Saturday, August 25, 2018

ধর্ষকের মনোজগত ও নারীর পোশাক




ধর্ষণ কি এবং কেন হয়? এই নিয়ে আমাদের প্রচুর একাডেমিক আলোচনা আছে, আমি ওইদিকে আপাতত যাব না। আলোচনা করব মূলত বহুল প্রচলিত এক ‘ধারণা’কে (অনেকের কাছে বিশ্বাস) কেন্দ্র করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই আলোচনা করার কোন প্রয়োজন থাকার কথা ছিল না আজকে, তবু করতে হচ্ছে।

ধারণাটি হচ্ছে, ‘নারীর কাপড়-চোপড় ধর্ষককে ধর্ষণে আকৃষ্ট করে’। প্রথমেই বলে নিয়েছি, ধর্ষণ কেন হয় আলোচনা এ বিষয়ে না, বরং ওই নির্দিষ্ট ধারণার ভিত্তি আছে কি নাই, থাকলেই বা কতটুকু আছে সেটা নির্ণয় করার চেষ্টা করবো। আলোচনার জন্যে আমি পুরোপুরি নির্ভর করেছি ১৯৯১ সালে প্রকাশিত নিউ-ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক আর্টিকেলের ওপর। আর্টিকেলের শিরোনাম হচ্ছে, New Studies Map the Mind of the Rapist; এখানে ধর্ষকদের বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

আমাদের আলোচনার পদ্ধতি হচ্ছে, আমরা খুঁজে দেখবো, ধর্ষকের মনে তার ভিক্টিমের কাপড়-চোপড়ের প্রতি আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় কি না। কিংবা, যে নারীকে সে ধর্ষণ করে তার পরিহিত বস্ত্রের প্রতি কোন আকর্ষণ সে অনুভব করে কি না?

অতীতে একটা সময় ছিল যখন ‘ধর্ষণ’কে তীব্র যৌনাকাঙ্ক্ষার প্রকাশ হিসেবে দেখা হতো। এবং, নারীরা পোশাক ও  ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্ষণে পুরুষদের আকৃষ্ট করতো – এমন ধারণাও তখন প্রচলিত ছিল। জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতির সাথে সাথে ধর্ষণ বিষয়ক কনসেপ্টেও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে, একে নারীর প্রতি সহিংসতার রূপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে যা প্রকাশিত হয় যৌনতার মাধ্যমে। সেই সাথে নতুন নতুন গবেষণা বিভিন্ন ধরনের ধর্ষক এবং তাদের চিন্তাধারার দিকে আলোকপাত করছে প্রতিনিয়ত।

এমন এক গবেষণায় বলা হয় যে, খুব অল্প সংখ্যক ধর্ষক নারীদের প্রতি ঘৃণা থেকে ধর্ষণ করে থাকে। বরং যাদের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন স্বাভাবিক তারাই সুযোগ পেলে ঝোঁকের বশে এটা বেশি করে থাকে। যেমন ডেটিং এর সময়।

১৯৮৭ সালে ৩১৮৭ জন কলেজ ছাত্রীর উপর একটা গবেষণা করা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায় ১৫% ছাত্রী বলেন যে, তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে দশজনের মধ্যে আটজন বলেছেন, যে করেছে তাকে তারা জানতেন এবং  ৫৬% ছাত্রীই ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ডেটিং এর সময়।

এ ধরণের গবেষণার পাশাপাশি ‘ধর্ষক’দের নিয়ে বিভিন্ন ধরণের মানসিক গবেষণাও পরিচালিত হয়েছে যেখানে স্বাভাবিক পুরুষদের যৌনতার সাথে ধর্ষকদের যৌনতার বিভিন্ন মিল ও অমিল ফুটে উঠেছে।  এমন এক গবেষণার ফলাফল নিশ্চিত করেছে যে, অধিকাংশ পুরুষ যৌন সহিংসতার (Sexual violence) দৃশ্য দেখে সাধারণত উত্তেজিত হন না; তবে পরিস্থিতি, যেমন কোন নারীর প্রতি রেগে থাকলে, এটা পরিবর্তন করে দিতে পারে। যৌন সহিংসতা দেখে উত্তেজিত হওয়ার ক্ষমতা প্রমাণ করে না যে একজন পুরুষ সম্ভাব্য ধর্ষক, তবে এই বৈশিষ্ট্য সফল ধর্ষকদের অবশ্যই থাকতে হবে।

Penile plethysmography (PPG) হচ্ছে পুরুষাঙ্গে রক্তপ্রবাহের পরিমাপক এবং সাধারণত যৌন উত্তেজনা পরিমাপের জন্যে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একজন ব্যক্তি যখন যৌন দৃশ্য দেখে কিংবা শোনে, গবেষকরা PPG ব্যবহার করে, তার পুরুষাঙ্গে রক্তের প্রবাহকে যথাযথভাবে নির্ণয় করতে পারেন। এরকম কিছু গবেষণাও পরিচালিত হয়েছিল যেখানে বিভিন্ন ধরণের যৌন দৃশ্য দেখানো কিংবা শোনানো হয়।

যে সকল বর্ণনায় ‘জোরপূর্বক’ সঙ্গমের কথা উল্লেখ আছে, মানে পুরুষ জোর করে নারীকে বাধ্য করছে সঙ্গমে, এবং সে নারী কষ্ট পাচ্ছে, এমন বর্ণনা শুনে অধিকাংশ পুরুষের উত্তেজনা দমে যায়। এমনকি ‘সম্মতিক্রমে সঙ্গম’ দৃশ্যে উত্তেজনার যে মাত্রা, তার চেয়ে ৫০ শতাংশ কম থাকে জোরপূর্বকের বেলায়। গবেষকরা বলেন যে, স্বাভাবিকভাবে সহিংসতা পুরুষদের যৌন উত্তেজকতা প্রশমিত করে ফেলে। যখন স্বেচ্ছাসেবকরা বেশ কয়েকদিন ধরে ‘সম্মতির দৃশ্য’ ও ‘জোরপূর্বক দৃশ্য’ এর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন লক্ষ্য করা যায় যে, জোরপূর্বক বর্ণনাগুলির প্রতি তাদের উদাসীনতা বেড়েই চলছে।

কিন্তু ধর্ষকদের বেলায় ঠিক উল্টো বিষয় ঘটে। এবং প্রায় দশ শতাংশ ধর্ষক, যাদের বিশাল সংখ্যক ভিকটিম আছে, জোরপূর্বক দৃশ্যতে (বা রেপ সিনে) তারা অধিক উত্তেজনা অনুভব করে থাকে। অভিযুক্ত ধর্ষকদের বেলায় আরো কিছু বিষয় লক্ষ্য করা যায়। যেমন, ‘জোরপূর্বক দৃশ্য’ দেখে যে যত বেশি উত্তেজিত হচ্ছে, তার বেশি সংখ্যক ভিকটিম থাকার সম্ভাবনাও তত বেশি থাকে এবং ভিকটিমদেরকে শারীরিক আঘাত তত বেশি এরাই করে থাকে। কোন কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে একজন সাধারণ পুরুষের উত্তেজনার প্যাটার্ন রেপিস্টদের মতো হয়ে যায়; এ নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। দেখা যায়, নারীদের প্রতি রেগে থাকা এমনই এক পরিস্থিতি।

কিছু পুরুষকে নিয়ে একটা পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল, যৌন উত্তেজনায় ব্যায়ামের প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করা হবে। এবং সে জন্যে তাদেরকে এক মিনিট সাইকেল প্যাডেল করতে বলা হয়। এক মিনিট শেষ হওয়ার পর গবেষণার অংশ হিসেবে একজন যুবতী সেখানে প্রবেশ করে প্যাডেলের সংখ্যা লিখতে থাকে। এবং, লেখার সময় পুরুষদের দিকে অপমানজনক উক্তি করে, ‘”Is that all you can do? I pedaled a lot more than that myself this morning.” ল্যাবে নিয়ে আসার পর দেখা যায়, they had the same degree of arousal to the rape as to consenting sex. অর্থাৎ, মেয়েটার প্রতি রাগের কারণে সাধারণ পুরুষদের উত্তেজনার প্যাটার্ন একজন ধর্ষকের মতো হয়ে গেলো।

আবার অন্য আরেক গবেষণায় দেখা যায়, মদ্যপ অবস্থায় সাধারণ পুরুষদের রেপ সিন দেখে উত্তেজিত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। এজন্যে গবেষকরা বলেন, সঠিক কারণগুলোর মিশ্রণে অধিকাংশ পুরুষই সহিংস যৌনতায় উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে। তবে শুধুমাত্র সঠিক কারণগুলো থাকলেই হয় না, ‘ট্রিগার’ এর প্রয়োজন পড়ে। ধর্ষকদের অনেকেই জানায় যে, তারা ধর্ষণের কিছুদিন পূর্ব হতে তীব্র রাগ ও হতাশায় ভুগতে থাকে। এবং অধিকাংশ সময়ই যখন কোন নারী তাকে রাগান্বিত করে তুলে তখনই সেটা ধর্ষণের জন্যে ‘ট্রিগার’স্বরূপ হয়ে যায়। পুরুষটি নারীর এই প্রত্যাখ্যানকে তার পুরুষত্বের প্রতি অপমান হিসেবে নেয় যা তার মানসিক যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দেয়।

সাধারণত, এমন কোন সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক ফর্মুলা নেই যা দিয়ে প্রত্যেক ধর্ষককে বিশ্লেষণ করা সম্ভব, গবেষকরা এ বিষয়ে সতর্ক করে দেন। ধর্ষকদের মন-মানসিকতার মধ্যে প্রচুর ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ৩০০ জন ধর্ষকের ওপর একটা গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল। দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ‘সুযোগসন্ধানী’ ধর্ষক, এবং, অনেক  গবেষকদের মতে, তারা প্রায়শই ধরা খায়না এবং অভিযুক্তও হয় না। এ ধরণের উদাহরণ হচ্ছে, ডেট রেপ। এই সুযোগসন্ধানীদের জন্যে, যৌন নির্যাতন, তাদের আবেগপ্রবণ অপরাধ (impulsive crime) প্যাটার্ণের এক অংশ। এজন্যে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের আবেগপ্রবণ অপরাধে – যা কিনা অবৈধ – জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও তাদের মধ্যে থাকে।

আরেকটা গ্রুপ পাওয়া যায় – প্রায় ২৫% এ দলেই পড়ে – যারা একধরণের সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি থেকে ধর্ষণ করে থাকে। এবং, তাদের ফ্যান্টাসিটা এরকম যে, জোর করে কোন মেয়েকে সেক্স করতে বাধ্য করলে মেয়েটা এরপর তার প্রেমে পড়ে যাবে। তারা ভিক্টিমের সাথে আবার দেখা করতে চেষ্টা করে, সময় এবং স্থানের কথা উল্লেখ করে, এবং প্রায়ই এরা এজন্যে ধরা পড়ে যায়।

ধর্ষকদের ৩২% হচ্ছে ‘প্রতি-হিংসাপরায়ণ’ এবং তারা প্রচণ্ড সহিংস। নারীর প্রতি তাদের আক্রমণ শারীরিকভাবে খুবই ক্ষতিকর হয়ে থাকে এবং তাদের অভিপ্রায়ও থাকে নারীকে নিপীড়ন ও অবমাননা করা। তাদেরকে বলা হয় woman-haters

পাশাপাশি, আরো ১১% ধর্ষক পাওয়া যায়, যারা প্রচণ্ড রাগ থেকে ধর্ষণ করে। কিন্তু, পূর্বোক্ত দল (woman-haters) থেকে তাদের রাগ ভিন্ন। এদের রাগ পুরুষ-নারী থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব কিছুর উপর। গবেষকরা এদের সম্পর্কে বলেন যে, They pick fights with men and rape womenতারা সাধারণত আরো অনেক ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত থাকে এবং তারা প্রায়শই, অন্যান্যদের তুলনায়, ভিক্টিমের প্রচুর শারীরিক ক্ষতি করে থাকে।

অভিযুক্তদের মাত্র ৮% হচ্ছে ধর্ষকামী(sadist), তারা বিভিন্ন ধর্ষকাম বিষয়ক ফ্যান্টাসি দ্বারা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। বলা হয় যে, এই ধর্ষকামীদের জন্যে ভিক্টিমের ‘ভয়’ যৌন উত্তেজক হিসেবে কাজ করে।

পুরুষদের ২৬৫২ জনের মধ্যে এক সার্ভে চালানো হয়েছিল; দেখা গিয়েছে, যারা নারীদের জোর করে সেক্সে বাধ্য করে, নারীদের সাথে তাদের সম্পর্ক সাধারণত বৈরী ও খারাপ থাকে। তাদের ধারণা, নারীর সাথে সম্পর্কের  নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকা উচিৎ। এই প্যাটার্নের পুরুষদের শৈশবকাল ও সহিংস পারিবারিক পরিবেশ তাদের চিন্তাধারার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। শৈশবকালে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া পুরুষদের মধ্যেই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য থাকার সম্ভাবনা বেশি। এ বিষয়ে গবেষকদের মন্তব্য হচ্ছে, the more men were abused as children, the more they were likely to rape as adults

এর পাশাপাশি এই পুরুষদের মধ্যে ধর্ষণ বিষয়ে একধরনের মিথ কাজ করে, যেমন, if you know the woman, it’s not rapeতারা সাধারণত ওইসব পুরুষদের সাথে মেলামেশা করে যারা নারীদেরকে ‘যৌন বস্তু’ হিসেবে দেখে।

ধর্ষকদের মনোজগৎ বিশ্লেষণ করে উপরোক্ত আলোচনায় ধর্ষণের সাথে কাপড়ের সম্পর্কের কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।  কোন ধর্ষককেই দেখা যাচ্ছে না যারা নারীর কাপড়ে আকৃষ্ট হয়ে ধর্ষণ করছে। এটা তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ‘কাপড়-চোপড়’ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণা শতভাগ ভিত্তিহীন। অবশ্য, এখানে আরেকটা প্রশ্নও চলে আসে। উপরোক্ত গবেষণা পরিচালিত হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাতে। আমাদের এখানে হয়তোবা পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে!

এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু তথ্যের দিকে নজর দেয়া যাক। ২০১৪ সালের রিপোর্ট দেখা যায়, মোট ৭০৭টা ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে ছয় বছরের নিচে আছে ৩৫ জন এবং ৭ -১২ বছরের মধ্যে আছেন ৯৯ জন।২০১৫ সালে ৮৪৬টা ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ১৬৩ জনই ছিলো ৭-১২ বছরের শিশু এবং ৫৩ জনের বয়স ছিল ৬ এর নিচে। ২০১৬ সালে ৭২৪ টা ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে ৬২ জন ছিল ছয় বছরের নিচে এবং ১৭৮ জন ছিল ৭-১২ বছরের মধ্যে। ২০০৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানানো হয়েছে, ধর্ষণের শিকার নারীদের ৩১ শতাংশই হচ্ছেন ১১ থেকে ১৫ বছরের মেয়ে এবং এটাই সর্বাধিক।

যেখানে ধর্ষণে আক্রান্তদের মধ্যে বাচ্চাদের সংখ্যাই অধিক, সেখানে ‘কাপড়-চোপড়’ সংক্রান্ত ধারনাটা পুরোপুরিই বাতিল হয়ে যায়।

যেহেতু, ‘ধর্ষণের কারণ’ হিসেবে প্রচলিত ‘পপুলার’ ধারণা পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে, সেহেতু, আমাদের উচিৎ ধর্ষণের প্রকৃত কারণ কি – এ বিষয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা শুরু করা। সেই সাথে আলোচনার টেবিলে এই প্রশ্নও রাখা উচিৎ, এমন ভিত্তিহীন ধারণা কেন জন্ম নিচ্ছে সমাজে? কোন প্রভাবক আমাদেরকে সমস্যার মূল থেকে সরিয়ে অন্যত্র মনোযোগ দিতে বাধ্য করছে?


No comments:

Post a Comment