Sunday, December 27, 2020

নব্য-মৌলবাদ প্রসঙ্গে অলিভার রয়: একটি সাক্ষাৎকার


অলিভার রয় ফরাসি রাজনৈতিক বিজ্ঞানী; পলিটিক্যাল ইসলাম, সেকুলারকরণ, জিহাদ, মৌলবাদ ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন। তাঁর Globalized Islam : The Search for a New Ummah কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। তিনি সেখানে এই সময়ের ইসলামি আন্দোলনের হাল হকিকত নিয়ে আলাপ করেছেন; পশ্চিমাকরণ, বিশ্বায়ন, আধুনিকতা ইত্যাদির মধ্যে বর্তমানের বিশ্বায়িত ইসলামের স্বরূপ খোজার চেষ্টা চালিয়েছেন। তার এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস ওয়েবসাইটেই; সেখানে তিনি মূলত আলাপ করেছেন এই বই নিয়ে। আকারে ছোট কিন্তু আগ্রহোদ্দীপক সেই আলাপের প্রাসঙ্গিকতা এখনো হারায়নি। বরঞ্চ অলিভার রয়ের সাম্প্রতিক কাজ, যেমন জিহাদ এন্ড ডেথসেকুলারিজম কনফ্রন্টস ইসলাম, এই আলাপের পরিসর আরো বাড়িয়েছে। অলিভার রয়ের জিহাদ এন্ড ডেথ নিয়ে আলোচনার জন্য 'নব্য-জিহাদী কারা' শীর্ষক লেখাতে চোখ বুলানো যেতে পারে। 

প্রশ্ন: আপনি লিখেছেন যে, নব্য-মৌলবাদ [নিও-ফান্ডামেন্টালিজম] শক্তি অর্জন করছে। নব্য-মৌলবাদ শব্দ দিয়ে কি বোঝাচ্ছেন?

রয়: মৌলবাদ, মানে ধর্মের ‘সত্য’ বিশ্বাস বা নীতিতে ফিরে যাওয়া অর্থে, খোদ ইসলামের মতনই পুরনো। সাম্প্রতিক যে প্রবণতাকে নব্য-মৌলবাদ বলা হচ্ছে সেটাতে মিশে আছে প্রযুক্তিগত আধুনিকতাবাদ, বি-সংস্কৃতায়ন, প্রথাগত মুসলিম ও আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতি উভয়ের প্রত্যাখ্যান, এবং বিশ্বায়ন।

 

প্রশ্ন: এই আন্দোলনে কারা নিযুক্ত হচ্ছে?

রয়: নব্য-মৌলবাদ বিশেষভাবে বিচ্ছিন্ন তরুণদের আকৃষ্ট করছে কারণ এটি তাদের সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাকে [রীতিনীতি ও প্রথা বিবর্জিত] সর্বজনীন ইসলামের রূপে হাজির করার ন্যায্যতায় পরিণত করে, এবং এভাবে সকল সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তুলে। এটি সু-শিক্ষিত এবং হতাশাগ্রস্তদের আকৃষ্ট করে, তাদের সামনে এমন এক ব্যবস্থা হাজির করে যা আফগান মরুভূমি থেকে শুরু করে আমেরিকার কলেজ ক্যাম্পাস পর্যন্ত যে কোনো পরিস্থিতিতেই আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যে সকল ইসলামপন্থী কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশে ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করতে চান তারা জাতীয়তাবাদের পাঁকে জড়িয়ে পড়েন, এর বিপরীতে নব্য-মৌলবাদীরা ট্রান্সন্যাশনাল উম্মাহতে সমর্থন রাখেন। তারা সেই সকল মুসলমানদের সর্বজনীনবাদী আকাঙ্ক্ষাকে পাত্তা দেয় যারা নিজেদেরকে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থান বা জাতির সাথে চিহ্নিত করতে পারছেন না। এই গঠনবাদী [কনস্ট্রাক্টিভিস্ট] উম্মাহকে অবশ্যই দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে হবে, যেখানে পশ্চিমা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমরূপতার সাথে লড়াই করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। ফলে, ম্যাকডোনাল্ড ও দ্বিতীয়-ভাষা-হিসাবে-ইংরেজি লড়ছে সাদা পোশাক পরিহিত ও দাড়িওয়ালা নব্য-মৌলবাদীদের সাথে যারা কিনা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজিতে কথা বলে এবং হালাল ফাস্টফুডের সন্ধান করে।

 

প্রশ্ন: প্রাচ্যের উপর পশ্চিমার কী প্রভাব পড়ছে?

রয়: প্রাচ্যের পশ্চিমাকরণ হয়েছে, এবং ইসলাম পশ্চিমে এসেছে। লাদেনের সংগঠনের অধিকাংশ তরুণ সন্ত্রাসী কোথায় born-again মুসলমান হয়েছে? পশ্চিমে; প্রাচ্যে নয়। এদের অনেকের জন্ম হয়েছে প্রাচ্যে। কারো কারো জন্ম ও বেড়ে উঠা পশ্চিমে। কিন্তু তাদের সবাই born-again মুসলমান হয়েছে মার্সেলে, লন্ডনে, প্যারিসে, নিউ-জার্সিতে। ফলে পশ্চিমে র‍্যাডিক্যাল ইসলাম এখন আর মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের সংযোজন নয়। এটি পশ্চিম ও পূবের মিশ্রণের পরিণতি। মধ্যপ্রাচ্যের সমাজগুলোর পশ্চিমাকরণ হয়েছে। তারা শহুরে ও আধুনিক সমাজ এখন। সমস্যাটা সনাতন [ট্র্যাডিশনাল] সমাজ নয়, সনাতনী লোকের সাথে আমাদের কোনো সমস্যাও নেই। আমাদের সমস্যা এমন লোকদের সাথে যারা পশ্চিমা হয়ে উঠেছে। এবং তাদের হাত ধরেই এখন ইসলাম পশ্চিমে শিকড় গেড়েছে।

 

প্রশ্ন: আপনি লিখেছেন যে, নব্য-মৌলবাদীরা একটা কাল্পনিক উম্মাহ তৈরির প্রচেষ্টা করেন, অর্থাৎ এমন এক সর্বজনীন মুসলমান সম্প্রদায় যারা কোনো একটা নির্দিষ্ট সমাজ ও জাতিতে সীমাবদ্ধ নয়। কী এই অভীষ্টকে কাল্পনিক করে তুলছে?

রয়: কাল্পনিক ইসলামে কোনো সত্যিকারের ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা নেই। নতুন সমাজ গঠনের কোনো নীল-নকশাও নেই। বিপ্লব, প্রতিষ্ঠান, সংবিধান, মতাদর্শ ইত্যাদি আধুনিক ধারণাসমূকে ব্যবহার করে ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা কাজ করবে না; এটা ইসলামের কারণে নয়, বরঞ্চ এই কারণে যে ধর্মীয় রাষ্ট্র বলতে কোনো কিছু নেই আসলে। আপনার ধর্মকে ব্যবহার করে এমন রাষ্ট্র থাকতে পারে। ধর্মের বৈধতা ব্যবহারকারী রাষ্ট্র থাকতে পারে, কিন্তু কেবল ধর্মের উপর ভিত্তি করে কোনো রাষ্ট্র থাকতে পারবে না, তা সে যে কোনো ধর্মই হোক না কেন।

 


প্রশ্ন: এই আন্দোলনগুলো কীভাবে অতীতের জঙ্গি আন্দোলনের চাইতে আলাদা?

রয়: আলকায়েদা এবং হিজবুত তাহরির মতো সংগঠনগুলো কোনো মধ্যপ্রাচ্যীয় রাষ্ট্র, গোয়েন্দা সংস্থা বা র‍্যাডিকেল আন্দোলনের সাথে যুক্ত নয় বা ব্যবহৃতও হচ্ছে না, যেমনটা আশির দশকে দেখা যেতো। এগুলো de-territorialized ইসলামি নেটওয়ার্কের অংশ যারা কাজ করছে পশ্চিমে এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রান্তে। তাদের পটভূমির সাথে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বা সনাতনী ধর্মীয় শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। বিপরীতে, তারা শিক্ষিত, বিচ্ছিন্ন, প্রায়শই পশ্চিমের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় -প্রজন্মের অভিবাসী। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নেতা এবং বাদ পড়া [ড্রপআউট] শ্রমিক-শ্রেণির মিশ্রণ- ১৯৭০-৮০ এর দশকের পশ্চিমা ইউরোপীয় র‍্যাডিকালদের অধিকাংশের মধ্যে এইটা সাধারণ প্যাটার্ন ছিল। বলা যেতে পারে তারা আধুনিক মার্ক্সবাদ ও ধর্মের মিশ্রণ। বিশ বছর আগে এমন ব্যক্তিরা র‍্যাডিকেল বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হতেন, যেটা এখন অদৃশ্য। বর্তমানে পশ্চিমে দুইটা র‍্যডিক্যাল আন্দোলন ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী’ দাবি করে: বিশ্বায়ন-বিরোধী আন্দোলন এবং র‍্যাডিকেল ইসলামিস্ট।

 

প্রশ্ন: আপনি লিখেছেন যে, অতীতের জঙ্গি ইসলামিস্ট আন্দোলনগুলোতে একটা স্ব-বিরোধিতা রয়েছে? সেটা কি?

রয়: ইসলামপন্থা [ইসলামিজম] এর স্ববিরোধীতাটা হচ্ছে যে, এই আন্দোলনগুলো রাষ্ট্রকে রূপ দেয়ার পরিবর্তে তারা যে রাষ্ট্রকে জয় করতে চেয়েছে সেই রাষ্ট্র দ্বারাই রূপায়িত হয়েছে।

 

প্রশ্ন: সৌদির মাটিতে আল-কায়েদার সাম্প্রতিক আক্রমণ কি ইসলামি সন্ত্রাসীদের চিন্তার কোনো পরিবর্তন তুলে ধরছে?

রয়: আমরা মনে করি না। সৌদি আরবে যে জঙ্গিরা সক্রিয় আছে তারা সৌদিরই, তারা আন্তর্জাতিকবাদী নয়। তারা সৌদি আরবের বিদেশীদেরকে লক্ষ্যবস্তু করে, এবং ইসলামের চাইতে সৌদি জাতীয়তাবাদ নিয়েই বেশি খেলতে চায়। এমনকি যদিও বা তাদের অনেক নেতাই আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন এবং বিন-লাদেনকে চিনেন, এর মানে এই নয় যে তারা আল কায়েদার স্থানিক সহায়ক।

 

প্রশ্ন: এরপর আমরা কী আশা করতে পারি? ইউরোপের মুসলমানদের মধ্যে কোন ধরণের নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক কেমন হতে যাচ্ছে?

রয়: র‍্যাডিক্যাল মুসলমানরা খুবই সংখ্যালঘু। আমি আমার বইতে দেখিয়েছি, ইসলামের আরো অনেক চেহারা রয়েছে যেগুলো পশ্চিমে ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের মধ্যেই হাজির করতে যাচ্ছে। লিবারেল ইসলাম রয়েছে, মডারেট রক্ষণশীল ইসলাম রয়েছে যা বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে রক্ষণশীল খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সাথে একমত পোষণ করে। কিন্তু আমার জন্য কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে যে নব্য-মৌলবাদসহ সকল ধরণের পুনঃইসলামিকরণ মূলত ভিত্তি করে আছে পশ্চিমাকরণের একধরণের প্রক্রিয়ার উপর: ইন্ডিভিজুয়ালাইজেশন, প্রজন্মগত ব্যবধান, সামাজিক কর্তৃত্বের সঙ্কট, আবেগী ধর্মভাব বনাম বুদ্ধিজীবীতাবাদ এবং বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগ হারিয়ে যাওয়া। সকল ধরণের আধুনিক মৌলবাদে সমধর্মিতা রয়েছে। পূর্ব-ইউরোপে ইসলাম এথনিক কালচার ও জাতীয়তাবাদের অংশ: ফলে বসনিয়া বা কসভোতে নব্য-মৌলবাদ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।   

 

No comments:

Post a Comment