জহির
রায়হানের ‘গল্পসমগ্রে’ গল্পের সংখ্যা একুশ। হিসেব করলে এই সংখ্যাটা একেবারেই
নিতান্ত, কিন্তু
মাত্র ৩৬ বছরের যে অল্প হায়াত নিয়ে দুনিয়াতে এসেছিলেন সেই সময়ে তার কাজের পরিধির
নিরিখে এই সংখ্যাটাও অনেক বলে মনে হবে। সিনেমা নির্মাণ করছেন, উপন্যাস
লিখছেন, গল্প
লিখছেন—সেই সাথে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন তার সময়কার যাবতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে।
সিনেমার জগতে কোনো সন্দেহ নেই জহির রায়হান এক মহীরুহ; ছোটগল্পেও
তিনি সফল। উপন্যাসের সাথে তুলনা করে কেউ কেউ মন্তব্য করেন যে, উপন্যাসের
চাইতে ছোটগল্পে তার ভাবালুতা কম। বলেছেন, ‘চেতনার উৎসারণে এবং আধার পরিচর্যার
সতর্কতায় ছোটগল্পের রচয়িতা হিসাবেই জহিরের ঔজ্জ্বলতা। সম্ভবত উপন্যাস রচনার মতো
ধৈর্য তার ছিল না।’ শুধু ধৈর্য কেন, হায়াতের কথা মনে রাখলে এও বলা যায়, জীবন তাকে
পর্যাপ্ত সময় দান করে নি। জহির রায়হানের জন্ম-মৃত্যুর বছরটাকে মনে রাখলেই বুঝতে
পারার কথা, জহির
রায়হানের সমগ্র কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে, বিশেষ করে
বর্তমানে বাংলাদেশ নামে দুনিয়ার মানচিত্রে জায়গা করে নেয়া এই ভূখণ্ডের এক উত্তাল
সময়ে। জহির রায়হানের গল্পের সমাজ ও বাস্তবতার হদিস পেতে হলে সে আমলের সমাজকেও
আমাদের আমলে নিতে হবে।
বাংলার
মধ্যবিত্তের উত্থান ও বিকাশ দুটোই ঘটেছিল ঔপনিবেশিক বাস্তবতায়, উপনিবেশের
কোলে। বিনয় ঘোষ তার একাধিক বইতে সেই উত্থান ও বিকাশের চিত্র এঁকেছেন নিপুণভাবে; দেখিয়েছেন
বর্তমানে আমাদের মধ্যবিত্তের যে সঙ্কট ও টানাপোড়ন তার অনেকগুলোর উৎস নিহিত আছে
উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যেই। কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে মধ্যবিত্তের জন্ম হয়েছিল
বিভিন্ন কারণেই সেই মধ্যবিত্ত বাঙালি না হয়ে শুধু হিন্দু-মধ্যবিত্তই হয়ে উঠেছিল।
ফলে ‘সমাজের শ্রেণিবিন্যাসে যে নবরূপান্তর ঘটল তা প্রধানত হিন্দু সমাজকে কেন্দ্র
করে। বাংলার সমাজে নতুন হিন্দু ধনিকশ্রেণি, হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণি ও হিন্দু
বুদ্ধিজীবীদের আধিপত্য বিস্তৃত হলো।’ সেই সাথে ‘বাংলার মুসলমানদের বৃহত্তম অংশ
সমাজের নিচের তলায় নেমে এলেন’। বিদ্বৎসমাজের এই বিকাশে ধারা থেকে মুসলমানদের বাদ
পড়াকে বিনয় ঘোষ বলছেন ‘প্রথম ও প্রধান ট্র্যাজেডি’। মুসলমানদের এই বাদ পড়ার কারণ ‘রাজনৈতিক অভিমান’, ‘অপমান’, ‘ইংরেজদের
প্রতি ক্ষোভ’ ইত্যাকার অনেক বিষয়াদির মধ্যে খোজ নেয়ার প্রবণতা আছে। তবে, এইসব কিছুর
পাশাপাশি শ্রেণিগত একটা দিকও ছিল; বাংলার মুসলমান সমাজের বড় অংশটাই ছিল কৃষকশ্রেণিতে
অন্তর্ভুক্ত। সেই সাথে ‘বাদপড়া’র প্রমাণ
পাওয়া সাহিত্যের ময়দানেও,
দেখা যায় সেই মধ্যবিত্ত যে সাহিত্য রচনা করেছিল তাতে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই
অনুল্লেখিত থেকে যায়। অনেক পরে যখন বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের জন্ম হলো, সে নিজেকে
একটি অসম পরিবেশে আবিষ্কার করল। যার ফলশ্রুতিতে জন্ম নিল প্রতিযোগিতা, সেই
প্রতিযোগিতা হলো হিন্দু মধ্যবিত্তের সাথে মুসলমান মধ্যবিত্তের। একই শ্রেণির দুই
সম্প্রদায়ের এমন প্রতিযোগিতার পরিণাম একেবারে রক্তাক্তভাবে দেশকেই ভাগ করে ছাড়ল।
চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে উপনিবেশক শাসকদের কাছ থেকে মুসলমান সম্প্রদায় যে আনুকূল্য
পেয়েছিল তা একদিকে যেমন তাদের উত্থানে সহযোগিতা করেছিল, অন্যদিকে
তেমনি তাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত কিছু সঙ্কটেরও জন্ম দিল। হিন্দু মধ্যবিত্ত ও
মুসলমান মধ্যবিত্ত দুটোর উত্থান ও বিকাশ হয়েছিল ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে, একে অপরের
বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, কিন্তু একই ঔপনিবেশিক বাস্তবতার মধ্যে। মধ্যবিত্তের যে
আর্থিক-সামাজিক-মানসিক সঙ্কট তার সবগুলোই তাদের মধ্যে ছিল, বা এখনো
আছে।
বাঙলার একই
শ্রেণির দুই সম্প্রদায়ের এই প্রতিযোগিতা দেশভাগ ও পাকিস্তানকে অবশ্যম্ভাবী করে
তুলেছিল। বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্ত যেমন তার শ্রেণিস্বার্থে পাকিস্তানের মধ্যে
স্বপ্ন বুনেছিল তেমনি এই অঞ্চলের নিম্নবর্গও পাকিস্তানের মধ্যে এক ইউটোপিয়া
দেখেছিল। কৃষককুলের কাছে বার্তা গিয়েছিল পাকিস্তান হলেই তাদের সুখের অভাব হবে না, দুঃখের দিন
শেষ। এই স্বপ্নের মধ্যেই পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের ফারাক ছিল। তাই, পাকিস্তান
জন্মের পরপরই বাংলায় শুরু হয়ে গেল আন্দোলন-সংগ্রাম। যে স্বপ্নের জন্যে পাকিস্তানের
জন্ম হলো, সেই
স্বপ্নের কারণেই পাকিস্তান কাঠামোর ভেতর থেকেই যে সংগ্রামের শুরু হলো তার শেষ হলো
পাকিস্তানের কাঠামো ভাঙার মধ্য দিয়ে। যে মধ্যবিত্ত দেশভাগের পূর্বে অন্য
সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্তের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল, সেই
মধ্যবিত্তই দেশভাগের পরে নিজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো।
পাকিস্তান আমলেও মধ্যবিত্তের পরিসর বাড়ছিল, কিন্তু দুই অংশে সমভাবে হচ্ছিল না।
বরঞ্চ, ক্রমাগত
রাষ্ট্রীয় বৈষম্য পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যবিত্তের অসম বিকাশকে আরো ত্বরান্বিত
করেছিল। মধ্যবিত্তের অসম বিকাশ প্রতিযোগিতার জন্ম দিল, সেই
প্রতিযোগিতাই পরবর্তী ইতিহাসের জন্ম দিল। ফলে পুরো পাকিস্তান-আমল জুড়ে
বিদ্রোহে-বিক্ষোভে-আন্দোলনে বাংলাদেশ মুখরিত ছিল। পাকিস্তান আমলের যে আন্দোলন
সংগ্রাম তাতে মধ্যবিত্ত সামনে থাকলেও কৃষক-শ্রমিকসহ নিম্ন শ্রেণির অংশগ্রহণ ছিল
সাফল্যের মূল কারণ।
পাকিস্তান
আমলের শুরু হতে শেষ—এই সময়ের লাগাতার রাজনৈতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক
আন্দোলন ধীরে ধীরে যেমন জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছিল, তেমনি মধ্যবিত্তের আচার-আচরণে বেশ
পরিবর্তনও এনেছিল। পুঁজির হালকা-পাতলা যে বিকাশ হয়েছিল তাতে কাপড়-চোপড় থেকে শুরু
করে ঘরের বাইরে নারীর অংশগ্রহণেও পরিবর্তন এসেছিল। আবার, পূর্ব-বাংলাতেই
মধ্যবিত্ত দুভাগে বিভক্ত ছিল, একভাগ ছিল শাসকদের আশেপাশে, তারা শাসকবর্গেরই উকালতি করতেন, আর বড়
অংশটাই ছিল নিজেদের জন্যে প্রতিযোগিতাহীন পরিবেশ তৈরির পক্ষে। এই অংশটাই
কৃষক-শ্রমিকের পাশে দাঁড়িয়েছিল, জাতীয়তাবোধের উজ্জীবিত হয়ে একধরনের প্রগতিশীল ভূমিকা পালন
করেছিল। রাজনীতি-সংস্কৃতি-সাহিত্য সবখানেই এই দুই অংশ সমানভাবে অংশগ্রহণ করলেও
ধীরে ধীরে একপক্ষ নিস্তেজ হয়ে যায়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও শোষণের ফলে
তৈরি আর্থিক-সামাজিক বাস্তবতাই মধ্যবিত্তের অন্যপক্ষকে ভারি করে তোলে। কিন্তু, ঔপনিবেশিক
বাস্তবতায় জন্ম নেয়া যাবতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তখনও মধ্যবিত্তের সমগ্র দেহের
মধ্যে লেগে ছিল। তাই দেখা যায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন মধ্যবিত্তই যে বেহাত করেছে
এমন আলাপও উঠে এসেছে বুদ্ধিজীবী মহল থেকে।
জহির
রায়হানের গল্প নিয়ে আলোচনার পূর্বে এই মধ্যবিত্তের পথচলা সম্পর্কে জানা প্রয়োজনীয়, কারণ একে তো
তার সমগ্র কাজ-কারবার ওই সময়টাতেই, আবার এখানকার মধ্যবিত্তের মধ্যে
জাতীয়তাবোধ উন্মেষে যে ঘটনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি সেই ভাষা-আন্দোলনে জহির রায়হানের
ছিল সক্রিয়তা। সহজভাবে বললে তিনি সেই আমলেরই একজন মধ্যবিত্ত। তার গল্পেও বিশেষ করে
মধ্যবিত্তের জীবনের যাপনটাই মূর্ত হয়েছে। গ্রামের সামন্তপ্রভুর খবরদারির গল্পও
যেমন উঠে এসেছে, তেমনই
এসেছে নাগরিক মধ্যবিত্তের আবেগ-অনুভূতি, ব্যক্ত-অব্যক্ত আনন্দ-বেদনা। তবে, নাগরিক
মধ্যবিত্তই কেন্দ্রে ছিল। সমালোচকরা বলেন, তার ছোটগল্পের দুনিয়া ‘নাগরিক
মধ্যবিত্তের স্বপ্ন,
সংগ্রাম আর হৃদয়রহস্য নিয়ে গড়ে উঠেছে’। তার মধ্যবিত্তের যেমন ‘সুবিধাবাদী’ বা
‘আর্থিক টানাপোড়নে’র মতো চিরায়ত কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, তেমনি কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যও আছে।
যেমন, তার
চরিত্রগুলোকে অনেক টানাপোড়নের মাঝেও আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। এই
বৈশিষ্ট্যের জন্মও মূলত তার সময়ের খাতিরে। ঢাকাকেন্দ্রিক বিকশিত মধ্যবিত্তকে অনেকে
তিনভাগে বিভক্ত করেছেন,
জাতীয়তাবাদী, স্বতন্ত্রবাদী
ও সমাজতান্ত্রিক। ‘গ্রাম থেকে আসা কিংবা নগরকেন্দ্রিক নব্য শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই
নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বারবার নানামাত্রিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে আবার
স্বতন্ত্রবাদী ধারার মধ্যবিত্ত নগরকেন্দ্রিক জীবনে নিজেদের টিকিয়ে রাখতেই ব্যস্ত
থেকেছে।’ জহির রায়হান এই দিকটা খুব
সচেতনভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। তার অধিকাংশ চরিত্রকে দেখা যায় জীবিকার সন্ধানে গ্রাম
থেকে নগরে আসতে। হয় পরিবার নিয়ে এসেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারকে গ্রামে
রেখেই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শহরে এসেছে; এসে জড়াচ্ছে আন্দোলন-সংগ্রামে।
পাকিস্তান আমলের মধ্যবিত্তের আন্দোলনের দিকে তাকালে তা বোঝা যায়। জহির রায়হান যে
মধ্যবিত্তের ছবি এঁকেছেন তা অনেক সময়ই বিভিন্ন আন্দোলনের প্রেক্ষিতে, আন্দোলনের
ক্যানভাসে।
জহির
রায়হানের সকল কাজ তা সিনেমা হোক, গল্প হোক, বা উপন্যাসই হোক সবখানেই বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের
প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে যেমন উপন্যাস লিখেছেন তেমনি সিনেমাও
বানিয়েছেন, কিংবা
সিনেমা বানানোর পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন। আর, তার একুশটা গল্পের মধ্যে ‘একুশের
গল্প’, ‘মহামৃত্যু’
ও ‘কয়েকটি সংলাপ’, ‘অতিপরিচিত’, ‘সূর্যগ্রহণ’
এই পাঁচটা গল্পে ভাষা আন্দোলনের উপস্থিতিই সেই প্রভাবের প্রমাণ দিচ্ছে। তার এই
গল্পগুলোতে যারা ভাষা আন্দোলনে মারা যাচ্ছে বা অংশগ্রহণ করছে তারা হয় মধ্যবিত্ত
না-হয় নিম্নমধ্যবিত্ত। জহির রায়হান এদের ব্যক্তিত্বের চিত্রায়ণ করেছেন খুব যতনে; এরা সবাই
যুবক, কর্মচঞ্চল, স্বপ্নগ্রস্ত।
‘একুশের গল্পে’র তপু এর চমৎকার উদাহরণ। ‘মহামৃত্যু’তে মৃত্যুকে মহান করে উপস্থাপন
করছেন। এই যে ‘আমাদের নুরুর ছেলে শহীদ’ গুলিতে মারা গেল, তার লাশ
দেখে সবাই খুব আঁতকে উঠল। আঁতকে উঠার দৃশ্য আঁকছেন জহির রায়হান :
কলগোড়ায়
যারা দাঁড়িয়েছিল,
তাঁরাই আর্তনাদ করে উঠল সবার আগে। আ-হা-হা কার ছেলেগো! কার
ছেলে এমন করে খুন হলো!
কোন
মায়ের বুক খালি হলো গো! ..
শেষ
দর্শনের জন্যে মুখের বাঁধনটা খুলে দেয়া হলো ওর।
পল্টুর
মা, ঝুঁকে
পড়ে চুমো খেল ওর কপালে। তারপর চোখে আঁচল চেপে সরে দাঁড়ালো একপাশে।
বুড়ি
দাদী বিড়বিড় করে বলল, হায় খোদা, এজিদের গুষ্ঠি বুঝি এখনও
দুনিয়ার ওপর রেখে দিয়েছ তুমি! হায় খোদা!
আহ।
মা যখন মউতের কথা শুনবে—তখন কী অবস্থা মা’র বলল আরেকজন।
সন্দেহ নেই, মৃত্যুর এমন
বর্ণনার মধ্যে নাটকীয়তা আছে, কিন্তু ভাষা শহিদদের প্রতি যে আবেগের ঢেউ সারাদেশে খেলে
গিয়েছিল তারও একটা নমুনা এই বিবরণ। পাকিস্তানি শাসকদের বুড়ি দাদির ‘এজিদের গুষ্ঠি’
বলে চিহ্নিত করাটাও আমাদের খুব পরিচিত দৃশ্য, এই অঞ্চলের মুরুব্বিরা এখনো যেকোনো
অত্যাচারী ব্যক্তিকে ‘এজিদ’ বলে গালি পাড়েন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যে এমন পথেই
হাঁটা আরম্ভ করেছিল এবং তার পরিণতিতে যা করেছে তা এজিদের গুষ্টির কর্মকাণ্ডের
চেয়েও ভয়ংকর ও নির্মম ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই রাষ্ট্রীয় নির্যাতন
বিভিন্নভাবে ঘুরেফিরে জহির রায়হানের লেখায় এসেছে, তা গল্পে হোক, উপন্যাসে
হোক, আর
সিনেমাতেই হোক। ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো’ এই বাক্য তো পাকিস্তানি শাসকদের
জেল-জুলুমের বিরুদ্ধে এক তীব্র হুঁশিয়ার-বার্তা। ‘সূর্যগ্রহণ’ গল্পে ভাষা আন্দোলন
হাজির হলেও তার মূল ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রভাবের দিকে। মূল চরিত্র তসলীম শহরে
চাকরি করতে আসা একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত; গ্রামে রেখে এসেছে স্ত্রী কন্যা।
তসলীমের কবিতা লেখা,
সারারাত ধরে পোস্টার লেখা, সকাল সকাল মিছিলে বের হওয়া এই সবকিছুই জহির রায়হানের
ভাষা-শহিদ চিত্রায়ণের খুবই পরিচিত দৃশ্য। তসলীম মারা যাচ্ছে ভাষা আন্দোলনে, কিন্তু তার
পরিবারকে সেটা জানতে দেয়া হচ্ছে না। শহর থেকে প্রতি মাসে তসলীমের হয়ে টাকা পাঠান
তারই সহকর্মী আনোয়ার সাহেব। তসলীমের স্ত্রী দিনের পর দিন চিঠি লিখছে, চিঠি গুলো
জমছে আনোয়ার সাহেবের টেবিলে। তসলীমের স্ত্রী লিখছে,
ওগো, আর কতদিন
বাড়ি আসবে না তুমি?
তুমি কি মাস মাস টাকা পাঠিয়েই শুধু নিশ্চিন্তে থাকবে? মা যে তোমার
জন্যে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেলো।
ওগো
…!
তসলীমের
স্ত্রীর এই বিলাপ ভাষা আন্দোলনে শহিদ হওয়া নাম-না-জানা আরো অনেকের
মা-স্ত্রী-কন্যাদের বিলাপই। গল্পে নাটুকেপনা আছে, কিন্তু গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কান্না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, জহির
রায়হানের মূল ঝোঁক ছিল এটা দেখানো যে, রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতি
কী হতে পারে, বিশেষ
করে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কী বেহাল দশা
হতে পারে! অবশ্য, শুধু
ছোটগল্পগুলোকে বিবেচনায় নিলে মনে হতে পারে, জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে শুধু
মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণকেই বড়ো করে দেখেছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলন নিয়ে অন্যান্য কাজ, যেমন একুশে
ফেব্রুয়ারি, আমলে
নিলে এই বিভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব। ভাষা আন্দোলনে যে সকল শ্রেণির অংশগ্রহণ ছিল তার
একটা সহজ-সরল-ছোটখাটো চিত্রায়ণ আছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে।
পূর্বেই
বলেছি, শাসকগোষ্ঠীর
সাথে মহব্বত হয়েছে যে মধ্যবিত্তের তার সুর ছিল অন্যরকম। সে-রীতি মোতাবেক
শাসকগোষ্ঠীর জবানেই কথা বলেছে। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাঙলার বিরোধিতা করেছে, অজুহাত
নিয়েছে ধর্মের। ‘অতিপরিচিত’ গল্পের ট্রলির বাবা আসলামকে বলছেন :
এদেশের
ছেলেমেয়েগুলো সব গোল্লায় গেছে। উচ্ছন্নে গেছে সব। নইলে ইসলামি ভাষা ছেড়ে দিয়ে ঐ
কুফুরি ভাষার জন্যে এত মাতামাতি কেন?
এই ট্রলির
বাবা যেমন মধ্যবিত্তেরই অংশ, তেমনি ‘কয়েকটি সংলাপ’ গল্পে যারা সংলাপ দিচ্ছে তারাও
মধ্যবিত্ত। এরা একসময় সংগ্রাম করেছে, আন্দোলন করেছে, আবার এরাই
আন্দোলন-সংগ্রাম উদ্যাপনের নামে ভাঁড়ামি করছে। এই গল্প লেখা হয়েছে ১৯৭১ সালের
ফেব্রুয়ারি মাসে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে তখন শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত করা
হয়েছে তারই একটা নমুনা। অবশ্য, বর্তমানে পুঁজিবাদের আশীর্বাদে একুশে ফেব্রুয়ারিকে যতটা
ফাঁপা-আবেগের স্তরে নামিয়ে বাজার ও মুনাফামুখী করা হয়েছে তা বোধহয় জহির রায়হানও
চিন্তা করতে পারেন নি। তবে,
এই গল্পের সবচেয়ে বড় দিক হলো এই যে, একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাস হয়ে গেলেও
এটা বোধহয় কেউই আন্দাজ করতে পারেন নি আর মাত্র একমাস পর এই ভূখণ্ডের মানুষদের
জীবনে কত বড় ঢেউ আসতে যাচ্ছে!
মধ্যবিত্ত
শোষক ও শোষিত এই দুই ভূমিকাতেই সমান্তরালে সরব থাকে। পুঁজিপতি শ্রেণির চরিত্র ও
মজুর শ্রেণির চরিত্রের খিচুড়ি তাদের
শ্রেণিচরিত্র। সে প্রতিনিয়ত উপরে উঠতে চায়, উচ্চবিত্তের কাতারে যেতে চায়, প্রয়োজনে
দলিয়ে-মাড়িয়ে যাবে নিম্নবিত্তকে। আবার দরকার হলে নিম্নবিত্তকে কোলেও টেনে নিতে
পারে, দরকার
শেষ হলে ছুড়েও ফেলে দিতে পারে। যার ফলে মধ্যবিত্ত সর্বদাই একটা টানাপোড়নের মধ্যে
থাকে। আর্থ-সামাজিক টানাপোড়ন জন্ম দেয় মানসিক টানাপোড়নের। তাই, ‘সামাজিক
রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ ও উত্থান-পতনে বিচলিত দোদুল্যমান এই শ্রেণি।
মধ্যবিত্তের কাছে হতাশা-বোধ, দুঃখ-যন্ত্রণা-বিলাস অনেক গুরুত্ববহ।’ আপোসকামিতা যেমন দানা
বাঁধে তেমনি শ্রেণি-স্বার্থ তাকে বিপ্লবীও বানিয়ে দেয়। আবার, সাংস্কৃতিক
দিকে মধ্যবিত্ত একটা বিপদে পড়ে থাকে। জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যায়, জনসংস্কৃতির
সাথে তাদের যোগাযোগ রহিত হয়ে যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যাকে বলছেন ‘সংস্কৃতির
ভাঙা সেতু’, যে
ভাঙা সেতুর কাছে এসে আমাদের বৈপ্লবিক রাজনীতিও মার খেয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতার সাথে
আবার ঔপনিবেশিক বাস্তবতার সম্পর্ক বিদ্যমান। উপনিবেশায়ন নিয়ে যারাই আলাপ আলোচনা
করেছেন তারা বারেবারে এই বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গ এনেছেন, কিভাবে
উপনিবেশের ফলেই সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর থেকে এখানকার মধ্যবিত্ত বা অভিজাতরা
বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখিয়েছেন কিভাবে এই জনবিচ্ছিন্নতার ফল
পড়েছিল সেই আমলের গদ্যেও।
পূর্বেই
উল্লেখ করা হয়েছে, জহির
রায়হান নিজেও পাকিস্তান আমলের আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, প্রায় প্রত্যেকটাতেই। তাই, মধ্যবিত্তের
সুখ-দুঃখ, টানাপোড়ন, আপোসকামিতা
সব তিনি তুলে এনেছেন আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই। এ-স্থলে ‘কয়েকটি সংলাপ’ গল্পের
কথা যেমন বলা যায়, তেমনি
বলা যায় ‘পোস্টার’ গল্পের কথা। আমজাদ সাহেব একজন আদর্শ ‘বিচ্ছিন্ন’ মধ্যবিত্ত।
সদ্য চুনকাম করা বাড়ির দেয়ালে কারা যেন পোস্টার লাগিয়ে যায়। ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস
হোক’, ‘বাঁচার
মতো মজুরি চাই’ ইত্যাদি লেখা সম্বলিত পোস্টার দেখে আমজাদ সাহেবের মেজাজ চটে যায়।
পাশের বাড়ির একজন এই পোস্টার লাগানেওয়ালা ছেলেদের প্রশংসা করলে তিনি উনার উপরও চটে
যান। অফিস থেকে যেদিন ছাঁটাই করা হলো আমজাদ সাহেবকে সেদিনও হতাশাগ্রস্ত আমজাদ সাহেব
দেখলেন তাদের দেয়ালে একটা ছেলে পোস্টার লাগাচ্ছে। পোস্টার লাগানেওয়ালাকে ধরতে
গিয়েও থমকে দাঁড়ান আমজাদ হোসেন, কারণ পোস্টারে লেখা, ‘ছাঁটাই করা চলবে না।’ শ্রেণিস্বার্থ
কিভাবে মধ্যবিত্তকে চালিত করে তার একটা অসাধারণ নমুনা হচ্ছে ‘পোস্টার’।
জহির রায়হান
মধ্যবিত্তের টানাপোড়নের চিত্রও তুলে ধরেছেন ‘সোনার হরিণ’, ‘হারানো বলয়’, ‘ভাঙাচোরা’, ‘জন্মান্তর’
গল্পে। ‘সোনার হরিণে’র দম্পতির কাছে ফার্নিচারগুলো সোনার হরিণই থেকে যায়। তার
আকাঙ্ক্ষা, তার
চাহিদা পূরণ হয় না। চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে জন্ম নেয়া ব্যবধানটুকু দশ বছর পার হয়ে
গেলেও ঘুচে না। ‘হারানো বলয়’ গল্পের প্রতিটা পরতে পরতে জুড়ে আছে কান্না। ভাই জেলে, এক বোন
মরণাপন্ন, এমতাবস্থায়
পরিবারকে টানছে আরজু। পারছে না। আলম তার দুঃখের সারথি হতে চায়, কিন্তু সেও
কিভাবে পারবে? তার
দেনা শোধ করতে হবে, বাড়িতে
মা-বোনদের জন্যে কাপড় পাঠাতে হবে। ‘অন্ধকার—চারদিকে যেন অন্ধকার’। এই অন্ধকার
মধ্যবিত্তের চরিত্রকে ‘সুবিধাবাদী’ বানায়, ‘আপোসকামী’ করে তুলে। জহির রায়হান
জানতেন এই সংকটের মূলে আছে অর্থনীতি, মূলে আছে টাকা। বারেবারে সেখানেই
গিয়েছে তার চরিত্রের আর্তনাদ।
নাগরিক
মধ্যবিত্তের এই টানাপোড়নের সবচেয়ে করুণ চিত্র পাওয়া যায় ‘ভাঙাচোরা’ গল্পে। সংসার
চলে না, স্বামী
রাতে স্ত্রীকে লুকিয়ে রিকশা চালান, আর স্ত্রী স্বামী থেকে লুকিয়ে অন্যের
বাসায় রান্নাবান্নার কাজ করেন। দুজনের আর্জি একই, অন্যে যেন এই খবর না জানে। স্ত্রীর
আর্জি—
পিয়নের
কাজ করলে কি হবে। লোকটার প্রেসটিজ জ্ঞান বড় টনটনে। খবরদার। আমি যে মেসের ভাত পাক
করে দিই, ঘুণাক্ষরেও
এ কথাটা বলো না ওকে।
অন্যদিকে
স্বামীর আর্জি—
দোহাই
আপনার সালাম সাহেব। ও কথাটা বলবেন না টুনুকে। প্রেস্টিজ জ্ঞান বড় টনটনে ওর! জানতে
পারলে কেলেঙ্কারি কিছু-একটা ঘটিয়ে বসবে। দোহাই আপনার!
এই টনটনে
প্রেস্টিজ জ্ঞানের সাথে আর্থিক অনটন এইসবই মধ্যবিত্ত জীবনের নিয়মিত দৃশ্য।
‘জন্মান্তর’ গল্পেও সেই আর্থিক টানাপোড়নের ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দিনে পনের ঘণ্টা
কাজ করেও পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, এই তথ্য একজন পকেটমারের কাছেও অদ্ভুত
ঠেকে। ‘মাগো, হাড়িতে
কি একটা ভাতও নেই। পেটটা যে পুড়ে গেল।’ এই কান্না পকেটমার মন্তুর কাঠিন্য-ভরা
প্রাণটাকেও নরম করে দেয়। তার মানবিকতায় ‘রাহুমুক্ত চাঁদ খলখলিয়ে হাসছে আকাশে’।
জহির রায়হান
মুক্তিযুদ্ধে খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও; কিন্তু
মুক্তিযুদ্ধের মাত্র এক-দেড় মাসের মধ্যেই ঘাতকদের হাতে শহিদ হোন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে
মাত্র একটা গল্পই লিখতে পেরেছিলেন, ‘সময়ের প্রয়োজনে’ নামে। গল্পে
পাকিস্তান বাহিনীর নির্মমতা-নৃশংসতার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মানুষের
বিচিত্রতা, তাদের
আশা-আকাঙ্ক্ষার বহুমাত্রিকতাকে নিপুণভাবে আঁকতে পেরেছিলেন। এই গল্পের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে,
ইতিহাস বা ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে বিচার-বিবেচনা করার জহির রায়হানের একটা
নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি। জহির যাকে বলছেন ‘সময়ের প্রয়োজনে’, কেউ কেউ একে
বলছেন ‘ইতিহাসের প্রয়োজনে’। বিশেষ করে, বাংলাদেশের ইতিহাস আলোচনায় এই ‘প্রয়োজন’কে
বুঝতে না পারলে এর বিচিত্র গতিপথ বোঝাও মুশকিলের হবে। মুক্তিযুদ্ধের যে ছবি তার
গল্পে পাই তার একটা নমুনা নিচে দিলাম—
খবর
পেয়েছি মা, বাবা, ভাই, বোন ওরা
সবাই কোথায় যেন চলে গেছে। হয়তো কোনো গ্রাম, কোনো গঞ্জে। কোনো উদ্বাস্তু
শিবিরে। কিংবা—
না।
ওটা আমি ভাবতে চাই না।
জয়ার
কোনো খবর নেই। কোথায় গেল মেয়েটা?
জানি
না। জানতে গেলে ভয় হয়।
শুধু
জানি, এ
যুদ্ধে আমরা জিতব আজ, নয় কাল। নয়তো পরশু।
একদিন
আমি আবার ফিরে যাব। আমার শহরে, আমার গ্রামে। তখন হয়তো পরিচিত অনেক
মুখ সেখানে থাকবে না। তাদের আর দেখতে পাব না আমি। যাদের পাব তাদের প্রাণভরে
ভালোবাসব।
যারা
নেই কিন্তু একদিন ছিল, তাদের গল্প আমি শোনাব ওদের।
সেই
ছেলেটির গল্প। বুকে মাইন বেঁধে যে ট্যাংকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
কিংবা
সেই বুড়ো কৃষক। রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে যে মৃদু হেসে বলেছিল, চললাম। আর
ফিরে আসেনি। অথবা উদ্বাস্তু শিবিরের পাঁচ লাখ মৃত শিশু।
দশ
হাজার গ্রামের আনাচে-কানাচে এক কোটি মৃতদেহ।
না
এক কোটি নয়, হয়তো
হিসাবের অঙ্ক তখন তিন কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
এক
হাজার এক রাত কেটে যাবে হয়তো। আমার গল্প তবু ফুরাবে না।
নাগরিক
মধ্যবিত্তকে ছেড়ে জহির রায়হান যখন গ্রাম-গঞ্জে প্রবেশ করেন সেখানেও তার ঝোঁক
গ্রামের সামন্তশাসন ও কুসংস্কারচ্ছন্নতা তুলে আনার দিকে। গ্রামের মানুষদের
অশিক্ষা-দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে
পীর-মহাজনদের উৎপাত বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে ‘বাধ’, ‘অপরাধ’, ‘ইচ্ছা
অনিচ্ছা’ প্রভৃতি গল্পে। আবার ‘জিজ্ঞাসা’ গল্পে এদের ধর্মীয় পীড়নের বিরুদ্ধে
করমআলীর মেয়ের জিজ্ঞাসা ‘হজে গেলে কিতা অয় বাবজান’ রীতিমতো একটা বিদ্রোহই বটে। এই
প্রশ্ন যত না ধর্মীয় আঙ্গিকে, তার চেয়ে ঢের বেশি আর্থ-সামাজিক। হজে গেলে যেহেতু সকল গোনাহ
মাফ হয়ে যায়, গুনাহ
মাফ করার অধিকার কি শুধু টাকা-পয়সাওলাদেরই আছে? মেয়ের প্রশ্ন বাপকে গভীর ভাবনায় ফেলে
দেয়। এই ভাবনা পরিবর্তনের। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া পাওয়া যায় ‘স্বীকৃতি’ গল্পে। যে
নারী সমাজের কাছে মাথা পেতে সংসারধর্মকেই পরমধর্ম মেনে নিয়েছিলেন তার মেয়ে যখন
মিছিল-মিটিং-এ যায়, থাপ্পড়
খেয়েও পথ থেকে সরে দাঁড়ায় না, এই পরিবর্তনকে তখন সেই নারীর মেনে নিতেই হয়। চেষ্টা করেও এই
দিন বদলকে অস্বীকার করা সম্ভব হয় না। নারীর জীবনে এই পরিবর্তনই ‘বিপ্লবী ঝড়ো
হাওয়া’। পাকিস্তান আমলের পঁচিশ বছরকে মাথায় রাখলে বাঙালি মুসলমান নারীর জীবনেও একই
ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সমাজ-ধর্মের ঘোরটেপে নারীর বন্দিত্ব বিভিন্নভাবেই
জহির রায়হানের গল্পে এসেছে।
‘অপরাধ’ গল্পের সালেহা স্বামীর বাড়ি
থেকে পালিয়ে এলেও মুক্তি মিলে না, রক্তবমি করতে করতেই মারা যায়। এই সালেহারা এখনো আমাদের
সমাজে আছেন। সালেহাদের সংখ্যা কমেছে ঠিকই, তবে সেটা যে সন্তোষজনক হারে নয় তা এই
সময়ের যেকোনো পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তবে, জহির রায়হান
এদের মুক্তি দিতে চান। এক প্রজন্ম না পারলে, পরের প্রজন্মকে মুক্তি দিতে চান।
‘নয়া পত্তন’ তো সেই নতুন শুরুর গল্পই। সরকার-জমিদার কাউকে দিয়ে হচ্ছে না; কারো
মুখাপেক্ষী না হয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষরা নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে সকল
কাজকারবার। ভেঙে পড়া স্কুলটারে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে নিজেরাই। বলছে, ‘গরমেন্টোরে
আর চৌধুরীদের আইনা একবার দেখাইলে ভালা অইবো পণ্ডিত। তাগোরে ছাড়াও চইলবার পারি
আমরা’। এই গল্পের শিক্ষা বিভাগের বড় সাহেব আমাদের উল্লিখিত ‘বিচ্ছিন্ন’
মধ্যবিত্তেরই উদাহরণ। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে স্কুলে পড়বে সেই স্কুল মেরামত করার
জন্যে সামান্য বাজেট দেয়া সম্ভব হয় না, কারণ ‘রাজধানীতে দুটো নতুন হোটেল
তুলে, আর
সাহেবদের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা ইংলিশ স্কুল দিতে গিয়ে প্রায় কুড়ি লাখ টাকার মতো
খরচ’। ‘বাধ’ গল্পটাও মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়
অতিপ্রাকৃত কিছুতে বিশ্বাস না করে, পীরদের দোয়া-দুরুদ উপেক্ষা করে, গ্রামের
মানুষদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। ‘দেমাক’
গল্পের রহিম শেখের দেমাকের মূল উৎসই হচ্ছে সে কাজ করে খায়, নিজের হাতে
নিজের রোজগার করে। অন্যের ঘাড়ে পুঁজি খাটিয়ে বসে বসে মুনাফা লুটে না। সে দুর্ঘটনায়
পড়ে, চোখ
হারায়। তবু দেমাক কমে না। কারণ সে তখনও কাজ করে খায়। কাজই তার গর্ব। জহির রায়হান
যে পরিবর্তন চান সে পরিবর্তন আসতে হলে এই মানুষদের হাত ধরেই আসতে হবে। এই
বোঝাপড়াটাই জহির রায়হানের রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য।
এ তো গেল
দেশীয় পরিস্থিতি। জহির রায়হান যখন দিনযাপন করছেন তখন শুধু তার দেশই নয়, সারা
দুনিয়াই এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দুনিয়া দেখে
ফেলেছে। সে-যুদ্ধের এক নির্মম প্রভাব পড়েছিল ভারতবর্ষে, বিশেষ করে
এই বাঙাল দেশে। দুর্ভিক্ষ। বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এই দুর্ভিক্ষের
ফলে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্যে ব্রিটিশ, বিশেষ করে চার্চিলের পলিসিই দায়ী। এ
যেন আরেক জেনোসাইডই। ইউরোপে চলেছে হিটলারের জেনোসাইড, এশিয়া-আফ্রিকাতে
চলেছে ইউরোপের জেনোসাইড। ‘ম্যাসাকার’ গল্পে তার একটা চিত্রায়ণ আছে—
পথে
পথে মোড়ে মোড়ে আর রাস্তার আনাচে-কানাচে বসে বসে ঠুকছে, রক্ত-মাংসহীন
শবের দল; এক
নয়, দুই
নয়, হাজার
হাজার। পথের কুকুর আর আকাশের শকুনদের ভোজসভা বসেছে নর্দমার পাশে। আধমরা
মানুষগুলোকে টানা হ্যাচড়া করে মহা উল্লাসে ভক্ষণ করছে ওরা। দ্বিতীয় মহাসমর। আর
দুর্ভিক্ষ—জর্জরিত সোনার বাংলা, চারদিকে শুধু হাহাকার, অন্ন নেই।
বস্ত্র নেই। নেই! নেই! কিছু নেই! শুধু আছে দুর্ভিক্ষ, মহামারি আর
অভাব অনটন।
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে শান্তি আসে নি, ভিয়েতনামে আমেরিকার নৃশংস হামলা
দেখেছে মানুষ। আবার,
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তখন উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম চলছে। আমেরিকায় চলেছে
বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামও। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চালিয়েছে একের পর এক যুদ্ধ, বিপরীতে
একদল মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন যুদ্ধবিরোধী প্ল্যাটফর্মে। জহির রায়হান ছিলেন যুদ্ধবিরোধী
ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শিবিরে। ‘ম্যাসাকার’ গল্পটি তার যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের
বহিঃপ্রকাশ। এই যুদ্ধ কোথায় হচ্ছে উল্লেখ নেই। হতে পারে আফ্রিকা, হতে পারে
ভিয়েতনাম, হতে
পারে ভারতবর্ষের কোনো স্থান, হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এলাকা। তবে দৃশ্য একই।
বিপর্যস্ত মানবতা, বিধ্বস্ত
মানবসমাজ। ভয়াবহতা ও বীভৎসতা একই। জাতি-রাষ্ট্র-ধর্মের নামে চলছে হত্যাযজ্ঞ।
আক্রান্ত হচ্ছে নারী। অথচ প্রত্যেক খুনিগুলোকে রাষ্ট্র মাথায় তুলে নাচছে, পুরস্কৃত
করছে। যুদ্ধের চেয়ে মারাত্মক ব্যাধি আর কি আছে দুনিয়ায়? প্লেগের মতো
মহামারিরও তো ওষুধ আছে,
কিন্তু যুদ্ধের মতো মহামারির জন্যে কি কোনো ঔষধ আছে? এই প্রশ্নের
সম্মুখীন হয়ে গল্পের ডাক্তার অসহায় হয়ে পড়েন। দুঃখ-দুর্দশা-অভাব-হিংসা-দ্বেষ এইসব
থেকে কিভাবে এই পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়। গল্পের ডাক্তার কিছুই জানেন না, শুধু
একপর্যায়ে যুদ্ধবাজ মেজর কলিন্সের মুখে চড় বসিয়ে দেন। এই চড়ই, তার ভাষায়, ‘শান্তি
সংগ্রামের পথে আমার প্রথম পদক্ষেপ’। জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ সিনেমার সাথে
মিলিয়ে পড়লে গল্পের কলকব্জাসহ জহির রায়হানের রাজনৈতিক মোটিভ বোঝা সহজতর হয়ে যায়।
জহির
রায়হানের গল্প তার অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং একই
কাতারে আসীন। তিনি তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে ‘নিপীড়িত মানুষের বিশ্বাস-সংস্কারে
সংগ্রাম আর সচেতনতার আলো সঞ্চার করেছেন’। শাসকের হুঁশিয়ারি তার পথ থেকে তাকে সরাতে
পারে নি। সিনেমা বানাতে গিয়ে নানান প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে যাওয়া তার সংগ্রামেরই
প্রমাণ। এর বাইরে, প্রায়
প্রত্যেক সমালোচকই তার ছোটগল্পকে বেশ উচ্চ আসনে বসিয়েছেন। আফজালুল বাসার তো বলেছেন
:
উপন্যাসগুলোর
সামগ্রিকতা ও বিস্তৃতির অভাব দেখে মনে হয় জহিরের রচনায় অব্যক্তের অংশ অধিক। কিন্তু
ছোটগল্পে তিনি তার রচনার সাধারণ প্রাঞ্জলতা রক্ষা করেও শুরু ও শেষের চমকে, চরিত্রায়নে, অনুভূতির
দৃঢ়করণে কিংবা প্লট-গতির সামঞ্জস্য বিধানে চমৎকার কৃতি প্রদর্শন করেছেন।
কোনো সন্দেহ
নেই, তার
গল্পের কেন্দ্রে আছে মধ্যবিত্তের জীবন, সে জীবনের আকুতি-মিনতি। তিনি খুব
সার্থকভাবে দেখাতে পেরেছেন যে, মধ্যবিত্তের মানসিক টানাপোড়ন তার আর্থ-সামাজিক টানাপোড়নের
মধ্যেই নিহিত। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন বাংলাদেশের এক বিশেষ সময়ের মধ্যবিত্তের
বিচিত্র কর্মকাণ্ড ও নানান চরিত্র। বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে জহিরের সক্রিয় অংশগ্রহণের
কারণেই তার বিভিন্ন গল্পে ঘুরেফিরে এসেছে আন্দোলন-সংগ্রাম। সেই আন্দোলনে
মধ্যবিত্তের শুভ-অশুভ,
বিদ্রোহী-আপোসকামী বিপরীতধর্মী দুই বৈশিষ্ট্যই হাজির হয়েছে। তার ছোটগল্পের
মধ্যবিত্তরা যে কারণে আন্দোলন-সংগ্রামে জড়াচ্ছে, একজন মধ্যবিত্ত হিসেবে বিভিন্ন
আন্দোলনে তার অংশ নেয়ার কারণ কি তা-ই? উত্তর ইতিবাচক হতে পারে, আবার
বামপন্থি রাজনীতিতে তার সক্রিয়তার কারণে অনেকে হয়তোবা এই প্রশ্নের উত্তর অন্যভাবে
দিতে পারেন। এই প্রসঙ্গ না-হয় তোলা থাক আপাতত।
________________________________________
তথ্যসূত্র :
১)
গল্পসমগ্র, জহির
রায়হান, অনুপম
প্রকাশনী।
২) অনুপম
হায়াৎ, জহির
রায়হানের চলচ্চিত্র পটভূমি বিষয় ও বৈশিষ্ট্য, দিব্য প্রকাশ।
৩) বিনয় ঘোষ, মেট্রোপলিটন মন।
৪) বিনয় ঘোষ, বাংলার
বিদ্বৎসমাজ।
৫)
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস,
সংস্কৃতির ভাঙা সেতু,
মাওলা ব্রাদার্স।
৬) সিরাজুল
ইসলাম চৌধুরী, উনিশ
শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা।
৭)
সলিমুল্লাহ খান, বেহাত
বিপ্লব ১৯৭১, আগামী
প্রকাশনী।
৮) শারমিন
আক্তার, জহির
রায়হানের ছোটগল্পে মধ্যবিত্তের জীবন, সাহিত্য পত্রিকা, বর্ষ: ৫২, সংখ্যা ১, কার্তিক
১৪২১, অক্টোবর, ২০১৪
No comments:
Post a Comment