে তবে তা সম্পূর্ণ ভুল। এ
ভুল যত শিগগির ভাঙ্গে ততই মঙ্গল।’
এই যে নিজ দলের ক্ষমতা
গ্রহণের পরও ‘কাজ শেষ হয়ে যায় নি’ বলে
মনে হওয়াটাই মওলানাকে স্থানিক রাজনীতির অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা করে ফেলেছে। তাঁর
চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে যেহেতু জনসাধারণ, সেহেতু তিনি ভালো
করে জানতেন, জনসাধারণের জন্যে/পক্ষে যে
লড়াই সেটাকে গতিশীল রাখতে হবে। আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে - হোক ক্ষমতায় নিজের দল বা নিজদলের
মন্ত্রী।
এরপর মওলানা মুসলিম লীগের
রাজনীতি বিষয়ে এক বিশাল ফিরিস্তি দেন। পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগ এতো জনপ্রিয়
একটা রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে স্বাধীনতার পর (৪৭’র) জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
গেলো এবং কীভাবে মাত্র এক দশকের মধ্যে এই দলের রাজনৈতিক পতন ঘটলো – এই বিষয়ে মওলানার বিশ্লেষণ মওলানার প্রখর ইতিহাসবোধের পরিচয় প্রদান করে। পাকিস্তান
যখন জন্ম নিচ্ছে, সেই ৪৭ সালে মুসলিম লীগ ব্যতীত আর কোনো
রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই পাকিস্তানে ছিল না। মওলানা
নিজেও ছিলেন সেই দলের একজন সভ্য। তিনি জানাচ্ছেন,
‘আমি নিজে তো বটেই, আজ যারা এখানে সমবেত হয়েছেন
তাদেরও অধিকাংশ মুসলিম লীগের সভ্য ছিলেন। জনসাধারণের
অগাধ বিশ্বাস ছিল তখন মুসলিম লীগের উপর। ... কিন্তু মাত্র ৯টি
বছর না যেতেই আজ মুসলিম লীগ জনসাধারণের মন থেকে ধুয়ে মুছে গেল।। এত
বড়ো একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এরূপ অবস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।’
তাই মওলানার প্রশ্ন হচ্ছে
কীভাবে এটা ঘটলো, ‘কেনো মুসলিম লীগের এমন শোচনীয় মৃত্যু হলো’?
মওলানা এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করেছেন, তাঁর
ভাষায়, ‘বৈজ্ঞানিক মন’ নিয়ে। মুসলিম
লীগের অকালমৃত্যুর পিছনে মওলানা ৮টা কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, তাঁর ভাষায়, অফুরন্ত ক্ষমতা তৎকালীন মুসলিম লীগ
নেতাদের মাথা গুলিয়ে দিয়েছিল। তাই গণতান্ত্রিক কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে না গিয়েই করাচীকে
রাজধানী করা হলো, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হলো
এবং বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো। উল্লেখ্য, ‘করাচিকে পাকিস্তানের রাজধানী করায় এবং ঢাকাকে “দ্বিতীয়
রাজধানী” না করায় প্রথম থেকেই ভাসানী ক্ষুব্ধ ছিলেন’। ভাসানীর
মতে,
জনগণের মতামত না নিয়েই এই সিদ্ধান্তসমূহ নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, বিপরীতদিক থেকে দেখলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিই মওলানার মতে
মুসলিম লীগের পতনের প্রথম কারণ। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ কারণ হিসেবে মওলানা মূলত ‘ধর্মের
রাজনৈতিক ব্যবহার’কেই দোষারোপ করেন। মুসলিম
লীগের নেতৃত্ববৃন্দ তখন ব্যক্তিগত ও দলগত স্বার্থে ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনলেন। মুসলিম
লীগের যেকোনো সমালোচনা ইসলাম বিরোধিতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা আখ্যায়িত পেতে থাকলো। সেই
সাথে রাজনৈতিক সভা-সমিতিকে তারা ধর্মীয় ওয়াজ-মাহফিলে রূপান্তরিত করলেন। এক আল্লাহ, এক রাসুল, এক কেতাব – তেমনি
রাজনৈতিক দলও ‘এক’টি হবে এমন যুক্তি
দেয়া হতে লাগলো। মওলানা বলেন, ‘একই যুক্তিতে তারা
বলে যেতে লাগলেন বিরোধী দলমাত্রই রাষ্ট্রদ্রোহী’। ভাসানী
ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক ছিলেন, এমনকি অনেকের কাছে
ধর্মীয় নেতা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। অনেকেই তাঁকে পীর বলে সম্বোধন করতেন
ও বিশ্বাসও করতেন। আমাদের সবার পরিচিত বাউল আব্দুল করিমও বিশ্বাস করতেন যে, মওলানা ভাসানী একজন পীর। আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী। তিনি
যা বলতেন তাই হতো। কিন্তু, মওলানা ছিলেন পুরাদস্তুর অসাম্প্রদায়িক। যার
ফলে মুসলিম লীগের ‘ধর্মকে ব্যবহার’ করার
রাজনীতিটা যেমন চিহ্নিত করতে পেরেছেন, তেমনি কঠোর কণ্ঠে এর
প্রতিবাদও জানাতে পেরেছেন।
পঞ্চম কারণ হিসেবে মওলানা
ভাসানী মুসলিম লীগ কর্ণধারদের অসততা, সীমাহীন লুটপাট,
দুর্নীতি, চোরাকারবারি, স্বজনপ্রীতি,
ও রাষ্ট্রীয় ধনের হরিলুটকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান হবার পর
মুসলিম লীগের নেতা, উপনেতা ও সরকারি কর্মচারীদের অনেকেই আঙুল
ফুলে কলাগাছ হয়েছেন’। ষষ্ঠ কারণ
হিসেবে মওলানা বলেন, ‘পাকিস্তানের মালিক হওয়ামাত্র মুসলিম লীগ
নেতারা নিজেদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার সীমারেখা ভুলে গেলেন’। তাঁর
মতে,
‘মূর্খতা ও আত্মম্ভরিতার মিশ্রণ একেবারেই অসহ্য’।
সপ্তম কারণের ব্যাখ্যা
দিতে গিয়ে মওলানা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। ষাটের
দশকের শেষভাগে এসে
পূর্ববাংলার রাজনৈতিক সাহিত্যে যে কথাগুলো জোরেশোরে উচ্চারিত হওয়া
শুরু হয়েছিল সে কথাগুলোকেই পাওয়া যায় মওলানার উদ্ধৃতিতে। তাঁর
মতে,
মুসলিম লীগ নেতারা রাজনীতির সাথে অর্থনীতিকে গুলিয়ে ফেললেন। রাজনীতিতে
অনেক কিছু বলা সম্ভব হলেও, মওলানার মতে, ‘অর্থনীতি
বর্তমান জগতে বিজ্ঞানের একটা শাখা’। তিনি একটা উদাহরণ দেন, ‘স্বাধীনতার পর ভারত পাকিস্তান থেকে ৪০ লাখ বেল পাট ও ১৫ লাখ বেট তুলা কিনত
কিন্তু আজ কেনে মাত্র ১০ লাখ বেল পাট। ভারত
উৎপাদন বৃদ্ধি করল, আমরা অবলম্বন করলাম পাট উৎপাদন কমাও নীতি।’ এর কারণ হিসেবে মওলানা মুসলিম লীগ নেতাদের অর্থনীতি বিষয়ক অজ্ঞতাকেই
দোষারোপ করলেন। তিনি আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলেন,
‘এঁরা দেশের দুই অংশের মধ্যে স্বর্ণের দুই রকম মূল্য নির্ধারণ করে কার্যত
পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্বীকার করতে নিজেদের
স্বার্থোদ্ধার ও পূর্ব পাকিস্তানকে লুণ্ঠনের জন্যে উভয় পাকিস্তানকে এক অর্থনীতির
জোয়ালে আবদ্ধ করে লাঙ্গল ধরলেন। এই অশ্রুতপূর্ব মূর্খতার ফলে আজ
পাকিস্তানি অর্থনীতি বিপর্যস্ত; জনসাধারণ আজ
অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন, পূর্ব
পাকিস্তান আজ ভিখারির দেশে পরিণত।’
অষ্টম কারণ হিসেবে মওলানা
ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রের মধ্যে হাবুডুবুকে খাওয়াকে চিহ্নিত করেন। তাঁর
মতে,
‘ইংরেজ আমলের মাথাভারী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করা দূরের কথা,
মুসলিম লীগ তাঁকে পূর্বাপেক্ষাও মাথাভারী করতে প্রস্তুত হলো’। মওলানা তাই বলেন,
‘মোট কথা, মুসলিম লীগ মুখে ধর্মের জিগির এবং কার্যত
দেশের জনসাধারণকে ইংরেজ আমল অপেক্ষাও দারিদ্র্যে নিমজ্জিত করে দেশকে ভিক্ষুকের
দেশে পরিণত করার যে অদম্য উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় মত্ত ছিল, তার
নজির কোনো ইতিহাসে নাই।’
মুসলিম লীগের এই হালের কথা
উল্লেখ করে মওলানা মূলত তাঁর দলকেই সতর্ক করে দিলেন, ইতিহাস
থেকে শিক্ষা নেয়ার কথাও পরোক্ষভাবে বলে দিলেন। বিরোধীদল
হিসেবে নিজেদের নিপীড়নের শিকার হওয়াটা যে অন্যায় ছিল এবং এখন যেহেতু নিজেরা
ক্ষমতায় সেহেতু সেই অন্যায় যেন নিজের দল না করে সে বিষয়ে উপদেশ দেন। নিজের
দলের কর্মীদের স্মরণ করিয়ে দেন,
‘বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের জন্যে সরকারি দলের মতোই সমান প্রয়োজন বলে
মনে করতে হবে। বিরোধী দলের ‘শির কুচাল’ দেওয়ার কল্পনা পরিত্যাগ করতে হবে। বিরোধী
দলের কারও দেশপ্রেমে সন্দেহ প্রকাশ করার নীতি বর্জন করতে হবে।’
মওলানা ভাসানী তারপরে কথা
বলেন একুশে দফার বাস্তবায়ন বিষয়ে; পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে যে দুই
অর্থনীতি সেই কথাও বেশ স্পষ্টভাবে ভাসানী পঞ্চাশের দশকেই বলেছেন। পরবর্তীতে
ষাটের দশকে যে ‘দুই অর্থনীতি’ বিষয়
আলাপ-আলোচনা শুরু হলো তার সাথে ভাসানীর ‘পার্থক্য হলো তাঁর বলার ভঙ্গি ও ভাষা অর্থনীতিবিদের মতো নয় – জাতীয়তাবাদী নেতার মতো’। তাঁর মতে, একুশ দফাকে বাস্তবায়ন করতে হবে, পররাষ্ট্র, মুদ্রা ও দেশরক্ষা বিভাগ ছাড়া আর সকল বিভাগের ভার প্রদেশকে দিতে হবে। এও
বলেন যে,
যতদিন না পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক বিচারে দুটি
সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ইউনিট বলে স্বীকার না করা হবে, ততদিন
পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের মঙ্গল সম্ভব না। অর্থাৎ, মওলানার মূল আলোচ্যবিষয় হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন। শিক্ষাব্যবস্থা, কৃষিব্যবস্থা, এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ সব বিষয়ে
কেন্দ্রীয় সরকারের কড়া সমালোচনা করে মওলানা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যেভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে,তাতে এমন দিন আসবে, যখন পূর্ব বাংলাবাসী পশ্চিম
পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানাবে।’ এই ‘সালাম’ যে বিদায়ী সালাম,
মানে ‘স্বাধীনতা’, মানে
পাকিস্তানের কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা তা সবাই বুঝতে পেরেছিল। মওলানা ‘ইতিহাসের প্রয়োজন’ বুঝতেন। এই
অঞ্চলের মানুষ ‘দেশপ্রেমে’র কোনো
রোমান্টিক তাড়না থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি, বরং বিবিধ আর্থ-সামাজিক
প্রয়োজনেই অংশগ্রহণ করেছিল। সেই প্রয়োজনটাই ইতিহাসের প্রয়োজন বা সময়ের প্রয়োজন। যদি
সেই আর্থ-সামাজিক শর্ত পূরণ না হয় তাহলে আবারো ‘স্বাধীনতা’র প্রয়োজন পড়বে, এই ইতিহাসবোধ ভাসানীর যে প্রখর ছিল
তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো সন্দেহ নেই, ভাসানীর সর্বাধিক
সমালোচনা হয়েছে বক্তৃতার এই ‘সালাম’ জানানো
বিষয়ে।
ভাষণের শেষাংশে বৈদেশিক
নীতিসংক্রান্ত আলোচনা করেন। পূর্বেই বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের পূর্বের কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত
নেয়া হয়েছিল পাকিস্তান কোনো সামরিক জোটে থাকবে না এবং কোনো পরাশক্তির লেজুড়বৃত্তি
করবে না। ভাসানীর মতে, যত বেশি সামরিক
চুক্তি হবে, যত দল-উপদলে জাতিগুলি
বিভক্তি হবে, ততই বিশ্বের অমঙ্গল হবে। ভাসানী
নিজেকে তৃতীয় বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবে নিজেকে মানচিত্রে স্থাপন করে
সাম্রাজ্যবাদীদের বিপক্ষে অবস্থান নিতেন। তিনি বলতেন, ‘এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার শোষিত মানুষ ও
সাধারণ নিপীড়িত কৃষকের দুঃখ একই দুঃখ’। তাঁর
এই সুর কাগমারী সম্মেলনের বক্তৃতাতেও উপস্থিত ছিল। কোনো
রাখঢাক না রেখে সরাসরিই বলেন,
‘পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য – ‘বিভেদ
সৃষ্টি কর এবং শাসন কর – শত শত বৎসরের এই সাম্রাজ্যবাদী নীতি
এশিয়া, আফ্রিকার ব্যর্থ হউক – দুনিয়ার
নিরবচ্ছিন্ন শান্তি স্থাপনের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠুক।’
মওলানা ভাসানীর এই ভাষণের
তাৎপর্য অনেক। উপরের আলোচনাতেই ভাসানীর চিন্তার কিছু দিক অস্পষ্টভাবে হলেও
তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছ। কোনো সন্দেহ নেই, মওলানাকে চিনতে ও
জানতে হলে এই ভাষণকে উপলদ্ধি করা খুব জরুরি। একদিকে
যেমন এটাতে ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছিল, অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের
একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই ভাষণ। ভাসানী-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের মন্তব্যটাই যথার্থ, আমাদের
‘স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে
হলে তাঁর ওই ভাষণটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজন’। এই
ভাষণের বিষয়বস্তু ও ঝোঁক এই সিদ্ধান্তে আসতে আমাদের প্রেরণা দেয় যে, ৭ই মার্চের ভাষণ যদি স্বাধীনতা-সংগ্রামের চূড়ান্ত
মুহূর্তের দিক-নির্দেশনা হয়ে থাকে, তাহলে
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর ভাষণ স্বাধীনতার প্রস্তুতি-পর্বের
দিক-নির্দেশনা। ১৯৭১’র ৭ই
মার্চের ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ এর সাথে ১৯৫৭ সালের ‘আসসালামু আলাইকুম’কে মিলিয়ে পড়লে আশা করি সেটা বোঝা সহজ হবে।
ভাষণের প্রতিক্রিয়া
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা
যে ভাষণ দেন সেখানে প্রধানত দুইটা বিষয় পরবর্তীতে আলোচনার মুখ্য বস্তুতে পরিণত হয়। এক, বৈদেশিক নীতিতে সামরিক জোট বিরোধী তাঁর অবস্থান এবং দুই, স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা। সমালোচনার তীর যেমন তাঁর দলের ভেতর থেকে আসে, তেমনি তার দলের বাইরের পাকিস্তানপন্থীদের কাছ থেকেও আসে। ভাসানীর
বক্তৃতার পালটা বক্তব্যে সোহরাওয়ার্দী তাঁর মত উপস্থাপন করেন। প্রথম
ইস্যুতে,
অর্থাৎ, বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী
যুক্তি দেন,
‘১৯৫৫ সালে যে পররাষ্ট্রনীতির কথা বলা হইয়াছে, তাহা
অদ্যাবধি চলিতে পারে কি না, তাহা দেখিতে হইবে। আমাদের
দেশের রাজনৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। আমাদের
কেন্দ্রে একটিমাত্র পার্টির জন্যই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করিতে হয় না। সমগ্র
দেশের জন্যে তাহা করিতে হয়’।
সোহরাওয়ার্দীরা বিশ্বাস
করতেন যে,
‘কোনো দলের ফরেন পলিসি আর রাষ্ট্রের ফরেন পলিসি সমান হতে পারে না’। অর্থাৎ
দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রে তাঁকে সেটাই বাস্তবায়ন করতে হবে এটা তিনি
মানতেন না। বরং তাঁর মতে ছিল, ফরেন পলিসি কখনোই
স্থিতিশীল হতে পারে না এবং ‘পরিবর্তিত অবস্থার সহিত ইহাকে
অবশ্যই সমন্বয় সাধন করিয়া চলিতে হইবে’। এছাড়া, ‘সময়ের কথাও বিবেচনা করিতে হইবে’ বলে তিনি মনে করতেন। সোহরাওয়ার্দীর
অনুসারীদের মত ছিল, ‘ভারতের পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট পাকিস্তানের
আর্থসামাজিক উন্নতির জন্যে আমেরিকার মতো দেশের সাহায্য – সহযোগিতা
বা বন্ধুত্বের প্রয়োজন’। সৈয়দ আবুল মকসুদ জানাচ্ছেন, ‘আমেরিকা
নানাভাবে আওয়ামীলীগের একটি মধ্যপন্থী গ্রুপকে আস্থায় নিয়েছিল। ১৯৫৭-তে লিডারশীপ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে শেখ মুজিব ও জহিরউদ্দিনকে আমেরিকা সফর
করিয়ে আনে। ওই প্রোগ্রামটির নেপথ্যে ছিল সিআইএ। তৃতীয়
বিশ্বের অনেক দেশের ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় নেতাদের যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আমন্ত্রণ
জানাত। দামি হোটেলে নিয়ে রাখত এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘুরিয়ে
দেখাত এবং বলার চেষ্টা করত, গণতন্ত্রের পথে থাকলেই এধরনের উন্নতি সম্ভব। সমাজতন্ত্র
বা কমিউনিজমের পথে গেলে শুধু যে কথা বলার স্বাধীনতা বা ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে না
তা-ই নয়, ও পথে আর্থসামাজিক উন্নতিও সম্ভব নয়।’
দ্বিতীয় ইস্যু, মানে
স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে মওলানার বক্তব্যের জবাবে সোহরাওয়ার্দী বলেন, ‘এই দাবির বাস্তব ভিত্তি নাই।
কারণ স্বায়ত্তশাসন মোতাবেক এই দাবির শতকরা ৯৮ ভাগই
স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে।’ পাশাপাশি
তাঁর ভাষণে ‘মৌলিক দেশপ্রেমে’র ওপর
গুরুত্বও আরোপ করেন। তাঁর মতে, সেপারেটিজম বা
বিচ্ছিন্নতাবাদ কোনো সমাধান নয়। ‘আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে
কাজ করতে হবে। পাকিস্তানের সংহতি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বক্তব্য এমনই হওয়া
উচিৎ ছিল।’
ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে আছেন এমন কারো সমালোচনা করলে এর জবাবও
যে এমনতরই হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। অপরদিকে ভাসানীর অবস্থানও আরো
পরিষ্কাররূপে ধরা পড়ে। ভাসানীর কাছে ফরেন পলিসি নিছক কোন পলিসি নয়, বরং এটা তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সাথে জড়িত, তাঁর
রাজনীতির একেবারে গোঁড়ার সাথে সম্পর্কিত। আবার
শুরুতেই বলেছি ভাসানীর চিন্তাভাবনা পার্টিজান রাজনীতির সীমানা দিয়ে আবদ্ধ ছিলনা
কোনোকালেই। নিজের দলের সমালোচনা করা যাবে না, এমন কোনো মত ভাসানী মানতেন না। ‘মওলানা বলতেন, দল ক্ষমতায় গেলে তাঁর খারাপ কাজের
সমালোচনা করা যাবে না, তা তিনি বিশ্বাস করেন না।’ নিজের ঘনিষ্ঠদের আরো বেশি সমালোচনা করার পক্ষপাতী ছিলেন মওলানা। যার
ফলে,
আমরা দেখতে পাই আতাউর রহমানসহ আওয়ামী লীগ, মানে
নিজ দলেরই অনেক নেতা তাঁর উপর বিরক্ত ছিলেন।
মওলানার বক্তৃতার
বিষয়বস্তু থেকেই আন্দাজ করা যায় যে, তাঁর সবচেয়ে কড়া
সমালোচনা এসেছে মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী অংশ থেকে। আজাদ
ছিল মুসলিম লীগের মুখপাত্র এবং দৈনিক ইত্তেফাক ছিল আওয়ামীলীগের সোহরাওয়ার্দী অংশের। দৈনিক
ইত্তেফাকের মানিক মিয়া তো সোহরাওয়ার্দী উপদলেরই
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। আজাদও সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে অবস্থান নেয়। পররাষ্ট্রনীতি
বিষয়ে আজাদ মন্তব্য করে যে, ‘সম্মেলনে
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের যে মারাত্মক চেষ্টা করা হইয়াছিল সুখের
বিষয়, প্রধানমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়াদীর হস্তক্ষেপে এবং তার
ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে।’ মওলানা ভাসানীকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে আজাদ। বলে, ‘মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যাঁরা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি বদলাইতে
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাঁরা পাকিস্তানকে কোথায় লইয়া যাইতে চান?’
মওলানার বিদায়ী-সালামেও আজাদ যে খুব বিরক্ত হয়ে তা তাদের
সমালোচনার ভাষা দেখলেই বোঝা যায়,
‘বস্তুতঃ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা সম্পর্কে এমন প্রশস্তি
(!) আর কোন দেশে কখনো উচ্চারিত হইয়াছে কিনা সন্দেহ পাকিস্তানের
উৎপত্তি সম্পর্কে এমন ন্যক্কারজনক ঘৃণ্য উক্তি শুনিবার দুর্ভাগ্য আমাদের হইবে এরূপ
কল্পনাও আমাদের ছিল না। পাকিস্তান সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করেন বলিয়াই কি মওলানা
ভাসানী ইহাকে আজ রসাতলে লইয়া যাইবার মতলব আটিয়াছেন? তাঁর এই মতলব ধরা পড়িয়াছে তাঁর আর একটি উক্তিতে। তিনি
বলিয়াছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের
শোষণ যদি বন্ধ না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসিবে, যখন
পূর্ব পাকিস্তান হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানকে জানাইবে আসসালামো আলায়কুম'। অর্থাৎ
পাকিস্তান হইতে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে। পাকিস্তান
সম্পর্কে কোন পাকিস্তানীর মুখে পাকিস্তান বিচ্ছেদের মারাত্মক কথা যে এমন হালকাভাবে
উচ্চারিত হইতে পারে, ইহা কে কবে ভাবিতে পারিয়াছিল? এমন কথা মুখে উচ্চারণ করিতে পারেন মাত্র তাঁরাই, যাঁরা
পাকিস্তানের সংহতির কোন গুরুত্বই উপলব্ধি করিতে পারেন না। পাকিস্তানের
উভয় অংশ যদি খোদা না করুন, পৃথক হইয়া পড়ে, তাহা
হইলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকিবে কি? আর থাকিলেও বিশ্ব
রাজনীতিতে তার কোন গুরুত্ব থাকিবে কি? পশ্চিম পাকিস্তান-বিদ্বেষে এমন কথা কোন পাকিস্তানী উচ্চারণ করিলে তাতে তার পূর্ব কিছুই নয়। তাছাড়া
মওলানা ভাসানীর দলই যখন বর্তমানে রাষ্ট্ৰতরণীর কর্ণধার তখন এমন উক্তির মাত্র একটি
অর্থই হইতে পারে, এবং তা হইতেছে: যিনি
এমন উক্তি করেন, পাকিস্তান হিসাবে এই রাষ্ট্রের টিকিয়া থাকা
তাঁর কাম্য নয়।’
পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে
মওলানা নেহরুর মতো জোটনিরপেক্ষ থাকতে পছন্দ করতেন, এবং তা
বেশ জোরেশোরে বলতেনও। আবার ভাসানী এও বলতেন, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিরোধ থেকে ভারত-পাকিস্তানের
সৃষ্টি। তারপর দুটি স্বাধীন দেশে যদি ঔপনিবেশিক আমলের মতোই বৈরিতা
অব্যাহত থাকে, তাহলে দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কি প্রয়োজন ছিল?
এছাড়া, তাঁর মতে, ভারত ও
পাকিস্তানের মতো দুটি নতুন রাষ্ট্র অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে আখেরে দুই দেশের
জনগণেরই আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। একারণে
এমনিতেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাঁকে
‘ভারত-পন্থি’ বা
‘ভারতের দালাল’ বা ‘ভারতের
লেলানো কুকুর’ ইত্যাদি বলতো; কাগমারী
সম্মেলনের পর সেটা বরং আরো বেড়ে যায়।
এছাড়া, কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষে যেসকল
তোরণ নির্মিত হয় সেখানে গান্ধী ও সুভাস বসুরও নাম ছিল, ফলে
‘ভারতের দালাল’ এবং ‘দেশদ্রোহী’
ইত্যাদি তাঁকে উদ্দেশ্য করে আরো বেশি পরিমাণে ছুড়ে দেয়া হয়। ভারত
প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর অনুসারীরা কেন্দ্রের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর সাথে সহমত
পোষণ করতেন।
ছবি গ্রাহক: অলিউর সান, জাবি |
সাংস্কৃতিক সম্মেলন, বাংলার সংস্কৃতি ও নতুন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা
কাগমারী সম্মেলন শুধু আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনই ছিল না, বরং এর মূল আকর্ষণ ছিল এর সাংস্কৃতিক সম্মেলনের দিকে। ভাসানীর পরিকল্পনা ছিল ‘আফ্রো-এশিয়া সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ করার। কাগমারী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এই যে সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা সেটার সাথে, সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, ‘আওয়ামীলীগের কোনো সম্পর্ক ছিল না, সরকারেরও নয়, সেটা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত আকাঙ্খাজাত’। ভাসানীর পক্ষের মানুষ আর বিপক্ষের মানুষ সবাই একমত হোন এই বিষয়ে যে, পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে কাগমারীর সেই সংস্কৃতি সম্মেলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। লেখক ও সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ভিত-ভূমি নির্মাণের তিনটি তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার অন্যতম হচ্ছে কাগমারী সম্মেলন। অপরদুটি হচ্ছে, তাঁর মতে, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫৫ সালের আওয়ামীলীগের সাম্প্রদায়িক নাম বর্জন। তিনি বিশদ ব্যাখ্যা করে সিদ্ধান্ত দেন,
‘এসব
কারণেই স্বাধীন জাতি রূপে বাঙালি এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক ভিতভূমি
নির্মাণে কাগমারী সম্মেলনকে আমি তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলতে চাই’
এই সাংস্কৃতিক সম্মেলন
অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মওলানা দেশের খ্যাতিমান অনেক কবি সাহিত্যিক
সাংবাদিক শিল্পীদের সাথে শলাপরামর্শ করেন। দেশি-বিদেশি
অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কাছে তাঁদের দেশের প্রতিনিধি পাঠানোর
জন্যে অনুরোধ জানানো হয়। অনেকেই প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন, অনেক
ব্যক্তি আসতে না পারলেও লিখিত প্রবন্ধ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আবার
অনেকেই যোগ দিতে না পেরে দুঃখ প্রকাশ করে ফিরতি বার্তাও পাঠিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব
বসুকে আমন্ত্রণ জানালে ‘কমিউনিস্টদের আয়োজিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী
সম্মেলনে’ তিনি যোগ দিতে অস্বস্তি বোধ করেন এবং আমন্ত্রণ
‘সবিনয়ে’ প্রত্যাখ্যান করেন। সম্মেলন
উপলক্ষে প্রায় ৫০টি তোরণ নির্মিত হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন মনীষীদের নামে
তোরণগুলো বানানো হয়। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ইবনে সিনা, ইবনে
রুশদ, ইমাম গাজ্জালি, শাহজালাল,
শ্রীচৈতন্যদেব, আলাওল, শেকসপিয়র,
মিল্টন, হেগেল, কার্ল
মার্ক্স, এঙ্গেলস, টলস্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, লেনিন, স্তালিন,
সাদি, হাফিজ, ওমর খৈয়াম,
মাও-সে-তুং, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ,
রামমোহন রায়, মির্জা গালিব, মোহাম্মদ আলী, জিন্নাহ,
মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,
মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ, নেহেরু,
ইকবাল, বেকম রোকেয়া, লালন
শাহ, তিতুমীর, হাজি শরিয়তুল্লাহ,
নবাব সলিমুল্লাহ, সূর্য সেন, মজনু শাহ সহ আরো অনেকের নামেই তোরণ ছিল। নামের
এই তালিকাই বলে দিচ্ছে কতটা বৈচিত্র্যময় ছিল নামগুলো। কোনো
ধরণের মতাদর্শের টুলি চোখে না লাগিয়ে এই যে বিচিত্র নাম নির্ধারণ এটা ভাসানী
খেয়ালের বশে করেননি। বরং আবুল মকসুদের মতে,
‘তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্ব-সংস্কৃতিরই অংশ। অন্য জাতির সংস্কৃতিতে যেমন বাঙালির অধিকার রয়েছে, বাঙালিরও তেমনি বিশ্ব-সংস্কৃতিতে অবদান রয়েছে এবং
তাতে তার অধিকার রয়েছে। তারাও বাঙালির পর নন। ভাসানী তাঁর ভাষণেও বলেছিলেন, বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্ব-সংস্কৃতির বাইরে নয় – তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ।’
তোরণের এইসব নামকরণ নিয়েও
সমালোচনা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দীর একান্ত পক্ষের মানুষ ইত্তেফাক এর মানিক মিয়া
যেমন বিস্মিত হয়েছিলেন তেমনি বিরক্তও হয়েছিলেন। খানিক
ব্যাঙ্গ করেই বলেছেন, ‘অসংখ্য তোরণ আর ফেস্টুনে এমন সব দেশ ও নেতার
নাম রহিয়াছে যাদের অনেকের নাম ইতিপূর্বে আমি শুনি নাই’। মুসলিম
লীগ সমর্থক এবং সোহরাওয়ার্দী পন্থীদের অনেকেই সমালোচনা করছিলেন মূলত গান্ধী, নেহেরু, সুভাষসহ বিভিন্ন ভারতীয় ও হিন্দু নেতাদের
নামের অন্তর্ভুক্তির কারণে। ভাসানীকে তো এমনিতেই শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ‘ভারতের দালাল’ গালি দেওয়া হতো, সম্মেলনের পর যেন সে পালে আরো হাওয়া লাগে।
সম্মেলনে আরো অনেক অতিথির
মতো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। কাগমারী সম্মেলন দেখে তিনি কলকাতা
ফিরে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার
মুসলমান তরুণেরা এত দ্রুত এত এগিয়ে যাচ্ছে যে তা না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব না। ভাসানীতে
তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন, বলতেন, ‘এমন মানুষ,
এমন মাটির মানুষ আমি জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।’ সম্মেলনের এক ফাঁকে মওলানার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তারাশঙ্করের কথাবার্তা হয়। মওলানা
দেশভাগের কিছু স্মৃতি উল্লেখ করে কথায় কথায় বলেন, ‘হাজার
মাইল দূরে এক রাষ্ট্র হয় না। আমরা বেরিয়ে আসবই, ১০-১২ বছরের বেশি লাগবে না। পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবেই।’ তারাশঙ্কর যখন অন্নদাশঙ্করকে এই অভিজ্ঞতা জানান, তখন
অন্নদা তাঁকে নিষেধ করে দেন যেন এই কথা আর কাউকে না বলেন। তাতে
মওলানার জান যেতে পারে!
কাগমারীতে মওলানার ‘সালাম’ জানানো এবং এই যে ১০-১২
বছরের মধ্যে স্বাধীন হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা তা মোটেও খেয়ালের বশে বা কথার কথা
ছিল না। তাঁর একটা নিজস্ব চিন্তাপদ্ধতি ছিল, তাঁর চিন্তার রাডারে অনেককিছুই ধরা পড়তো যা অনেক শিক্ষিত নেতাদেরও চোখ
এড়িয়ে যেত। অবশ্যই ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে স্বাধীনতার ব্যাপারে মওলানার
আন্দাজ সঠিকই ছিল; তবু এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকও আছে। তিনি
শুধু স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখছিলেন না, বরং এই পূর্ব বাংলা
কীভাবে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে
কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে এই বিষয়ে তাঁর ছিল সতর্ক দৃষ্টি। এর
প্রমাণ পাওয়া যাবে সম্মেলনে যে সকল প্রবন্ধ পঠিত হয়েছিল, বা যে সকল বিষয় আলোচ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেগুলোর শুধু
শিরোনাম দেখলেই। কয়েকটার কথা উল্লেখ করা যায়, যেমন,
পাকিস্তানের ভাষা, দ্যা কনসেপ্ট অফ ইসলামিক
কালচার, রোল অফ ওমেন ইন মডার্ন সোসাইটি, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা, পাকিস্তানের
শিক্ষার মাধ্যম, বিকল্প খাদ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা ও পন্থা,
পূর্ব পাকিস্তানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব, পূর্ব
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পূর্ব পাকিস্তানের সেচ
ব্যবস্থা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা উন্নয়নে মেডিকেল এসোসিয়েশনের ভূমিকা ইত্যাদি। অর্থাৎ, যদি পূর্ব বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়, তাহলে
সেই রাষ্ট্রের শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-অর্থনীতি-কৃষি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা কেমন হবে বা হওয়া উচিৎ এইসকল বিষয়ও তাঁর ভাবনাতে ছিল। তাই
প্রতিটা বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কথা বলিয়েছেন। তাঁদের ‘অভিমত জনগণকে অবগত করার’ একটা চেষ্টাও এতে পরিলক্ষিত
হয়। এখানে মওলানার দূরদৃষ্টির সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। আওয়ামীলীগের
কাউন্সিল অধিবেশনের বিতর্ক এবং সাংস্কৃতিক সম্মেলনের চাপে মওলানার এই দিকটা অনেকটা
আড়ালে পড়ে যায়।
রবিঠাকুরের ‘স্বদেশী মেলা’ এবং কাগমারী
‘এখন কতকগুলি অদ্ভুত অসংগতি আমাদের চোখে ঠেকিবে এবং তাহা সংশোধন করিয়া লইতে
হইবে। প্রোভিন্শ্যাল কন্ফারেন্সই তাহার একটি উৎকট দৃষ্টান্ত। এ কন্ফারেন্স দেশকে মন্ত্রণা দিবার জন্য সমবেত, অথচ ইহার
ভাষা বিদেশী। আমরা ইংরেজি-শিক্ষিতকেই আমাদের
নিকটের লোক বলিয়া জানি-- আপামর সাধারণকে আমাদের সঙ্গে অন্তরে
অন্তরে এক করিতে না পারিলে যে আমরা কেহই নহি, এ কথা কিছুতেই
আমাদের মনে হয় না। সাধারণের সঙ্গে আমরা একটা দুর্ভেদ্য পার্থক্য তৈরি করিয়া
তুলিতেছি। বরাবর তাহাদিগকে আমাদের সমস্ত আলাপ-আলোচনার বাহিরে খাড়া করিয়া রাখিয়াছি। আমরা
গোড়াগুড়ি বিলাতের হৃদয়হরণের জন্য ছলবলকৌশল সাজসরঞ্জামের বাকি কিছুই রাখি নাই-- কিন্তু দেশের হৃদয় যে তদপেক্ষা মহামূল্য এবং তাহার জন্যও যে বহুতর সাধনার
আবশ্যক, এ কথা আমরা মনেও করি নাই।’
উপরের কথাগুলো
রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ নামক
প্রবন্ধ হতে নেয়া হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই রবিঠাকুর এখন পর্যন্ত আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ
বুদ্ধিজীবী। গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাসের বাইরে তাঁর ভাষা, শিক্ষা, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাভাবনাও আমাদেরকে চিন্তার প্রচুর খোরাক দেয়। রবীন্দ্রনাথের
রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক আলাপ-আলোচনায় তৎকালীন
ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চিত্র যেমন উঠে আসে তেমনি এই বাস্তবতার বিরুদ্ধে বিকল্প
প্রস্তাবনাও থাকে। রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্টভাবে বলতেন, ‘ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার প্রাণশক্তি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত’। কোন
মত বা পথ ইউরোপে সফল হয়েছে বলে তা ভারতেও সফল হবে এমন ভাবনা গলদ-পূর্ণ। তাই দেখা যায়, নেশনালিজমের বাংলা
কি হবে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের সাথেই প্রচুর যুক্তি-তর্কের
মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। কেননা, ইউরোপ ‘নেশন’ বলতে যা বোঝায়, ভারতে ‘জাতি’
অর্থে ঠিক তা বোঝায় না; আরো অনেক অর্থই বুঝিয়ে
থাকে। তো, নেশনালত্ত্ব
এবং নেশন-রাষ্ট্র যে ইউরোপিয়ান ধারনা, সেটা
যে এখানকার বিষয় না এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতন। তাঁর
মতে,
পশ্চিমা জাতীয়তাবাদ ( নেশনালত্ত্ব ) নির্দয়, ছলনাপূর্ণ ও মিথ্যাশ্রয়ী। তিনি
বলতেন,
ইউরোপে যেখানে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক, ভারতবর্ষ
সেখানে সমাজকেন্দ্রিক। তাই তাঁর রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় ‘সমাজ’ই কেন্দ্রে অবস্থান করে। দেশের
ঐক্য ও জাতীয় মুক্তির জন্যে যে নেশনের দরকার রবীন্দ্রনাথ সেটাও বলতেন। কিন্তু
তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘যাহা হউক, আমাদিগকে নেশন
বাঁধিতে হইবে – কিন্তু বিলাতের নকল নহে’। তাই, ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় যখন এখানে সভা-সেমিনার শুরু হলো
তার হালত কেমন হলো সেটা রবীন্দ্রনাথের উপরোক্ত মন্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে। দেশকে
মন্ত্রণা দেবার জন্যে আয়োজিত ‘কনফারেন্সে’র ভাষা কিন্তু বিলাতি; পুরো প্রক্রিয়াটাই দেশের
জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই, রবীন্দ্রনাথ আরেকটা সত্য কথা উচ্চারণ করেন,
‘পোলিটিক্যাল সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে এক করা। কিন্তু
দেশের ভাষা ছাড়িয়া, দেশের প্রথা ছাড়িয়া, কেবলমাত্র
বিদেশীর হৃদয় আকর্ষণের জন্য বহুবিধ আয়োজনকেই মহোপকারী পোলিটিক্যাল শিক্ষা বলিয়া
গণ্য করা আমাদেরই হতভাগ্য দেশে প্রচলিত হইয়াছে।’
ইউরোপ-ধাঁচের কনফারেন্সের সমালোচনা করে রবিঠাকুর বসে থাকেন নি, বরং এর বিপরীতে এক বিকল্প প্রস্তাবও দেন। তিনি
বলেন,
‘দেশের হৃদয়লাভকেই যদি চরম লাভ বলিয়া স্বীকার করি, তবে
সাধারণ কার্যকলাপে যে-সমস্ত চালচলনকে আমরা অত্যাবশ্যক বলিয়া
অভ্যাস করিয়া ফেলিয়াছি, সে-সমস্তকে
দূরে রাখিয়া দেশের যথার্থ কাছে যাইবার কোন্ কোন্ পথ চিরদিন খোলা আছে, সেইগুলিকে দৃষ্টির সম্মুখে
আনিতে হইবে। মনে করো, প্রোভিন্শ্যাল কন্ফারেন্সকে যদি আমরা যথার্থই দেশের মন্ত্রণার
কার্যে নিযুক্ত করিতাম, তবে আমরা কী করিতাম? তাহা হইলে আমরা বিলাতি ধাঁচের একটা সভা না বানাইয়া দেশী ধরনের একটা বৃহৎ
মেলা করিতাম। সেখানে যাত্রা-গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূরদূরান্তর হইতে একত্র হইত। সেখানে
দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হইত। সেখানে ভালো কত্থক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেওয়া হইত। সেখানে
ম্যাজিক-লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদিগকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশ
সুস্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইত এবং আমাদের যাহা-কিছু
বলিবার কথা আছে, যাহা-কিছু সুখদুঃখের
পরামর্শ আছে, তাহা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলিয়া সহজ বাংলা ভাষায়
আলোচনা করা যাইত।’
রবীন্দ্রনাথ এখানে বিলাতি
কায়দার সভা-সেমিনারের বিপরীতে দেশিয় মেলাকে স্থান দেন। সভা-সেমিনারে আটকে না থেকে তিনি মেলায় যেতে বা মেলার আয়োজন করতে উপদেশ দেন। এতে
উপনিবেশায়নের ফসল হিসেবে জনসাধারণের সাথে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে সেটাও
ঘুচবে। রবীন্দ্রনাথের এই আলোচনা যেমন আমাদের রাজনীতিতে উপনিবেশায়নের
কালো ছায়ার উপস্থিতির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে সাহায্য করে, তেমনি এর থেকে উত্তরণের একটা উপায়ও বাতলে দেয়।
এতো ঘটা করে রবীন্দ্রনাথকে
হাজির করলাম এই কারণে যে, কাগমারী সম্মেলন নিয়ে যখন পড়তে বা জানতে যাই তখন অবাক হয়ে
রবীন্দ্রনাথের সেই ‘দেশি ধরণের বৃহৎ মেলা’র
কথাই মনে পড়ে। উপরের উদ্ধৃতিসমূহের সাথে মিলিয়ে দেখলে আশা করি কেউ খুব একটা
দ্বিমত পোষণ করবেন না। কাগমারী সম্মেলনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকের মধ্যে একটা হচ্ছে
এর আয়োজনস্থল। স্বাভাবিকভাবে কেন্দ্রে আসীন একটা রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল
অধিবেশন এবং আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজনস্থল কেন্দ্রে বা শহরে বা আরো স্পষ্টভাবে বললে ঢাকাতেই
হওয়ার কথা। কিন্তু মওলানা সেটাকে নিয়ে গেলেন গ্রামে, কেন্দ্র হতে বেশ দূরে, আবার প্রান্তিকের খুব পাশে। সম্মেলনকে
ঢাকার বাইরে গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যেতে সোহরাওয়ার্দী-আতাউর
রহমান খান সহ অনেকেরই মৃদু আপত্তি ছিল। মানিক
মিয়ার ইত্তেফাক সম্মেলন কাগমারীতে না করে ঢাকায় আয়োজন করতে সুপারিশ করেন। তাঁর
যুক্তি ছিল কাগমারীতে সম্মেলন হলে ‘কাউন্সিলার, ডেলিগেট এবং অন্যান্য আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা
করা সুকঠিন হবে’। তাঁর আশঙ্কা ভুল প্রমাণিতই হয়েছিল। কিন্তু
রাজনীতিকে কেন্দ্রে আটকে না রেখে বিকেন্দ্রীকরণের এই যে পাল্টা উদ্যোগ মওলানা
নিয়েছিলেন সেটা তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা থেকেই। বলার
অপেক্ষা রাখে না, এটা তাঁর রাজনীতির সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ। জনসাধারণের
পাশে যদি রাজনীতিকে না নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে সে রাজনীতি যে উপনিবেশিক-প্রভুদের
দেখানো রাজনীতির পুনরাবৃত্তিই হবে তা তিনি বুঝতেন। আর
জানতেন ও বুঝতেন বলে তাঁর রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল সমাজ ও মানুষ। সৈয়দ
আবুল মকসুদ যথার্থই বলেন, ‘রাজনীতিকে রাজধানী-কেন্দ্রিক
রাখার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। তিনি চাইতেন গ্রামের সাধারণ মানুষকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত
করতে,
যাতে তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার মান উন্নীত হয়।’
তো, রবিঠাকুর প্রস্তাবিত ‘মেলা’র
সাথে মওলানা আয়োজিত কাগমারী সম্মেলনের যে মিল তার একটা নমুনা পাওয়া যায় সম্মেলনের
প্রচারপত্রের মধ্যেই। প্রচারপত্রের আহ্বান যেভাবে শেষ হয় তাতে এই জমানার সভা-সেমিনারের চেয়ে দেশিয় মেলার সাথেই মিল বেশি। উদাহরণস্বরূপ
প্রচারপত্রের ‘কর্মসূচি’ অংশ তুলে
দিচ্ছি,
‘৭ই ও ৮ই ফেব্রুয়ারি – পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ কাউন্সিল
সভা।
৭ই
ফেব্রুয়ারি হইতে – কৃষি, শিল্প প্রদর্শনী
ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন। প্রদর্শনীর জন্য শ্রেষ্ঠ দ্রব্যসম্ভার আনয়নের এবং সাংস্কৃতিক
সম্মেলনে যোগদানের জন্যে শিল্পীগনকে অনুরোধ জানান যাইতেছে। থাকার
ব্যবস্থা হইবে, বিছানা সঙ্গে আনিবেন।’
আবার প্রচারপত্রের নিচে ‘বিশেষ
দ্রষ্টব্য’ দিয়ে লেখা হয়েছে –
‘সম্মেলনের জন্যে চাউল, পাতা,
ডেকচী, কড়াই, গরু-বকরী যে যাহা দান করিতে চান সম্মেলনের পূর্বেই পৌঁছাইয়া দিবেন।’
বিভিন্নজনের অভিজ্ঞতায়
কাগমারী সম্মেলনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে রবিঠাকুরের ‘মেলা’কেই যেন বেশি আবিষ্কার করি। সৈয়দ
আবুল মকসুদ তাঁর বইতে জানাচ্ছেন, জানুয়ারি মাসের
শেষের দিক থেকেই সারাদেশ হতে জিনিসপত্র সন্তোষে যেতে যেতে থাকে। শুধু
সচ্ছল গৃহস্থই নয়, দরিদ্র মানুষেরাও গরু-ছাগল-ভেড়া-মুরগি-হাস-ডিম-তরকারি যার যেটা সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়ে গিয়েছে। যার
কিছুই দেয়ার ছিল না, সে ভাত খাওয়ার জন্যে কয়েক বাণ্ডিল কলাপাতা
নিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ জঙ্গল থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে এনে দিয়েছে। কিশোরগঞ্জ
ও উত্তরবঙ্গের জেলেরা ছোট ছোট মাছ ধরে তাঁর শুটকি করে পাঠিয়েছেন। এতো
শুটকি এসেছিল যে খেয়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। শত শত মাটির সানকি ছিল। খাবারের
আয়োজনে দিন আর রাত বলে কিছু ছিল না। বিভিন্নস্থানের কুমারেরা কাগমারী সম্মেলনের জন্য শত শত মাটির
সানকি বানিয়ে দিয়েছিলেন অতি অল্প দামে। মৃৎশিল্পীরা তাঁদের তৈরি বিভিন্ন
পণ্য নিয়ে অংশ নেন কুটিরশিল্পের মেলায়। সিলেট থেকে এসেছিল বহু শীতল পাটি। মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এসেছিল খেজুরপাতার পাটি। সম্মেলনের
পর ভাসানী সেগুলো গরিব মানুষকে দিয়ে দেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই তাই
কাগমারী সম্মেলনকে বলছেন ‘এলাহি কাণ্ড’।
আবার রাতে বসতো সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান,
নাচে গানে আসর মেতে থাকতো। কবিগান, জারিগান, ভাওইয়া গান সবই হতো। দেশের
বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর শিল্পী দাওয়াতে বা না-দাওয়াতে
এসেছিলেন। আমাদের সবার পরিচিত বাউল শাহ আবদুল করিমও গিয়েছিলেন, তিনি কোনো দাওয়াত ছাড়াই গিয়েছিলেন। (বিঃদ্রঃ বাউল আবদুল করিম যে দাওয়াত ছাড়া গিয়েছিলেন সেই তথ্য দেয়া আছে সৈয়দ আবুল মকসুদের বইতে। কিন্তু আবদুল করিবের 'আত্মস্মৃতি' এবং সুমনকুমার দাশ রচিত 'শাহ আবদুল করিম: জীবন ও গান' গ্রন্থে দাওয়াত দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।) সম্মেলনে
গান পরিবেশনের পর ভাসানী তাঁর প্রশংসা করেছিলেন – এই কথা
আবদুল করিম আজীবন বলে গিয়েছেন। এমনও বলেছিলেন যে, ভাসানীর মুখের প্রশংসাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো পুরষ্কার।
কাগমারী সম্মেলনের এই যে
পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে সেটা যত না এই জমানার ‘কনফারেন্স’, তার চেয়ে বেশি বরং ‘দেশিয় মেলা’।
জনসাধারণের ভুল বনাম জনসাধারণে আস্থা
‘ইতিহাস সাক্ষী, কোন দেশের জনসাধারণ কোন কালেই ভুল
করেনি। যারা বলেন যে, নিরক্ষরতা বা
অজ্ঞতার জন্য জনসাধারণ ভুল করতে পারে, সুতরাং জনসাধারণের উপর
পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না, তাদের সঙ্গে জনসাধারণের কোন
পরিচয় নেই। সমবেতভাবে জনসাধারণ যদি ভুলই করত, তবে তারা পাকিস্তান আনতে পারত না। পূর্ব
বাংলার বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনতা যে অপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছে, তার তুলনা নেই।’
কাগমারী সম্মেলনের ভাষণেই
মওলানা এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই উক্তি দিয়ে নুরুল কবির তাঁর ‘রেড
মওলানা’ বইটা শুরু করেছিলেন এবং ধাপে ধাপে মওলানা ভাসানীর
‘এভার অপোজিশনাল’ চেতনার স্বরূপ উদঘাটন
করেছিলেন। উপরের কথাটার মধ্যেই ভাসানীর রাজনৈতিক চেতনার একটা
সংক্ষিপ্তরূপের সন্ধান পাওয়া যায়; এমনকি যদি বলি যে,
ভাসানীর চেতনার ভিত্তিমূলের পরিচয়ও পাওয়া যায় তাতেও মনে হয় না খুব
একটা বড়ো ভুল হবে। তাঁর রাজনীতির ভরকেন্দ্রই হচ্ছে জনসাধারণ। তাদের
উপর তাঁর পূর্ণ আস্থা রয়েছে এবং তাঁর রাজনীতির মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে সেই আস্থা। জনসাধারণ
অজ্ঞ ও নিরক্ষর হলেও, তাদের উপর আস্থা রাখাটাকেই ভাসানী যৌক্তিক
মনে করেন। এবং যেসব নেতা ভাবেন জনসাধারণ ভুল করতে পারে, তাদের তিনি কটাক্ষ করেন। জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন মনে করেন। সমবেতভাবে
জনসাধারণ ভুল করে না - এই উক্তি গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক চর্চার
প্রতি তাঁর আস্থারও বহিঃপ্রকাশ।
মওলানা ভাসানীর এই উক্তি
কিছুদিন পূর্বে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেছিলাম; লক্ষ করলাম যে বন্ধু এবং বড়ভাইদের অনেকেই এই উক্তির বিরোধিতা করছেন;
তাদের বিরোধিতার জায়গা হচ্ছে মূলত দুটো। এক, সমবেত জনসাধারণের ভুল করা বা না করা প্রসঙ্গে এবং দুই, জনসাধারণের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা প্রসঙ্গে। তাই, কারো কারো মন্তব্য হচ্ছে, ভাসানীর এই কথা শুনতে
শ্রুতিমধুর হলেও এতে কোনো বাস্তবতা নেই এবং এটা একেবারেই ফালতু কথা। মূলত, ভাসানীর উক্তির বিপরীতে আমার বন্ধুদের প্রদত্ত মতামতের প্রেক্ষিতেই একটু
আলাপের দরকার আছে বলে মনে হলো। তাই ছোটখাটো আলাপটা যতটা ভাসানীকে নিয়ে তাঁর চেয়ে বেশি ভাসানীর
ঐ বিশেষ ‘উক্তি’কে নিয়েই। অবশ্যই
আমার কথা শেষ কথা না, আমার যুক্তির বিপরীতেও যুক্তি থাকতে পারে। আলোচনার পূর্বে এটা স্মরণ
করে নেয়া মঙ্গলজনক যে, আমরা যে সময়ে বসবাস করছি, সেখানে ব্যক্তি বা জনসাধারণ বা আমজনতাকে ক্রিমিনালাইজ করার প্রবণতা খুব
স্বাভাবিক একটা প্রবণতা হিসেবে হাজির হয়েছে। তা
ডানপন্থী রাজনীতি হোক, বা প্রচলিত বামপন্থী রাজনীতি হোক দুই পন্থার
রাজনীতিতেই এই প্রবণতা স্পষ্ট।
পূর্বেই বলেছি, আমার মনে হয় বা হচ্ছে, উপরোক্ত উক্তির মূল বিষয়
হচ্ছে ‘জনগণের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা’। দেশের
সমবেত জনসাধারণ ভুল করতে পারেনা - এমন সিদ্ধান্তের
স্বপক্ষে তাঁর উক্তির মধ্যেই মওলানা সাহেব দুটো প্রমাণ হাজির করেছেন। এক, পাকিস্তান আন্দোলন এবং দুই, যুক্তফ্রন্টের সাধারণ
নির্বাচন। তিনি বলেন, ‘সমবেতভাবে জনসাধারণ যদি ভুলই করত, তবে তারা পাকিস্তান আনতে পারত না।
পূর্ব বাংলার বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনতা যে অপূর্ব
রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছে, তার তুলনা নেই।’ সমবেতভাবে নেয়া এই সিদ্ধান্তসমূহকে
কি ভুল বলা যায়? এমনকি ব্রিটিশ আমলেও জনসাধারণ - যারা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে ‘অজ্ঞ’ ও ‘অশিক্ষিত’ হিসেবে পরিচিত
- ক্রমাগত আন্দোলন করেছে,
প্রতিরোধ প্রতিবাদ করে গিয়েছে। সমবেত
জনসাধারণের এই সিদ্ধান্তসমূহকে কি কোনোভাবে খারিজ করা সম্ভব? যে দেশের মানুষ সমবেতভাবে আন্দোলন করে পাকিস্তান স্বপ্ন সত্যি করলো সেই
মানুষই আবার পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী দলকে কয়েকবছরের মধ্যেই অস্বীকার
করলো। আবার, যে পাকিস্তানের জন্যে লড়লো, মাত্র ২৫ বছরের মাথায় সেই পাকিস্তানকেই ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি করলো। তাহলে
কি জনসাধারণের পাকিস্তান আন্দোলন ভুল ছিল? দেশের জনসাধারণের এই
যে সিদ্ধান্ত নেয়া বা সিদ্ধান্তের পরিবর্তন তার গোঁড়া সমাজের পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক জমিনে প্রথিত থাকে। একাত্তরে দাড়িয়ে কি এই সিদ্ধান্তে
আসা সম্ভব যে, পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেয়া জনসাধারণের ভুল
ছিল? এই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখে পড়েছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ। নিজেই
নিজেকে এই প্রশ্ন করেছিলেন। কামরুদ্দিন আহমদ যেমন পাকিস্তান আন্দোলনের সাক্ষী তেমনি তিনি
স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনেরও সাক্ষী। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানের হাতে
বন্দি তখন নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, তবে কি পাকিস্তান
আন্দোলন ভুল ছিল? তাঁর সিদ্ধান্ত হচ্ছে এটা ভুল সঠিকের বিষয়
না। ইতিহাসের প্রয়োজনে পাকিস্তান এসেছিল, ইতিহাসের প্রয়োজনেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ছেন। কামরুদ্দিন
আহমদ যাকে ‘ইতিহাসের প্রয়োজন’ বলছেন,
তাকেই আমরা বলছি ‘সময়ের প্রয়োজন’।
তাহলে কি সংখ্যাগরিষ্ঠতাই
সঠিকতার মানদণ্ড? না তাও না। গণতন্ত্রকে
শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতার মাপে বোঝা বিপদের। গণতন্ত্র
যতটা না সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতার প্রশ্ন তাঁর চেয়ে বেশি ভিন্নমতকে আমার মতের পাশে
জায়গা দেয়ার প্রশ্ন, ভিন্নমতকে আমার মতের মতো স্পষ্টভাবে বলতে
দেয়ার চর্চা। গণতন্ত্র শুধু কোনো ঘটনা না, বরং
প্রসেস। এটাকে চর্চা করতে হয়, প্রতিটা জমিনে,
প্রতিটা ক্ষেত্রে। এর নিয়মিত চর্চা ভুলের চেয়ে সঠিক
সিদ্ধান্তের জন্মই বেশি দেয়। রাষ্ট্রীয় পরিসরে গণতন্ত্র চর্চার সবচেয়ে বড় জায়গা হচ্ছে সংসদ, বা পার্লামেন্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ ধারা সেই
গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, আমরা সুষ্ঠু
নির্বাচন প্রত্যক্ষ করি কদাচিৎ।
যার ফলে আমাদের রাষ্ট্রীয়-জীবনে গণতন্ত্র ‘চর্চা’র বিষয় হয়ে উঠতে পারে নাই, বরং হয়েছে ‘ঘটনা’মাত্র। কিছুকিছু
নির্দিষ্ট দিনে সেটা ঘটে থাকে। তাই, ‘জনগণের উপর ভরসা রাখা’ এবং ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সঠিকতার মানদণ্ড নয়’ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
এখানে আরো গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় হচ্ছে, মওলানা সাহেবের যে চিন্তপ্রবণতা - জনগণের উপর আস্থা রাখা - তাঁর বিরুদ্ধচিন্তাপ্রবণতা
বরঞ্চ আরো ভয়াবহ এবং ক্ষতিকর। অশিক্ষিত ও অজ্ঞ জনগণ যেহেতু ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাই
তাদেরকে সঠিক পথে রাখতে তাদেরকে শাসনের বিকল্প নেই। তাদের
যেহেতু যোগ্যতা নেই, এবং যেহেতু আমরা শিক্ষিত [এলিট] সেহেতু তাদের উচিৎ আমাদের কথা শোনা। আমাদেরও
উচিৎ তাদের শাসন করা। তাদেরকে শাসন করবো, তাদেরই মঙ্গলের
জন্যে, তাদেরই ভালোর জন্যে। একদিকে
এই চিন্তাধারা উপনিবেশিক; অন্যদিকে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই চিন্তাপ্রবণতাই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়, ফ্যাসিবাদের
সহযোগী করে তোলে, ফ্যাসিবাদের সরব/নীরব
সমর্থক করে তোলে। এখানেই তাই চলে আসে ভাসানীর উক্তিটার দ্বিতীয় প্রসঙ্গ - সমবেতের ভুল করার ‘ভয়’!
‘ভুল করার’ ভয় যদি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় তাহলে আমাদের যাবতীয় স্বাধীনতাই হুমকির
সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এখানে আমি আমার কথা না বলা তিনজন মহান ব্যক্তির উক্তি দিয়েই
এই আলাপের ইতি টানবো। মহামতি লেনিন নাকি বলেছেন যে, ভুল করার
সুযোগের নামই স্বাধীনতা। এবং, যে ভুল করে না সে আসলে কিছুই করে না। আবার, মহান আত্মা গান্ধীজীও বলেছেন যে, তিনি ভুল করার
স্বাধীনতা চান, ভুল শোধরানোর স্বাধীনতা চান, ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বাধীনতা চান, হোঁচট খেয়ে পড়ারও স্বাধীনতা চান। অর্থাৎ
স্বাধীনতা মানে ভুল করার স্বাধীনতাও। এখানে সবচেয়ে দুর্দান্ত বক্তব্য দিয়েছেন রোজা লুক্সেমবার্গ। তিনি
বলছেন যে,
‘সবচেয়ে চালাক একটি কেন্দ্রীয় কমিটির অভ্রান্ততার তুলনায় সত্যিকারের
একটি বৈপ্লবিক আন্দোলনের করা ভুলভ্রান্তি সীমাহীন রকমের অধিক কাজের।’
ভাসানীর বর্তমান ইঙ্গিত
বাংলাদেশের ইতিহাসে
কাগমারী সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক। সম্মেলনের পরপরই পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসন কেন্দ্রিক
বিতর্কের জের ধরে মওলানা আওয়ামীলীগ থেকে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেন। শেখ
মুজিব ছিলেন ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী দুজনেরই স্নেহভাজন। সৈয়দ
আবুল মকসুদ জানাচ্ছেন যে, মুজিব চেয়েছিলেন যেন দল না ভাঙ্গে। কিন্তু
ভাসানী তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন,
বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় মওলানা কখনোই পিছপা হন নি। আর
সোহরাওয়ার্দীর সাথে মওলানার যে দ্বন্দ্ব সেটা কোন ব্যক্তিগত কারণে নয়, বরং তা ছিল পুরোপুরি আদর্শিক। মওলানা
তাই নতুন দলই গড়লেন। অবশ্য কেউ কেউ সমালোচনা করে বলেন, আওয়ামীলীগ থেকে বের হয়ে যাওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং আওয়ামী লীগে থেকে ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা উচিৎ ছিল। মওলানা
ভাসানীর রাজনীতি ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়, তিনি
অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেগুলোকে অনেকেই ‘ভুল
সিদ্ধান্ত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বা করে থাকেন। কোনো
নেতাই আসলে
ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। এই আলোচনা আপাতত আজকে না, অন্যদিনের
জন্যে তোলা থাকুক।
এই লেখার অবতারণা করা হয়েছিল মওলানার
পুরো জীবনকে কেন্দ্র করে নয়, শুধু কাগমারী সম্মেলনকেই কেন্দ্র করে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে,
কাগমারী সম্মেলন যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের একটা
বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, তেমনি মওলানা ও তাঁর রাজনীতিকে বুঝতে এই
সম্মেলনের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের অনেকখানিই সাহায্য করবে। বর্তমানে আমরা যে সময়ে রাজনীতি-যাপন করছি সেখানে আমাদের প্রায় সকলেরই – তা ডান হোন
আর বাম হোক – চিন্তাভাবনা প্রচণ্ড পার্টিকেন্দ্রিক। গণতন্ত্রের
জন্যে লড়াই করছে এমন দাবি করনেওয়ালা পার্টিগুলোর ভেতরের কাঠামো চরমমাত্রার
অগণতান্ত্রিক। দলের ভেতর ‘টপ - বোটম’ ক্ষমতা কাঠামোয় তারা আবদ্ধ। এমতাবস্থায়
মওলানা আমাদের জন্যে কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেন। ক্ষমতাকে
সবসময় প্রশ্ন করা তা সে হোক নিজের দল, বা নিজের দলের
সমালোচনা করা, বা পার্টি করেও পার্টিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনায়
আচ্ছন্ন না থাকা – মওলানার এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে আমাদের নতুন
করে নাড়াচাড়া করা বোধহয় খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। মওলানার
একটা উক্তি দিয়েই আলোচনার ইতি টানা যাক,
‘আমি
কমিউনিজম বুঝিনা, লেনিনিজম বুঝিনা, মাওইজমও
বুঝি না, এমনকি আমি মার্ক্সের ক্যাপিটালও পড়ি নাই! তবে, এটা আমি খুব ভালো করেই বুঝি যে পৃথিবীর অধিকাংশ
মানুষই ক্ষুধার্ত!’
দোহাই
১)
সৈয়দ আবুল মকসুদ, কাগমারী সম্মেলন (মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাঙলার স্বাধিকার
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম), প্রথমা প্রকাশক,
২০১৭
২) কামরুদ্দিন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, ধ্রুপদ
সাহিত্যাঙ্গন, ২০০৯(তৃতীয় সংস্করণ)
৩) সেলিম রেজা নিউটন, নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্য এম. এন. রায়ের মুক্তিপরায়নতা প্রসঙ্গে, আগামী
প্রকাশনী, ২০১৩
৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বদেশী সমাজ, রবীন্দ্ররচনাবলী
৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মশক্তি, রবীন্দ্ররচনাবলী
৬) হুমায়ুন আজাদ, রবীন্দ্রপ্রবন্ধ
রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা, আগামী প্রকাশনী, ২০১২
(চতুর্থ সংস্করণ)
৭)
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড
৮) সহুল আহমদ ও সারোয়ার তুষার, সময়ের ব্যবচ্ছেদ,
গ্রন্থিক প্রকাশন, ২০১৯
- প্রথম প্রকাশিত হয় 'বাংলা জার্নাল' ২০১৯ সংখ্যায় (১৭শ বর্ষ, ২৫শ সংখ্যা)।
No comments:
Post a Comment