Sunday, March 20, 2022

হাওয়ার্ড জিনের ‘এমা’: এক আজন্ম-বিদ্রোহী নারীর প্রতিচ্ছবি



সংক্ষেপে এমা গোল্ডম্যানকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য বলা যায়, তিনি গত শতকের একজন এনার্কিস্ট রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট ও লেখক। কিন্তু এতে তাঁর বিদ্রোহী, দুরন্ত ও স্বাধীনতাকাঙ্খী উত্তাল জীবনের নাগাল পাওয়া যাবে না। একটা ছোট ঘটনা এমার উত্তাল জীবন সম্পর্কে পাঠককে হালকা আঁচ দিতে পারে। এমার প্রেমিক ও সঙ্গী আলেক্সান্ডার বার্কম্যান (তিনিও প্রখ্যাত এনার্কিস্ট এক্টিভিস্ট ও চিন্তুক) শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হেনরি ক্লে ফিক নামক এক কর্তাব্যক্তিকে হত্যার চেষ্টা করেন, কিন্তু কেবল আহত করতেই সক্ষম হন। বার্কম্যান গ্রেফতার হোন, ২২ বছরের জন্য জেল হয়। জেলে হয়তোবা তাকে মেরে ফেলা হতে পারে, এমন উদ্যোগের কথা তিনি এমাকে জানান। এমা ও তাঁর বন্ধুরা মিলে বার্কম্যানকে জেল থেকে বের করে আনার এক অকল্পনীয় ও অবাস্তব উদ্যোগ নেন। জেলখানার খুব নিকটে একটি বাড়ি ভাড়া করেন তারা, সেখান থেকে একটা টানেল খোড়া শুরু করেন। উদ্দেশ্য একেবারে জেলের উঠান পর্যন্ত খনন করবেন। যখন তারা গর্ত খোঁড়ার কাজ করতেন তখন একজন পিয়ানো বাজাতেন, যেন কর্তৃপক্ষ টের না পায়। কিন্তু কপাল খারাপ। একদম শেষ প্রান্তে কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে যায়। ফলে এমার ‘অবাস্তব’ এই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয় না।


হাওয়ার্ড জিন রচিত ‘এমা’ হচ্ছে প্রধানত এই দুরন্ত স্বাধীনতাপ্রেমি এমা গোল্ডম্যানের জীবনীনির্ভর নাটক। হাওয়ার্ড জিনও আমেরিকার আরেক বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। তবে ইতিহাসবিদ, সমাজচিন্তক, সাহিত্যিক, নাট্যকার এইসব পরিচয় ছাড়িয়ে রাজনৈতিকে এক্টিভিস্ট পরিচয়টাও বড়ো হয়ে উঠেছিল। আমেরিকার বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলন ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ, গ্রেফতার হয়েছেন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তবু শেষ দিন পর্যন্ত আমেরিকার যুদ্ধবাজ চরিত্রের চরম সমালোচক হিসাবে নাম কুড়িয়েছেন। জিনও নিজেকে এনার্কিস্ট হিসাবে পরিচয় দিতেন। অহিংস ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম প্রচারক ছিলেন তিনি। কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে অহিংস নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে যেমন বিস্তর লিখেছেন, তেমনি মাঠেও সক্রিয় থেকেছেন। তাঁর মতে, সহিংস আন্দোলনের চাইতে অহিংস আন্দোলন বেশি কার্যকর ও বেশি টেকসই। তাঁর সামগ্রিক কাজকে অহিংস আন্দোলনের একটা নমুনা হিসাবেও পাঠ করা সম্ভব। ফলে, হাওয়ার্ড জিন কেন এমা গোল্ডম্যানকে নিয়ে নাটক লিখতে গেলেন, তা সহজেই অনুমেয়।

‘এমা’ নাটকটি এমা গোল্ডম্যানের জীবনের একটা বিশেষ পর্ব নিয়ে। শুরু হয়েছে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে, এবং শেষ হয়েছে দেশ ত্যাগের মুহূর্তে। এমার জন্ম হয়েছিল লিথুনিয়ার ১৮৬৯ সালের এক ইহুদি পরিবারে। পরিবারের সাথে ১৮৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান। কাজ করতেন সেখানকার কারখানায়। ১৮৮৫ সালে শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রভাব তাঁর ওপর এতো বেশি ছিল যে, এর পরই তিনি এনার্কিজমের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ‘এমা’ নাটকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মী হয়ে উঠা, আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং ধরণ ইত্যাদি বিষয়ে একটা ছোট পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু নাটকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আসলে এক স্বাধীনতাকামী নারীর অবয়বই প্রধান ও প্রবল: যে নারী মিলের শ্রমিকদের রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলছেন, তাদেরকে উজ্জীবিত করছেন, আবার নারীমুক্তির কথা বলছেন, মুক্তভালোবাসা, বিবাহসম্পর্ক, সমকামিতা নিয়ে আলোচনা করছেন, এবং নিজের জীবনেও সেটা চর্চা করছেন। আবার এনার্কিস্ট আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে জেলও খাটছেন। ‘এমা’ নাটকটি এক আজন্ম-বিদ্রোহী নারীর প্রতিচ্ছবি।

অনুমান করা যায়, হাওয়ার্ড জিন ও এমা গোল্ডম্যানের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার মূল সুতা রাজনৈতিক আন্দোলন ও এনার্কিজম। বাংলাদেশে এনার্কিজম সম্পর্কে একধরণের ‘খারিজি’মূলক মনোভাব রয়েছে; রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে এনার্কিজম অনালোচিতও। কিন্তু, দেশে ও বিদেশে পরিবর্তনবাদী রাজনৈতিতে এনার্কিজমের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা ক্রমেই জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। হাওয়ার্ড জিন ডিরেক্ট একশন, সিভিল ডিসঅভিডিয়েন্সকে এনার্কিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কৌশল হিসাবে বিবেচনা করতেন। আবার উদ্দেশ্য ও উপায়ের সঙ্গতিকেও অন্যতম প্রধান মূলনীতি হিসাবে বিবেচনা করতেন। প্রশ্ন করতেন, যুদ্ধের মাধ্যমে কী শান্তিময় জীবনে প্রবেশ সম্ভব? জিন যখন এমাকে নিয়ে নাটক লিখেন তখন এই ধারণাগুলোই ক্রমশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে, নাটকীয়ভাবে তো বটেই। এমা গোল্ডম্যান, এনার্কিজম, এনার্কো-ফেমিনিজম, নারীমুক্তির বিভিন্ন ধারণা, মুক্তভালোবাসা ইত্যাদি সম্পর্কে পাঠকও একটা সহজ ধারণা এতে পাবেন।

শেষ বেলায় মনে হতে পারে, কেন বাংলাদেশে বসে ‘এমা’ পাঠ করবো? সচেতন (ও অসচেতন) পাঠকমাত্র নাটকের শুরুতেই একটি দৃশ্যাংশ খেয়াল করবেন। দৃশ্যে এমাসহ কয়েকজন নিউইয়র্কের একটি সেলাই কারখানার শ্রমিক। ওরা কাজ করতে করতে বড় এক অগ্নিদুর্ঘটনার কথা আলাপ করছে যেখানে দরজা বন্ধ থাকার কারণে অনেক শ্রমিক নিহত হন। নাটকের একজন চরিত্র ডোরা বলছেন: ‘আঠারোজন নারী মারা গিয়েছিল। কেউ কেউ আগুনে পুড়ে মরে। কেউ জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে। এরকম মর্মান্তিক ঘটনা কেউ কি ভুলতে পারে?’ আরেকজন প্রশ্ন করে, ‘ওরা পেছনের দরজা দিয়ে নামতে পারে নি কেন?’ জেনি নামক আরেক শ্রমিক উত্তর দিয়েছিল: ‘দরজা বাইরে থেকে তালা দেয়া ছিল। কেসিনস্কি সেটা বন্ধ রেখেছিল কারণ ও জানতো কিছু মেয়ে ছাদে যায়। তাও আবার দমবন্ধ অবস্থা থেকে কিছু সময় সামান্য বাতাস নেয়ার জন্য তারা ছাদে যেত।’ তাজরীন গার্মেন্টসের ঘটনা এবং সাম্প্রতিক নারায়নগঞ্জের কারাখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মনে রাখলে এই দৃশ্যগুলোর ‘অদ্ভুত’ মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। স্থান ও কালের প্রায় শতাধিক বছরের ব্যবধান থাকলেও কারখানার শ্রমিকদের জীবন ও ভাগ্য এখনো যেন একই রয়ে গিয়েছে। এমন জমানায় তাই হাওয়ার্ড জিন ও এমা গোল্ডম্যান আমাদের জন্য উপকারী উঠতে পারেন!

No comments:

Post a Comment