গত কিছুদিনের মধ্যে আমরা দুইটা আন্দোলন প্রত্যক্ষ
করলাম; এক কোটা সংস্কার আন্দোলন, দুই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। দুইটার ধরণ দুই রকম, অংশগ্রহণকারীদের বয়সও দুইরকম, তবে, একটা বিষয়ে মিল হচ্ছে তারা
সকলেই শিক্ষার্থী। একেবারে নতুন নতুন কিছু বিষয় এই আমাদের দেখিয়েছে।
এতদিন ধরে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেভাবে ‘ফার্মের মুরগী’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল সেটা একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে এই দুইটা আন্দোলনই। কোটা আন্দোলনের সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর যখন হামলা করা হলো, তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার পায়তারা চললো, তখন এর হাল ধরল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তারা রাস্তায় নেমে আসলো। শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরাই বেসরকারিতে পড়ে, এই ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। বেসরকারিতে এখন মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এটা যত বাড়তে থাকবে, দাবি-দাওয়ার জন্যে রাস্তায় নামার হারও বাড়বে। নো ভ্যাট আন্দোলন দিয়েই এর শুরু হয়েছিল বলা যায়। এইজন্যে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ক্ষোভও বাড়বে, সেটা নিরাপদ দাবি আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রের নগ্ন আক্রমণ প্রমাণও দেয়।
এতদিন ধরে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেভাবে ‘ফার্মের মুরগী’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল সেটা একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে এই দুইটা আন্দোলনই। কোটা আন্দোলনের সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর যখন হামলা করা হলো, তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার পায়তারা চললো, তখন এর হাল ধরল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তারা রাস্তায় নেমে আসলো। শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরাই বেসরকারিতে পড়ে, এই ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। বেসরকারিতে এখন মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এটা যত বাড়তে থাকবে, দাবি-দাওয়ার জন্যে রাস্তায় নামার হারও বাড়বে। নো ভ্যাট আন্দোলন দিয়েই এর শুরু হয়েছিল বলা যায়। এইজন্যে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ক্ষোভও বাড়বে, সেটা নিরাপদ দাবি আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রের নগ্ন আক্রমণ প্রমাণও দেয়।
আমরা যে যুগে বাস করছি সেটাকে বলা হয় ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র যুগ। ইংরেজিতে বললে
বলা যায় ‘নিওলিবারেজমে’র যুগ। বাংলা-ইংরেজি দুই শব্দের মধ্যেই ‘মুক্ত’ ও ‘লিবারেল’
আছে, তাই শুনতেও শ্রুতিমধুর। এখন আপনি পুরোপুরি মুক্ত, তবে সেটা শুধু ‘পণ্যে’র নির্মাণে। আপনার আবেগ-অনুভূতি সবই ‘পণ্য’। আপনার বাজার দর
নির্মাণ করা হবে ‘প্রতিযোগিতা’র উপর ভিত্তি করে। প্রতিযোগিতায় টিকতে পারলে আপনি সফল, আর না হলে আপনি লুজার। আপনি কিভাবে বিশেষ সুবিধা পেলেন, আপনি কোন শ্রেণিতে অবস্থান করেন এসব বিবেচনায় না আনলেও হবে, আপনি টাকা কামাইতে পেরেছেন এইটাই আপনার কৃতিত্ব! আপনি structural unemployment এর শিকার সেটা বড় কথা না, আপনি চাকরি যেহেতু পান নাই তাইলে সেটা শতভাগ আপনারই
ব্যর্থতা! আপনার বাচ্চার স্কুলের সামনে মাঠ নাই এইটা কোন বিবেচনার বিষয় না, কিন্তু বাচ্চা মোটা হয়ে গেলে বা অবেসিটিতে আক্রান্ত হলে
সেটা আপনার ব্যর্থতা। সহজ কথা হচ্ছে, সফল/অসফলের মানদণ্ড
হচ্ছে ‘প্রতিযোগিতা’। তাই, দেখা যাচ্ছে যখনই
শিক্ষার্থীরা কোন ‘structure’ এর সংস্কারের
আন্দোলনে নামছে তখন সমাজের কথিত মোটিভেশনাল স্পিকারদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। গত
দুইটা আন্দোলনে তাদের অবস্থান দেখলেই বিষয়টা পরিষ্কার বুঝা যাবে। এইটা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন আমাদের মধ্যে মোটিভেশনাল স্পিকারদের আনাগোনা বেড়ে যাচ্ছে! তারা
সবচেয়ে বড় যে কাজটা সফলভাবে করে থাকে সেটা হচ্ছে, সিস্টেমের ভুলের দায়ভার ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দেয়া। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কোন
ভুলের কারণে যখন কর্মসংস্থান কমে যেতে থাকে একদিকে যেমন বেকারত্বের হার বাড়তে থাকে, অন্যদিকে তেমনি মোটিভেশনাল
স্পিকারদের হারও বাড়তে থাকে। আমাদের এখানে দেখতে পাচ্ছি নতুন কর্মসংস্থান
সৃষ্টির হার কমেছে, তাই স্বাভাবিকভাবে এই
স্পিকারদের সংখ্যাও বাড়ছে। তারা, প্রথমেই বলেন, চেষ্টা করো পারবে। চেষ্টা করলেই পারবে। যদি না পারো তার
মানে এনাফ চেষ্টা করো নাই। অর্থাৎ, তুমি চাকরি পাচ্ছো কি
পাচ্ছো না সেটা নির্ভর করছে পুরোপুরি তোমার যোগ্যতার উপর। দেশে কর্মসংস্থানের
ব্যবস্থা কতটুকু আছে কি নাই সেটা কোন মুখ্য ব্যাপার না। ফলাফল এই দাঁড়াচ্ছে যে, চাকরি না পাওয়াটা ব্যবস্থা-গত ভুল নয়, নিজের অক্ষমতাই আসল কথা।
তাই শিক্ষার্থীরা যখন কোন ব্যবস্থা-গত ভুলের
বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে তখন এই স্পিকাররা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। স্কুলের কিশোরদের
বিচারের যে আন্দোলন সেটাও আমাদের ‘ব্যবস্থা-গত ভুলে’র বিরুদ্ধে আন্দোলনই। কিন্তু, আন্দোলনের সময় এবং পরে একদল বের হয়েছেন যারা উপদেশ দেয়া শুরু করেছেন
ছাত্রছাত্রীদের। তাদের কথা হচ্ছে, ‘আমাদের রাস্তা আমরাই
ঠিক রাখবো’! মানে, ব্যবস্থা ঠিক না করলেও চলবে, আমরা ঠিক হলেই চলবে। মানে হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে
দায়ী সাধারণ জনগণই, ভাঙাচুরা লাইসেন্স
বিহীন গাড়ীও না, লাইসেন্স বিহীন চালকও
না। ত্রুটি সিস্টেমের না, ত্রুটি আপনারই। তাই
এই ক্ষেত্রেও এই মোটিভেশনাল স্পিকাররা আন্দোলনের বিরুদ্ধে রইলেন!
মুক্তবাজার অর্থনীতির যে ‘প্রতিযোগিতা’ সেটারই আরেক অবধারিত
ফলাফল হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। আমরা সকলেই বিচ্ছিন্ন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একটা লেখায়
বলেছিলেন, এই যুগে ভিড় জমে, কিন্তু ঐক্য গড়ে ওঠে না। এইটাই বিচ্ছিন্নতা। শিক্ষার্থীরা
আন্দোলনে করেছে ঠিকই, তাদের ঘনঘন দাঁড়িয়ে
যাওয়াটা যেমন চোখে পড়ার মতো ছিল, তেমনি কিছু কিছু
ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। যেমন, শাবিপ্রবির একটা নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্ট দেখা যাচ্ছে ক্লাস বর্জন করছে, পুরো ভার্সিটি কিন্তু এক হতে পারছে না, নিজেদের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সকলে এরা বিচ্ছিন্ন থেকে
যাচ্ছে। আর যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে তারাও সবসময় এই ‘বিচ্ছিন্নতা’কেই কামনা করেন।
মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা আনতে পারলেই আন্দোলন দমানো সহজ হয়ে ওঠে।
আমেরিকায় শ্রমিকরা তখন ঘনঘন আন্দোলন করতেন, লাঠিপেটা করেও তাদের দমন করা যাচ্ছিল না, তাই মালিক পক্ষ মিডিয়াকে হাতিয়ার বানিয়ে সামনে নিয়ে আসে।
বলা হলো, এই শ্রমিকরা আসলে আন্দোলনের
নামে আমেরিকার জিনিসই নষ্ট করছে, তাই আন্দোলনকারীরা
আমাদের শত্রু। এবং, এই প্রচারের ফলও
হয়েছিল দারুণ, আন্দোলনকারীদেরকে সাধারণ জনগণ
হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় কোন লাটি-বৈঠা ছাড়াই আন্দোলন দমন করা যেত। গত দুই আন্দোলন
যেমন ছিল চমক জাগানো, তেমনি একে দমন করাও
হয়েছিল চমকিয়ে। শুধু লাঠি-পেটা দিয়ে কিন্তু কাজ হচ্ছিল না। খেয়াল করে দেখেন, দুই আন্দোলনেই যেদিন পুলিশ-লীগ আক্রমণ করেছিল তাঁর পরেরদিন
আন্দোলন আরও বড় আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু দমে যায় তখনই যখন মিডিয়া এসে আন্দোলনে
হাজির হয়। কি সুন্দর করে দুইটা আন্দোলনকে দমন করা হয়ে গেলো, একটাতে হাজির হইলো ‘রাজাকার তত্ত্ব’, আরেকটাতে আসলো ‘গুজব তত্ত্ব’! সাথে ছিল ‘তৃতীয় পক্ষে’ উপস্থিতি সংক্রান্ত খবর!
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখজনক
অধ্যায় হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে শ্রমিকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া। এই দুই পক্ষকে
কি এর পূর্বে কখনো মুখোমুখি অবস্থায় দেখা গিয়েছিল? বরং বাসে উঠলে কোন শিক্ষার্থী হাফ পাস দিতে চাইলে এই হেলপাররা কখনো কখনো বলতেন, মামা আপনারা না দিলে আমরা খাব কি? এই শ্রমিকরা হচ্ছেন প্রথমত শিক্ষা হতে বঞ্চিত, দ্বিতীয়ত এরা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। শাসকগোষ্ঠী সেই
দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করছে। তাদেরকে যে মালিক অবৈধভাবে লাইসেন্স
এনে দিবেন, সে সারাজীবন কিন্তু সেই
মালিকের ‘মাসলম্যান’ হিসেবে কাজ করবে। অন্যভাবে বলা যায়, এই শ্রমিকদের যতদিন দারিদ্র্যের পুকুরে রাখা যাবে ততদিন
তাদেরকে ‘মাসলম্যান’ হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।
ঘুরেফিরে দুই আন্দোলনেই একটা বিষয় কমন হচ্ছে এরা
কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে না, বরং ‘ব্যবস্থা’র বিরুদ্ধে নেমেছিল।
ব্যক্তির চেয়ে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়া কঠিন,
তাই দমন
করা হয়েছে কঠিন ভাবে। আবার দেখা যাচ্ছে দুই ক্ষেত্রে ‘বৈষম্যে’রও একটা ভূমিকা আছে।
সেই বৈষম্যকে স্বাধীনভাবে টিকিয়ে রাখার কাজটাই করে যাচ্ছে ‘মুক্তবাজার’!
No comments:
Post a Comment