Wednesday, December 16, 2020

বিজয়ের উদযাপনের মধ্যে উৎকট ‘জাতীয়তাবাদ’ ছাড়া আর কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না



কিশোর দা জেলে, সাংবাদিক কাজল জেলে, মত প্রকাশের দায়ে হরহামেশা জেলে যাচ্ছেন নাগরিকরা, ক্রসফায়ার নিত্য সঙ্গী, ঘাড়ের উপর ভর করে আছে উপনিবেশিক আইন-কানুন - এমন বাস্তবতায় বিজয়ের ৪৯তম পর্ব আমরা ‘উদযাপন’ করছি। এই জীবন আর ‘যাপন’ করা হয়ে উঠলো না, কেবল ক্ষণিকের ‘উদযাপনে’ই সীমিত রয়ে গেলো।

বিজয়ের বছর খানেকের মধ্যে যে সংবিধান বা শাসন-কাঠামো নাজিল হইলো তাতে চারটা মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সেকুলারিজম, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া, সংবিধানের ভেতরকার সংকট, উপনিবেশিক চরিত্র এসব নিয়ে বহুজন লিখেছেন, বলেছেন। সংবিধানে যে সুন্দর সুন্দর কথা শুরুতে বলা হয়েছে তা কায়েমের পথ যে খোদ সংবিধানই রদ করে দেয় সেটাও তো অনেকেই দেখিয়েছেন।

কিন্তু ধরেন আমি চারটা মূলনীতি নিয়েই যদি আলাপ করি, তাহলে কি দেখি। প্রথমত মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রকট নিশানা ছিল গণতন্ত্রের নিশানা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবকে দেখা যায় আফসোস করে বলছেন, পাকিস্তানের একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত এই গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার হদিস ভালোভাবেই পাওয়া যায়। কিন্তু স্বপ্নের এই গণতন্ত্র সংবিধানেও এলো। তবে সেটা এলো একটা ঘটনাস্বরূপ। তবু তো জনগণের ভোট দেয়ার অধিকার ছিল। বাকশাল, পরবর্তীতে জিয়ার আমল, এরশাদের আমল সবকিছুর পর মনে হলো নব্বই থেকেই বুঝি গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলো। সেই গণতন্ত্রও কেবল ‘পাঁচ বছর পর পর ভোট দেয়া’র অধিকারের মধ্যে সীমিত থাকলেও তবু তো ছিল। গত বারো-বছর যাবত সেটাও উধাও। এখানে বহুবছর যাবত গণতন্ত্রের যে রূপ জারি আছে সেটাকে আলী রীয়াজ তো ‘গণতন্ত্র’ই বলেন না; নতুন একটা নামই দিয়েছেন ‘হাইব্রিড রেজিম’।

বোঝাই যাচ্ছে, এখানে যে গণতন্ত্রের কথা বলছি সেটা সর্বক্ষেত্রে চর্চার বিষয় হিসাবে না, বরঞ্চ কেবল পাঁচবছর পর পর ‘উদযাপন’মূলক গণতন্ত্রের কথা বলছি। আমরা আম-জনতা ‘সিটিজেন’ হয়ে উঠি মূলত এই ভোটাধিকারের মাধ্যমে। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো একটা সিদ্ধান্তে আমাদের অংশগ্রহণের উপায়স্বরূপ। আমাদের কপালে আপাতত সেই ন্যূনতম ‘সুযোগ’ও নেই। আমরা বর্তমানে এক ধরণের অ-নাগরিক।

এতো গেলো রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারার বিষয়; ধরেন যখন প্রতিনিধি নির্বাচন করেও ছিলাম, তখন হালচাল কেমন ছিল? একে তো ব্যবস্থাই ছিল ‘উইনার্স টেক ইট অল’ ব্যবস্থা। এটা যতটা না গণতন্ত্র তার চাইতে বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ। তারউপর বহুত ক্যাচালের পর যারা সংসদে গেলেন, তারা কি সেখানে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারেন? সংবিধানের ৭০ ধারা আমাদের জানাচ্ছে যে, সংসদে আসলে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা আছে, গণতন্ত্রের কোনো স্থান সেখানে নেই।

এই হচ্ছে বিজয়ের ৪৯ বছর পর আমাদের গণতন্ত্রের হালচাল। তাহলে সেকুলারিজমের কি অবস্থা। সেকুলারিজম এখানে যতটা না প্রিন্সিপল তার চাইতে বেশি মতাদর্শ। জনপ্রিয় দাবি অনুযায়ী বর্তমানে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেকুলার সরকার ক্ষমতাসীন। সেকুলারিজমের বেহাল দশা জিয়া-এরশাদের থেকে শুরু করে বর্তমান আমল পর্যন্ত কোথায় আছে তাও জানি। বর্তমানের ইসলামিকরণ তো আসলে সেকুলার দলই করছে, রাজনৈতিকভাবে। জাসমিন লর্চ দেখিয়েছিলেন কীভাবে সেমি-অথোরেটিয়ানিজম ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে; কীভাবে সেকুলার দলই সোৎসাহে সেটা করে থাকে। অর্থাৎ, গণতন্ত্র থাকা বা না থাকার সাথে মিলিয়ে তিনি ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে পড়াকে পাঠ করেছেন। তবে আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, এখানে প্রগতিশীলরা সেকুলারিজম নিয়ে যতটা সচেতন গণতন্ত্র নিয়ে ততটা নয়। ফলে ‘অশিক্ষিত’ জনগণের জন্য ‘মোলায়েম’ স্বৈরশাসন তারা নির্ধিদায় চাইতে পারেন। তবে ইসলামবাদী ও সেকুলারবাদী সকলেই রাষ্ট্র নির্ধারিত ছকেই কাজ করতে পছন্দ করেন। 

তাহলে সমাজতন্ত্রের কি হাল? নিওলিবারেল জমানায় সমাজতন্ত্রীরাই আজকাল সমাজতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করেন না।

তাহলে টিকে রইলো কি? জাতীয়তাবাদ। রেহমান সোবহান বলেছিলেন, বাঙালি জাতীয়তাবোধ ছিল বঞ্চনার জাতীয়তাবোধ। কিন্তু এখন জারি আছে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ, কখনো প্রকাশিত হচ্ছে উন্নয়নের ব্যানারে, কখনো সেনাবাহিনীর ব্যানারে, কখনো পাহাড়ে। অর্থাৎ এখন জারি আছে নিপীড়কের জাতীয়তাবাদ। যাক, অন্তত সংবিধানের কিছুটা টিকে আছে!

গণতন্ত্রহীন অবস্থায়, একটা ফ্যাসিবাদী রেজিমের অধীনে, যেখানে কিনা দেদারছে কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিকদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, ক্রসফায়ারে মানুষ মরছে, কথা বলার অপরাধে জেল খাটছে, ক্রন্দনরত সাংবাদিককে উদ্ধার করা হচ্ছে, আরো বহু কিছু- এমন একটা অবস্থায় ৪৯তম বিজয়ের উদযাপনের মধ্যে একটা উৎকট ‘জাতীয়তাবাদ’ ছাড়া আর কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। 

সংগ্রামের ইতিহাস, সংগ্রামের নিশানা তো বহু দূরের জিনিস ...

No comments:

Post a Comment