‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমা শেষ হয়েছিল ‘মুক্তি’ নামের এক নবজাতকের জন্মের মধ্য দিয়ে এবং সিনেমার মুক্তির
মাত্র এক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানিদের কারাগার থেকে আমরাও মুক্তি পেয়েছিলাম; সেটা ছিল বহু ত্যাগের,
বহু
রক্তের, বহু সংগ্রামের মাধ্যমে
প্রাপ্ত মুক্তি। তাই আমরাও সিনেমার নবজাতককে পাকিস্তানের কারাগার থেকে প্রাপ্ত এই
মুক্তির সাথে মিলিয়ে দেখতে পছন্দ করি,
এবং
দেখিও। তবে, আরেকটা প্রশ্নও উত্থাপন করা
যায়, সিনেমায় জহির রায়হান যে
মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন কিংবা দেখেছিলেন সেটা কি ‘একাত্তরে’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ
ছিল নাকি আরো বড় কিছু ছিল? এবং যদি আরো বড় কোন
মুক্তির কথা বলা হয়েই থাকে ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায়ে তার কতটা আমরা অর্জন করতে
পেরেছি? উত্তরের সন্ধান তাঁর সেই
সিনেমার মধ্যেই করা যেতে পারে।
সিনেমাতে আমরা আন্দোলনের দুটো পর্যায় দেখি কিংবা বলা যায় আন্দোলনকে দুই রূপে দেখতে পাই। এক হচ্ছে ঘরের ভেতরে, আরেক হচ্ছে ঘরের বাইরে রাজপথে। ঘরের ভেতরে নির্যাতিত মানুষগুলো ঘরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছিল এবং স্বৈরাচারী শাসক কিংবা একনায়কত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল; আবার এই ঘরের মানুষগুলোই যখন রাজপথে যাচ্ছিল তাদের দাবিগুলোও পরিবর্তন হচ্ছিল। যেমন ঘরের ভেতরে স্বৈরাচারী শাসকের রূপকে চিত্রায়িত দজ্জাল বোনের বিরুদ্ধে সাঁটানো পোস্টারগুলোতে ‘একজনের শাসন চলবে না’, ‘গান গাইতে দিতে হবে’, ‘গুণ্ডামি বন্ধ কর’ প্রভৃতি দাবি দেখা যায়। অন্যদিকে ঘরের বাইরে মানুষগুলোকে দেখা যায় লাঙল হাতে ‘দুনিয়ার সব গরীবকে আজ জাগিয়ে দাও’ গানের সাথে ঠোট মেলাতে। রাজপথে যখন নামছে তখন তারাই গলা ফাটাচ্ছে ‘অন্ন চাই বস্ত্র চাই, বাচার মতো বাচতে চাই’ বলে। তাদের প্ল্যাকার্ডগুলোতে ঘুরেফিরে আসে ‘অন্ন চাই’, ‘বস্ত্র চাই’ লেখাগুলো। ঘরের ভেতর ও বাইর – দুটোকে রূপক হিসেবে ধরলে জহির রায়হানের মুক্তি বিষয়ক চেতনার সন্ধান পাওয়া যাবে। সিনেমা যখন বানানো হচ্ছিল তখন ১৯৬৯-৭০, মানে আইয়ুব বিরোধী তথা স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিভিন্ন বেড়াজালে আবদ্ধ – এমন পরিবেশে একনায়কের শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা বলছেন। প্রতিবাদস্বরূপ, সিনেমাতে ব্যবহার করছেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। কিন্তু, এখানেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন নি জহির রায়হান, দৃষ্টি প্রসারিত করে বুঝেছেন শুধুমাত্র এসব দিয়ে ‘মুক্তি’ আসবেনা। মুক্তি আসবে তখনই যখন গরীবরা বিদ্যমান সমাজ কর্তৃক আরোপিত কারার লৌহ কপাট ভেঙে জেগে উঠবে, মুক্তি আসবে তখনই যখন সবাই অন্ন বস্ত্র নিয়ে বাঁচার মতো বাঁচতে পারবে। ঘুরে ফিরে এই মুক্তির বিষয়টা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এবং উঠবে বিভিন্ন কারণেই। মুক্তিযুদ্ধের পর তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠেও এই কথাগুলো শোনা গিয়েছিল। জহির বলেছিলেন রূপক দিয়ে, তাজউদ্দীন বলেছেন অনেক সরাসরি, অনেক স্পষ্টভাবে, ‘একটি কঠিন যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক ও ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ আরও কঠিন’। শুরুতেই যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম, তাঁর উত্তরে এটা বলা যায়, জহির রায়হান যে মুক্তির স্বপ্ন দেখছিলেন সেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও ভৌগলিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তার দৃষ্টি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে নিঃসন্দেহে।
সিনেমাতে আমরা আন্দোলনের দুটো পর্যায় দেখি কিংবা বলা যায় আন্দোলনকে দুই রূপে দেখতে পাই। এক হচ্ছে ঘরের ভেতরে, আরেক হচ্ছে ঘরের বাইরে রাজপথে। ঘরের ভেতরে নির্যাতিত মানুষগুলো ঘরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছিল এবং স্বৈরাচারী শাসক কিংবা একনায়কত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল; আবার এই ঘরের মানুষগুলোই যখন রাজপথে যাচ্ছিল তাদের দাবিগুলোও পরিবর্তন হচ্ছিল। যেমন ঘরের ভেতরে স্বৈরাচারী শাসকের রূপকে চিত্রায়িত দজ্জাল বোনের বিরুদ্ধে সাঁটানো পোস্টারগুলোতে ‘একজনের শাসন চলবে না’, ‘গান গাইতে দিতে হবে’, ‘গুণ্ডামি বন্ধ কর’ প্রভৃতি দাবি দেখা যায়। অন্যদিকে ঘরের বাইরে মানুষগুলোকে দেখা যায় লাঙল হাতে ‘দুনিয়ার সব গরীবকে আজ জাগিয়ে দাও’ গানের সাথে ঠোট মেলাতে। রাজপথে যখন নামছে তখন তারাই গলা ফাটাচ্ছে ‘অন্ন চাই বস্ত্র চাই, বাচার মতো বাচতে চাই’ বলে। তাদের প্ল্যাকার্ডগুলোতে ঘুরেফিরে আসে ‘অন্ন চাই’, ‘বস্ত্র চাই’ লেখাগুলো। ঘরের ভেতর ও বাইর – দুটোকে রূপক হিসেবে ধরলে জহির রায়হানের মুক্তি বিষয়ক চেতনার সন্ধান পাওয়া যাবে। সিনেমা যখন বানানো হচ্ছিল তখন ১৯৬৯-৭০, মানে আইয়ুব বিরোধী তথা স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিভিন্ন বেড়াজালে আবদ্ধ – এমন পরিবেশে একনায়কের শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা বলছেন। প্রতিবাদস্বরূপ, সিনেমাতে ব্যবহার করছেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। কিন্তু, এখানেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন নি জহির রায়হান, দৃষ্টি প্রসারিত করে বুঝেছেন শুধুমাত্র এসব দিয়ে ‘মুক্তি’ আসবেনা। মুক্তি আসবে তখনই যখন গরীবরা বিদ্যমান সমাজ কর্তৃক আরোপিত কারার লৌহ কপাট ভেঙে জেগে উঠবে, মুক্তি আসবে তখনই যখন সবাই অন্ন বস্ত্র নিয়ে বাঁচার মতো বাঁচতে পারবে। ঘুরে ফিরে এই মুক্তির বিষয়টা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এবং উঠবে বিভিন্ন কারণেই। মুক্তিযুদ্ধের পর তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠেও এই কথাগুলো শোনা গিয়েছিল। জহির বলেছিলেন রূপক দিয়ে, তাজউদ্দীন বলেছেন অনেক সরাসরি, অনেক স্পষ্টভাবে, ‘একটি কঠিন যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক ও ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ আরও কঠিন’। শুরুতেই যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম, তাঁর উত্তরে এটা বলা যায়, জহির রায়হান যে মুক্তির স্বপ্ন দেখছিলেন সেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও ভৌগলিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তার দৃষ্টি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে নিঃসন্দেহে।
জহির রায়হানকে নিয়ে এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ‘জীবন থেকে নেয়া’
নয়, বরং তার একটা অসমাপ্ত কাজের দিকে নজর দেয়া এবং তাঁর ‘মুক্তি’র সন্ধান করা। সেই
অসমাপ্ত কাজের গুরুত্ব বুঝতে হলে জহির রায়হানের সমাপ্ত কাজগুলোকেও গুরুত্ব সহকারে
নিতে হবে, এ উপলধ্বি থেকেই উপরোক্ত
সিনেমা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করতে হলো। কেননা,
একটু
পরেই আমরা দেখবো, জহির রায়হান যে
মুক্তির কথা বলতেন সেটা নির্দিষ্ট কোন দেশ বা সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, তার দৃষ্টি ছিল অনেক সুদূর পর্যন্ত প্রসারিত।
গত শতাব্দীতে মানব ইতিহাসের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও
অভূতপূর্ব কিছু ঘটনা ঘটেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান,
যোগাযোগ
থেকে শুরু করে প্রতিটা বিভাগে বিজ্ঞান মানুষকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে কিংবা
নিয়ে গিয়েছে সেটা পূর্বের শতাব্দীগুলোতে কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলেন কি না
সন্দেহ আছে। শতাব্দীর শুরুতেই পৃথিবী এক অবিস্মরণীয় বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছিল, নিপীড়িত-নিগৃহীত শ্রমিকরা যেখানে দেখেছিল মুক্তির সনদ। আবার, এই শতাব্দীতে সেই বিপ্লবের পতনও দেখেছিল বিশ্ব, যদিও বিপ্লবের আগুন এখনো নিভে যায় নি পুরোপুরি।
ইউরোপিয়ানদের কুখ্যাত উপনিবেশায়নের সমাপ্তি ঘটেছিল গত শতাব্দীতেই এবং ঔপনিবেশিক
শক্তির হাত থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন নতুন অনেকগুলো রাষ্ট্র গঠন হয়েছিল। অবশ্য, এই ঔপনিবেশিক শক্তির
সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের খেলায় শতাব্দীর প্রথম অর্ধেই পৃথিবী দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখে ফেলে, এবং শেষেরটাতে প্রথমবারের মতো পারমানবিক হামলার ভয়াবহতাও টের
পাওয়া যায়। এই ভয়াবহতা এতই তীব্র ছিল যে পাবলো পিকাসো হিরোশিমার ঘটনাকে স্মরণ করে
আইনস্টাইন সম্পর্কে বলেছিলেন, 'প্রতিটি ইতিবাচক
মূল্যের একটি নেতিবাচক ফলও থাকে। আইনস্টাইনের প্রতিভা তাই হিরোশিমার জন্ম দেয়'। প্রথম অর্ধে উপনিবেশায়নের যুগ সমাপ্ত হয়ে গেলেও মূল
ধারনাটা তখনো শেষ হয় নি, এমনকি এখনো শেষ হয়
নি। এখন আছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই এম এফ সহ আরও অনেক
অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যারা ওই পূর্বোক্তদের মতোই কাজ করে, তবে নতুন উপায়ে।
বিংশ শতাব্দীর আরেক অন্যতম অবদান হচ্ছে ‘গণহত্যা’ কিংবা ‘জেনোসাইড’ শব্দের উৎপত্তি।
বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে সিস্টেমেটিকেলি মানুষ হত্যার ঘটনা এ শতাব্দীতে এত বেশি ঘটে যে এ নামে একটা নতুন
শব্দ অভিধানে যুক্ত করতে হয়। আর্মেনিয়াতে গণহত্যা দিয়ে শুরু হয়েছিল, কিছুদিন পর ঘটে জার্মানিতে নাৎসি বাহিনী কর্তৃক ইহুদী
গণহত্যা। তারপর এই দাঙ্গা আর গণহত্যা হাত ধরাধরি করেই চলতে থাকে। বসনিয়াতে চলে, ভিয়েতনামে চলে,
বাংলাদেশে
চলে, প্যালেস্টাইনে চলে এবং
শতাব্দীর শেষ দশকে এসে রুয়ান্ডাতেও ঘটে। শক্তিমত্তা প্রদর্শনের এই খেলায় গত
শতাব্দীতে প্রায় ২০ কোটি লোক প্রাণ হারায় - অনেকটা নতুন কোন মহামারী রোগের
আবির্ভাবের মতোই ঘটনা। এই হত্যাযজ্ঞ থামিয়ে শান্তি আনয়নের জন্যেই ঘটিত হয়েছিল ‘জাতিসংঘ’র মতো প্রতিষ্ঠান, যদিও দিনশেষে তারাই আবার সেই ‘শক্ত’র পুতুল হিসেবেই
হাজির হয়।
অবশ্য এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্যে মানুষের অভাবও
ছিল না কখনো। গত শতাব্দীকে পৃথিবী শুধু নেতিবাচক ঘটনার জন্যেই যে মনে রাখবে তা না,
বরং মনে
রাখবে অসংখ্য মুক্তির মিছিলের কল্যাণেও। পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তির জন্যে
যেমন মিছিল হয়েছে, তেমনি হয়েছে বর্ণবাদের মতো জঘন্য প্রথা হতেও মুক্তির মিছিল।
জহির রায়হান যখন লিখছেন কিংবা সিনেমা বানাচ্ছেন কিংবা জীবন যাপন অতিবাহিত করছেন
তখন এই ছিল পৃথিবীর অবস্থা।
ওই সময়টাতে যখন পৃথিবীব্যাপী মানুষ ফুঁসছিল সকল
ধরণের সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তখন জহির রায়হানের দেশ, এই বাংলাদেশও, ফুঁসছিল তার শাসকের
বিরুদ্ধে। গণ মানুষের এই আন্দোলনে জহির রায়হান নিজেকেও সম্পৃক্ত করেছিলেন; নিজে যেমন ছিলেন লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালক, তেমনি ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। শহীদুল্লাহ
কায়সারের প্রভাবে কমিউনিস্ট রাজনীতি করেছেন,
যদিও
আন্তর্জাতিক মতবাদ-বিতর্ককে কেন্দ্র করে রাশিয়াপন্থী ও চীনপন্থি দুইভাগে নিজেদের
কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে গেলে তিনি সরাসরি পার্টি অফিসেও এর সমালোচনা করেছেন।
একাত্তরের মার্চে যখন অসহযোগ আন্দোলন চলছে তখন এক নিবন্ধে বলেন, ‘গণআন্দোলন আর গণশিল্প পরস্পর নির্ভরশীল। শ্রেণী বৈষম্যে ভরা
সমাজে গণশিল্প গণআন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।’ অর্থাৎ, জহির রায়হান তার শিল্প-সত্ত্বা ও রাজনীতি-সত্ত্বা দুটোকে
ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েই রাখতেন। তার সাহিত্যচর্চার মূল অনুপ্রেরণা ছিল বৈষম্য পূর্ণ এই
সমাজ এবং এর মানুষ। একথা উল্লেখ করতে হয়,
বর্তমানে
বাংলাদেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী চর্চা যারা করেন তারা জহির রায়হানকেও ব্যবহার করে
থাকেন বিভিন্ন উপায়ে; অথচ, জহির রায়হান যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেছিলেন সেটা
উগ্র ছিল না, সেটা ছিল পাকিস্তানের কালো
থাবা থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তির এক উপায় হিসেবেই।
একাত্তরের মে মাসের শেষ দিকে জহির রায়হান ‘স্টপ জেনোসাইড’
তৈরির
পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আবার ওই সময়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের
বিভিন্ন বিষয়ের ওপর স্বল্প-দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করা হবে। এদেরকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চলচ্চিত্র’ নামে অভিহিত করা হবে। উপরোক্ত ‘স্টপ জেনোসাইড’
ছিল সেই
সিরিজের প্রথম পর্ব। এই চলচ্চিত্রতে আসলে কি ছিল? এ বিষয় স্পষ্ট যে, stop genocide চলচ্চিত্র জহির
রায়হান বানাচ্ছিলেন একাত্তরের পাকিস্তানি কর্তৃক গণহত্যাকে কেন্দ্র করেই, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি শুধুমাত্র বাংলাদেশ কিংবা
পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ ছিল? কিছু উল্লেখযোগ্য
বিষয় আলোচনা করা যাক তাহলে।
পৃথিবীব্যাপী গড়ে ওঠা স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তি
সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখানো - সাম্রাজ্যবাদী এই নীতির দিকে দৃষ্টিপাত
করেই ছবিটির সূচনা ঘটে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও এই নীতি আন্তর্জাতিক মহলে
আলোচিত হচ্ছিল যে, এটা কি স্বাধীনতা
আন্দোলন নাকি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন?
জহির
রায়হান তার অবস্থান শুরুতেই পরিষ্কার করে নেন
লেনিনের বিখ্যাত এক উক্তি দিয়ে,
To accuse those who support freedom of self-determination, i. e., freedom to
secede, of encouraging separatism, is as foolish and hypocritical as accusing
those who advocate freedom of divorce of encouraging the destruction of family
ties. লেনিনের
কথাটাই ছবির গোড়াতেই দর্শককে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে, কেননা সীমানা অতিক্রম করে যাওয়ার দিকেই
যে পরিচালক ছুটছেন সেটা তখন পরিষ্কার।
কিছুদূর এগোতেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়টা তুলে
এনেছেন মাত্র তিনটা দৃশ্য দিয়ে। প্রথমেই দেখা যায় নিউইয়র্কে জাতিসংঘ খুব সুন্দর
করে মানবাধিকারের কথা বলছে। ঠিক পরের দৃশ্য একই দিনের, শুধুমাত্র স্থান আলাদা। এবার দৃশ্যপটে সাইগন, ভিয়েতনামের এক শহর,
যেখানে
এই মানবাধিকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মার্কিন বিমানবাহিনী বোমা বর্ষণ করে চলছে; পর্দায় ভেসে উঠে বোমার আঘাতে নিহত ভিয়েতনামী শিশু ও আগুনে
ঝলসানো তার হাত-মুখ। পরবর্তী দৃশ্যও একই
তারিখে, এবারও স্থান আলাদা। এবার
বনগাঁও, ভারতীয় সীমান্ত শহর বনগাঁর
রাস্তা যেখানে যতদূর চোখ যায় শুধুমাত্র শরণার্থীদের অন্তহীন মিছিল। কেন মিছিল, কেননা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তখন চলছে গণহত্যা। একই তারিখের
তিনটা ভিন্ন ভিন্ন স্থানের দৃশ্য মূলত আমাদের সামনে সেই মহাসত্য তুলে ধরেন, যা কিনা বর্তমানের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো শান্তি
প্রতিষ্ঠার নামে করে থাকে। একদিকে তারা ‘জাতিসংঘ’ এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে যারা মানবাধিকারকে সংজ্ঞায়িত
করবে বিভিন্ন উপায়ে এবং মুখে মুখে সেই মানবাধিকারের কথা প্রচারও করবে নিয়মিত। অথচ, যে শক্তিধর দেশগুলো এই প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা তারা চোখের
সামনেই সেই সংজ্ঞায়িত অধিকারগুলো লঙ্ঘন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেটা যেমন গত
শতাব্দীতে হয়েছে তেমনি এই শতাব্দীতেও হচ্ছে। ‘শান্তি’র প্রতি এর চেয়ে বড় প্রহসন আর
কি হতে পারে। কিছুক্ষণ পরে আবারো মানবাধিকারের কথা বলা হয়, ঠিক পরের দৃশ্যেই শোনা যায় গোলাগুলি আর বোমার শব্দ এবং এক
বাচ্চা ছেলেকে দেখা যায় রেললাইনে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে। সাম্রাজ্যবাদ যে
মানবাধিকারকে সবসময়ই থোড়াই কেয়ায় করে –
এই
প্রতীকটি এখানে স্পষ্ট। ‘জাতিসংঘ’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা আর কর্মের বিপরীতার্থক অবস্থান
পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে জহির রায়হান যে মুনশিয়ানার পরিচয় এখানে দিয়েছেন সেটা
অবিশ্বাস্য!
‘স্টপ জেনোসাইড’ এর প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ, ইয়াহিয়াদের গণহত্যা এবং শরণার্থী শিবির –
এটা
আমরা সকলেই জানি। তবু খেয়াল করে দেখবেন,
জহির
রায়হান বারেবারে নিজেকে শুধুমাত্র দেশীয় প্রেক্ষাপটে না রেখে নিজের অবস্থানটা
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করছিলেন। তিনি বাংলাদেশের গণহত্যার প্রেক্ষাপটেই
সিনেমা বানাচ্ছিলেন, কিন্তু সেখানে
শুধুমাত্র বাংলাদেশই ছিল না, সেখানে ছিল জার্মানির
কথা, সেখানে ছিল ভিয়েতনামের কথা।
তিনি বেবে ইয়াহিয়া খানকে চেঙ্গিস খান,
হিটলার, উইলিয়াম কেলীদের সাথে তুলনা করছিলেন। বাংলাদেশকে তুলনা
করছিলেন নাৎসিদের কনসেন্ট্রনশন ক্যাম্পের
সাথে। একটি কিশোরীকে দেখানো হয়, বয়স ১১’র মতো হবে। কোন সন্দেহ নেই যে সে বাংলাদেশী এবং ভারতের
শরণার্থী শিবিরেই ছিল, কিন্তু সিনেমায় যখন
বলা হয় – সে জানে না তার নাম কি, সে জানেনা সে কোথা হতে এসেছে, সে জানেনা তার অতীত কি, এমনকি যখন তাকে বেবে নাম জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল সে শুধু ঠোট
নাড়াতে পেরেছিল, কিছু বলতে পারে নাই – তখন এই কিশোরী আসলে স্থান-কালের ঊর্ধ্বে চলে যায়। সে হয়ে
উঠে সকল সময়ের সকল স্থানের নির্যাতিত মানুষের প্রতিকৃতি। এই কিশোরী বাংলাদেশের, এই কিশোরী ভিয়েতনামের,
এই
কিশোরী হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের। তার অকথিত গল্প আসলে পৃথিবীর সকল
নির্যাতিত মুক্তিকামী মানুষের গল্প।
জহির রায়হান যে শুধু গণহত্যা কিংবা নির্যাতিত
মানুষের প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছেন তা না, তিনি মুক্তিকামী
মানুষের মুক্তি জন্যে প্রতিরোধ যুদ্ধটাকেও তুলে এনেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং
এর দৃশ্য নিয়েছেন, অবশ্যই সেটা
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের, কিন্তু এটাও মনে
রাখতে হবে এই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি পৃথিবীর আপামর মুক্তিকামী মানুষ ও তাদের
আন্দোলন থেকে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখেন নি। আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামকে তিনি
দেখেছিলেন দুনিয়া জুড়ে সব মুক্তিসংগ্রামের অংশ হিসেবে। এজন্যেই শুরুতেই বলেছিলাম, জহির রায়হান যে ‘মুক্তি’র কথা বলতেন সেটা ছিল অনেক সুদূর পর্যন্ত প্রসারিত, এর সাথে জড়িয়ে ছিল অনেক ঐতিহাসিক ঘাত-প্রতিঘাত। এ সিনেমা
সম্পর্কে একজন সমালোচকের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য, ‘‘স্টপ জেনোসাইড’ গণহত্যা বিরোধী,
মানবাধিকারের
পক্ষে এক সুতীব্র, শিল্পিত দলিল।’
জহির রায়হান যে মুক্তির কথা বলতেন সেটা অনেকেরই
কাছে বোধগম্য হয় না, তাই এর বিরোধিতা করে।
একে আটকানোর পাঁয়তারা করে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ নিয়ে ঝামেলা পাকিয়েছিল পাকিস্তানিরা, আর ‘স্টপ জেনোসাইড’ নিয়ে আপত্তি উঠেছিল খোদ বাংলাদেশ থেকে। প্রথমত, সিনেমায় আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছিল, দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সরকারের
ভেতরের অনেকেই তখন আমেরিকার দ্বারা প্রভাবিত – এই দুটোর যুগলবন্দী আলোচ্য সিনেমাটি বন্ধের দাবি তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল। দাবি
তোলাও হচ্ছিল। যেমন, কলকাতায় অবস্থানরত
একজন চলচ্চিত্র পরিচালক তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে চিঠি
লিখে এই চলচ্চিত্র নিষিদ্ধের দাবি জানান। অভিযোগ ছিল যে, এখানে লেনিনের ছবি দেখানো হয়েছে, শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের দৃশ্য
কম দেখানো হয়েছে, শেখ মুজিবের কথা
উল্লেখ করা হয় নি এবং আ’লীগের ছয়দফার কথাও উল্লেখ
করা হয় নি। চিঠি প্রেরক এটাও উল্লেখ করেছিলেন, ‘If it is not done, I alone, am ready to start a movement’। এই অভিযোগের
প্রেক্ষিতে চলচ্চিত্রটি মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গ দেখেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ এর
ছাড়পত্র প্রদান করেন। ইন্দিরা গান্ধী এটা দেখে মুগ্ধ হয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র বিভাগকে
ছবিটি ক্রয় করে আন্তর্জাতিকভাবে বিতরণের নির্দেশ দেন।
সিনেমার শেষ দৃশ্যে যখন গণহত্যা বন্ধের জন্যে যে
হুংকার ছোড়া হয়, মানে ‘স্টপ জেনোসাইড’
কিংবা ‘গণহত্যা বন্ধ করো’
বলে যে
আদেশ দেয়া হয় সেটা কি শুধুমাত্র একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের আদেশ হিসবেই কি ফুটে উঠে? নাকি সেটা শোষকদের প্রতি একজন শিল্পীর আদেশ হয়ে উঠে? নাকি একজন ব্যক্তি জহির রায়হানের আদেশ হয়ে উঠে? নাকি শাসকদলের প্রতি পৃথিবীর প্রতিটা শোষিত মানুষের আদেশ
হয়ে উঠে!
জহির রায়হানরা গণহত্যা বন্ধের আদেশ দিয়েই ক্ষান্ত
হন না, তারা আলো জ্বালাতে চান।
হানাহানিতে লিপ্ত পৃথিবীর বুকে শান্তি ও মুক্তির আলো জ্বালাতে চান, কিন্তু শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে যান। তাই দেখা যায়, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’
ছবির
কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ – বাক্য দুটো একসাথে উচ্চারণ করে দেখুন, ছন্দ খুঁজে পাবেন। স্পষ্টই, পূর্ববর্তী সিনেমাটা পরবর্তীর মুখবন্ধই হয়ে থাকলো।
‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দেয়া হয় ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে। ছবিটি
বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও রুশ ভাষাতে ডাব করা হবে বলেও জানানো হয়। ছবির উর্দু
ও ইংরেজি ভাষায় সংলাপ লিখবেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ এবং
রুশ সংলাপ লিখবেন নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী ওপন্যাসিক মিখাইল সোলকভ। ১৯৬৬ সালে জানানো
হয় এ বছরেই কাজ শুরু হবে। বিভিন্ন কারণে অতঃপর ১৯৬৭, ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালেও ছবির কাজ শুরু হয় নি। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে বহুল প্রতীক্ষিত
এই ছবির শুটিং শুরু হয়। কাজ শুরু করার দিন জহির রায়হান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘‘লেট দেয়ার বি লাইট’
হচ্ছে
আমার প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র; এই অর্থে যে এই প্রথম
চিত্র ব্যবসায়ের নির্মম কমার্সের নিগড় মুক্ত হয়ে একজন মুক্ত শিল্পী হয়ে আমি একটা
ছবি করতে যাচ্ছি। এতদিন আমি সব ছবিতেই কমবেশি ক্রীতদাসের মতো কাজ করেছি’।
কথা ছিল ছবিতে সংলাপ থাকবে মাত্র ১৫ টি। প্রথমে
ছবির নায়ক চরিত্রে ওমর চিস্তি আর নায়িকা চরিত্রে অলিভিয়া গোমেজ করেন। হঠাৎ করেই
সেপ্টেম্বরের দিকে জহির রায়হান অলিভিয়াকে বাদ দিয়ে ববিতাকে নায়িকা চরিত্রে নেয়ার
কথা ঘোষণা করেন। ছবির সংলাপ লিখেছিলেন শহিদুল্লাহ কায়সার এবং সংগীত পরিচালনা
করেছিলেন খান আতাউর রহমান।
একাত্তরে মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে
গেলে ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং আর শুরু করা সম্ভব হয় নি, যদিও জানুয়ারির মধ্যেই ছবির ৩০ ভাগ কাজ শেষ হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতের উপর নির্মিত এই সিনেমাটা অতঃপর রয়ে যায় জহির রায়হানের
অসমাপ্ত কাজ হিসেবেই।
কি ছিল আসলে এই ‘লেট দেয়ার বি লাইট’এ, যাকে কিনা জহির রায়হান নিজের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে ঘোষণা
দিচ্ছেন? তাও তার নিজের ভাষায়, এই জহির রায়হান ছিলেন ‘মুক্ত’ জহির রায়হান, একজন ‘মুক্ত’ শিল্পী। ‘মুক্তি’ পেয়ে তিনি আসলে কি দেখাতে চাচ্ছিলেন আমাদের? উল্লেখ্য, এই সিনেমার
স্কৃপ্টই বই আকারে বের হয়েছিল ‘আর কতদিন’ নামে।
গল্পে দেখা যায় তপু এবং ইভা, এ দুই তরুণ-তরুণী ভয়ংকর একদল খুনিদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে
দৌড়ে পালাচ্ছে। তপু যখন ইভাদের বাড়িতে যায়,
গিয়ে
আবিষ্কার করে ইভাই শুধুমাত্র বেঁচে আছে,
পরিবারের
সবাই মারা পড়েছে। রাস্তায় বের হয়েই তপু-ইভা দেখে তাদের মতো আরও হাজারো মানুষ জীবন
বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে। দুজনের লক্ষ্য যেভাবেই হোক তপুদের বাড়িতে পৌঁছা, কেননা তপুর দাবি,
তার
পিতা-মাতা-ভাই-বোন সকলেই ইভাকে ভালোবেসে গ্রহণ করবেন। এদিকে তপুর পরিবার আশ্রয়
দিয়েছে বিপদে পড়া কয়েকজন শরণার্থীকে, যাদেরকে খুনিরা
খুঁজছে হন্য হয়ে। তপুর পরিবার হঠাৎ করে জানতে পারে যে তপুকেও নাকি মেরে ফেলা হয়েছে, সেই আক্রোশে তারা আশ্রিত মানুষগুলোকেও হত্যা করে ফেলে।
কিন্তু, তপু তখনো বেঁচে আছে এবং সে
বাড়িতে ফিরে যখন দেখে পিতা-মাতা-ভাই সকলের হাত রক্তে রঞ্জিত তখন সে ইভাকে নিয়ে আবারো পালায়, দৌড়ে পালায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পুরো গল্পে কি কোন নির্দিষ্ট সময় কিংবা নির্দিষ্ট স্থান আছে? মানে, গল্পের মানুষগুলো কোন
দেশের, কোন স্থানের, কিংবা কোন সময়ের সেটা কিন্তু নির্ধারণ করা যায় না। তবে, এটা বুঝা যায় যে,
পৃথিবীব্যাপী
যে হানাহানি চলছে তা থেকে বাঁচতে এই মানুষগুলো প্রাণপণ চেষ্টায় মত্ত। অর্থাৎ, এরা নির্যাতিত জনগোষ্ঠী, যাদের কোন নির্দিষ্ট দেশ নেই। যুগ যুগ থেকে লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হতে হতে এরা
একসময় ভুলেই যায় এরা অন্যসকলের মতো মানুষ! তাদেরও ‘অধিকার’ বলতে কিছু একটা আছে! লেখকের
ভাষায়, ‘দীর্ঘদিন একটা বাক্সের মধ্যে
হাত-পা গুটিয়ে বন্দী হয়ে থাকতে ওরা ধীরে ধীরে দ্বিপদ থেকে চতুষ্পদ হয়ে গেছে।’ মাথা নিচু করে থাকতে থাকতে যখন বুকের কাছ থেকে মাথাটা তুলতে
যায় তখন দেখে যে তাদের মেরুদণ্ডেও টান পড়েছে। এই গল্প মূলত তাদের নিয়ে।
জহির রায়হান যে পৃথিবীকে এখানে তুলে আনার চেষ্টা
করছেন সেই পৃথিবী কেমন? আপনার-আমার চারপাশটা
একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই সেই পৃথিবীর ছবি পেয়ে যাবেন, যেখানে মানুষ মানুষকে হত্যা করে চলছে ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতীয়তার নামে, সংস্কৃতির নামে। হত্যা করা হয়েছে বৃদ্ধকে, হত্যা করা হয়েছে যুবক-যুবতীকে, এমনকি হত্যা করা হয়েছে নবজাতককে – যার চোখে পৃথিবীর আলো প্রবেশই করতে পারেনি পুরোপুরি। এই
হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর কোথায় হচ্ছে? গল্পে যে শরণার্থীর
মিছিল দেখা যায় সেখানে একজন বলে, ‘ওরা আমার ছেলেটাকে
মেরে ফেলেছে হিরোশিমায়। আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়। আমার বোনটা এক
সাদা কুত্তার বাড়িতে বাঁদি ছিল। তার প্রভু তাকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকাতে। আমার
বাবাকে হত্যা করেছে ভিয়েতনামে। আর আমার ভাই,
তাকে
ফাঁসে ঝুলিয়ে মেরেছে ওরা। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো।’
এই ভালোবাসাটা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা যে যুগে আমরা বসবাস করছি সেটা ‘পণ্য’র যুগ; এখানে ভালোবাসাটাও একটা পণ্য। তাই যারাই এর বিরুদ্ধে
ভালোবাসতে গিয়েছে নিঃস্বার্থভাবে, তারাই শিকার হয়েছে
নির্মম গণহত্যার। তবু, এই নির্যাতিত
মানুষগুলো স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকার, স্বপ্ন দেখে একটা
ঘরের, স্বপ্ন দেখে সুখের, স্বপ্ন দেখে শান্তির,
স্বপ্ন
দেখে ভালোবাসার। জহির রায়হানও আমাদের সেই স্বপ্ন দেখান। যখন বাইরে শুকর ছানা ও
পাগলা কুকুরগুলো খুনে মেজাজে হৈ-হুল্লোড় করছে তখনও তপু ইভাকে জিজ্ঞেস করে
ভালোবাসার কথা। ইভা মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলে, ‘ভালো লেগেছে। ভালো লাগে। তাই ভালোবাসি।’
যা দিয়ে এই ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ এর কথা শুরু করেছিলাম
সেখানেই ফিরে যাই আবারো। এখানে মূলত আমরা জহির রায়হানের সেই আন্তর্জাতিকতাবাদকে
খুঁজে পাই যিনি বেবে তুলে ধরছেন, সর্বহারাদের আসলে কোন
নির্দিষ্ট সীমানা নাই। এখানেও তিনি ‘স্টপ জেনোসাইড’
এর মতো
করে গণহত্যাকে তুলে আনছেন, এবং সেটা সকল সময়ের ও
সকল স্থানের। তবে সেটা আরও মানবিক উপায়ে এবং আরও হৃদয়স্পর্শী উপায়ে। গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় হচ্ছে, উক্ত লেখার প্রায় অর্ধশতাব্দি
পার করে ফেললেও পৃথিবীর চেহারা একটুও বদলায় নি। এখনো সিরিয়া ও লিবিয়াতে
শরণার্থীদের ঢল দেখা যায়, এখনো বোমা আঘাতে
হতবিহ্বল শিশুকে দেখা যায়, এখনো বাচ্চাদের লাশ
সমুদ্রের পাড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়, যেমন করে ইভার কোলে
আশ্রিত শিশুটি মারা যায়। মানবাধিকার নিয়ে অনেক সুন্দর ও আবেগময়ী কথা বর্তমানে
হচ্ছে ঠিক, তবু দুঃখের বিষয় এটাই যে, এখনো গণহত্যা এখনো বন্ধ হয় নি। বরং বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে
আরো নতুন নতুন উপায় বের করা হচ্ছে মানবসন্তানকে হত্যার জন্যে। এই ‘লেট দেয়ার বি লাইট’
গণহত্যা
বিরোধী, মানবাধিকারের পক্ষে আরও এক
সুতীব্র ও শিল্পিত দলিল।
আলোচনার এ পর্যায়ে এসে আফসোস ও আক্ষেপ একসাথে ভর
করে, কেননা যে মুক্তির জন্যে জহির
রায়হান গলা ফাটাচ্ছিলেন, যে গণহত্যা বন্ধের
জন্যে জহির রায়হান বেবে আকুতি জানাচ্ছিলেন,
কিংবা
হুংকার দিচ্ছিলেন, সেই গণহত্যার শিকার
তাকেও হতে হয়। বাহাত্তরের ৩০ জানুয়ারি তিনিও নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তার
গল্পের ‘শুকরছানা’দের হাতে। তাই,
‘লেট
দেয়ার বি লাইট’ সিনেমার কাজ শেষ পর্যন্ত
অসমাপ্তই রয়ে যায়।
সমাপ্ত ও অসমাপ্ত - উপরোক্ত দুটো সিনেমারই
কেন্দ্র বিষয় হচ্ছে ‘গণহত্যা’! জহির রায়হান গণহত্যা বন্ধ করে মুক্তির আলো জ্বালাতে
চেয়েছিলেন – এই ‘চাওয়া’টা তাঁর
সাহিত্যকর্মের শুরু থেকেই উপস্থিত ছিল এবং এই বোধ তাঁকে সারাজীবন তাড়িত করেছে। তাই
দেখা যায় জীবনের প্রথম প্রকাশিত কবিতায় - যা কিনা হাই স্কুলে থাকাকালীন সময়ের – লিখছেন, ‘ওরা আমার
ভাইবোনকে/কুকুর বেড়ালের মতো মেরেছে/ওদের স্টিম রোলারের নিচে...’। পরিবারের
মানুষদের প্রভাবেই তিনি সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট রাজনীতি করেছেন, গণ মানুষের জন্যে লড়েছেন, গণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, জেল খেটেছেন। এই ‘মুক্তি’টাকে শুধুমাত্র
সাহিত্যকর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখেন নি,
একে
পাওয়ার জন্যে সদা সক্রিয়ও ছিলেন রাজনীতির ময়দানে। তাই, বর্তমানে আমরা যে ‘অরাজনৈতিক’ পরিবেশে বাস করছি –
যেখানে
রাজনীতি খারাপ বলে দূরে রাখা হয়, কেননা, রাজনীতি থেকে আমাদেরকে যত দূরে রাখা সম্ভব হবে শাসকরা
আমাদের ‘মুক্তি’টাকেও ততটা দূরে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে- সেখানে জহির রায়হান
আমাদের আলোচনায় বেবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন। এটাই স্বাভাবিক।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
১) জহির রায়হানের চলচ্চিত্র, পটভূমি বিষয় ও বৈশিষ্ট্য, অনুপম হায়াৎ
২) ভূমিকা,
শাহরিয়ার
কবির, একুশে ফেব্রুয়ারি, জহির রায়হান।
৩) ভারতে জহির রায়হান পরিচালিত একটি প্রামাণ্য
চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রতিবাদে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত বাংলাদেশের
চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালক জনাব ফজলুল হক–এর চিঠি, ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১,
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ৩য় খণ্ড।
No comments:
Post a Comment