Friday, February 2, 2018

গণহত্যা, প্রোপ্যাগান্ডা এবং দৈনিক সংগ্রাম

       


ভূমিকা

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দশক থেকে শেষ দশক পর্যন্ত - আর্মেনিয়া থেকে শুরু করে নাৎসি জার্মানি, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ), বসনিয়া, কম্বোডিয়া হয়ে রুয়ান্ডা পর্যন্ত - পৃথিবী এত বেশী সিস্টেমেটিক হত্যাযজ্ঞ দেখেছে এবং এত অধিক সংখ্যক প্রাণহানি হয়েছে যে গত শতাব্দীকে রক্তাক্ত শতাব্দীবললে অত্যুক্তি হবে না। শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ‘genocide’ বলতে একটা নতুন শব্দ তাই প্রবর্তন করতে হয়। এই গণহত্যা কখনো হুট-হাট করে ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনা নয়, বরং এটা সবসময়ই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ফসল হয়ে থাকে। কোন একক প্রভাবকের দ্বারা কখনোই এটা প্রভাবিত হয় না, একটি সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামোগুলোও বেশ প্রভাব রাখে এতে। গণহত্যা চলাকালীন সময়ে হত্যাযজ্ঞে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে, গণহত্যার তীব্রতা বাড়াতে এবং গণহত্যাকে বৈধতা দিতে আক্রমণকারীর প্রয়োজন পড়ে ব্যাপক প্রোপ্যাগান্ডার। এই প্রোপ্যাগান্ডার ধরণ এবং মাত্রা সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবুও, তাদের মধ্যে কতক সাধারণ মিল লক্ষ্য করা যায় সবসময়। জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রগতির সাথে সাথে গণহত্যা এবং তাতে প্রোপ্যাগান্ডার ব্যবহারেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের সংগঠিত গণহত্যায় পাকিস্তানিদের সহযোগী গোষ্ঠীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামএর অবদান কেমন ছিল এবং গণহত্যার তীব্রতা বাড়াতে তাদের ভূমিকা কতটুকু ছিল, তাই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য। শুরুতেই, তাইসংক্ষেপে গণহত্যা এবং প্রোপ্যাগান্ডা বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তীতে, উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং রুয়ান্ডার ঘটনার দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। 

গণহত্যা

লিও কুপার তাঁর বইয়ের শুরুতেই বলেছিলেন, ‘গণহত্যাশব্দ আমাদের জন্যে নতুন হলেও অপরাধটা পুরনো। আসলেও তাই; মানব ইতিহাসে প্রচুর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনার উপস্থিতি থাকা স্বত্বেও একে আলাদা কোন শব্দে চিহ্নিত করা হয় নি এতদিন।  রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে তাঁর বইতে প্রথম এই শব্দ ব্যবহার করেন, অনেকটা হোমিসাইড, এথনিসাইড এর মতো করে [1]Homo মানে মানুষ এবং তাই হোমিসাইড মানে নরহত্যা (একজনকে হত্যা), আবার অন্যদিকে Geno মানে গোষ্ঠী, তাই জেনোসাইড মানে গোষ্ঠীসহ হত্যা। পরবর্তীতে, বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে বহু আলাপ আলোচনার পর জাতিসংঘের গণহত্যা অধিবেশন১৯৪৮ সালে গণহত্যার আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করে, অবশ্য ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শেষ হয়ে গিয়েছে। সেখানে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে গণহত্যার সংজ্ঞা দেয়া আছে। 
‘genocide means any of the following acts committed with intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnical, racial or religious group, as such:
(a) Killing members of the group;
(b) Causing serious bodily or mental harm to members of the group;
(c) Deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in whole or in part;
(d) Imposing measures intended to prevent births within the group;
(e) Forcibly transferring children of the group to another group.’[2] 

উপরোক্ত সংজ্ঞাতে দুটি উপাদান আছে, এক, বাহ্যিক উপাদান (মানে কোন কোন কাজ করলে গণহত্যা হবে) এবং দুই, অন্তর্গত উপাদান (হত্যার উদ্দেশ্য, হত্যার মাত্রা, এবং রক্ষিত গোষ্ঠী)।  সংজ্ঞার এই দুই উপাদানের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা নিয়েও প্রচুর আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। যেমন, লেমকিন প্রথমেই যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন সেখানে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ছিল, প্রথমত, তিনি একটা রাষ্ট্রের ভেতরে সবগুলো গোষ্ঠীকেই (racial, religious, political and other) রক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং, দ্বিতীয়ত, তিনি সাংস্কৃতিক গণহত্যার কথাও বলেছিলেন।[3] কিন্তু অধিবেশন যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করে সেখানে রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র চারটা দলকে (national, ethnical, racial, religious group) অন্তর্ভুক্ত করে। এমনকি প্রথমে যে খসড়া দেয়া হয়, সেখানেও রাজনৈতিক দল অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু  সোভিয়েত ইউনিয়নসহ আরও অনেকের প্রবল আপত্তির কারণে, প্রচুর তর্ক বিতর্কের পর, এটা বাদ দেয়া হয়।[4] রাজনৈতিক দলকে রক্ষিত গোষ্ঠীহতে বাদ দেয়ার সমালোচনা এখনো চলছে, কেননা, যে কোন রাজনৈতিক দলের উপরও আক্রমণ হতে পারে। পূর্বে ধর্ম-বর্ণ-জাতি গোষ্ঠীর উপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতে সেটা রাজনৈতিক দলের উপর হতেও পারে - এমন আশঙ্কাও অনেকদের মধ্যে ছিল। এছাড়া, প্রতিটা গণহত্যার মধ্যেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। তাই, বর্তমানে অনেক গবেষকই যখন গণহত্যার সংজ্ঞা দাড় করান তারা সেখানে এই অন্তর্ভুক্তিটা করে নেন।  

একইভাবে অধিবেশনে সাংস্কৃতিক গণহত্যা বা এথনোসাইডের প্রসঙ্গেও প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়। প্রথম যে খসড়া উত্থাপন করা হয়, সেখানে মূলত তিন ধরণের গণহত্যার কথা উল্লেখ ছিল[5]এক, ‘শারীরিকগণহত্যা (হত্যা করা), দুই, ‘জৈবিকগণহত্যা ( জন্মদানে বাধা দেয়া) এবং তিন, ‘সাংস্কৃতিকগণহত্যা। সাংস্কৃতিক গণহত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল, কোন গোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের ভাষা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, নিজস্ব ভাষার প্রকাশনার প্রচারে বাধা দেয়া, এবং, সে গোষ্ঠীর স্কুল কলেজ, লাইব্রেরী, জাদুঘর ইত্যাদি ধ্বংস করা।[6] খসড়ায় সাংস্কৃতিকগণহত্যার এই অন্তর্ভুক্তিও বিতর্কের জন্ম দেয়। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, এখানে গণতন্ত্রের পতাকাবাহী ইউরোপীয় দেশগুলো এই অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে এবং, সোভিয়েত ব্লক অন্তর্ভুক্তির পক্ষে রায় দেয়। ইউরোপিয়ানরা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেননা, উপনিবেশায়নের মাধ্যমে তারা সকলেই সাংস্কৃতিক গণহত্যা চালিয়েছেন এশিয়া ও আফ্রিকায়।  যার ফলে, সাংস্কৃতিক গণহত্যা বাদ পড়ে যায় সংজ্ঞা থেকে, যদিও  নিদর্শনস্বরূপ (যেমন, পাঁচ নম্বর পয়েন্ট) কিছু ছিটেফোঁটা রয়ে যায়।     

হত্যার উদ্দেশ্য এবং হত্যার মাত্রা নিয়েও প্রচুর আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে এই সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। যদিও, এই সংজ্ঞার কিছু সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান, তবু প্রায় সকলেই এটাকে গ্রহণ করেছেন এবং এখন পর্যন্ত এর ভিত্তিতে গণহত্যাকে চিহ্নিত করা হয়। যেমন লিও কুপার বলেন, যদিও পুরোপুরি একমত না, তবু আমি কনভেনশনে দেয়া গণহত্যার সংজ্ঞাকেই মেনে নেব। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে গবেষকরা গণহত্যার যে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন, এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন তার কয়টা দেখা যাক। [7]

Genocide is the deliberate destruction of physical life of individual human beings by reason of their membership of any human collectivity as such.  - Peter Drost (1959)

Genocide is] a structural and systematic destruction of innocent people by a state bureaucratic apparatus. …Genocide represents a systematic effort over time to liquidate a national population, usually a minority…[and] functions as a fundamental political policy to assure conformity and participation of the citizenry. - Irving Louis Horowitz (1976)

Genocide is the deliberate destruction, in whole or in part, by a government or its agents, of a racial, sexual, religious, tribal or political minority. It can involve not only mass murder, but also starvation, forced deportation, and political, economic and biological subjugation. Genocide involves three major components: ideology, technology, and bureaucracy/organization - Jack Nusan Porter
Genocide occurs when a state, perceiving the integrity of its agenda to be threatened by an aggregate population—defined by the state as an organic collectivity, or series of collectivities—seeks to remedy the situation by the systematic, en masse physical elimination of that aggregate, in toto, or until it is no longer perceived to represent a threat. - Mark Levene (2005)

Genocide is sustained purposeful action by a perpetrator to physically destroy a collectivity directly or indirectly, through interdiction of the biological and social reproduction of group members, sustained regardless of the surrender or lack of threat offered by the victim. - Helen Fein

Genocide is a form of one-sided mass killing in which a state or other authority intends to destroy a group, as that group and membership in it are defined by the perpetrator. - Frank Chalk and Kurt Jonassohn

ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রয়, রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির কারণে, এই শেষোক্ত সংজ্ঞাকেই যথাযথ বলে মনে করেন।[8] পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বর্তমানে অনেক গবেষকই  তাদের প্রদত্ত সংজ্ঞাতে রাজনৈতিক দলকেও রক্ষিত গোষ্ঠীতে রেখেছেন, তাঁর প্রমাণ উপরেই দেখা যাচ্ছে। উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোতে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে, যেমন, আক্রমণকারী, আক্রান্ত গোষ্ঠী, হত্যার উদ্দেশ্য, হত্যার মাত্রা এবং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আক্রমণকারী কাউকে যখন আক্রমণ হত্যা করবে শুধুমাত্র সে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে, আংশিক কিংবা পুরোপুরি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে, পরিকল্পিত উপায়ে তখনই আমরা একে গণহত্যা বলবো। বিশেষ করে, জ্যাক নুসান পোর্টার গণহত্যার তিনটা উপাদানের কথা বলেন: মতাদর্শ, প্রযুক্তি এবং আমলাতন্ত্র/সংগঠন। উল্লেখ্য, আক্রমণকারী হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র কিংবা এর উপাদানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অবশ্য, আক্রমণকারী সর্বদাই যে রাষ্ট্রীয় সরকার কিংবা তার সামরিক বাহিনীই হতে হবে তাও না, ন্যাটোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও আক্রমণকারী হতে পারে। গণহত্যার সংজ্ঞায় আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে in whole or in part অংশ; এর অর্থ সেইসব মানুষের সংখ্যার কোন নিম্ন সীমা নেই, যাদের ওপর এই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। 

তবে, গণহত্যার সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞা পাওয়া যায় সাহিত্যের মধ্যেই। হোমারের ইলিয়াডে এগামেমনন যে আদেশ দেন - ‘We are not going to leave a single one of them alive, down to the babies in their mother’s wombs - not even they must live. The whole people must be wiped out of existence, and none be left to think of them and shed a tear’ - সেখানে পাওয়া যায় গণহত্যার সবচেয়ে প্রকৃত সংজ্ঞা।

সামাজিক, অর্থনৈতিক কাঠামোসহ অনেক প্রভাবকই গণহত্যাকে প্রভাবিত করে থাকে। বিশেষ করে, বহুরূপী সমাজের (plural society) সাথে গণহত্যার বেশ একটা সম্পর্ক দেখা যায়। সমাজের এই বহুরূপ ধর্মের ভিন্নতা, ধর্মের ভেতরে মতাদর্শের ভিন্নতা, মুখের ভাষার ভিন্নতা এবং সাংস্কৃতিক বিচিত্রতা সহ আরও অনেক কারণেই হয়ে থাকে। তার মানে এই না যে, সমাজে একাধিক জাতি গোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকলেই সেখানে গণহত্যা হবে; তবে, প্রতিটা গণহত্যায় সমাজের এ বিভক্তির প্রভাব টের পাওয়া যায়। আসলে, বিষয়টাকে প্লুরাল সোসাইটিবললে ভুল বলা হবে। এখানে একাধিক জাতি গোষ্ঠীর উপস্থিতির চেয়ে তাদের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যই গণহত্যার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এমনকি জাতি ধর্ম বর্ণভেদে শিক্ষাক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখা যায়। কখনো কখনো এই ধরণের সমাজে বিভিন্ন জাতি ধর্ম ও বর্ণের মানুষদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ থাকে। তবে, এই বৈষম্য তৈরি করার মাধ্যমে আধুনিক কালের সমাজে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সহাবস্থান ধ্বংস করে তাদেরকে  মুখোমুখি করে দেয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে উপনিবেশায়নগণহত্যা গবেষক লিও কুপার তো বলেই ফেলেন, উপনিবেশায়নই হচ্ছে প্লুরাল সোসাইটির স্রষ্টা।[9]

উপনিবেশায়ন বলতে আমরা সাধারণত বুঝি কোন রাষ্ট্র অথবা কোন জাতিগোষ্ঠী কর্তৃক অন্য কোন রাষ্ট্র অথবা জাতিগোষ্ঠীকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পদানত ও নিয়ন্ত্রণ করে সেখানকার ভূমি ও সম্পদ লুটে নেয়া। ব্রিটিশদের ভারত শাসন এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। শুধু যে সামরিক বা রাজনৈতিক কর্তৃত্বই স্থাপন করা হয় তা না, সেই সাথে যুক্ত হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্প, মানে মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশ, যেখানে বিভিন্নভাবে উপনিবেশিত রাষ্ট্র বা জাতি সম্পর্কে হীনমন্যতার আত্মপরিচয় গড়ে তোলা হয়[10] উপনিবেশিক শক্তি তার এই শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে, তাই, আশ্রয় নেয় ডিভাইড এন্ড রুলপলিসির। উপনিবেশিত সমাজের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে, যেন উপনিবেশ বিরোধী কোন সংগ্রাম গড়ে উঠতে না পারে, নিজেদের ফায়দা ইচ্ছেমত তুলে নেয়াটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। আমাদের আলোচনার জন্যে এটা বুঝা জরুরী কারণ, দেখা যায় যে, আধুনিক যুগে সংঘটিত অধিকাংশ গণহত্যায় যে দুটো দল মুখোমুখি হয়ে থাকে কিংবা হয়েছে, মানে আক্রমণকারী ও আক্রান্ত, তাদের মধ্যকার বিবাদের মূল উৎসস্থল সবসময় উপনিবেশ আমলেই নিহিত। এবং, ‘ডিভাইড এন্ড রুলপলিসির কারণে উপনিবেশিক শক্তির হাতেই এই বিবাদের সূচনা হয়ে থাকে।

১৯৬৭ সালে, ভিয়েতনামে যুদ্ধের সময়ে, বার্ট্রান্ড রাসেলের বিখ্যাত গণ-আদালতে গণহত্যাবিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন গত শতাব্দীর আরেক দিকপাল জাঁ পল সাত্রে। সেখানে তিনি উপনিবেশায়নকে সাংস্কৃতিক গণহত্যার সাথে তুলনা করে  বলেছিলেন, এটা শুধু নিছক বিজয় নয়, এটা সাংস্কৃতিক গণহত্যা। স্থানীয় সমাজের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যকে পরিকল্পিত উপায়ে ধ্বংস না করে বিজেতারা কখনো উপনিবেশ করতে পারে না।[11] 

এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন ইরেনে ভিক্তোরিয়া মাসিমিনো। তিনি আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি দে লোমাস দে সামোরার আইনের শিক্ষক এবং গণহত্যার বিচার ও আইন বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিত। উপনিবেশের সাথে গণহত্যার এই সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘গণহত্যা বিষয়ে বিশেষভাবে কাজ করার জন্য আমি বিভিন্ন দেশের গণহত্যা সম্পর্কে গবেষণা করেছি। বিশেষ করে বিশ শতকে বিশ্বে ঘটে যাওয়া গণহত্যাগুলোর বিষয়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক বিষয় উপনিবেশবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যার পরিণতিতে পরবর্তী সময়ে গণহত্যা ঘটেছে। বাংলাদেশেও সেরকম হয়েছে[12]

যেহেতু, গণহত্যা এককভাবে পরিচালিত হয় হয় না, হয় সম্মিলিতভাবে, তাই, তাদের কৃতকর্মকে বৈধতা দেয়ার জন্যে একটা নির্দিষ্ট আদর্শ আমদানির প্রয়োজন পড়েতা না হলে, তারা নিজেদের কাছেই একজন সাধারণ খুনি কিংবা সাধারণ চোর বলে প্রতীয়মান হবে, যা আপাতদৃষ্টিতে তাদের জন্যে হজম করা কঠিন। এ কারণে, ‘মতাদর্শিক বৈধতাগণহত্যার প্রয়োজনীয় পূর্ব-শর্ত। এই মতাদর্শের জন্যে সবচেয়ে কার্যকর তত্ত্ব হচ্ছে, আক্রমণকারীদের মাথায় এমন ছবি ঢুকিয়ে দেয়া যেন তারা ভুলে যায় আক্রান্তরাও তাদের মতো মানুষ। অন্যভাবে বলতে গেলে, আক্রান্তের মনুষ্যত্বকে সরাসরি অস্বীকার করতে হবে। এটাকেই বলা হচ্ছে Dehumanization; বাংলায় একে মনুষ্যত্ব-চ্যুতিকিংবা  অমানবীকরণবলা যেতে পারে। আরও খোলাসা করে বললে, ভিক্টিমকে মানুষের পর্যায় থেকে একেবারে প্রাণী কিংবা বস্তুর স্তরে নামিয়ে আনা। গণহত্যার সময়ে যেভাবে যান্ত্রিক উপায়ে মানুষকে হত্যা করা হয়, সেটা শুধু ঘৃণা থেকেই ঘটে না, বরং, আক্রমণকারীরা আক্রান্তদের মানবিক বৈশিষ্ট্য কিংবা গুরুত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করে। মনুষ্যত্ব-চ্যুতিমানুষের সহিংসতার বিপক্ষে দাঁড়ানোর সাধারণ নৈতিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও নস্যাৎ  করে ফেলে। মনুষ্যত্ব-চ্যুতিকে, তাই, অনেকেই denial of identity and community হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।[13]

আক্রান্তদেরকে মানব কাতার হতে বের করে দেয়ার এই প্রক্রিয়ায় প্রাণিজগৎকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। তাদেরকে সাপ, ইঁদুর, তেলাপোকা , গরিলা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। স্থানভেদে প্রাণীদের নাম পরিবর্তিত  হয়।  প্রাণী নির্বাচনের বেলায় ওই প্রাণীগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয় যেগুলো সাধারণত গৃহপালিত কিংবা সে সমাজে উপকারী কিংবা পছন্দের। ভয়ংকর অথবা যে প্রাণীগুলোকে সমাজ ঘৃণার চোখে দেখে, আক্রান্তদের জন্যে সেগুলোই নির্বাচন করা হয়। এছাড়া, কিছুটা নমনীয় হলেও, আক্রান্তদের সম্পর্কে এমন এক ছবি আকা হয় যেখানে তাদেরকে অসৎ, নোংরা এবং অহংকারী হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়।

মনুষ্যত্ব-চ্যুতির মতাদর্শের আরেক উৎসস্থল হচ্ছে ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ। কেননা, আক্রমণকারীরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থানুসারে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসী এবং কাফের ভেদ তুলে দেয়। হিন্দু-মুসলমান, মুসলমান-খ্রিস্টান, খ্রিষ্টান-ইহুদি ইত্যাদি ভেদ তুলে শুধুমাত্র ধর্মের নামে গণহত্যার প্রচুর নজির ইতিহাসে রয়েছে। ভারত উপমহাদেশ এর সাক্ষী, বিশেষ করে বাংলাদেশ। 

এর পাশাপাশি রোগ’, যেগুলো আরোগ্য, ভয়াবহ, কিংবা সার্জারির প্রয়োজন পড়ে, দিয়েও মনুষ্যত্ব-চ্যুতির প্রক্রিয়া কাজ করে। রাজনৈতিক উপমা হিসেবে রোগের নাম ব্যবহৃত হওয়ার প্রচলন আছে সবখানেই। তন্মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত রোগের নাম হচ্ছে ক্যান্সারযেহেতু, ক্যান্সার থেকে মুক্তির কোন পথ নেই, সেহেতু, একে চিরদিনের জন্যে বিদায় করে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

এছাড়াও, আছে প্রগতি ও সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট তত্ত্ব; উপনিবেশায়নের জন্যে উপনিবেশিক যে যুক্তি দেখাতো অনেকটা এর মতোই। ওরাঅন্ধকারে আছে, তাই তাদেরকে আলোতে ও প্রগতির পথে নিয়ে আসা আমাদের জন্যে কর্তব্য। আমরা মহান, তাই পৃথিবীকে শাসন করাও আমাদের কর্তব্য। এখানে শুধুমাত্র তারাই বেঁচে থাকবে যারা যোগ্যতর। জার্মানির নাৎসি আমলই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে, ‘ওরা’, ‘আমরাখুব গুরুত্বপূর্ণ! তুমি’ ‘আমিদিয়ে গণহত্যা হয় না। এর জন্যে প্রয়োজন ওরা’ ‘আমরার মতো সম্মিলিত প্রয়াস।

হারবার্ট সি ক্যালমেন বলেন, একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী যখন গণহত্যার শিকার হয় অবশ্যই তখন এর কোন না কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অথবা পরিস্থিতিগত কারণ থাকে। কিন্তু, তাই বলে এটা বলা যাবে  না যে, তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে তাদের কৃতকর্মের জন্যে। কিংবা এরা নিরাপত্তার জন্যে হুমকিস্বরূপ তাই হত্যা করা হচ্ছে, এটাও বলা যাবে না। মূলত, তারা আক্রমণের শিকার হন কোন বৃহৎ পলিসির কারণেই; সে পলিসি বাস্তবায়নের জন্যেই সে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাই, লিও কুপার বিভিন্ন গণহত্যা পর্যালোচনা করে জানান যে, সবগুলোই মূলত ক্ষমতা কাঠামোর সাথে জড়িত এবং সবগুলোই ‘essentially political struggle’. [14]

কিছু সংখ্যক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ ব্যতীত সমাজের অধিকাংশ মানুষই নিরীহ গোছের এবং শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সে বিশ্বাসমত শান্তিতে বসবাস করতে পছন্দ করে এবং করেও থাকে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায়, যে কোন গণহত্যা কিংবা দাঙ্গার মুহূর্তে সেই শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর একাংশই সহিংস হয়ে ওঠে এবং নিজেদের প্রতিবেশীদের রক্তেই নিজের হাত রঞ্জিত করে। তাদের এই আমূল পরিবর্তনের মূল কারণ উপরে উল্লিখিত মনুষ্যত্ব-চ্যুতির মতাদর্শই। আবার এই মতাদর্শ সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন প্রোপ্যাগান্ডা।

প্রোপ্যাগান্ডা

প্রোপ্যাগান্ডা বার্তা উপস্থাপনের একটি নির্দিষ্ট ধরণ যেখানে শুধুমাত্র তথ্য পরিবেশনের পরিবর্তে বরং জনগণের মতামত ও আচার-আচরণকে প্রভাবিত করা হয়। Britannica Encyclopedia এর মতে, এটা হচ্ছে, ‘dissemination of information—facts, arguments, rumours, half-truths, or lies—to influence public opinion.’ বর্তমানে এই শব্দটা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হলেও, এর মূল অর্থ নেতিবাচক ছিল না। সহজ অর্থে, যা প্রচার করা হবে কিংবা ছড়িয়ে দিতে হবে তাই প্রোপ্যাগান্ডা (to propagate)১৬২২ সালের দিকে তৎকালীন পোপের নেতৃত্বে কার্ডিনালদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়, খ্রিষ্টীয় মতবাদ চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে। কমিটির নাম ছিল  Congregatio de Propaganda Fide, যার অর্থ হচ্ছে Congregation for Propagating the Faith (বিশ্বাস প্রচারের জন্যে ধর্মসভা)। মূলত, এর থেকেই প্রোপ্যাগান্ডা শব্দের উৎপত্তি; কিন্তু, তখনো এখনকার মত বিভ্রান্তিকর তথ্যঅর্থে তা ব্যবহৃত হত না।

অবশ্য, বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রোপ্যাগান্ডা র অর্থ ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক জগতে ঢুকে পড়ে।  নিদর্শনস্বরূপ, কিছু সংজ্ঞা দেখা যেতে পারে। Merriam-Webster অভিধানে প্রোপ্যাগান্ডা র তিনটা সংজ্ঞা দেয়া আছে: 
                             a congregation of the Roman curia having jurisdiction over missionary territories and related institutions
                             the spreading of ideas, information, or rumor for the purpose of helping or injuring an institution, a cause, or a person
                             ideas, facts, or allegations spread deliberately to further one's cause or to damage an opposing cause; also :a public action having such an effect

অক্সফোর্ড অভিধানেও একইভাবে প্রোপ্যাগান্ডা র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Information, especially of a biased or misleading nature, used to promote a political cause or point of view

অর্থাৎ, বর্তমানে প্রোপ্যাগান্ডা মানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পক্ষপাতদুষ্ট অর্ধসত্য/মিথ্যে সংবাদ পরিবেশন করে জনগণকে প্রভাবিত করা; মানে একধরনের ধাপ্পাবাজি করা।  আধুনিক প্রোপ্যাগান্ডার ইতিহাস বেশি দূরবর্তী নয়ধরে নেয়া হয় যে, একে সর্বাধিক সফলভাবে প্রথম কাজে লাগায় ১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন প্রশাসন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সে সময়টাতে মার্কিন সাধারণ জনগণ তখন প্রচণ্ড যুদ্ধবিরোধী, ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাইএই মনোভাবে বিশ্বাসী  । অন্যদিকে মার্কিন প্রশাসন যুদ্ধের প্রতি ভীষণ দায়বদ্ধ, তাই আশ্রয় নেয় প্রচারমাধ্যমের। এবং, মাত্র ছয়মাসের মাথায় পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সেই শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোই হয়ে ওঠে প্রচণ্ড যুদ্ধবাজ। তারা জার্মানদেরকে ধ্বংস করে দিতে চায়, পৃথিবীটাকে যুদ্ধের মাধ্যমে রক্ষা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। প্রচারণার এই যে ব্যবহার শুরু হল তারপর সেটা কমিউনিস্ট বিরোধিতায় কাজে লাগানো হয়। এমনকি, এখনও মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন দেশ দখলের পূর্বে নিজের জনগণের কাছে এই কাজের বৈধতা পাওয়ার জন্যে সম্মতি উৎপাদনে প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়। কোন দেশকে আক্রমণ করতে চাইলে প্রথমেই ‘Appeal to fear’ মতবাদকে ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ, সেই দেশ আমেরিকার অস্তিত্বের জন্যে হুমকিস্বরূপ, তাই ওদের পূর্বে আমাকেই আক্রমণ করা উচিত। নোয়াম চমস্কি অবশ্য বর্তমানে প্রচলিত গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে এই প্রোপ্যাগান্ডা কেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, Propaganda is to a democracy what the bludgeon is to a totalitarian state[15] উল্লেখ্য, ১৯১৭ সালে উইলসন প্রশাসন যে নতুন পথের সৃষ্টি করেন তার সবচেয়ে বড় ব্যবহার কিন্তু মাত্র কিছুদিন পরে হিটলারই করেছেন।

নোয়াম চমস্কি এবং এডওয়ার্ড এস হারম্যান প্রোপ্যাগান্ডা র একটি মডেল হাজির করেছেন আমাদের সামনে, তাঁদের বিখ্যাত সম্মতি উৎপাদন: গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতিগ্রন্থে। তাঁরা দেখিয়েছেন, আমেরিকা চালিত বিভিন্ন যুদ্ধের সময় অথবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সময় মার্কিন সংবাদসংস্থাগুলোর ভূমিকা কি থাকে, এবং কোন সুরে ও কাদের সুরে তারা নিরপেক্ষতার খুঁটি ধরে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়ায়। এমন না যে, মিডিয়া ভুল তথ্য দিচ্ছে, বরং সে সঠিক তথ্যই দিবে। কিন্তু, কোনটাকে গুরুত্ব দিতে হবে  আর কোনটাকে গুরুত্ব দিতে হবে না, সেটা ঠিক করে দেয়া হবে। পত্রিকার কোন অংশে কতটা জায়গা জুড়ে খবর প্রকাশিত হবে, হেডলাইন কেমন হবে, ঘটনার বর্ণনা কেমন হবে, এসব দিয়েই গুরুত্বর মাত্রা ফুটিয়ে তোলা হয় সাধারণত। চমস্কি ও হারম্যান দেখিয়েছিলেন কিভাবে শুধুমাত্র খবর পরিবেশনে ভাষা ব্যবহার করেও লঘু সংবাদকে গুরুত্বপূর্ণ করা হয়ে থাকে। তাদের প্রদত্ত মডেলে পাঁচটি ফিল্টারের কথা উল্লিখিত হয়, যাদের সম্পর্কে বলা হয়, ‘সংবাদের কাঁচামালকে অনিবার্যভাবেই, প্রকাশযোগ্য হওয়ার জন্যে, একে একে ফিলটারগুলো অতিক্রম করতে হয়এই ফিল্টারগুলো আবার সরকারি ভাষ্য ও সমাজের এলিট শ্রেণির মুনাফার দিকে দৃষ্টি রেখেই ‘filtration’ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।[16]

প্রোপ্যাগান্ডা র সর্বাধিক ব্যবহার ঘটে দুটো ক্ষেত্রে, এক জন-সংযোগ এবং, দুই, যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রোপ্যাগান্ডাযুদ্ধের একটা কৌশল হিসেবে কখনো কখনো উপস্থিত হয়; এর প্রমাণ পাওয়া যায় সান জুর বিখ্যাত দ্যা আর্ট অব ওয়ারবইতে। সেখানে বলা হয়, ‘সকল যুদ্ধের ভিত্তিই প্রতারণা। তাই, যখন আঘাত করতে সক্ষম, তখন দেখাতে হবে অক্ষম; যখন শক্তি প্রদর্শন করতে হবে, তখন দেখাতে হবে নিষ্ক্রিয়; যখন আমরা কাছাকাছি তখন শত্রুকে বিশ্বাস করাতে হবে যে আমরা দূরে; যখন আমরা দূরে, তখন তাকে বিশ্বাস করাতে হবে আমরা কাছাকাছিএতো গেলো শুধুমাত্র যুদ্ধকালীন সময়ে শত্রু শিবিরের জন্যে প্রচারণা। পাশাপাশি যুদ্ধ কিংবা দাঙ্গাতে এই প্রোপ্যাগান্ডা আরও শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে হাজির হয় অন্য ক্ষেত্রে: পূর্বোল্লিখিত মনুষ্যত্ব-চ্যুতির প্রচার। বিভিন্ন শব্দ, বাক্য, ছবি ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের জনগণের মনের মধ্যে শত্রু সম্পর্কে ভ্রান্ত ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়। শত্রুর কাঁধে এমন কিছুর দায়ভার চাপিয়ে দেয়া হয়, যার জন্যে আদৌ সে দায়ী নয়। প্রতিটা প্রচারণাতেই নিজের জনগণের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত করতে হয় যে, শত্রুপক্ষ দ্বারা কোন অবিচার সাধিত হয়েছে, যদিও অধিকাংশ সময় সে অভিযোগ কাল্পনিক কিংবা কোন একটা নির্দিষ্ট ঘটনার অর্ধ-সত্য বা বিকৃত তথ্য হয়ে থাকে। 

বদরুদ্দীন উমর ১৯৭০ সালে লিখিত এক প্রবন্ধে কথা বলেছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে প্রচার মাধ্যমসমূহের ভূমিকা প্রসঙ্গে। সেখানে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মানুষ এমন উন্মত্ত হয় কেমন করে?’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন কিভাবে জনমত গঠিত হয় তার উপর নির্ভর করে। সেখানে তিনি কয়টা উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, ‘উচ্চ-মধ্যবিত্ত স্বার্থ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিই অধিকাংশ সংবাদপত্র এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমসমূহের সমর্থক, মালিক এবং নিয়ন্ত্রেতা। এজন্য এগুলির মাধ্যমে শুধু দাঙ্গার ক্ষেত্রেই নয় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই উচ্চ মধ্যবিত্ত স্বার্থ সূক্ষ্মভাবে রক্ষার ব্যবস্থা হয়। এজন্যই দেখা যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে দেশের সকল সংবাদপত্রের ভূমিকা এক হয় না, কোন কোন সংবাদপত্র হয়তো দাঙ্গা মনোবৃত্তির বিরোধিতা করে, কিন্তু জনমত গঠনে তাদের প্রভাব অন্যগুলির তুলনায় থাকে অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক দুর্বল।[17]   

প্রোপ্যাগান্ডার জন্যে যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহৃত হয় তন্মধ্যে “Ad nauseam” এবং  “Appeal to fear” খুবই প্রচলিত এবং কার্যকর।  “Ad nauseam” হচ্ছে যে কোন তত্ত্ব বারে বারে প্রচার করা যেন সেটা মিথ্যে হলেও জনসাধারণের কাছে সত্য বলেই মনে হয়। মূলত রেডিও পত্রিকা এই তত্ত্ব প্রচারের গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকে। “Appeal to fear” হচ্ছে এমন সব তত্ত্ব ও তথ্য জনগণের সামনে প্রচার করা তারা যেন প্রতিপক্ষের ব্যাপারে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এটা সফল হয়ে গেলে শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোও নিজেদের জান ও মাল রক্ষার্থে ‘Self-defense’ করতে উদ্ধত হয় যা পরিশেষে তাদেরকে ভয়ংকর খুনি বানিয়ে দেয়। গণহত্যাসহ যে কোন ধরণের দাঙ্গাতে এই শেষোক্ত পদ্ধতি খুবই কার্যকর, কেননা, ‘if this is done successfully, honest people will take whatever measure thy think necessary for legitimate self – defense’[18]

সব দেশে সবসময় যে একইভাবে প্রচারণা বা প্রোপ্যাগান্ডা চালানো হয় তাও না, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে  সাথে প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যম ও ধরণেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যেমন, এককালে পোস্টার, লিফলেট ছিল প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যম, কিন্তু রেডিও টেলিভিশন আগমনের পরে এরাই হয়ে গিয়েছে মূল মাধ্যম। আবার, বর্তমানে, সোশাল মিডিয়া মানে ভার্চুয়াল জগত হয়ে গিয়েছে প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যম।  বর্তমানে মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত এই সময়ে আসলে শাসকগোষ্ঠী আমাদের মনোজগতকেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন মাধ্যমে; কখনো খবরের মাধ্যমে, কখনো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। শাসকগোষ্ঠী যখন তাদের কার্য হাসিলের জন্যে জনগণের অংশগ্রহণ কামনা করে, কিংবা জনগণের সম্মতি আদায়ের দরকার পড়ে (কেননা, জনগণ বিদ্রোহ করতে পারে) তখনই আশ্রয় নেয় ব্যাপক প্রোপ্যাগান্ডার ! গণহত্যার ক্ষেত্রেও যে প্রোপ্যাগান্ডা মাধ্যমের আশ্রয় নেয়া হয় সেটাও সময়ে সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় পোস্টার লিফলেটের আধিক্য ছিল, পরবর্তীতে সেখানে স্থান নিয়েছে রেডিও - টেলিভিশন এবং এখন আছে সোশ্যাল মিডিয়া।

এটা সত্যই যে, গণহত্যা কিংবা যে কোন দাঙ্গার মূল পরিকল্পনা তৈরি হয় মূলত নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ দ্বারা, সাধারণ জনগণের একাংশের অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয় সেটার বাস্তবায়নের জন্যে কিংবা তীব্রতা বাড়ানোর জন্যেই। জনসাধারণকে তাই প্রভাবিত করার জন্যে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে তখন প্রোপ্যাগান্ডা। প্রিন্ট মিডিয়া, রেডিও, টেলিভিশন, লিফলেট, পোস্টার, সভা সমাবেশের বক্তৃতা তাই প্রোপ্যাগান্ডা র অংশ হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে গণহত্যায়। তার মানে এই না যে প্রোপ্যাগান্ডার কারণেই গণহত্যা সঙ্ঘটিত হচ্ছে, বরং  গণহত্যার পরিকল্পনা সুচারুভাবে বাস্তবায়িত করতে ও তীব্রতা বাড়াতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। গণহত্যাকালীন সময়ে প্রচারিত এই প্রোপ্যাগান্ডাকে Hate propaganda বলেও সম্বোধন করা হয়[19] অন্যভাবে এটাকে ঘৃণাত্মক কথন (Hate Speech) বলাও হয়ে থাকে। মিডিয়াকে ব্যবহার করে কোন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো; যা কিনা উস্কানিতে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। এটাও মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘের অধিবেশন অনুযায়ী, গণহত্যায় উস্কানি প্রদানও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।[20] তবে, প্রোপ্যাগান্ডা , ঘৃণাত্মক কথন এবং উষ্কানি (Incitement) খুব পাশাপাশি শব্দার্থ তৈরি করলেও এদের মধ্যে সূক্ষ পার্থক্য আছে। ঘৃণাত্মক কথন একধরণের উত্তেজনামূলক ভাষা, প্রায়শই অপমানজনক ও নিন্দনীয়, যা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে প্রচার করা হয়ে থাকে। সেটাতে সহিংসতার আহ্বান থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। অন্যদিকে, প্রোপ্যাগান্ডা হচ্ছে পক্ষপাতদুষ্ট খবরে প্রচার করে জনগণকে প্রভাবিত করা। এই কথন (speech) কিংবা প্রোপ্যাগান্ডা গণহত্যায় তৈরি করছে কি না তা প্রসঙ্গ এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে। কোন পরিস্থিতিতে, কি প্রসঙ্গে এবং কাদের উদ্দেশ্যে  বলা হচ্ছে তা বুঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে নিচের মন্তব্যটা গুরত্বপূর্ণ,
Certain utterances achieve terrifying power, in the right context. In a climate of ethnic animosity, statements of ethnic pride are indistinguishable from insults against one’s opponents. And the converse is also true: Even the most hateful or inciteful speech remains benign, if it has no audience or if its audience is firmly and explicitly determined to keep the peace. [21]

পূর্বেই বলেছি গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার জন্যে দরকার সু সংগঠিত ক্ষমতা কাঠামো এবং অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রই সে কাজ করে থাকে। প্রোপ্যাগান্ডার ব্যাপক ব্যবহার ছাড়াও গণহত্যা সংঘটিত হতে পারে, কিন্তু সাংগঠনিক ক্ষমতা কাঠামো ব্যতীত এটা সম্ভব না। এছাড়া, ঘৃণ্য কথনের প্রভাবের মাত্রা নির্ভর করে একটা সমাজের আর্থ সামাজিক অবস্থার উপর। যে সকল সমাজে stratified hierarchy, tenuous rule of law, state-sponsored violence, impunity, or widespread corruption বিদ্যমান, সেখানে ঘৃণ্য কথন খুব সহজেই সহিংসতার জন্ম দেয়।[22]

হলোকাস্ট

গণহত্যার তীব্রতা বাড়াতে এবং এতে জনগণের সম্মতি আদায়ে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা কতটা প্রভাবশালী হতে পারে তার উজ্জ্বল (অথবা অনুজ্জ্বল) উদাহরণ হচ্ছে জার্মানির নাৎসি আমল। লিফলেট থেকে শুরু করে সিনেমা পর্যন্ত - হেন কোন মাধ্যম নেই যা হিটলার ও তার বাহিনী ব্যবহার করে নি তাদের মতবাদ প্রচারের জন্যে। জার্মানিতে নাৎসি বাহিনী ক্ষমতা আসে ১৯৩৩ সালের জানুয়ারীতে; এসেই হিটলারের নির্দেশে জোসেফ গোয়েবেলস নেতৃত্বে গঠন করা হয়  নতুন মন্ত্রণালয়, Reich Ministry of Public Enlightenment and Propaganda’গোয়েবেলস বুঝতে পারেন তিনি একটা বিশাল সাম্রাজ্য পেয়ে গিয়েছেন যারা স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে ফিল্ম, রেডিও সব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। তিনি লিখেন, জার্মানদের জাতীয় শিক্ষা এখন আমার হাতের উপর ন্যস্থ[23]এই মন্ত্রনালয় স্থাপন করা ছিল এক বিরাট ঘটনা, কেননা পরবর্তী সময়ে ইহুদীদের বিপক্ষে ঘৃণা ছড়ানো এবং গণহত্যায় এর ভূমিকা ছিল ব্যাপক! তৎকালীন পৃথিবীতে প্রোপ্যাগান্ডা র নেতিবাচক  অর্থের কারণে গোয়েবেলস  নাকি মন্ত্রণালয়ের নামের মধ্যে এই শব্দটা ব্যবহার করতে চান নি। কিন্তু, হিটলার এ শব্দের পক্ষেই ছিলেন[24]।  হিটলার তাঁর Mein Kampf (১৯২৬) বইতেও প্রোপ্যাগান্ডা র প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলেন, ‘Propaganda tries to force a doctrine on the whole people... Propaganda works on the general public from the standpoint of an idea and makes them ripe for the victory of this idea.’ অতঃপর, প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যমেই প্রচার করা হয় নাৎসিবাদের আদর্শ, যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল বর্ণবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ এবং বলশেভিক বিরোধিতা। 
  
নাৎসিরা যে আদর্শ প্রচার করতো সেদিকেও কিঞ্চিৎ আলো ফেলা দরকার। তারা ‘race’ এর কিছু সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছিল যা একদিকে ছিল শতভাগ অবৈজ্ঞানিক এবং অন্যদিকে এটা ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জন্ম দিচ্ছিল ক্রমাগতভাবে। ইহুদীদেরকে পশ্চিমা ও বিশ্ব সভ্যতার জন্যে অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করে। বিভিন্ন লেখা, বক্তৃতা-বিবৃতি, লিফলেট, পত্রিকা এবং ফিল্মে ইহুদীদের সম্পর্কে প্রচণ্ড নেতিবাচক ও ঘৃণ্য কথন প্রচার করা হত।

১৯৪৩ সালে  নাৎসি পার্টি থেকে প্রচারিত এক পুস্তিকায় ইহুদিদেরকে পরজীবী হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, The Jew is the parasite of humanity. He can be a parasite for an individual person, a social parasite for whole peoples, and the world parasite of humanity. [25] 

জোসেফ গোয়েবেলস ১৯৪১ সালে ইহুদীরা অপরাধী’  শিরোনামে যে আর্টিকেল লিখেন সেখানে সরাসরি ইহুদিদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, The Jews are our destruction. They started this war and direct it. They want to destroy the German Reich and our people. This plan must be blocked. [26]

ডারউইন এর সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্টথিওরি এবং আর্যতত্ত্বমিশিয়ে বলা হল, পৃথিবী একটা যুদ্ধক্ষেত্র এবং সেখানে জার্মানরা আর্য হওয়াতে পৃথিবীতে তারা টিকে থাকবে এবং তারাই শাসন করবে। কেননা, তারা শ্রেষ্ঠ। সাথে যুক্ত হল রক্ত ও মাটিতত্ত্ব; বলা হল জার্মান মাটির সাথে খাঁটিজার্মানদের সম্পর্ক রয়েছে, যা কিনা পৃথিবীকে ঊর্ধ্বতনঅধস্তনদৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য করে[27]জাতিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বারে বারে মার্ক্সকে আক্রমণ করা হচ্ছিল, সেই সাথে কমিউনিস্টদেরকেও। বলা হল, মানুষ উচ্চতর কিংবা নিম্নতর হয়ে জন্মায় এবং এটা কখনো পরিবর্তন করা যাবে না। তাদের একজন তাত্ত্বিক বলেন, Racial science teaches us that all the essential differences between peoples and races in this world are inherited. They cannot be changed by educational or training systems. Humanity cannot change them. [28]

গোয়েবেলসের মন্ত্রনালয় রেডিও, নাটক, ফিল্ম, পত্রিকা সবকিছুকে ব্যবহার করে তাদের উপরোক্ত মতাদর্শের প্রচারে। সেই সাথে প্রণীত হয় কুখ্যাত Nuremberg Race Laws যা ইহুদি নিধনের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। ১৯৪০ সালে The Eternal Jew  নামে ইহুদি বিদ্বেষী একটা ফিল্ম তৈরি করা হয় যেখানে ইহুদিদেরকে দেখানো হয় ভ্রান্ত সাংস্কৃতিক পরজীবী এবং যৌন ও অর্থের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত গোষ্ঠী হিসেবে। জার্মানিতে তখন এমন অনেক ফিল্মই নির্মিত হতে থাকে । সোভিয়েত আক্রমণের প্রাক্কালে নাৎসি প্রোপ্যাগান্ডাতে ইহুদিদের পাশাপাশি কমিউনিস্টদেরকেও পশ্চিমা সংস্কৃতির জন্যে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।    
Get the Jewish-Bolshevist warmongers out of Europe!

প্রোপ্যাগান্ডা র অংশ হিসেবে ১৯৩৩ সালের দিকে জার্মানির বাজারে নতুন ধরণের রেডিও চালু করা হয় যার কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল
; যেমন, এটাতে শুধুমাত্র লংওয়েব ধরার নব ছিল এবং ডায়ালে জার্মান স্টেশনগুলো মার্ক করা ছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানরা যেন আর কোন ধরণের খবর জানতে না পারে, এবং শুধু তাই জানবে যা তাদের সরকার জানাতে চাইবে। আর, কেউ যদি আগ্রহী হয়ে বিদেশী সংবাদমাধ্যম শুনতে চায় তবে সে ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া ছিল ডায়াল ট্যাগে,
“Think about this: listening to a foreign broadcasts is a crime against the national security of our people. It is a Fuehrer order punishable by prison and hard labor.”[29]  উল্লেখ্য, জার্মানির সেই বিশেষরেডিওর মডেল নাম্বার ছিল ৩০১; কারণ, ৩০ শে জানুয়ারি নাৎসি বাহিনী ক্ষমতায় আসে। বলার অপেক্ষা রাখে না এই আইডিয়ার জন্ম জোসেফ গোয়েবলসের মস্তিষ্কেই।

জার্মানির আরেকটি কুখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা, Der Sturmer, নিরলসভাবে সে সময় ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়েছিলতাদের শ্লোগানই ছিল ইহুদিরা আমাদের দুর্ভাগ্য’ (Die Juden sind under Ungluck!)তাদের প্রচারিত সংবাদের বিষয়বস্তু ছিল ইহুদিদের অপরাধসমূহ’; যেমন ইহুদিরা যিশুকে হত্যা করেছে, জার্মান নারীদের ধর্ষণ করেছে, অর্থনৈতিক জোচ্চুরি করেছে ইত্যাদি। প্রকাশিত কার্টুনে ইহুদী পুরুষদের বিকৃত চেহারা তুলে ধরা হতো। পরবর্তীতে এই পত্রিকায় প্রকাশিত খবর, ছবি  নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সময় নাৎসিদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন Julius Streicher; গণহত্যায় উস্কানি দেয়ার অভিযোগে নুরেমবার্গ ট্রায়াল তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় এবং ১৯৪৫ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় এই পত্রিকা [30]। 

“When the vermin are dead, the German oak will flourish.”

নাৎসি শাসনামলে নিয়ন্ত্রিত
, আমলাতান্ত্রিক এবং রাষ্ট্রীয়- পৃষ্ঠপোষকতায় যে গণহত্যা চালানো হয় সেখানে ছয় মিলিয়ন ইহুদি মারা যান। নাৎসি গণহত্যার ভয়াবহতা ও নির্মমতা কেমন ছিল তা আমাদের সকলেরই জানা। নমুনাস্বরূপ মাত্র একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কথা বললেই নির্মমতা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যাবে। Auschwitz সম্পর্কে গার্ডিয়ানপত্রিকা যে তথ্য প্রদান করে তা নিম্নরূপ,
‘...the German SS systematically killed at least 960,000 of the 1.1-1.3 million Jews deported to the camp. Other victims included approximately 74,000 Poles, 21,000 Roma, 15,000 Soviet prisoners of war and at least 10,000 from other nationalities. More people died at Auschwitz than at any other Nazi concentration camp and probably than at any death camp in history. The Soviet troops found grisly evidence of the horror. About 7,000 starving prisoners were found alive in the camp. Millions of items of clothing that once belonged to men, women and children were discovered along with 6,350kg of human hair. The Auschwitz museum holds more than 100,000 pairs of shoes, 12,000 kitchen utensils, 3,800 suitcases and 350 striped camp garments.’ [31]


রুয়ান্ডা

আফ্রিকার পূর্ব-মধ্যাংশের রাষ্ট্র রুয়ান্ডাতে গণহত্যা সঙ্ঘটিত হয় ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে। যদিও এই গণহত্যা চলে প্রায় ১০০ দিন, কিন্তু এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল অন্যান্য স্থানের মতো উপনিবেশ আমলেই। তৎকালীন সময়ে রুয়ান্ডার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখজনকভাবে বেড়ে গেলেও বিভিন্ন কারণেই এর আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিম্নমুখী হতে থাকে। তাছাড়া, উপনিবেশ আমলে তৈরি হওয়া বিভক্তি সাধারণ জনগণকে এমন এক জটিল অবস্থায় ফেলে দেয় যা আসলে গণহত্যার পাটাতন তৈরি করতে সাহায্য করে। প্রকৃতিগত দিক থেকে একাত্তর সালে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার সাথে রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রচুর মিল রয়েছে। তাই, রুয়ান্ডা সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।

Twa, Hutu এবং Tutsi – এই তিন জনগোষ্ঠী দ্বারা রুয়ান্ডা গঠিত। কিন্তু, সংখ্যাগত দিক থেকে প্রথম দলটি খুবই ছোট হওয়াতে রাজনীতিতে কার্যত তাদের কোন ভূমিকা ছিলনা। আবার, শেষোক্ত দুই গোষ্ঠী হুতু ও টুটসিদের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে প্রচণ্ড মিল ছিল। তুলনামূলক ভাবে সংখ্যায় অল্প হলেও টুটসিরা ছিল এলিট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, অন্যদিকে জনগণের বেশীরভাগই ছিল হুতু গোষ্ঠীর সদস্য। বেলজিয়ান উপনিবেশকালে বেলজিয়ানরা টুটসি এলিটদেরকেই ক্ষমতার চক্রে রাখে এবং প্রতিটা আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর জন্যে পরিচয় পত্রের প্রচলনও শুরু করে।  অনেকেই বলতেন যে টুটসিদের আদি নিবাস নাকি ইথিওপিয়াতে ছিল; তাই গণহত্যাকালীন সময়ে লাশগুলোকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে বলা হত, এদেরকে ইথিওপিয়ায় আবারো ফিরিয়ে দেয়া হল[32]বেলজিয়ানদের আর্শিবাদ পুষ্ট দল হিসেবে এলিট টুটসিরা নিজেদেরকে উচ্চতরহিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে এবং এর বিপরীতে হুতুরা নিজেদেরকে নির্যাতিতহিসেবে চিহ্নিত করে[33]

হুতুদের এই ক্রমাগত অসন্তোষের ফলে তাদের অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৫৯ সালে; উত্থান কালে হুতুদের হাতে বিভিন্ন দাঙ্গাতে প্রায় ২০, ০০০ এর বেশী টুটসি নিহত হন এবং বিরাট একটা অংশ দেশ ছেড়ে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়[34]। ১৯৫৯ সালর এই ঘটনা হুতু এবং টুটসিদের মনে দুই ধরণের প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়; টুটসিদের কাছে এটা ছিল “Tragic and Criminal Event” এবং হুতুরা এটাকে ‘Heroic Battle of liberation’ হিসেবেই ধরে নেয়[35]

১৯৫৯ সালে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া টুটসিদের বংশধরেরাই একসময় Rwandan Patriotic Front (RPF) গেরিলা সংগঠন গড়ে তুলে এবং ১৯৯০ সালে তারা রুয়ান্ডাতে আক্রমণ করে। একাধিক চাপের কারণেই তখন ১৯৯৩ সালের আগস্টে RPF এবং রুয়ান্ডার সরকারের মধ্যে ‘Arusha Accords’ নামে এক শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এটা মনে রাখা প্রয়োজন RPF টুটসি-প্রাধান্য দল হওয়া সত্ত্বেও সেখানে হুতুরাও ছিল এবং সাধারণ টুটসিদের অধিকাংশেরই এই গেরিলা দলের সাথে কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং তার সমর্থকেরা সে ঘটনাকে টুটসিদের আক্রমণ হিসেবেই চিহ্নিত করেন। এটাকে জাতিগত দাঙ্গাতে পরিণত করার মূল কারণ ছিল বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলা প্রেসিডেন্ট জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার এবং তার বিপক্ষে থাকা হুতুদেরও সমর্থন আদায় করা। তাই সাধারণ টুটসিদের এই গেরিলা দলের সাথে কোন সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও তখন প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সকল টুটসিদের। প্রধান শত্রুর সংজ্ঞায় বলা হয়,

“The Tutsi inside or outside the country, extremist and nostalgic for power, who have NEVER recognized and will NEVER recognize the realities of the 1959 social revolution and who wish to reconquer power by all means necessary, including arms.”[36]

১৯৯০ সালে RPF এর আক্রমণের পর থেকে Kangura নামক পত্রিকা শুরু করে টুটসিদের বিপক্ষে জঘন্যতম প্রচারণা। কিন্তু জনগণের মধ্যে শিক্ষার হার অল্প এবং দারিদ্র পীড়িত রুয়ান্ডাতে পত্রিকার দাম তুলনামূলক বেশী হওয়াতে পত্রিকার চেয়ে সেখানে রেডিওর শ্রোতাই বেশী ছিল। শহরের প্রায় ৫৮.৭% মানুষের বাড়িতেই রেডিও ছিল এবং গ্রামে সে সংখ্যা ছিল ২৭.৩%। গণহত্যার সময়ে সে সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি গণহত্যার প্রারম্ভে সরকারের পক্ষ থেকেও রেডিও বিতরণ করা হয় কর্তৃপক্ষের কাছে। এই তথ্যই বলে দেয় যে, রেডিওই ছিল রুয়ান্ডা সরকারের প্রধান প্রচারযন্ত্র। [37]

শুধুমাত্র টুটসিদের বিপক্ষে প্রচারণার লক্ষ্যেই ১৯৯৩ সালে কুখ্যাত Radio Television Libre des Mille Collines (RTLM) যাত্রা শুরু হয়। পূর্বে Kangura পত্রিকা যা প্রকাশ করত তারই প্রতিধ্বনি উচ্চারণ করে RTLMউল্লেখ্য, রাজনৈতিক প্রোপ্যাগান্ডিস্টরা মূলত তখন টুটসিদের বিরুদ্ধে কিছু নির্দিষ্ট অভিযোগ তুলত। যেমন, টুটসিরা বিদেশি, তাই এখানে বসবাস করার কোন অধিকার নেই। টুটসিরা এখনো উচ্চ মর্যাদা ও অধিক সম্পদ ভোগ করছে এবং কোন না কোনভাবে হুতুদের দারিদ্র্যতার জন্যে তারাই দায়ী। এছাড়াও, মিডিয়াতে টুটসিদেরকে হুতুদের জন্যে হুমকিস্বরূপ হিসেবেই তুলে ধরা হতো, যেমন, টুটসিরা টাকা দিয়ে হুতুদের কিনে নিতে পারে কিংবা, হুতু নারীদেরকে প্রলুব্ধ করতে পারে। এবং এজন্যেই হুতুদের দায়িত্ব হচ্ছে নিজেদের আত্মরক্ষা করা[38]

গণহত্যার জন্যে আদর্শিক পটভূমি তৈরির জন্যে হুতুরা প্রচারণায় Appeal to fear পদ্ধতি কাজে লাগায়। গবেষকরা RTLM’র তাদের প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডকে দুইভাবে বিভক্ত করেছেন - গণহত্যার পূর্ববর্তী সময়ে এবং পরবর্তী  সময়ে। পূর্ববর্তী সময়ে তারা মূলত হুতু এবং টুটসিদের জাতিগত ভিন্নতা তুলে ধরত এবং হুতুদের মনে টুটসি সম্পর্কে ভয় সংক্রমণ করত। ভয় উৎপাদনের সাথে সাথে জানিয়ে দেয়া হত আত্মরক্ষার উপায় যেন, আক্রমণ তারাই শুরু করে দিতে পারে। মনুষ্যত্ব-চ্যুতির প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে টুটসিদেরকে তখন Cockroach, wicked, sorcerers নামে সম্বোধন করা হতো। তৎকালীন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে টুটসিদেরকে বিভিন্ন প্রাণীর নামে লেভেল করা কতটা বিপজ্জনক ছিল তা একজন গবেষকের নিম্নের কথায় ফুটে উঠে,
“Given the volatile political climate of the time, labelling a group of people cockroaches was similar to sentencing them to death” [39]

দুই গোষ্ঠীর মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে হুতুদের প্রচারণা মাধ্যমগুলো যে উগ্রতার পরিচয় দেয় তার একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৯৯৪ সালের মার্চে রেডিও থেকে বলা হয়[40]
“The thirst for power and blood for which the Tutsis of Burundi are known has just resurfaced… Soldiers invaded Kamenge (neighbourhood) and killed over 200 people… Most of the victims were intellectuals or eminent Hutus…The Tutsis are still blood thirsty. In fact, they are used to shedding blood and they continue to do so. Today, as they are still planning a coup, it means they still want to shed blood, this time around, on a large scale. ...

What lesson can be drawn from what is happening in Burundi? Whatever the case may be, we must draw a lesson from the events of Burundi. Tutsi grandchildren who fled Rwanda gave themselves the name Inkotanyi and attacked Rwanda in 1990. They claimed they wanted to install democracy, but to date, it is obvious they want to take back power seized from them by the Hutus in 1959.

এরকম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে  ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল রাতে হুতু প্রেসিডেন্ট Habyarimana নিহত হন। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পর শুরু হয়ে যায় হত্যাযজ্ঞ। রুয়ান্ডা সৈনিক এবং আনঅফিসিয়াল মিলিশিয়া Interahamwe এর পাশাপাশি সাধারণ  হুতুদের একাংশও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এই গণহত্যায়। নারী-পুরুষ নির্বিচারে টুটসিদের হত্যা করা হয়। প্রতিবেশীকে হত্যা করা হয়, এমনকি কখনো কখনো হুতু স্বামী তার টুটসি স্ত্রীকে হত্যা করে। সে সাথে মডারেট হুতু যারা হত্যাযজ্ঞে অংশ নিতে অপারগ ছিলেন তাদেরকেও হত্যা করা হয়। টুটসি নারীদেরকে ধর্ষণ করা হয় নির্বিচারে এবং, যৌন দাসী হিসেবে বন্দী করে রাখা হয়। মাত্র ১০০ দিনে প্রায় ৮- ১০ লক্ষ টুটসি নিহত হন সেই গণহত্যায়। 

গণহত্যা চলাকালীন সময়ে RTLM সরাসরি টুটসি নিধনের পরিকল্পনা তৈরিতে অংশ নিয়েছে; শ্রোতাদেরকে কখন কিভাবে কোথায় হত্যা করতে হবে সেটাও বলে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সে সময়ের মে মাসে এক বার্তায় বলা হয়
“And you people who live down there near Rugunga, even though it is raining, go out. You will see Inkotanyi's straw-huts in the marsh where horses are kept. It is clear then that this place shelters Inkotanyi [RPF soldiers]. I think that those who have guns should immediately go to these Inkotanyi before they listen to Radio RTLM and flee. Stand near this place and encircle them and kill them because they are there” [41]

জুলাই মাসে RPF এর রাজধানী কিগালি দখল করার মাধ্যমে শেষ হয় এই গণহত্যা। কিন্তু এই ১০০ দিনেই পৃথিবী দেখে ফেলে নৃশংসতম কয়েকটি গণহত্যার একটি। এই গণহত্যার একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল আক্রমণের ধরণে। প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিভিন্ন ধরণের কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার প্রমাণ করে গণহত্যায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল; তাই দেখা যায়, প্রতিবেশীর হাতে মারা যাচ্ছেন আরেক প্রতিবেশী, ঘনিষ্ঠ মানুষগুলোই একে অপরকে হত্যা করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই পুরো বিষয়, মানে সাধারণ জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ সম্ভব হয়েছিল প্রোপ্যাগান্ডার কারণেই। 


  
বাংলাদেশ

এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে।  ৪৭ এ দেশভাগের মাধ্যমে  ভারত পাকিস্তান গঠিত হয়। পূর্ব  পাকিস্তান ও  পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে তৈরি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তখন ভীষণ অদ্ভুত ধরনের এক রাষ্ট্র; একই দেশের দুই অংশের মধ্যে ভৌগলিক ব্যবধান যেমন বিদ্যমান ছিল, তেমনি দুই অংশের মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র ধর্ম ছাড়া সংস্কৃতির আর কোন বিষয়ই মিল ছিল না। ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল পশ্চিমেই। শুরুতেই আঘাত আসে ভাষার উপর। উর্দু ছিল গুটিকয়েক পাকিস্তানীর মাতৃভাষা, অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষাই ছিল বাংলা, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) এর সকলের মুখের ভাষাই ছিল বাংলা, অথচ ঘোষণা করা হল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এক রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে  সফল প্রতিবাদের পর থেকেই  বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে থাকে।

সামরিক শাসনের প্রবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য চলে যায় পশ্চিমাদের গুটিকয়েক  এলিট শ্রেণির হাতে। সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য চলতে থাকে এবং তা বৃদ্ধি পেতে থাকে ধীরে ধীরে। ১৯৫৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তানিদের চেয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি ছিল। দশ বছর পরে, ১৯৬০-৭০ সালের দিকে দেখা যায়, এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তানিদের চেয়ে ৬১ শতাংশ বেশি ছিল। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে।[42] পাশাপাশি চলতে থাকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভিন্ন আগ্রাসন, যার ফলশ্রুতিতে বাংলার প্রতিটা শ্রেণি ফুঁসে উঠছিল শাসকদের বিরুদ্ধে। শেখ মুজিব যখন ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন, তখন তা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৯ সালে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের মিলিত প্রয়াসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব পদত্যাগ করলে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। কিন্তু সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের দল আওয়ামীলীগ বিশাল ব্যবধানে নির্বাচনে জয়ী হওয়াতে পশ্চিমা শাসকদের কপালে আবারো চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ক্ষমতা নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে শাসক গোষ্ঠী। বাঙ্গালীদের এই উত্থান দমন করতেই ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে রাতের আঁধারে সাধারণ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। দেশীয় দালালদের  সহায়তায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দীর্ঘ নয়মাসে ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা ও চার লক্ষ নারীকে ধর্ষণের মাধ্যমে রচনা করে বিংশ শতাব্দীর আরেক নৃশংসতম গণহত্যার আখ্যান।



পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রোপ্যাগান্ডা আসলে শুরু হয়েছিল একাত্তরেরও বহু আগে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ আর সিদ্দিকী The military in Pakistan: Image and reality বইতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইমেজ গড়ে উঠার কাহিনী বিশদভাবে আলোচনা করেছেন; তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যমে আইয়ুব খানকে  জাতীয় বীরএ পরিণত করা হয়। পাক ভারত যুদ্ধের পর সেনাবাহিনীর শৌর্য বীর্যের এই প্রচারণা এতই বেশি চলতে থাকে যে, সে সময় কিছু গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, যেমন: মেরা মাহি চাইলে চাবে লি/ কানাইলি জার্নাইল নিবা মেরি চান মাহি কাপ্তান[43]ঠিক সে সময় তাদের প্রচারণার সাথে যুক্ত হয় নতুন উপাদান, ‘ধর্মপাকিস্তানি সেনাবাহিনী এত বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিল কেন? কারণ সে মুসলমান। সে ইসলামের জন্যে যুদ্ধ করেছে। প্রচারণার এই ইসলামীকরণ একাত্তরে গণহত্যা চালানোর সময় ব্যাপক সাহায্য করেছিল পাকিস্তানি ও তার দালালদের। এরপর থেকে যখনই কেউ পাকিস্তানি সেনা ও শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়েছে তাকে ইসলামের দুশমন’, ‘ভারতের (হিন্দুদের) দালালআখ্যা দিয়ে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রচারণার এমন কৌশলের কারণেই ধীরে ধীরে পাকিস্তান’, ‘সেনাবাহিনীএবং ইসলামহয়ে উঠে একে অপরের সম্পূরক শব্দ।

যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আরও তীব্র ভাবে প্রোপ্যাগান্ডা চালাতে থাকে, যত ধরণের মাধ্যম আছে সবগুলোকে ব্যবহার করা হয়। পূর্বের তুলনায় এই সময়কার প্রচারণার ধরণ পুরো ভিন্ন; পূর্বে যেখানে প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে সামরিক বাহিনীকে মহান করে তোলা হত, যুদ্ধের সময় সেখানে মূলত গণহত্যাকে অস্বীকার ও জাস্টিফাই করার কাজে প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক জহির রায়হানের এক বক্তব্যে পাওয়া যায় পাকিস্তানিদের প্রোপ্যাগান্ডা র নমুনা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

“I am Jahir Raihan. I don’t belong to any political party. I am a writer and a film maker. But I saw, in Bangladesh, the most surprising aspect of that war; when a military unit was moving for an operation after destroying and killing people, they were taking shots by a movie camera […]  After compelling the […] to loot a shop they were taking shots of those looters through a movie camera. And later on when I heard and when I saw that, they edited those portions and release it.... And telling and showing that, Bengalis are killing non – Bengalis and because of that chaos and confusion, they had to intervene. It was an utter lie.”[44]

পাকিস্তানি শাসকদের প্রোপ্যাগান্ডার অংশ হিসেবে বিখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারেনহাস এসেছিলেন ঢাকাতেআসার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যাকে অস্বীকার করে বিশ্বকে জানানো যে সবকিছু স্বাভাবিকই আছে। তাঁর ভাষায়, “পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে পাকিস্তানী কজন সাংবাদিক ও আলোক চিত্রশিল্পী সহ আমিও ঢাকায় গিয়েছিলাম। পূর্ববাংলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছেএ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করা ছিল আমাদের কাজ বা এ্যাসাইনমেন্ট[45]নিজের পেশাগত ও মানবিক দায়বদ্ধতার কারণেই অতঃপর অনেকটা পালিয়ে গিয়ে লন্ডনে সানডে টাইমসএর মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়েছিলেন আসলে কি হচ্ছিল এই বাংলায়। এই রিপোর্টকে নিয়ে পরে পাকিস্তান অবজারভারপ্রতিবেদন ছাপায় “Mascarenhas report in Sunday Times malicious” শিরোনামে।

মে মাসের পাঁচ তারিখে পাকিস্তান সরকার যে প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করে সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের সংকট নিয়ে সরকারী বক্তব্য হাজির করে। শুরুতেই, বিস্তর বিবরণ দেয়া হয় কিভাবে হিন্দুভারত মুসলমানপাকিস্তানকে ধ্বংস করে দিতে যাচ্ছে এবং ব্রিটিশ আমলে কিভাবে হিন্দু শিল্পপতিরা এই এলাকাকে পশ্চাৎপদ করে রেখেছিল। বলা হয়, ‘হিন্দু মাতৃভূমিতৈরি করার জন্যে ভারত পাকিস্তানের জনগণের আনুগত্য ধ্বংসের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে সময়ের বাঙ্গালি নেতাদের দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়, ‘ইন্ডিয়া তার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু প্রতারক এবং সহযোগী পেয়েছে।পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণ হিসেবে অত্যধিক জনসংখ্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যাকে দোষী করা হয়। মার্চে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, সে সম্পর্কে প্রচারপত্রে বলা হয়, ‘১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ বেসামরিক প্রশাসন পুরো পঙ্গু হয়ে পড়ে। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের খবরের প্রতিবেদন আসতে থাকে প্রদেশ জুড়ে -ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট সহ অন্যান্য শহরে ফ্যাসিস্ট হিস্টিরিয়ার ঢেউ উঠে।এমতাবস্থায় দেশকে বাঁচানোর জন্যেই সেনাবাহিনী পালটা আঘাতের একটি সিরিজের উদ্যোগ নেয়সুচিন্তিত এবং সুগঠিতআক্রমণের মাধ্যমে পুরো শহরের চেহারা পালটে দেয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা[46] প্রচারপত্রে বিভিন্ন অপযুক্তি প্রদর্শন করলেও প্রকারান্তরে  মেনে নেয়া হচ্ছে অপারেশন সার্চলাইটের তাণ্ডবের কথা। সংবাদপত্রে বিভিন্ন প্রকারের নিষেধাজ্ঞা জারির পরও যেহেতু আক্রমণের কথা লুকাতে পারছিল না কোনভাবেই, তাই প্রয়োজন পড়ে এর বৈধতা প্রদানের। এছাড়া ডিসেম্বর মাসে ওয়াশিংটন পাকিস্তান দূতাবাস থেকে আরেকটি প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে মার্চ মাসের প্রতিদিনকার সরকারী বয়ান হাজির করে দেখানো হয়, পয়লা মার্চ হতে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা লুটপাট এবং চরমপন্থি গ্রুপের অগ্নিসংযোগ এবং হত্যারকারণেই পঁচিশে মার্চ রাতে সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়। [47] 

তখন জুন মাস, ভারতে আশ্রয় নেয় শরণার্থীদের সংখ্যা তখন ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছিল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও আসতে শুরু করে। এমতাবস্থায়, ওয়াশিংটনের পাকিস্তানি দূতাবাস তাদের প্রচার পুস্তিকায় শরণার্থী সমস্যার পাকিস্তানী ব্যাখ্যা হাজির করে। কেন এত মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে, এর কোন জবাব দেয়ার চেষ্টা না করেই বলা হয়, ‘ভারত সমস্যাকে কাজে লাগাচ্ছে।কিন্তু কেন এই সমস্যার উদ্ভব হল সে প্রসঙ্গে কোন কথা না বলে  দাবি করা হয় শরণার্থীদের সংখ্যা অতিরঞ্জিত। বলা হয় যে, ‘ভারত চাইছে তার পছন্দ মতো শরণার্থী সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে, যা আসলে বিদ্রুপকারী শোষণের নামান্তর[48]   

জুন মাসে পাকিস্তান সরকার আরেকটা প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সংকটবিষয়ে আলোচনা করা হয়। পুরো পরিস্থিতির দায়ভার চাপিয়ে দেয়া হয় শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগের ওপর। সেখানে বলা হয় যে আর্মি জনগণের ওপর আক্রমণ করে নাই, করেছে শত্রুর উপর। এবং শত্রু হচ্ছে তারাই যারা ভিতর এবং বাইরের বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ভারতীয় অণুপ্রবেশকারীমার্চ মাসে আন্দোলনকারী জনতার ওপর যে গুলি চালানো হয়েছে এ বিষয়ে পাকিস্তানি সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, সৈন্যরা ডাকাত শ্রেণির লোককেই গুলি করেছে।[49]   

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এক বাঙালি অধ্যাপকের সাহায্যে তখন তৈরি করে ডকুমেন্টারি, “The Great Betreyal” – যা দেখার পর ইয়াহিয়া প্রশ্ন করেছিলেন, “I hope all the devastation shown in the film is not result of army action”অবশ্য পরে আর রিলিজ দেয়া হয় নি এটা।

পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির হাতিয়ার হিসেবে পাকিস্তানি পত্রিকাগুলোও নিরলস ভাবে কাজ করতে থাকে। উপরে উল্লেখিত পাকিস্তানি প্রচারপত্রের ভাষ্যই ঘুরেফিরে তারা প্রচার করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিংবা রাজাকারদের কোন সম্মুখযুদ্ধকে তারা ভারতীয় দালালদের সাথে যুদ্ধ বলে উল্লেখ করতো। যদিও ভারতের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ  শুরু হয়েছিল ডিসেম্বর মাসের শুরুতে, কিন্তু এপ্রিল থেকেই পাকিস্তানি পত্রিকাগুলো ভারতের সাথে যুদ্ধ বলে রিপোর্ট প্রকাশ করতো।  মুক্তিবাহিনীর কথা কখনো উচ্চারণ করে নি, তাদেরকে সম্বোধন করার জন্যে কিছু প্রত্যয় নিয়মিত ব্যবহার করা হতো, যেমন, ‘দুষ্কৃতিকারী’, ‘ভারতের দালাল’, ‘ইন্ডিয়ান এজেন্ট’, ‘অ্যন্টি-স্টেট এলিমেন্ট’, ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীএই দুষ্কৃতিকারীকারা, তাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানি সরকারের তরফ হতে দুষ্কৃতিকারী ধরিয়ে দেয়ার জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়। সে ঘোষণাপত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার পুরষ্কারের কথা উল্লেখ করা হয়; যেমন, দুষ্কৃতিকারী যদি  ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয় তাহলে তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার ৭৫০.০০ টাকা। আবার, দুষ্কৃতিকারী যদি  দলের নেতা হয় তাহলে তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার ২০০০.০০ টাকা। কারা তাহলে এই দুষ্কৃতিকারী? তারও সংজ্ঞা দেয়া ছিল ঘোষণাপত্রে। মোট যে পাঁচটা শ্রেণিতে ভাগ করা হয় দুষ্কৃতিকারীদের, তা নিম্নরূপ
•         তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত সদস্য, তথাকথিত মুক্তিবাহিনী ভর্তিতে সাহায্যকারীরা ।
•         স্বেচ্ছায় বিদ্রোহীদের খাদ্য, যানবাহন ও অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহকারী।
•         স্বেচ্ছায় বিদ্রোহীদের আশ্রয়দানকারী।
•         বিদ্রোহীদের ইনফরমারবা বার্তাবাহকরুপে যারা কাজ করে এবং
•         তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সম্পর্কিত নাশকতামূলক লিফলেট, প্যাম্পলেট, প্রভৃতির লেখক বা প্রকাশক।[50]

মোদ্দা কথা, যারাই মুক্তিযুদ্ধের সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তারা সবাই দুষ্কৃতিকারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যভাবে বললে, হাতে গোনা কিছু দালাল ব্যতীত বাংলার সকল মানুষই ছিল শাসকগোষ্ঠীর চোখে দুষ্কৃতিকারী। এই প্রচারণার দরকার ছিল  গণহত্যাকে জাস্টিফাই করতে, কেননা, যদি মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতিকারী' কিংবা অপরাধী বানিয়ে ফেলা যায় তাহলে তাদের উপর আক্রমণটাও বৈধতা পেয়ে যায়। রাজাকারদের সমাবেশ অথবা মিছিলের খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হতো; পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে এবং  বিচ্ছিন্নবাদীকে প্রত্যাখ্যান করেছে এটা প্রমাণ করাই ছিল ওই খবরগুলোর উদ্দেশ্য।  পত্রিকাগুলো তখন জোর দিত পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিকএ সংক্রান্ত খবরের দিকে। 


পাকিস্তান অবজারভার নভেম্বরের দিকে রাজকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নিহত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করে ‘Razakars killed 19 Indian Agent’ শিরোনামে। আগস্ট মাসের আরেকটা রিপোর্ট ছিল 70 anti-state elements killed in Mymensingh’ শিরোনামে। খবরে বলা হয়, The razkars in Mymensing district killed 70 anti-state elements and injured many besides capturing a huge quantity of arms and ammunition during last month’. লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, প্রতিটা খবরের উপস্থাপনা এমনভাবে ছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা (তাদের ভাষায় দুষ্কৃতিকারী) যেন যুদ্ধ করতে না গিয়ে জনসাধারণের উপর হামলা করতে গিয়েছিল, কিংবা সন্ত্রাসী (চুরি কিংবা ডাকাতি) কার্যকলাপে গিয়েছিল এবং সেখানে গিয়ে ধরা পড়েছে। অর্থাৎ, ‘যুদ্ধকথাটা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা হতো, কেননা যুদ্ধের কথা বললে স্বাভাবিক অবস্থার খবর ভিত্তিহীন হয়ে যায়।

পাকিস্তান অবজারভার ৩০ এপ্রিল Life returing to noromal in Sylhet শিরোনামে সিলেট শহর নিয়ে যে খবর প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়, ‘সেনাবাহিনী দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় দালালদের হাত থেকে মুক্ত করার পর সিলেট শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহের জীবন দ্রুতই স্বাভাবিক হচ্ছে। দিনের বেলায় শহর জীবনভারে জীবন্ত হয়ে উঠছে। দোকান পাট ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে এবং সাধারণ মানুষ তার প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেজিন্দাবাজার ও বন্দরবাজার মানুষের ভিড় এতটাই হচ্ছে যে, কাঁধের সাথে কাঁধ না মিলিয়ে হাটা দুরূহ হয়ে পড়ছে। ...পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আছে। ...আর্মি বর্তমানে ব্যস্ত সময় পার করছে বাকী দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের নির্মূল করতে। দুষ্কৃতিকারীরা এলাকার জঙ্গল ও বনাবৃত পাহাড় গুলোর সুবিধা কাজে লাগিয়ে জনগণকে হয়রানি করছে’ 

জুনের ৩০ তারিখ ফরিদপুর নিয়েও এরকম প্রতিবেদন প্রকাশ করে পত্রিকাটি, Faridpur humming with activities শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, Economic and social activities in Faridpur district have returned to normal. খবরে আরও উল্লেখ করা হয় যে, যারা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তারা আবার ফিরে এসেছেন এবং থানায় থানায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই সাথে জনগণ সমাজবিরোধীকর্মকাণ্ডে জড়িত কয়েকজনকে আটকও  করেছে, এটাও বলা হয়। স্পষ্টতই, এখানে মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই সমাজবিরোধী বলা হচ্ছে।  খবর পড়ে যে কারো মনে হতে পারে লোকেরা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল ওই সমাজবিরোধীদের জন্যে।

পাকিস্তান হতে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে যে বিজ্ঞাপন- বিভিন্ন পণ্য কিংবা প্রতিষ্ঠানের- প্রচার করা হতো সেখানে যুদ্ধ সম্পর্কে  সম্মতি উৎপাদনের আরও ভয়াবহ চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। সেগুলোতে মূলত, যুদ্ধকে পুরোপুরি ধর্মীয় লেবাস দিয়ে, মানে জেহাদ আখ্যায়িত করে, বাঙালিকে প্রকারান্তরে  কাফের বা ইসলামের শত্রু বলে চিহ্নিত করা হতো। এই মতবাদও প্রচার করা হতো যে, বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা (তাদের ভাষায় জেহাদ) ফরজ।

মুক্তিযুদ্ধ যে বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রাম, তা থেকে বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ একে ভারতের সাথে যুদ্ধদাবি করতে থাকে। বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে তারা ভারতের বিরুদ্ধে বিষেদগার করে যুদ্ধের আবহ নির্মাণের চেষ্টা করেন। তাদের বিবৃতি দেখলে মনে হয় পূর্ব বাংলার মানুষ আসলে মুক্তিযুদ্ধে লড়ছিল না, বরং, ভারতই তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় লড়ছিল। এই যুদ্ধকে ভারতের সম্প্রসারণবাদ বলে প্রমাণ করতে আদাজল খেয়ে পানিতে নামেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। সেই সাথে চলতে থাকে উস্কানিমূলক বিবৃতি। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, দেশ রক্ষার্থে তিনি অবশ্যই যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। আগস্ট মাসে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘If fighting continues along the border between East Pakistan and India, it may lead to war…I can not just tell my army to stop it and take it. For the defence of the country, I will not turn the other check. I will hit back’. [51]    

অক্টোবরে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ করেন। তার বক্তৃতা শুনে মনে হবে না যে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা যে মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। বরং, তিনি তা অস্বীকার করে তার মত হচ্ছে যে, ভারতের মদদেই ষড়যন্ত্র হচ্ছে। নভেম্বর মাসে নিউজউইকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘I have no reason to tell you war is inninent because it is… If the Indians escalate with a view to capturing territory and installing a puppet Bangla Desh regime, the will be war.’  নভেম্বরের শেষের দিকে এপিতে দেয়া আরেক বিবৃতিতে বলেন, ‘In ten days I might not be here in Rawalpindi, I will be fighting a war.’ [52]

পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট খান আবদুল কাইয়ুম আগস্ট মাসে এক বিবৃতিতে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করার হুমকি দেন। সিন্ধ এর গভর্নরও একই ধরণের কথা বলেন এক বক্তৃতায়। আজাদ কাশ্মীর অংশের প্রেসিডেন্ট বিবৃতিতে বলেন, ‘দুই জাতির মধ্যে এটাই হবে শেষ যুদ্ধ এবং ধর্মের ভিত্তিতে এই যুদ্ধ হবে।মুলতানের এক সমাবেশে ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আমাদের আর্মি যুদ্ধের জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত এবং, ‘now we do not need any notice for waging a war.’ পাকিস্তানের তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আখতারুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘পাকিস্তানের মানুষ ভারতের নোংরা ও অসাধু খেলা ধরে ফেলেছে। তারা ভারতের শয়তানি চূর্ণ-বিচূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।পিপিপির প্রধান ভুট্টো তার দলের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন ভারতীয় আগ্রাসন চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে পিপিপি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবে।লে জেনারেল বখতিয়ার রানা বলেন, ভারত, তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব স্বত্বেও পাকিস্তানকে কখনো পরাজিত করতে পারবে না। যদি আমরা একতাবদ্ধ থাকি, ‘India will get another crusing defeat.’ মেজর জেনারেল আকবর খানও একইভাবে পাকিস্তানের যুদ্ধ জয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে কথা বলেন। তার মতে, যদি যুদ্ধ হয়, তবে পাকিস্তান অবশ্যই জিতবে। সুবা সিন্ধের জামায়াতের ইসলামির আমীর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার তাগাদা দিয়ে বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদের জন্যে জাতিকে প্রস্তুত করুন। একইভাবে জামিয়াতুল উলেমা-ই-পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদের আহ্বান জানায়। তারা বলে, ‘আমরা শুধু আমাদের পবিত্র ভূমি রক্ষাই করব না, বরং, ভারতকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিব। এবার আমাদেরকে কেউ রুখতে পারবে না।নিজামী ইসলামিপার্টির এক নেতাও বলেন, পাকিস্তানের বারো কোটি মুসলমান প্রতি ইঞ্চি মাটির জন্যে লড়বে এবং ভারতকে হারিয়েই ছাড়বে। [53]      

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মিডিয়া মূলত তাই প্রচার করে যা সরকার কিংবা সমাজের এলিট শ্রেণি  চায়। আন্তর্জাতিক যে কোন ইস্যুতে দেশের সরকারী দৃষ্টিভঙ্গিটাই কোন না কোনভাবে সে দেশের মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদে প্রতিফলিত হয়। একাত্তরে এর প্রমাণ পাওয়া যায় New York Times  এবং লন্ডনের The Times পত্রিকার সংবাদে। তারা একধরণের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে তাদের প্রকাশিত সংবাদে। যুদ্ধ সংক্রান্ত খবরে তাদের মনোযোগ ছিল সামরিক যুদ্ধ এবং ভবিষ্যদ্বাণীমূলক খবরের দিকে। বাংলাদেশের যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্ব-শক্তিগুলোর অংশগ্রহণই ছিল তাদের পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের প্রধান বিষয়। যুদ্ধের সহিংসতা এবং বাংলাদেশের মানুষদের দুর্ভোগ তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সরকারের মতো এই পত্রিকাগুলোর কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আন্তর্জাতিক সংঘাতের অংশবিশেষ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মেরুকরণের ফল। এভাবে, পত্রিকাগুলো তাদের সরকারী বয়ানই তুলে ধরে একধরনের নিরপেক্ষ কণ্ঠ বজায় রেখে। অন্যভাবে বলতে গেলে, তাদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধ মোটেও উদ্বেগের বিষয়বস্তু ছিল না [54]। 

প্রচারণার মনস্তাত্ত্বিক কৌশল সম্পর্কে একটা উদাহরণ দেয়া যাক। একাত্তর সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আকস্মিক ভাবে ভারতের একাংশে অবতরণ করার ঘটনাকে আমেরিকা ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এপি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডানকার্কে ব্রিটিশ বাহিনীর অবতরণের সাথে তুলনা করে বলেছিলদ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ওই ঘটনার পর এটাই হচ্ছে সর্ববৃহৎ অভিযান। কিউবার সমাজবিজ্ঞানী নিওনার্দো আকোস্টা লিখেছেন, ‘এই প্রতি তুলনা অত্যন্ত স্পষ্ট: পাকিস্তানিদের চিহ্নিত করা হয়েছে ব্রিটিশদের (ভালোদের)  সঙ্গে, এবং, ভারতীয়দের জার্মানদের (খারাপদের) সঙ্গে।[55]

দৈনিক সংগ্রাম

পাকিস্তানিরা যখন বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে, তখন কিছু দক্ষিণ-পন্থী দল ও ওই মানসিকতার লোকেরা এগিয়ে আসে গণহত্যার তীব্রতা বাড়াতে এবং গণহত্যাকে জাস্টিফাই করতে। পূর্ববাংলায় দক্ষিণ-পন্থী দলগুলোর জনসমর্থন কখনোই ছিল না, উল্টো সত্তরের নির্বাচনে তারা একেবারেই জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। যেহেতু জনসমর্থন ছাড়া ক্ষমতার স্বাদ কোনভাবেই পাওয়া সম্ভব না, সেহেতু, তারা বিকল্প পথ ধরে; সামরিক গোষ্ঠীর পদলেহন করে ক্ষমতার ছিটেফোঁটা ভোগ করাটাই ছিল তাদের বিকল্প পথ। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলায়, এদের দালালহিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই দালালরা পুরো নয় মাস জুড়ে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করার জন্য মিছিল মিটিং সভা সমাবেশ করেছেএমনকি, পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ডকে জায়েজিকরণের ব্যবস্থাও করেছে।  তাই, স্বভাবতই দেখা যায়, পাকিস্তানি পত্রিকাগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার জন্যে যে প্রত্যয়সমূহ ব্যবহার করেছে, দালালরাও তাদের পত্রিকা, লিফলেটে সেগুলোই ব্যবহার করেছে। 

দক্ষিনপন্থী এই দলগুলোর প্রতি সামরিক শাসকদের সমর্থন কতটুকু ছিল, কিংবা অন্যভাষায় বলতে গেলে, দক্ষিনপন্থীরা কেন পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে গলা ফাটাচ্ছিল সেটা বুঝা যায় সত্তরের নির্বাচনের সময়। নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলোকে সাহায্য করার জন্যে শিল্পপতিদের ওপর চাপ দিয়ে প্রায় ২২/২৩ লক্ষ টাকা জোগাড় করে দেয়া হয়েছিলো। তবু নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে, এজন্যে অবশ্য শাসকগোষ্ঠী দায়ী করেছে ইসলামপন্থী দলগুলোর বিভক্তিকেই। অনেকে তাই দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন কেন এই ইসলামিদলগুলো একত্রে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো না।[56] অর্থনৈতিক এই হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী দালালদের পত্রিকাগুলোও কথা বলেছে শাসকগোষ্ঠীর সুরেই।    

একাত্তরেও, আলবদররা শুধু যে আদর্শিক জায়গা থেকে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছিল তাও না, বরং, পাকিস্তানি শাসকেরা এসব দালালদের জন্যে নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থাও করেছিল। সাধারণ দরিদ্র মানুষদেরকে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হতে প্রলুব্ধ  করতে সামরিক বাহিনী তখন উচ্চহারে বেতনের ব্যবস্থা করেছিল। রাজাকাররা সেনাবাহিনী ও মুজাহিদদের মতো ফ্রি রেশন পাবে, এই ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল তখন।  তাই, তাদের প্রোপ্যাগান্ডা-মাধ্যম যে সামরিক গোষ্ঠীর আর্থিক মদদ পুষ্ট ছিল সেটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। 
পূর্বপাকিস্তান থেকে যে পত্রিকাগুলো পাকিস্তানের পক্ষে প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়েছে, তন্মধ্যে আইএসের অর্থায়নে প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামঅন্যতম। জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করা এই পত্রিকা পুরো একাত্তর জুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও শাসকদের প্রোপ্যাগান্ডা র অংশ হিসেবেই কাজ করেছে। জামায়াত-ই-ইসলাম ও মুসলিম লীগের সাথে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর সম্পর্ক ছিল খুব মধুর। একাত্তরে, পঁচিশে মার্চের রাতের পর থেকে এই সম্পর্ক আরও নগ্নভাবে ধরা পড়ে জামায়াত ও মুসলিম লীগের নেতাদের কর্মকাণ্ডের কারণে। দৈনিক সংগ্রামযোগ্য মুখপাত্র হিসেবেই তখন কাজ করেছে। তাদের খবরগুলো থেকে দুটো বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা পাওয়া যায়। এক, কিভাবে একাত্তর নিয়ে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার চালানো হয়েছে, এবং দুই, জামায়াত ও মুসলিম লীগের নেতারা কি করেছেন।

দৈনিক সংগ্রামএ প্রকাশিত বিভিন্ন খবর ও সম্পাদকীয়গুলোর সংকলন প্রকাশ করেছেন আলী আকবর টাবী; নাম দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকা [57] পরবর্তী আলোচনার যাবতীয় তথ্য নেয়া হয়েছে আলী আকবর টাবীর তথ্যবহুল সে বই থেকে। ১৯৭১ সালের মার্চ ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত খবর এবং সম্পাদকীয়গুলোকে মোটা দাগে চার ভাগে ভাগ করা যায়:
১) শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রশংসা এবং দুষ্কৃতিকারীমুক্তিবাহিনী নিধনের কিংবা নিধনে উৎসাহদানের খবর।
২) গোলাম আযম, মওদুদী, নিজামী, মুজাহিদ সহ শান্তি কমিটির বিবৃতি সমূহ।
৩) আওয়ামী লীগের সাথে একত্র হয়ে হিন্দু তথা হিন্দুস্থান কর্তৃক ষড়যন্ত্র; খবরে ভারত আর হিন্দু আসলে সমার্থক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।  অর্থাৎ, ধর্মকে ব্যবহার করে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়।
৪) বিভিন্ন ব্যক্তিদেরকে নিয়ে রসালো, চটুল এবং অশালীন ভাষার খবর; কখনো কখনো সাহিত্য পাতায় কিছু কু সাহিত্য প্রকাশিত হয় যার মূল উদ্দেশ্য ছিল (৩) নম্বর পয়েন্ট, ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি।

একাত্তর সালের ২৫ শে মার্চ থেকে বাংলার জমিন হয়ে উঠে এক মৃত্যুপুরী; পাকিস্তানি ও তার দোসরদের দ্বারা হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ চলতে থাকে অবিশ্বাস্য মাত্রায়। মার্চের তিরিশ তারিখে প্রকাশিত এক সংবাদে নিহতের সংখ্যা ১৫ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়।[58] এপ্রিলের প্রথমার্ধেই টাইম পত্রিকা ধারনা করেছিল, মৃতের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানিদের আক্রমণ সম্পর্কে পশ্চিমা এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, এটা যথার্থই রক্তস্নান, সৈন্যরা চরম নির্দয়।[59] অথচ এর কোন কিছুই দৈনিক সংগ্রামেরচোখে পড়েনি। অপারেশন সার্চলাইটের সেই কালো রাত সম্পর্কে তাদের বয়ান ছিল পুরো উল্টো, নির্জলা মিথ্যায় ভর্তি। মার্চের প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনকে ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত উল্লেখ করে বলা হয়, ‘মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এ প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার নরনারীকে অমানুষিক ভাবে হত্যা করা হয়, বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়, ২৫ শে মার্চের মধ্যরাত্রিতে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিদ্রোহের সমস্ত পরিকল্পনা যখন সম্পূর্ণ হওয়ার পথে এমন এক সংকট মুহূর্তে আল্লাহর অফুরন্ত রহমতে পাক সেনাবাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হয়(দৈনিক সংগ্রাম, ৭ আগস্ট, ১৯৭১)

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সামরিক শাসন কিছু নির্দিষ্ট প্রত্যয় ব্যবহার করতো; তাদের সাথে সুর মিলিয়ে দালাল গোষ্ঠীও একই কাজ করতে থাকে। তাইএই দুষ্কৃতিকারীদের শায়েস্তা করে পাকিস্তানের শান্তি বজায় রাখার জন্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল এরা পুরো নয় মাস। এ ধরণের খবর প্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত খবর লুকিয়ে জনগণকে গণহত্যার বিষয়ে অন্ধকারে রাখা, অর্থাৎ এক কথায় গণহত্যার প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থনদান। কিন্তু সমর্থন দিলেও এটাকে গণহত্যা বলে স্বীকার করে নেয়া যাবে না, তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলা উল্লিখিত হয় সময়োচিত পদক্ষেপহিসেবে।

অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেনারেল টিক্কা খান। মার্চের শুরুতেই তাকে পূর্বপাকিস্তানে নিয়োগ করা হয় সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। তার নিয়োগের পূর্বে আরও দুজনকে সরিয়ে ফেলা হয়, কেননা তারা অপারেশনে অংশগ্রহণ করতে অপারগতা জানিয়েছিলেন। বেলুচিস্তানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্যে জেনারেল টিক্কা খানকে  তখন বেলুচিস্তানে কসাই নামে ডাকা হত।  কিন্তু, দৈনিক সংগ্রামের নিকট তিনি ছিলেন একজন মহাবীর, যার কর্মের জন্যে তারা কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করছিল। সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করে, ‘পাকিস্তানের ইতিহাসে এক চরম সংকট সন্ধিক্ষণে তিনি যে বীরত্ব, নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন, এ দেশের ইতিহাসে তাঁর এ কীর্তি যেমন চিরদিন অম্লান ও অক্ষয় হয়ে থাকবে, তেমনি এ দেশবাসী তাঁর কাছে থাকবে কৃতজ্ঞ(দৈনিক সংগ্রাম, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)

৮ এপ্রিল ভারতীয় অপপ্রচারের ব্যর্থতাশিরোনামের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘নতুন করে জাতীয় মীর জাফরদের তারা চিনবার সুযোগ পেয়েছে। ভারত ও তার এজেন্টদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে যে কোন মূল্যে তারা স্বদেশ ও জাতি রক্ষার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে

এপ্রিলের দিকে যখন শরণার্থীর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলছে, তখন ১২ এপ্রিল অর্থনীতি পুনর্গঠনসম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘গত মাসে রাজনৈতিক আন্দোলন হিংসাত্মক পথে মোড় নেয়ার পর যারা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তারাও ফিরে আসছেন, এমনকি যারা প্রদেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন তারাও পরে আসছেন...অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার এক পর্যায় থেকে শান্তি ও শৃঙ্খলার  দিকে দেশের উত্তরণ ঘটেছে

১৫ এপ্রিলের সম্পাদকীয়তে বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ করার জন্যে সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ‘সরকারের কাছে আরজ করা হচ্ছে ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও অনুপ্রবেশকারী নিয়ে এখনও কিছু সংখ্যক ভারতীয় চর পূর্ব পাকিস্তানের কোন কোন পল্লী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে বলে শোনা যায়, তারা যেন অনতি বিলম্বে সে সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে প্রদেশের শহরগুলোর মতই দুষ্কৃতিকারী মুক্ত করে স্বাভাবিক জনজীবন ফিরিয়ে আনে

৩০ এপ্রিল নৈরাজ্যের অবসানলেখায় পাকি বাহিনীর প্রশংসা করে লেখা হয়, ‘মাত্র এক মাসের ভিতর আমাদের ঐতিহ্যবাহী পাক সেনারা পূর্ব পাকিস্তানের গোটা ভূখণ্ড নাপাক হিন্দুস্তানি অনুপ্রবেশকারী ও অনুচরদের হাত থেকে মুক্ত করে এ এলাকার জনতাকে দুঃসহ এক অরাজকতার রাজ্য থেকে মুক্তি দিয়েছে

২৭ মে দেশপ্রেমিক জনগণ পুরস্কৃতশিরোনামে বলা হয়, ‘দুষ্কৃতিকারীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্যে কর্তৃপক্ষ জনগণের মধ্যে এক হাজার টাকা বিতরণ করেছেন […] দুষ্কৃতিকারীদের ধরিয়ে দিলে বা তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য জানালে কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত পুরষ্কার দেবে৯ জুন প্রথম পাতার খবরের শিরোনাম ছিল, ‘পুনর্বাসন কাজে সেনাবাহিনীর আত্মনিয়োগ৮ জুলাই এক খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিষেদগার করে বলা হয়, ‘দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানএ ধরণের অসংখ্য খবর তখন প্রকাশিত হতে থাকে।

এখানে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শুধুমাত্র দুষ্কৃতিকারী কিংবা সেনাবাহিনীর প্রশংসাই করা হচ্ছে না, বরং, ‘পুরষ্কারপ্রদানের খবর প্রচারিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু, প্রশ্ন হল, তাহলে পুরস্কার কি জনগণকে দেয়া হয় নাই? আসলে শান্তি কমিটি, রাজাকার নামে যে বেতনভুক দালাল বাহিনী গঠন করা হয় তারাই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ধরিয়ে দিত এবং নিজেরা এসব খবর প্রকাশ করতো সাধারণ জনগণের নামে। সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার তাদের এই প্রচেষ্টা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে তা বলা মুশকিল।

এবার দেখা যাক দ্বিতীয় ধরণের খবর: পাকিস্তানি দালালদের বিবৃতিসমূহ। যুদ্ধ শুরুর কয়দিন পর, এপ্রিলের শুরুর দিকে গঠিত শান্তি কমিটিনামক সংগঠনটির আড়ালে আসলে লুকিয়ে ছিল জামায়াতে ইসলামী। এই শান্তি কমিটি থেকে ধীরে ধীরে রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি সশস্ত্র দল গঠিত হয়। এই দালালদের সাহায্য ব্যতিরেক পাকিরা এত বড় গণহত্যা এত কম সময়ে চালাতে পারত না।  তাদের  কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানিরা এতই খুশি ছিল যে জেনারেল নিয়াজী তাঁর বইটি রেজাকারদেরকেই উৎসর্গ করেন। রাজাকাররা পুরো নয় মাস জুড়েই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, সংঘর্ষ হলে খুন করেছে, লুটপাট ও ধর্ষণ করেছে, পাকিদের নারী সরবরাহ করেছেআর অন্যদিকে আলবদর  ছিল ডেথ স্কোয়াড এবং তাদের লক্ষ্যও ছিল স্থির। প্রকৃতিতে  তারা  ছিল অতীব  হিংস্র ও নিষ্ঠুর[60]দালালদের চিন্তাধারা ও আদর্শিক অবস্থানে পাকিস্তানিদের সাথে প্রচুর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দৈনিক সংগ্রামএর শান্তি কমিটির বিবৃতি সংক্রান্ত’-খবরে দেখতে পাওয়া যায়, সশস্ত্র একটা সহযোগী বাহিনী তৈরি করার জন্যে কিভাবে তারা বারে বারে অনুরোধ জানিয়েছিল পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে। এই সশস্ত্র বাহিনীর কারণেই যে সবদিকে শান্তি বিরাজ করছে সেটাও সবগুলো বিবৃতেই উল্লেখ থাকত। মোটামুটি প্রতিদিনই ছাপা হত এমন বিবৃতি, নমুনাস্বরূপ কিছু উল্লেখ করা যেতে পারে।

১১ এপ্রিল ঢাকায় শান্তি কমিটির গঠন ও এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘ঢাকায় দৈনন্দিন জীবন যাত্রার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে গতকাল শনিবার ১৪০ সদস্যের একটি নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে
         
১২ এপ্রিল একটি লেখায় শান্তি কমিটি গঠনকে একটি শুভ পদক্ষেপ আখ্যায়িত করে শিরোনাম করা হয়, ‘একটি শুভ পদক্ষেপনামেঠিক পরেরদিন, ১৩ এপ্রিল পাকিস্তান রক্ষার জন্যে গোলাম আযমের মোনাজাতের খবরও ফলাও করে ছাপা হয়।

২৮ মে শান্তি কমিটির মত আরও আরও কিছু বাহিনী গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়, ‘আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তান ও জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী নির্ভরযোগ্য লোকদের সমন্বয়ে একটি বেসামরিক পোশাকধারী বাহিনী গঠন করে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে অতি তাড়াতাড়ি এসব দুষ্কৃতিকারীকে নির্মূল করা সহজ হবে২ সেপ্টেম্বর সহযোগিতার দৃষ্টিতেনামক  উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর বিগত পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালে বারবার দাবী করেছিলেন যে দেশপ্রেমীদের সশস্ত্র করা হোক অন্যথায় পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটবে। সুখের বিষয় সরকার এ সঠিক পরামর্শ গ্রহণ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় দেশপ্রেমিকদের সামিল করেছে৭ অক্টোবর এক সম্পাদকীয়তে ঠিক একই ধরনের কথা বলা হয়, ‘রেজাকারদেরকেও ভারী অস্ত্র দেয়া আবশ্যক।  ১১ অক্টোবর আরেক সম্পাদকীয়তেও রাজাকারদের হাতে অস্ত্র দেয়ার জন্যে অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, ‘অন্যথায় রেজাকারদের মন দুর্বল হয়ে যেতে পারে।  নভেম্বরের ১২ তারিখে প্রকাশিত রোকেয়া হলের ঘটনাশিরোনামের সম্পাদকীয়তে সরাসরি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার উপদেশ দেয়া হয়। এতে বলা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তর থেকে যারা এ দুষ্কর্মকে সহায়তা করছে তাদেরকে যদি খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয় তবে সেটাই সঠিক পদক্ষেপ হবে বলে আমরা মনে করি। সেই সাথে বুদ্ধিজীবীদের ছদ্মবেশী দুষ্কৃতিকারীআখ্যা দিয়ে তাঁদেরকে উচ্ছেদের আহ্বান জানানো হয় এবং আশা করা হয় যে, এর মাধ্যমেই হিন্দুস্তানি চরদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করেদেয়া সম্ভব হবে।

২৬ জুলাই রাজাকার বাহিনীর প্রশংসা করে লেখা হয়, ‘ইতিমধ্যেই প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়ে তারা দুষ্কৃতিকারীদের দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেএছাড়া, ‘আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে রাজাকারদের গুলি চালনা ট্রেনিং’ (৪ জুলাই), ‘জনগণ এখন স্বেচ্ছায় রাজাকার ট্রেনিং নিচ্ছে (৯ জুলাই) ধরণের খবর তখন নিয়মিতই ছাপা হত।

দৈনিক সংগ্রামে নিয়মিত প্রকাশিত গোলাম আযম, মওদুদী, নিজামীদের কিছু বিবৃতি তুলে ধরা হয়েছে নিম্নে:

দুষ্কৃতিকারীরা জনগণকে রেডিও পাকিস্তান শুনতে দেয় না- গোলাম আযম (১৭ জুন)
বর্তমানের এমন কোন শক্তি নাই যা সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে- গোলাম আযম (২১ জুন)
সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ছিল না- গোলাম আযম (২২ জুন)
৬ দফা কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া- গোলাম আযম (২৩ জুন)
মুজিবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জনতা সমর্থন করেনি- মওদুদী (৭ জুন)
প্রেসিডেন্টের শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা খুবই যথোপযুক্ত এবং জামায়াত একে অভিনন্দন জানিয়েছে- মওদুদী (৩০ জুন)
পাকিস্তান কোন ভূখণ্ডের নাম নয়, একটি আদর্শের নাম- নিজামী (১৬ আগস্ট)
পাকিস্তানকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা এ দেশ থেকে ইসলামকেই উৎখাত করতে চায়- নিজামী (২৩ আগস্ট)
ছাত্রসংঘ কর্মীরা পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি জায়গা রক্ষা করবে- নিজামী (৮ সেপ্টেম্বর)
পাকিস্তান যদি না থাকে জামায়াত কর্মীরা দুনিয়ায় বেচে থাকার কোন সার্থকতা মনে করে না- গোলাম আযম (২৬ সেপ্টেম্বর) সেদিন আর খুব বেশী দূরে নয় যে দিন আল বদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যদুস্থ করে হিন্দুস্থানের অস্তিত্বকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে- নিজামী (১৪ নভেম্বর)
পাকিস্তান আল্লাহর ঘরনিজামী (১৬ নভেম্বর)

এবার দেখা যাক তৃতীয় ধরণের খবর: হিন্দু তথা হিন্দুস্থান কর্তৃক ষড়যন্ত্র বিষয়ক খবর। বলা হয়েছে যে, প্রায় অধিকাংশ খবরেই হিন্দু ও ভারত আসলে সমার্থক হিসেবেই তুলে ধরা হতো; যেখানে হিন্দুস্থানের ষড়যন্ত্র বলা হয়েছে সেখানে আসলে হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছিল। প্রথম দুই ধরণের খবর থেকেই দেখা যাচ্ছে, যেখানেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক খবর এসেছে সেখানেই এই হিন্দু তত্ত্বএসেছেএ ধরণের খবরের প্রধান টার্গেট ছিল মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা; তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তত্ত্বপ্রচার করে  এবং তাদের দ্বারা যে মুসলমানদের ক্ষতি হচ্ছে, যেমন, ‘মুসলমানদের দাড়ি জোর করে কেটে দিচ্ছে’(১৭ জুন) এমন উত্তেজনাকর  খবর প্রকাশ করে দুই ধর্মের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করাই ছিল প্রধান লক্ষ। আগেই বলেছিলাম, একাত্তরের পূর্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রচারণার ইসলামীকরণ শুরু করেছিল; একাত্তরে এসে সেই প্রচারণা সবচেয়ে বেশী কাজে লাগিয়েছিল দৈনিক সংগ্রাম। তাদের হিন্দু-তত্ত্বসংক্রান্ত কিছু খবর নিম্নরূপ,

রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি হিন্দু’ (১০ এপ্রিল, ভারতের মায়াকান্না)
আমরা গত ১ লা মার্চ থেকে থেকে তাদের তথাকথিত জয়বাংলার স্বেচ্ছাচার দেখেছি, তাদের লুঠতরাজ ও হত্যা অপহরণ আমাদের অনেকেই স্বচক্ষে দেখেছে। দেখেছে তাদের অমুসলিমদের সহযোগিতায় পাইকারি হারে মুসলমানের গলাকাটার লীলা’ (১৫ এপ্রিল, শিরোনাম: জনতা পাকিস্তান চায়)
জনাব তাজউদ্দীন পাকিস্তানকে অস্বীকার করে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণের সাথে সাথে তিনি স্বভাবতই শ্রী তাজউদ্দীন হয়ে গেছেন(৮ মে, শ্রী তাজউদ্দীনের বাংলাদেশ)
মুসলমানি ভাবধারা পুষ্ট জাতীয় সঙ্গীতের স্থান দখল করেছিল মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু কবির রচিত গান(১২ মে, সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশের ইতি হোক)
এ নতুন জাতির নাম হল জয় বাংলাজাত। তাদের কলেমা ও সালাম কালাম হল জয় বাংলা”, তাদের দেশের নাম বাংলাদেশ, তাদের ধর্মের নাম বাঙালি ধর্ম। এ ধর্মের প্রবর্তকের নাম দিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধু(১৩ মে, জয় বাংলা ধর্মমত)
মুসলমানদের জাত শত্রু ইহুদীরা আরব মুসলমানদের যেভাবে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে তেমনি ইহুদিদের পরম বন্ধু হিন্দুরাও একই যোগসাজশে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলোপের কাজ করে যাচ্ছে(১৫ জুন, আলেমদের বিরুদ্ধে হিন্দু প্রচারণা)
শত শত বাংলাভাষী আলেম ও ওলামা ও দাড়ি টুপী ওয়ালাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হোতাদের আসল রূপ আজ ধরা পড়েছে।’ (১২ আগস্ট, দালালদের স্বরূপ)
মুক্তিবাহিনী আসলে একটি হিন্দু বাহিনী।’ (৯ অক্টোবর)
তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর শতকরা ৯০ জনই এখন হিন্দু এবং তাদের চালাচ্ছে ভারতীয় আর্মি ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের অফিসাররা(১৩ অক্টোবর)
শেখ মুজিবের বাংলাদেশ ছিল আসলে হিন্দু ইহুদিদের বাংলাদেশ(৮ নভেম্বর, হিন্দু ইহুদী পরিকল্পিত বাংলাদেশ)

৬ মে শরণার্থী বাহানাশিরোনামের খবরে বলে, ভারতে কোন শরণার্থী যায়নি; অথচ, ৩ জুন খবরে বলা হয়, ‘ভারত এ নীতি নিয়েছে যে হিন্দু হলে শরণার্থী এবং মুসলমান হলে অনুপ্রবেশকারী। খাবার ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও হিন্দু মুসলমানের বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে। এমনকি কোন কোন শিবিরে মুসলমান যুবকদের আলাদা করে গুলি করে হত্যা করার মত ঘটনা ঘটেছেএখানেও হিন্দু - মুসলিম উত্তেজনা ছড়ানোর প্রচেষ্টা! ব্রিটিশ টেলিভিশনে বাংলাদেশের গণহত্যার ছবি প্রদর্শন করার পর সারা বিশ্বে যখন হৈচৈ পড়ে যায় তখন ১৯ জুলাই দৈনিক সংগ্রাম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিউপসম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘ব্রিটিশ টেলিভিশনে যে সব ছবি দেখানো হচ্ছে সে গুলো সাম্প্রতিককালের নয় বরং সেগুলো ঘূর্ণিঝড়ের সময়কার ছবি [...] সন্দেহ নেই ব্রিটিশ প্রচার মাধ্যমের এ ষড়যন্ত্র হিন্দুস্থান থেকেই প্রেরণা পেয়েছেএখানে উল্লেখ্য, তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বধীরে ধীরে এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করছিল যে তারা ব্রিটিশ পত্র পত্রিকা থেকে শুরু করে জাতিসংঘের মাঝেও ভারতীয় ও হিন্দুদের চক্রান্ত খুঁজে পেয়েছিল। ৫ জুলাই হিন্দুস্থানের চক্রান্ত জালে ব্রিটিশও ৬ জুলাই চক্রান্তকারী ভারতের আরেক দোসর মার্কিন পত্র পত্রিকা’  শিরোনামের খবরগুলো সে চক্রান্ত সংক্রান্তই।

সর্বশেষ ধরণের খবর: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াইরত নেতাদের নিয়ে রসালো অশালীন ভাষায় পরিবেশিত খবর। স্বভাবতই তাদের মূল টার্গেট ছিলেন শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী। যখন দেখত যে তাদের অপকর্মকে ঢেকে রাখতে পারছে না তখনই তারা আশ্রয় নিত  ব্যক্তিগত নোংরা আক্রমণের। দুটো উদাহরণ দেয়া যাক।

জুলাই মাসের ৬ তারিখ দশ হাত শাড়ীর রাজনীতিশিরোনামে যে লেখা প্রকাশ করে সেখানে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে শেখ মুজিবকে জড়িয়ে বলা হয়, ‘ইন্দ্রদেবের স্বর্গরাজ্যের ইন্দিরা দেবীর কথাই বলছি। [...] তাই আসুন ইন্দিরা দেবী এবারে মান অভিমান ছেড়ে দিয়ে সইদের মাধ্যমে খোশামোদ না চালিয়ে সোজাসুজি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। শেরোয়ানীর কাছে শাড়ীর আত্মসমর্পণে কোন লজ্জা নেই। তারপর আসুন মিলেমিশে যারা ঘর ভেঙ্গে ঘর করতে চায় তাদের ভালো হাতে দেখে নেই(দৈনিক সংগ্রাম, ৬ জুলাই, ১৯৭১)

অক্টোবরের ১৯ তারিখ একই ধরণের লেখা প্রকাশ করে রাজনৈতিক ধ্রুমজালশিরোনামে। বলা হয়, ‘বৈধ হোক কি অবৈধ, আমাদের মুজিবের সাথে যে তাঁর একটি সম্পর্ক আছে তা আজ আর তিন ঢেকে চালাতে পারছেন না। [...] মুজিব কোন প্রয়োজনে দু একবার ইন্দিরা দেবীর দিকে তাকিয়েছিলেন। সেটাকেই প্রেম ধরে নিয়ে ইন্দিরা দেবী যদি তাদের আদর্শ রমণীর রাধিকার মত চির জীবন ভাগ্নের গান গাইতে থাকেন, তো আমাদের কিছুই বলার থাকেনা। [...] আমাদের সবিনয় নিবেদন, ইন্দিরা দেবী যদি একান্তই আমাদের মুজিব কে ভালোবাসেন, তা হলে বিশ্বময় চেঁচামেচি করে মুজিবকে অধিকতর বিপন্ন না করে তাদের প্রেমের আদর্শ রাধিকার পথ অনুসরণ করুন। সে পথেই মুজিব ও তাঁর তথা মুজিবের দেশ ও তাঁর দেশের কল্যাণ নিহিত। আশা করি ইন্দিরা দেবী আমাদের এ নিবেদনটি নারী সুলভ আবেগের আতিশয্যে  উপেক্ষা করবেন না(দৈনিক সংগ্রাম, ২৯ অক্টোবর, ১৯৭১)

এছাড়া, ৭ নভেম্বর বদর দিবস উপলক্ষে দৈনিক সংগ্রামের সাহিত্য বিভাগে প্রকাশিত হয়েছিল আলবদর আলবদর  আলবদর  - ত্রি ওয়ান ত্রি, ত্রি ওয়ান ত্রি , ত্রি ওয়ান ত্রিনামক নাটিকা যার প্রতিটা লাইন জুড়েই ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষণীয়।

সংগ্রাম নিয়ে শেষ কথা:

উপরের প্রতিটি সংবাদ মনোযোগ দিয়ে পড়লে খেয়াল করে দেখবেন যে, তারা একদিকে যেমন প্রচার করছিল পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি বিরাজ করছে আবার অন্যদিকে বলছিল শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে শান্তি কমটিগঠনের কথা। একদিকে যেমন বলছিল শরণার্থী একটা বাহানা আবার অন্যদিকে বলছিল সেই শরণার্থী শিবিরে নাকি হিন্দু মুসলিম বৈষম্য চলছে। অর্থাৎ, কোন ভাবেই তারা সত্যকে চেপে রাখতে পারছে না, তাদের মুখ দিয়েই নিজের অজান্তে ফাঁস করে দিচ্ছিল তাদের কু কর্ম। তাদের খবরগুলোর ধরণ বিচার করলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ‘দৈনিক সংগ্রামআসলে গণহত্যাকারীর বয়ানটুকুই প্রকাশ করে পুরো নয় মাস জুড়ে। গণহত্যা অধিবেশন অনুযায়ী গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণ করা যেমন শাস্তিযোগ্য অপরাধ, ঠিক তেমনি গণহত্যার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করা(Conspiracy to commit genocide) কিংবা গণহত্যায় উস্কানি দেয়াও (Direct and public incitement to commit genocide)  শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত খবরগুলোতে এই দুটো অপরাধ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।

পাকিস্তানি এবং তাদের দোসরদের প্রোপ্যাগান্ডার ধরণ বুঝার জন্যে তাদের মতাদর্শিক স্থানটাকেও পর্যালোচনা করা উচিৎ; বিশেষ করে কেন এবং কিভাবে এই মতাদর্শ প্রচারের প্রয়োজন পড়লো তা আলোচনা করা জরুরী। পূর্বে উল্লিখিত নমুনা থেকে পরিষ্কার যে, তাদের বক্তব্য ও বিবৃতিতে অখণ্ডপাকিস্তানের মতবাদ প্রচার হয়েছে সর্বাধিক। পোকায় কাটাখণ্ডিত পাকিস্তান অখণ্ড-রূপ ধারণ করেছিল শুধুমাত্র একটা যোগসূত্র দিয়ে; সেটা হচ্ছে ইসলাম। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে যে জাতীয়তাবাদের উত্থান, তা পথ হারিয়ে ঢুকে পড়ে সাম্প্রদায়িকতার খোলসে। ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় হিন্দু-মুসলমান বিরোধে। এক জাতিতত্ত্বের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেয় দ্বি-জাতিতত্ত্ব। দুই তত্ত্বের জাতীয়তাবাদীরাই জাতি প্রশ্নের গোঁড়ায় না গিয়ে দিনশেষে কথা বলেছেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের ইচ্ছানুসারে, তাদের সুরে। এই যে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, তার জন্ম যেমন দেশি ও বিদেশি শাসকদের হাতে, তেমনি এর বিকাশও ঘটেছে তাদের হাতে, তাদের শ্রেণি স্বার্থের কারণেই। সাম্প্রদায়িকতাকে পরিচর্যা করে নেতা ও এলিট শ্রেণি  তাদের ফায়দা তুলে নিয়েছেন দুহাত ভরে। তাদের অমূলক, অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক জাতিতত্ত্বের কারণে যে পাকিস্তান জন্ম নেয় তার মধ্যে ধর্ম ছাড়া কার্যত কোন মিল ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেও অনেকেই এই পাকিস্তানের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। আশঙ্কা করেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর যখন এই অদ্ভুত রাষ্ট্রের সমস্যাগুলো উন্মোচিত হতে শুরু করলো, তখনই শাসকরা খণ্ডন রোধকরার জন্যে হাতিয়ার হিসেবে নিলো দুই অংশের একমাত্র মিলকে। মানে, ইসলামকে। শুরু হল ধর্মকে ব্যবহারের দ্বিতীয় পর্যায়। পূর্বে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছিল দেশকে খণ্ডন করতে, এবার ব্যবহার করা হল খণ্ডন রোধ করতে।

শাসক গোষ্ঠীর কাছে পূর্ব পাকিস্তান ছিল লোভনীয় স্থান, ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ করার জন্যে প্রকৃত স্থান। তারা যে তা করেছে সেটা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। একাত্তরে ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেটর কনসাল জেনারেল মি আর্থার কে ব্লাড এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানের দুই অংশে বিরাজমান বৈষম্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নীতি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্বার্থ জিম্মি।[61] দি সানডে টাইমস পত্রিকায় মাসকারেনহাস যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন সেখানেও তিনি উপনিবেশায়নের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার মতে পাকিস্তানের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াছিল আদতে উপনিবেশ বানানোর প্রক্রিয়া। সেনাবাহিনীর তরফ হতে পূর্ব বাংলা সংক্রান্ত সরকারী যে নীতির কথা তাকে বলা হয়েছিল তা নিম্নরূপ,
         ১) বাঙালিরা নিজেদেরকে অবিশ্বস্ত প্রমাণ করেছে এবং তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনে থাকতে হবে।
২) বাঙালিদের অবশ্যই সঠিক ইসলামি নীতিমালায় নতুন  করে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে দৃঢ় ধর্মীয় বন্ধন গড়ে তোলার অভিপ্রায়েই সরকারীভাবে জনসাধারণের ইসলামীকরণেরজিকির তোলা হয়েছে।
৩) নিহত ও পলায়নের মধ্য দিয়ে হিন্দুরা নির্মূল হয়ে গেলে, তাদের সম্পদ স্বল্প সুবিধাভোগী মুসলমান মধ্যবিত্তদের মন জয় করার ক্ষেত্রে সোনার মূল্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আর ভবিষ্যতে তা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে[62] 

মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে প্রয়োজন ছিল অখণ্ডপাকিস্তানের এবং এই অখণ্ডতার জন্যে প্রয়োজন হয়েছিল জনসাধারণের ইসলামীকরণেরজিকির তোলা। তা করাও হয়েছিল সরকারীভাবে। প্রচারণার কৌশল হিসেবে, পাকিস্তানি শাসক ও দেশীয় দালাল, সকলেই ধর্মকে ব্যবহার করছে  নগ্নভাবে। এর মূল কারণ, ধর্মের প্রতি মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের মনোজগতে বাংলার মানুষ সম্পর্কে যে ধারণা ছিল তা এই ইসলামীকরণপ্রক্রিয়াতে বেশ সহায়তা করেছে। তাদের দৃষ্টিতে বাঙালী  ছিল সর্বদা নিচু জাত, কমজোর মুসলমান এবং হিন্দু দ্বারা প্রভাবিত সংকর মুসলমান। একাত্তরে এত অধিক হারে নারী ধর্ষণের মূল কারণ ছিল তাই এই নিচু সংকর মুসলমানদের মধ্য থেকেই সাচ্চা ইমানদারি পাকিস্তানি প্রজন্ম তৈরি করা। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সাচ্চা ইমানদারি পাকিস্তানিতত্ত্বের সাথে নাৎসিদের খাঁটি জার্মানতত্ত্বের বেশ মিল পাওয়া যায়।

বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে যখন বাঙালি জাতীয়তাবোধের উত্থান শুরু হল, তা অসাম্প্রদায়িক রূপে হলেও, পাকিস্তানি শাসক চক্র এটাকে সাম্প্রদায়িক রূপে গ্রহণ করলো। তারা প্রচার করা শুরু করলেন এটা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ষড়যন্ত্র। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশই সরকারী এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিশ্বাস করেন। প্রচারণার তোড়ে অনেকেই ভেবেছিলেন, পূর্ব বাংলার প্রায় সকলেই হিন্দু হয়ে গিয়েছেন। এমনকি শাসক চক্রের মধ্যেই এ ধারণা এতই গভীরে প্রোথিত ছিল যে যুদ্ধের ২০ বছর পরেও তাদের মাথা থেকে যায় নি। তাই যখন আবিষ্কার করেছিলেন বাংলাদেশের টেলিভিশনে আজান প্রচার করা হয়, তখন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের এই মনোভাবেরই প্রতিফলন দেখা যায় তাদের প্রোপ্যাগান্ডাতে। তারা সুচারুভাবে বাঙালির স্বাধীনতার জন্যে লড়াইটাকে আখ্যায়িত করেছিলেন হিন্দু-মুসলমানএর জেহাদহিসেবে।

প্রচারণায়  ইসলামীকরণের প্রমাণ পাওয়া যায় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে পাকিস্তান ও ইসলামকে সমার্থক হিসেবে উপস্থাপনের মধ্যে। পাকিস্তান আল্লাহর ঘর’, এবং ইসলাম ও পাকিস্তান এক ও অবিচ্ছেদ্য’ – এমন উক্তিগুলো দৈনিক সংগ্রামে ঘুরেফিরে বারে বারে আসে। তাছাড়া , লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত যে চার ধরণের সংবাদের কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রায় অধিকাংশ সংবাদেই হিন্দুশব্দটা এসেছে, এবং সেটা নেতিবাচক অর্থে। দৈনিক সংগ্রাম ছাড়াও অন্যান্য পত্র-পত্রিকা সে সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে প্রবন্ধও ছাপায়।

প্রোপ্যাগান্ডার সময়ে এমন কিছু শব্দ বা প্রত্যয় ব্যবহার করা হয় আক্রান্তদের চিহ্নিত করতে, তা তাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। পূর্বেই বলা হয়েছে, প্রত্যয় ব্যবহার নির্ভর করে পরিস্থিতির উপরে। এককালের নিরীহ শব্দও কখনো কখনো পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে হয়ে ওঠে ভয়ংকর। দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে যেসব প্রত্যয় করতো, যেমন, ‘দুষ্কৃতিকারী’, ‘ভারতের দালাল’, ‘ইন্ডিয়ান এজেন্ট’, ‘অ্যন্টি-স্টেট এলিমেন্ট’, ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীতা বর্তমানে নিরীহ গোছের মনে হলেও তৎকালীন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে তা ছিল ভয়ংকর। যেহেতু এরা খারাপ’, তাই এদেরকে হত্যা করতে কোন অসুবিধা না। মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু দুষ্কৃতিকারীএবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদের নির্মূলকরছে, তাই সেনাবাহিনীর প্রশংসাও করতে হবে সাধ্যমত। উপরে যে চার ধরণের সংবাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে এই প্রত্যয়গুলোর প্রচুর ব্যবহার পাওয়া যায়। দৈনিক সংগ্রাম যখন রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি বলে প্রচার করে তখন রবীন্দ্রনাথের শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের দিকে ইঙ্গিত কর হয় না, বরং, একাত্তরের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে সেটা হয়ে উঠে বিদ্বেষপূর্ণ। ঠিক তেমনি দেখা যায় মুজিব -তাজউদ্দীনকেও হিন্দু বানিয়ে দেয়া হচ্ছে।

পরিস্থিতি অনুযায়ী  শব্দ-বাক্যের অর্থের ভিন্নতা দেখা দেয়। যে কোন সংঘাতের মূহুর্তে নিজের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা অন্য জাতির জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অন্য সময়ে, হয়তোবা তা খুব স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হতে পারে। পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠী এবং তাদের দালালদেরকে দেখা যায় বিভিন্ন সভা সমিতিতে বক্তৃতা প্রদানকালে, বিশেষ করে জনসাধারণের সামনে, ‘মুসলমানরা শ্রেষ্ঠএমন দাবি প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন[63]তাদের এমন দাবির মাধ্যমে প্রকারান্তরে  অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকে হেয় করা হয় এবং ওই পরিস্থিতিতে এ বক্তব্যগুলো মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যে হুমকিস্বরূপই ছিল।

পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রথম দিকে দৈনিক সংগ্রামের সংবাদগুলোতে ভয় উৎপাদনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।  উত্তেজনা ছড়াত মূলত Appeal to fear এর মাধ্যমে। মুসলমানদেরকে হিন্দুরা হত্যা করছে এই ধরনের খবর প্রকাশ করত জনসাধারণদের মনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সম্পর্কে ভয় ঢুকিয়ে দিতে। সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হিন্দুদের দালালআখ্যায়িত করে তাদের সম্পর্কেও নেতিবাচক ধারনা প্রচার করত যেন সাধারণ মানুষ জীবনের ভয় থেকেই আত্মরক্ষার্থেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে। দেখা যায়, যুদ্ধ যত এগিয়ে যায় দৈনিক সংগ্রাম গণহত্যার জন্যে বিভিন্ন পরিকল্পনাও দিতে থাকে। দেশীয় দালালদের  হাতে ভারী অস্ত্র শস্ত্র তুলে দিতে শাসকদের কাছে অনুরোধ করে। শেষের দিকে এসে সরাসরি হত্যার হুমকি ও প্ররোচনা দিতে থাকে তারা; অনেকটা রুয়ান্ডার মতোই।

ভাষা প্রয়োগে গণহত্যা লুকানোর চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। যেমন, সেনাবাহিনী হত্যা করেছে এমন সংবাদ প্রকাশ করা হত না। মানে, ‘হত্যাউল্লেখ করা হত না। হত্যার স্থলে ব্যবহার করা হত শত্রু নিধনকিংবা শুদ্ধি প্রক্রিয়ার মতো গালভরা নাম। কখনো কখনো আরও সুন্দর ও নরম ভাষায় বলা হত সময়োচিত পদক্ষেপঅনেকটা ভূট্টোর মতো করে। পঁচিশে মার্চ রাতের পর তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলেছিলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।       

এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষার হার ছিল খুবই অল্প। ১৯৬৭ সালের পরিসংখ্যান বলছে পূর্বাঞ্চলে সাক্ষরতার হার ছিল শতকরা ১৭.৬তাই ধরে নেয়া যায় যে, পত্রিকার পাঠকদের সংখ্যা অধিক ছিল না।  জনসাধারণের উপর পত্রিকার প্রভাবের মাত্রাও কম থাকাটাই স্বাভাবিক। এমন পরিবেশে জনসভার বক্তৃতা বিবৃতি প্রোপ্যাগান্ডার জন্যে খুবই কার্যকর। দৈনিক সংগ্রামএ প্রকাশিত দালালদের সভা সমাবেশ বিবৃতির  খবরের আধিক্য  তাদের প্রচারণার সে কৌশলের সত্যতা প্রমাণ করে। তবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একাংশের উপর যে পত্রিকাগুলোর প্রভাব পড়েছিল সেটাও অস্বীকার করা যায় না।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের  মাধ্যমে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং বাংলাদেশ নামক নতুন  রাষ্ট্রের জন্ম  হয়।

বাংলাদেশ এবং রুয়ান্ডার গণহত্যায় প্রকৃতিগত অনেক ধরনের মিল থাকলেও এর পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে কিছু মৌলিক অমিলও বিদ্যমান। প্রথমত, রুয়ান্ডার গণহত্যার পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার হাত বদল হয় কিন্তু পাকিস্তানের গণহত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দ্বিতীয়ত, রুয়ান্ডা গণহত্যাকারীদের বিচার শীঘ্রই শুরু এবং শেষ করতে পারে, কিন্তু আমরা যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্রই বিচারকার্য শুরু করলেও রাজনৈতিক উত্থান পতনের কারণে সে বিচার ৪৫ বছর পিছিয়ে যায়।

বলা হয়েছে, Der Sturmer পত্রিকার সম্পাদক জুলিয়াসকে গণহত্যায় উষ্কানিদানের জন্যে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছিল, যুদ্ধের পরপরই  বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল পত্রিকার প্রকাশনাও । একইভাবে, International Criminal Tribunal for Rwanda (ICTR) ২০০০ সালেই RTLM এর কর্তৃপক্ষকে গণহত্যার পূর্বে এবং গণহত্যাকালীন সময়ে উষ্কানিমূলক  খবরের জন্যে গণহত্যায় উষ্কানিদানএবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধএর দায়ে অভিযুক্ত করে। এবং, ২০০৩ সালেই তাদের বিচার হয়।   Kangura পত্রিকার প্রধানকেও বিচার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দৈনিক সংগ্রামএর বিচার তো হয় নি, উল্টো তারা এখনো তাদের প্রচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন ভাবেযুদ্ধ পরবর্তী তাদের প্রোপ্যাগান্ডা জন্যেই একাত্তরের গণহত্যাকারীরা খুব সহজে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত হয়।

উপসংহার

উপরোক্ত আলোচনায় যে গণহত্যার কথা বলা হয়েছে তার সবগুলোই গত শতাব্দীর। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই একবিংশ শতাব্দীর দুই দশকের মধ্যেই অনেকগুলো গণহত্যা আমরা প্রত্যক্ষ করে ফেলেছি, তারমধ্যে কিছু ঘটেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশসমূহের ভেতরে। যে কোন সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যাকে সমস্যা বলে চিহ্নিত করা। আমরা এখনো তা করতে পারি নি। গণহত্যা অস্বীকার করার প্রবণতা, বিভিন্ন মতবাদের চশমার কারণেই, আমাদের মধ্যে বিরাজমান। অরুন্ধতী রয় ভারতের গুজরাটে সংঘটিত গণহত্যার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, তুরস্ক আর্মেনিয়ার গণহত্যা অস্বীকার করে নীরবতার মাধ্যমে এবং ভারত গুজরাটের গণহত্যা অস্বীকার করে উৎসবের মাধ্যমে। গণহত্যা অস্বীকার করা হয় আমাদের দেশেও। আমরা কখনো অস্বীকার করি নিজেদের ওপর সংঘটিত গণহত্যা, আর নিজেদেরটা স্বীকার করলেও অনেকসময় গণহত্যার প্রকৃতি বুঝে উঠতে না পেরে কিংবা বিভিন্ন মতাদর্শিক কারণে অস্বীকার করি অন্যের উপর চালিত গণহত্যাকে। গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিবর্গের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে দল মত নির্বিশেষে পৃথিবীতে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকার কর নিতে হবে আমদের। বিষয়টা সরলীকরণ হয়ে গেলেও এটা সত্য যে, প্রতিটা গণহত্যার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই বৈষম্য থেকেই উৎসারিত বিভিন্ন সমস্যা ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্যায়ে গণহত্যার পথ সুগম করে। সাত্রে বলেছিলেন যে, অধীনস্থ জনগণের বিদ্রোহে ঔপনিবেশিক শক্তির উত্তর একটাই নিপীড়ন ও গণহত্যা। একটু অন্যভাবে বলা যায়, অধীনস্থ জনগণের বিদ্রোহে ক্ষমতাবান শক্তির উত্তরও হচ্ছে গণহত্যা। তাই, গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবেই আমাদের রুখে দাড়াতে হবে সকল সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আওয়াজ তুলতে হবে নিপীড়নকারী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।


[1] Kuper, Leo. 1981. Genocide Its Political Use in the Twentieth Century. Yale University Press.
[2] Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide
[3] Eng, Kok-Thay. n.d. Redefining Genocide . Genocide Watch. http://www.genocidewatch.org/redefininggenocide.html
[4] Kuper, 1981
[5] Ibid   
[6] Any deliberate act committed with the intent to destroy the language , religion, or culture of national, racial or religious group of the ground of the national or racial origin or religious belied of its members such as: 1) Prohibiting the use of the language of the group in daily intercourse or in schools, or the printing and circulation of publications in the language of the group; 2) Destroying or preventing the use of libraries, museums, school, historical monuments, places of worship or other institutions’ and objects of the group. (Source – Leo Kuper, Genocide, 1981)   
[8] Arundhati Roy, Listening to Grasshoppers
[9] Kuper, 1981
[10] সৈয়দ নিজার, (২০১৭), ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা, চৈতন্য
[11] On Genocide, Jean Paul Sartre, November 1967
[12] কামাল আহমেদ, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬, গণহত্যা অস্বীকারের পেছনে থাকে রাজনীতি, প্রথম আলো
[13] Kuper, 1981
[14] Kuper, 1981
[15] Chomsky, Noam, Media control: the spectacular achievements of propaganda.
[16] CHOMSKY, NOAM, and EDWARD S. HERMAN. MANUFACTURING CONSENT the Political Economy of the Mass Media. New York: Pantheon Books, 2002.
[17] বদরুদ্দীন উমর, ১৯৯৩, ধর্ম, রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা
[18] The Rwandan Genocide: How It Was Prepared, a Human Rights Watch Briefing Paper, April 2006
[19] Dictionary of Genocide
[20] The following acts shall be punishable: (a) Genocide; (b) Conspiracy to commit genocide; (c) Direct and public incitement to commit genocide; (d) Attempt to commit genocide; (e) Complicity in genocide. (Source - Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide)  
[21] Hate speech and Group Targeted Violence the Role of speech in violent conflicts
[22] Hate speech and Group Targeted Violence the Role of speech in violent conflicts
[23] Nazi Propaganda, United States Holocaust Memorial Museum, https://www.ushmm.org/  
[24] Ibid
[25] The Jew as World Parasite, German Propaganda Archive, http://research.calvin.edu/german-propaganda-archive/weltparasit.htm
[26] Goebbels, Joseph, 1941, The Jews are Guilty, German Propaganda Archive
[27] Bartrop, Paul R., and Samuel Totten. 2008. Dictionary of Genocide.
[28] Groß, Walter, 1934, Race, German Propaganda Archive
[29] Volksempfänger - Nazi Radio, https://www.enemyinmirror.com/communication/volksempfanger-nazi-radio/  
[30] Bartrop and Totten, 2008
[31] Arnett, George. 2015. Auschwitz: a short history of the largest mass murder site in human history. The Guardian
[32] Rwanda: How the genocide happened, BBC, 17 may, 2011
[33] The Rwandan Genocide: How It Was Prepared, a Human Rights Watch Briefing Paper, April 2006
[34] BBC, 2011
[35] A Human Rights Watch Briefing Paper, April 2006
[36] Ibid
[37] Asad, Rabiya, 2014, "Major Research Paper: Radio and the Rwandan Genocide"
[38] A Human Rights Watch Briefing Paper, April 2006
[39] Ibid  
[40] Asad, Rabiya, 2014
[41] Ibid
[42] মার্কিন সরকারের অতি গোপনীয় প্রতিবেদন, পূর্ব পাকিস্তানে সংঘাত: পটভূমি ও ভবিষ্যৎসূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, ফজলুল কাদের কাদরী।
[43] মুনতাসীর মামুন, ২০১০, পাকিস্তানি জেনারেলদের মন বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, সময়।
[44] ডকুমেন্টারী: 1972, Nine months to freedom, Directed by Sukhdev Singh Sandhu
[45] Mascarenhas, Anthony, 1971, Rape of Bangladesh
[46] হাসান হাফিজুর রহমান, ১৯৮২, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, প্রথম প্রকাশ, হাক্কানী পাবলিশার্স।
[47] দলিলপত্র
[48] দলিলপত্র
[49] দলিলপত্র
[50] দলিলপত্র
[51] Bangla Desh Documents, Ministry of External Affairs, Delhi, India
[52] Ibid
[53] Ibid
[54] Hossian, Mohammad D, 2015, "Manufacturing consent: framing the liberation war of Bangladesh in the US and UK media." Journalism, http://journals.sagepub.com/doi/abs/10.1177/1464884914524516.
[55] মফিদুল হক, ১৯৮৫, মনোজগতে উপনিবেশ তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত, প্রাচ্য প্রকাশনী।
[56] সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০১৬, "একাত্তরের যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের পরীক্ষা", নতুন দিগন্ত চতুর্দশ বর্ষ (তৃতীয় সংখ্যা)
[57] আলী আকবর টাবীরমুক্তিযুদ্ধে দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকাপ্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে।  
[58] ডেইলি টেলিগ্রাফ, ৩০ মার্চ, ১৯৭১। সূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, ফজলুল কাদের কাদরী।
[59] টাইম সাময়িকী, ১২ এপ্রিল, ১৯৭১। সূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, ফজলুল কাদের কাদরী।
[60] মুনতাসির মামুন, রাজাকারের মন
[61] মার্কিন সরকারের অতি গোপনীয় প্রতিবেদন, পূর্ব পাকিস্তানে সংঘাত: পটভূমি ও ভবিষ্যৎসূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, ফজলুল কাদের কাদরী।
[62] গণহত্যা: এন্থনি মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন, দি সানডে টাইমস, ১৩ জুন ১৯৭১। সূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, ফজলুল কাদের কাদরী।
[63] সহুল আহমদ, মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের অপব্যবহার, আমার প্রকাশনী, ২০১৭


No comments:

Post a Comment