Monday, June 21, 2021

‘অপরায়ন’ এর রাজনীতি

 


সম্প্রতি ব্রাম্মনবাড়িয়াতে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের এক শিশুর লাশ কবর থেকে তুলে ফেলার ঘটনা ঘটেছে অবশ্য, আহমদিয়াদের উপর এমন আক্রমণ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, এ বছরের জানুয়ারিতে তাদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয় আহমদিয়াদের উপর এমনতর হামলাকে বাংলাদেশ অপরাপর সংখ্যালঘুদের উপর হামলা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে পাঠ করা অসম্ভব কিন্তু, আহমদিয়া শিশুর লাশ তুলে ফেলা বা বাড়িঘরে হামলা করার ঘটনাসমূহকে দেওবন্দীসহ বিভিন্ন ইসলামিস্ট দলগুলো কর্তৃকঅপরায়নপ্রক্রিয়া এবং সেই প্রক্রিয়ারবাস্তবায়ন হিসাবেও দেখা দরকার

পরিচয়বাদী রাজনীতির জন্য, বিশেষত যে কোনো গোষ্ঠীর পরিচয় নির্মাণ ও বোঝার জন্য, ‘আদারিংবাঅপরায়নখুব জরুরি; এটি আসলে একটি প্রক্রিয়া, নিজেকে (সেলফ) চিহ্নিত করার পাশপাপাশি ক্রমাগতঅপরতৈরির প্রক্রিয়া তবে, নিজের গোষ্ঠীগত পরিচয় নির্মাণের জন্যআমি কেবাআমি কীভাবে নিজেকে দেখছিকেবল এই প্রশ্নের উত্তরে পুষায় না, বরঞ্চ আমি কীভাবে অন্যের চেয়ে আলাদা সেটাও সমভাবে নির্ধারণ করতে হবেঅপরের সাথে নিজেদেরফারাকটা চিহ্নিত করাটা পরিচয় নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ দিক এইফারাকটা কোনো স্বাভাবিক বা সহজাত বিষয় না, তা নির্মিত ও আরোপিত হয়ে থাকে; এইফারাকনির্মাণই আসলেঅপরায়ন

অপরায়নপ্রক্রিয়ার দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, ক্ষমতা ও অর্থ নির্মাণ নিয়ত ছাড়া বা কোনো ফলাফল ছাড়াঅপরনির্মিত হয় না, এটার সাথে পুরস্কার বা শাস্তির বিষয় জড়িত থাকে, সেটা প্রতীকী অর্থে হলেও যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে কেবল তারাই পারে নিজেদের পরিচয়কেসহজাতহিসেবে উপস্থাপন করেঅপরনির্মাণ করতে আবার, আমরা কীভাবে নিজেদের দেখতে চাই এবং অন্যরা কীভাবে আমাদেরকে গ্রহণ করবে সেটার অর্থও নির্মাণ করতে হয়

বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকারফারাকতুলে ধরাটা যেমনঅপরায়নতৈরি করে, তেমনি অপরায়নের মাধ্যমে কেন্দ্রের সাথে প্রান্তিকের একধরণের ক্ষমতা সম্পর্ক এবং হায়ার্কি তৈরি হয়   

দেওবন্দীদেরসহি মুসলিমবর্গ এবং আহমদিয়ার অবস্থান 

আলী রীয়াজ Lived Islam and Islamism in Bangladesh গ্রন্থে দেওবন্দীদের পরিপ্রেক্ষিতেসহি মুসলমানপরিচয় নির্মাণের জন্যঅপরনির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি দেওবন্দীর ইতিহাস, বিশেষত পূর্ববাংলার সমাজে তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি আলোচনার পাশাপাশি তাদের সমসাময়িক বিভিন্ন টেক্সট এবং সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এইঅপরনির্মাণ ও সমাজে এর প্রভাব তুলে ধরেছেন

দেওবন্দী উলেমাদের কাছেসহি মুসলমানহওয়ার জন্য ঈমান, আমল ও আদাব খুব জরুরি; মাদ্রাসার কাজ মূলত এই তিনটা বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাদানের মাধ্যমে উপযুক্তসহি মুসলমানহিসাবে ছাত্রকে গড়ে তোলা কিন্তু, এই সহি মুসলমান হওয়ার জন্য নিজেদের নামাজ-রোজা বা ধর্মীয় মৌলিক বিধানগুলো মানা যেমন জরুরি, তেমনি কারা কারা-সহি মুসলমানসেটা নির্ধারণ করা এবং ওদের সাথে নিজেদেরফারাকচিনতে পারাটাও সমান জরুরি

কিন্তু, এই আলাপ-আলোচনা কেবল মাদ্রাসায় বা শিক্ষায় বা তাত্ত্বিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না, প্রাত্যাহিক জীবনের আমলের সাথেও এটা মিশছে ফলে, অন্যান্য ইসলামি সম্প্রদায়সমূহের সাথে (তাত্ত্বিক পর্যায়ে) নির্মিতফারাকতাদের অনুসারীদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে সহি মুসলমানিত্বের জন্য তাকে কেবল বিশ্বাস করলেই হয় না, বরঞ্চ আমলও করতে হয় নিজে কি, এটা তার জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে, নিজে কি না সেটা বারেবারে প্রমাণ করাও তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে আলী রীয়াজ তাই জানাচ্ছেন, দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলো কেবলসহি মুসলমানই তৈরি করছে না, একই সাথে কে ভালো মুসলিম, কে খারাপ মুসলিম, কে কম মুসলিম এগুলোও নির্ধারণ করছে

এখানেসহি মুসলমানএকটা বর্গ; এখন এই পরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করার জন্য অন্যান্য যে ইসলামি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীসমূহ রয়েছে তারা কতটা কোন মাত্রায় মুসলমান, কারা মুসলমান নয়, কারা কাফির হয়ে গিয়েছে সেটা নির্ধারণ ও বিশ্বাস করতে হয় আলী রীয়াজ দেওবন্দীদের টেক্সট ও ওলেমাদের ভাষ্য থেকে জানাচ্ছেন যে, তারা আহমদিয়াদেরকাফিরহিসাবে চিহ্নিত করেন, এবং মৃত্যুদণ্ডই তাদেরকুফরির শাস্তি বলেও মনে করেন এটা কেবল আহমদিয়াদের জন্য না, একই মনোভাব তারা পোষণ করেন শিয়া মতাবলম্বীদের জন্যও অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে দেওবন্দীরা তাদের নির্মিত অর্থের উপর দাঁড়িয়ে নিজেদেরপরিচয়এর পরিপ্রেক্ষিতেঅপরএর অস্তিত্বের প্রশ্নে সিদ্ধান্তে পৌছাচ্ছেন আলী রীয়াজ বলছেন, দেওবন্দী উলেমা এবং তাদের মাদ্রাসাগুলো আহমদিয়াদেরকাফিরহিসাবে বিশ্বাস করাটাকে ইমানের ব্যাখ্যায় অঙ্গীভূত করেছেন

ক্রমাগতঅপরনির্মাণ ও বিমানবিকীকরণের এই রাজনীতি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তার এক উজ্জ্বল নজির হচ্ছে কাদিয়ানি শিশুর লাশ তুলে ফেলা জানা যায়, প্রতিটি মসজিদ থেকে মাইকিং করে আহমদিয়াদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে লোক জড়ো করা হয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শাহ আহমেদ শফীর ওয়াজে ঘোষণা দিয়েছিলেন, কাদিয়ানীদের লাশ কবর থেকে তুলে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে এছাড়া বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিল-সভা-সমাবেশ থেকে আহমদিয়াদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা ও বিভিন্ন সামাজিক মেলামেশা করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিও তোলা হয় বলা হয় যে, কাদিয়ানীদেরকে যারা কাফের বলে না, তারাও কাফের বিভিন্নভাবে (টেক্সট, ওয়াজমাহফিল, ইত্যাদি) ক্রমাগতঅপরনির্মাণ ও বড়ো হুজুরের খোলা-ফতোয়া এবং সেই ফতোয়াকে 'আমল' করার এক দৃষ্টান্ত হচ্ছে লাশ তুলে ফেলার ঘটনা শাহ আহমেদ শফীর এই রাজনীতি চরম বর্ণবাদী রাজনীতি, এবং উপরোক্ত ঘটনাটা সেই বর্ণবাদী রাজনীতি বহিঃপ্রকাশঅপরায়ন দিনশেষে এমন বর্ণবাদী রাজনীতিরই জন্ম দিয়ে থাকে

দেওবন্দীদের এই অপরায়ন যেমন অন্যান্য মুসলমান সম্প্রদায়কে বিমানবীকিকরণের ক্ষমতা প্রদান করে, তেমনি নিজেদের ব্যাখ্যা বা অর্থকেসহিদাবি করার ক্ষমতাও দেয় যেমন করে মিশেল ফুকো বলেছিলেন, যারা ডিসকোর্স তৈরি করে তারা এটা আরোপ করারও বৈধতা হাসিল করে যা কিনা দিনশেষেরেজিম অফ ট্রুথনির্মাণ করে

 

 রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদ 'অপর' নির্মাণ

পারভেজ আলম 'মদিনা' গ্রন্থে রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদের কথা বলেছিলেন; রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতার বর্ণবাদী মতাদর্শ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয় ফলে, সমাজেরই বিভিন্ন গোষ্ঠী ক্রমাগত 'বধযোগ্য' 'খরচযোগ্য' মানুষের জন্ম দেয় এবং এই বধযজ্ঞে এই ধরণের সামাজিক সম্মতি প্রতিষ্ঠা করে তাই দেখা যায় বিভিন্ন ‘নামে’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জীবনইনাঙ্গাহয়ে গিয়েছে। কখনোনাস্তিকনামে, কখনোশিবিরনামে, কখনোআহমদিয়ানামে, কখনোকাদিয়ানিনামেসম্মতিক্রমেএই রাষ্ট্রের নাগরিকের জীবন কেড়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে

শফি হুজুর সহ এখানে যে ইসলামিস্টরা আহমদিয়া বা কাদিয়ানিদের নিয়ে এমনঅপরায়নের'বর্ণবাদী' রাজনীতি চালু রেখেছেন এবং এই রাজনীতির পক্ষে সাফাই গাচ্ছেন তারা আসলে রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদেরই একটা অস্ত্র তাদের রাজনীতিই হচ্ছে নাগরিকের জীবনকে বিভিন্ন কায়দায় বর্গীকরণ করে নাঙ্গা করে ফেলা আবার, আল্লমা শফির সাথে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসম্পর্ককে আড়াল করেও আবার তার এমন বর্ণবাদী ও ঘৃণাত্মক বক্তব্যের মোজেজা বোঝা যাবে না

আহমদিয়াদের উপর এই ঘটনাকে প্রায় সকলেই সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ হিসাবে দেখছেন, এবং রাষ্ট্রীয় নিস্ক্রিয়তার সমালোচনা করেছেন সংখ্যালঘুর সাথে সংখ্যাগুরুর সম্পর্ক একটা ক্ষমতার সম্পর্ক, একটা রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক রাষ্ট্রের সাথে কোন পক্ষের দহরম-মহরম ভালো সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠে তাই দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ঘটলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাদের হেফাজত করা দূরে থাকুক, কোনোসক্রিয় ভূমিকাই পালন করতে পারে না    

তবে, বাংলাদেশে যে নজিরবিহীন শাসনব্যবস্থা চালু আছে, সেখানে কোনো নাগরিকেরই আপাততনাগরিক জীবননেই; যে কোনো নাগরিককে রাষ্ট্রীয় বাহিনীই যে কোনো সময় তুলে নিয়ে যেতে পারে, খেয়ালখুশি মতোউধাওকরে দিতে পারে, ক্রসফায়ার করে দিতে পারে, এবং এইসব কিছু করেওসরল বিশ্বাসের বলেদায় থেকে মুক্ত থাকার আইনি ব্যবস্থাও করে দেয়া হয়েছে এখানে প্রত্যেক নাগরিকই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ‘অপর’। এই রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সমাজে, ফলে সেখানেও জনগণ ক্রমাগতঅপরনির্মাণ করছে জনগণের প্রায় সবাই সবারঅপর হয়ে উঠছে। আবার, দেশের বাইরে-ভেতরে সবখানেই এই রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, জীবিকার অধিকার, কথা বলার অধিকার, খেলাধুলা করার অধিকার, লেখালেখির অধিকার, ছবি আঁকার অধিকারসহ সকল ধরণের নাগরিক ও জৈবিক অধিকার কেড়ে নেয়া সম্ভব জনগণের ন্যূনতম কোনো নাগরিক অধিকার না থাকার কারণে, বা নাগরিকের সাথে রাষ্ট্রেরনাগরিকসুলভ কোনো সম্পর্ক না থাকার কারণে শফি হুজুরদেরঅপরায়নবর্ণবাদীরাজনীতির এমন নির্মম বহিঃপ্রকাশ ও চর্চা সহজতর হয়ে উঠছে যে কোনো ধরণের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে  

বাংলাদেশের লড়াই তাই আসলে যে কোনোধরণের বর্ণবাদী ও অপরায়নের রাজনীতির বিরুদ্ধেও লড়াই বটে ‘অপর’ নির্মাণের এই রাজনীতি যত বাড়বে, ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর মুখের হাসি তত চওড়া হবে।   

প্রথম প্রকাশ: শুদ্ধস্বর, ২৭ জুলাই ২০২০     


No comments:

Post a Comment