Tuesday, February 23, 2021

ক্রাইসিস এজ ফ্রিডম: আল্লামা ইকবাল ও ওয়াল্টার বেঞ্জামিন।। আসাদ ডানডিয়া



কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসাদ ডানডিয়া'র Crisis as Freedom: Muhammad Iqbal and Walter Benjamin লেখাটি গত ২৪শে জানুয়ারিতে LOS ANGELES REVIEW OF BOOKS (LARB) ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। এই অনুবাদে, আল্লামা ইকবালের উদ্ধৃতিগুলোর ক্ষেত্রে ‘ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ এর বাংলা অনূদিত [প্রথমা থেকে প্রকাশিত] গ্রন্থ থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে। কখনো কখনো বাক্যগুলো হুবহু এই গ্রন্থ থেকেই তুলে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের থিসিসগুলো অনুবাদে পারভেজ আলমের লেখাপত্রের সাহায্য নেয়া হয়েছে। অনুবাদক ও বোধিচিত্ত ইকবালের গ্রন্থটির অনুবাদক ও পারভেজ আলমের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। অনুবাদটি প্রথম বোধিচিত্তে প্রকাশিত হয়।


বিদ্যমান অতিমারীর মধ্যে আমরা যখন শীতের মৌসুমে প্রবেশ করছি তখন মনে হচ্ছে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এই সঙ্কটের বুঝি আর কোন শেষ নেই। কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামী মানুষদের কাঠামোগত অধীনতা, যা কারাগারপ্রথা-বিলোপবাদী রুথ উইলসন গিলমোরের জবানে ‘গোষ্ঠী-ভেদী অকালমৃত্যুর ঝুঁকির রাষ্ট্র-অনুমোদিত বা আইনবহির্ভূত উৎপাদন ও শোষণ’, একেবারে উলঙ্গ হালতে সবার সামনে হাজির হয়েছে। অবশ্য, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন একদা লিখেছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসীসহ অন্যান্য নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য ”যে ‘জরুরি অবস্থায়’ বসবাস করা হচ্ছে তা ব্যতিক্রম নয় বরঞ্চ এটাই নিয়ম”। এই সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তুলতে রাজনৈতিক শ্রেণি এবং অভিজাত বিদ্বৎসমাজ একই নব্য-উদারনৈতিক বা নিওলিবারেল, বাজার-ভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাব করে যাচ্ছেন যা কিনা গোড়াতে এই পরিস্থিতিরই জন্ম দিয়েছিল। আন্তোনীয় গ্রামসির বিরতি (interregnum) ধারণার মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক মুহূর্তটি দূর্দান্তরূপে ধরা পড়ে: “সঙ্কটটি আদতে এই বাস্তবতার মধ্যেই নিহিত যে পুরাতনটি মারা পড়ছে এবং নতুনের জন্ম হচ্ছে না; এই বিরতিতেই অজস্র পরিমাণে অসুস্থ আলামত দেখা দেয়।"

কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় দুনিয়াজুড়ে যে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ দেখা গিয়েছে তা থেকে যদি কিছু শিখতেই হয় তাহলে সেটা হচ্ছে একটি নতুন সামাজিক বিন্যাসের (order) সম্ভাবনা, এবং এরই সাথে এই বিরতি থেকে মুক্তি পাওয়ার নতুন উপায় ঠাহর করা। বিলোপ (abolition বা তিরোহিত) গৃহস্থালি শব্দে পরিণত হয়েছে; জনগণ প্রশ্ন করছে কম্যুনিটির সুরক্ষার জন্য পুলিশিং ও কারাগারের আদৌ কোনো জরুরত আছে কিনা; এমনকি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতি-রাষ্ট্র তার কার্য সম্পাদন করে ফেলেছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন করছে। এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসার অর্থ হলো, যে পরিস্থিতি অর্থনৈতিক পতন, পরিবেশ বিপর্যয় এবং ডানপন্থী ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঘটিয়েছে—যা কিনা অতিমারীর কারণে আরো খারাপের দিকে গিয়েছে, সে পরিস্থিতিকে প্রত্যাখ্যান করা। টনি মরিসনের ভাষায়, “এটাই শিল্পীদের কাজ করার প্রকৃত সময়। এখন হতাশার সময় নয়, এখানে আত্ম-করুণার স্থান নেই, নীরবতার দরকার নেই, ভয়ের কোন জায়গা নেই। আমরা কথা বলবো, আমরা লিখবো, আমরা ভাষাকে কাজে লাগাবো। এভাবেই সভ্যতা আরোগ্য লাভ করে।“

অনেকের কাছে, কোয়ারেন্টিনের স্থিরতা এবং এর পরিণামে সময়ের শূন্যতা (emptiness of time) এই সঙ্কটকে আরো জটিল করে তুলছে। সময়ের যে সেক্যুলার ও রৈখিক ধারণার সাথে আমরা পরিচিত তাতে বৈশ্বিক মাত্রায় ছেদ পড়েছে, স্বাভাবিকতা ও বিন্যাসের সকল ভান উলট-পালট হয়ে গিয়েছে। আমরা ‘স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে’ যেতে পারবো কিনা সেই জিজ্ঞাসার পরিবর্তে (যেহেতু পারবো না) আমাদের সঙ্কটগুলোর মধ্যেই সময়ের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার নতুন উপায় প্রবর্তন করার অর্থ কী হতে পারে তা নিয়ে আলাপ করতে চাই। যদি ‘স্বাভাবিক’ই আমাদের এই সঙ্কট নিয়ে আসার কারণ হয় তাহলে আমাদের উচিৎ হবে এই স্বাভাবিকতার পূর্বানুমান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা। সেইসাথে, এই খপ্পর থেকে নিজেদের মুক্ত করে কীভাবে ধারণা ও ভাষা তৈরি করা যায় সে সম্পর্কে আরো উচ্চাভিলাষী চিন্তা করা। সময়ের মধ্যে সঙ্কট, সময় ও সঙ্কট, সময়ের সঙ্কট এবং সময় হিসাবে সঙ্কট ধারণাগুলো দিয়ে আমরা কী বুঝবো? আরো জরুরি বিষয় হচ্ছে, যে জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছি তাকে উল্টো আরো জোরদার করবে না এমন একটা উপায়ে আমরা কীভাবে কাজ করতে পারি?

এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে আমি বিশ শতকের ইহুদি দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের কাছে ফিরে যাবো, তাঁর সাথে তাঁর সময়েরই মুসলিম দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের একটা আলাপচারিতা ঘটাবো। সময়ের এই ঘের থেকে বাঁচার জন্য বেঞ্জামিনের প্রবন্ধ ‘থিসিস অন দ্যা ফিলোসফি অব হিস্ট্রি’ (১৯৪০, প্রকাশিত ১৯৪২) এবং আল্লামা ইকবালের ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন (১৯৩০) গ্রন্থের মধ্যে দুর্দান্ত মিল লক্ষ্য করা যায়। দুই লেখকই তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকে উক্ত বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এমনভাবে করছেন যেন আমাদের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক কল্পনা কর্তৃক চাপানো সেই জ্ঞানতাত্ত্বিক ও ডিসিপ্লিনারি বা শাস্ত্রীয় সীমাবদ্ধতাগুলোকে (যেমন, ধর্মীয় বনাম সেকুলার) খারিজ করে দেয়া যায়। একটি অতিমারী সঙ্কট যেখানে আমাদের চিন্তাকে আবদ্ধ করে ফেলেছে সেখানে সময় ও ইতিহাসের ধারণাগুলোকে পুনর্পাঠ করতে এই দুজনের কাজ থেকে আমরা কী কী উপাদান গ্রহণ করতে পারি?


সময় ও ইতিহাসের রৈখিক ধারণার বিপরীতে আমাদের দুই আলোচক ভাবনার একটা রসদ যোগান, যাকে তালাল আসাদ তাঁর ফরমেশন অব দ্যা সেক্যুলার (২০০৩) গ্রন্থে “অসমসত্ত্ব (heterogeneous) সময়” বলে অভিহিত করেছেন। “অসমসত্ত্ব সময়” অর্থাৎ, সময়ের যে ধারণাগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যে প্রাণসঞ্চার করেছিল এবং যা ‘অতীত থেকে বর্তমানকে, প্রত্যাশিত দুনিয়া থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ দুনিয়াকে অবিরাম স্থানচ্যুত করে এবং পুনঃপাঠ ও পুনঃসংযোগের আহ্বান জানায়’। সময়কে চিন্তা করার বিভিন্ন উপায় থাকতে পারে, এটা কবুল করেই আমরা এর খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করতে পারি। অসমসত্ত্ব সময়ের ধারণাকে পুনরুদ্ধার করতে আমরা আধুনিক সেক্যুলার জাতিরাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদ কর্তৃক আরোপিত সময় ও ইতিহাসের বৌদ্ধিক, রৈখিক ও হিসাবি ধারণাকে বাতিল করতে পারি।

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল পুনর্গঠন গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে সুন্নি ধর্মতত্ত্বের মূলধারার আশারীয়দের “অ্যাোমিক টাইম বা আণবিক সময়” মতবাদের পর্যালোচনা করে সময়ের সাথে মোকাবিলায় লিপ্ত হোন। তিনি লিখেন, “আশারীয়দের মতে,সময় হচ্ছে প্রতিটি ‘এখন’-এর অনুক্রমিক ধারা”। “এই ধারণা থেকে সম্ভবত এটা-ই বোঝায় যে, দুটি ‘এখন’ বা সময়ের মুহূর্তের মধ্যে একটি অনধিকৃত মুহূর্ত রয়েছে, অর্থাৎ সময়হীনতা বা শূন্যতা (void of time) রয়েছে” – এমন একটা ধারণাকে তিনি অর্থহীন বলে বিবেচনা করেন। ইকবাল আশারীয়দের সমালোচনা করে বলেন, তাঁরা ‘সম্পূর্ণ ব্যক্তিনিরপেক্ষ’ [অর্থাৎ বৌদ্ধিক] দৃষ্টি দিয়ে সময়কে বিচার করার ফলে ‘সময়ের ব্যক্তিসাপেক্ষ দিকটি উপলব্ধি করতে অসমর্থ হয়েছেন।“ এই কাঠামো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সময়কে আণবিক হিসাবে না ভেবে জৈবিক বা অর্গানিক হিসাবে ভাবতে হবে। এটাকে ‘পরম খুদি’ (Ultimate Ego, অর্থাৎ খোদা) এবং ‘খুদি’ (Ego, অর্থাৎ মানুষ)’-এর মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক হিসাবে বুঝতে হবে। পরম খুদি হচ্ছে যিনি “তাঁর অনির্দিষ্ট সৃজন-সম্ভাবনার অসীম ঐশ্বর্যের পরিমাণ পরখ ও আত্মোপলব্ধি করতে চান”, এবং খুদি সেই বহু সম্ভাবনার একটির প্রতিনিধিত্ব করেন। ফলে খুদি যেমন “বেঁচে থাকে অনন্তকালে বা শাশ্বতে” (অর্থাৎ অনুক্রমহীন পরিবর্তনের মধ্যে), তেমনি থাকে ধারাবাহিক সময়ের মধ্যেও।

উদাহরণ হিসাবে আল্লামা ইকবাল “আদমের পতন” কাহিনীর কোরানিক ও বাইবেলীয় আখ্যানের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ হাজির করেন। এই উপাখ্যান অনুযায়ী মানবজাতি একটি অস্থায়ী দুনিয়াতে প্রবেশ করে, যে দুনিয়ার সময় ও ইতিহাসের একটা সূচনা থাকে। ইকবাল উল্লেখ করেন যে, কোরআন এসব উপাখ্যানে কোন ঐতিহাসিক বিবরণ না দিয়ে বরঞ্চ “একটি নৈতিক ও দার্শনিক ভাষ্য” দিতে প্রচেষ্টা নিয়েছে। নাম, সংখ্যা এগুলো মূল গুরুত্বের জায়গা নয়; বরঞ্চ উপাখ্যানের নৈতিক শিক্ষাগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। কোরআন তার শ্রোতাদেরকে নবী-রসুলদের উপাখ্যানগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় যেন সেই ঘটনাগুলোতে শ্রোতাদেরও একটা অংশ রয়েছে (বা শ্রোতারাও সেই ঘটনাসমূহের অংশীদার)। কোরানিক ইতিহাস ফলে একটি বৃহৎ-ইতিহাস (meta-history) যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে জারি রয়েছে, যেখানে খুদিকে পরম খুদির সাথে সংলাপে নিয়ে আসা হয়। এই অর্থেই, খুদি একই সাথে “বেঁচে থাকে অনন্তকালে” এবং “ধারাবাহিক সময়ে”র (আমাদের প্রাত্যহিক দুনিয়ার অনুক্রমিক সময়) মধ্যে।

পতনের কোরানিক উপাখ্যান অনুযায়ী, মানবজাতিকে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার জন্য জান্নাত থেকে নির্বাসিত করা হয়, যদিওবা এই জান্নাত পরকালের “ধার্মিকদের চিরস্থায়ী আবাস” সেই জান্নাত নয়। এখানে, “প্রথম যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা হচ্ছে মানুষের অবাধ্যতার পাপ, ফলস্বরূপ তার নির্বাসন।“ ইকবাল লিখেছেন, পতন পূর্ব অবস্থানটি “এমন এক আদি অবস্থার ধারণা যেখানে মানুষ তার পরিবেশের সাথে কার্যত সম্পর্কহীন এবং ফলস্বরূপ মানব-চাহিদার দংশন অনুভব করতেও পারে না, এই অনুভূতির জন্মই কেবল মানবসংস্কৃতির সূচনাকে নির্দেশ করে।“ ফলে এই পতন—প্রতীকী সঙ্কট হিসাবে—একটি উত্থানও বটে: অবাধ্যতা, অস্বীকার ও বিদ্রোহের সক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে মানবতাকে পৃথিবীর একটি উঁচু অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ইকবাল লিখেন,

মানবের প্রথম অবাধ্যতাজনিত কাজ তার স্বনিয়ন্ত্রিত স্বাধীন কাজও বটে। এবং সে জন্যই কোরআনের বর্ণনায় মানুষের প্রথম লঙ্ঘন (transgression)-কে ক্ষমা করা হয়েছে। সততা কোন বাধ্যবাধকতার ব্যাপার নয়; এ হচ্ছে নৈতিক আদর্শের নিকট খুদির স্বাধীন আত্মসমর্পণ এবং তা বিভিন্ন স্বাধীন খুদির ইচ্ছাকৃত পারষ্পরিক সহযোগীতার মধ্যে উৎপত্তি লাভ করে।

বাইবেলীয় আখ্যানের সঙ্কটটি কোরানিক আখ্যানে চূড়ান্ত স্বাধীনতার নজির হিসাবে হাজির হয়েছে।


‘আদমের পতন’ পাঠে ইকবাল কোরানিক আখ্যানের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রেখেছেন। কিন্তু তিনি এতে সৃজনশীল ও স্বাধীন কর্মের প্রতি এমন এক জরুরতের বিস্তার ঘটান, যা কোন একটি পূর্বনির্ধারিত পথ গ্রহণ না করে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে পুনর্জীবন দান করে। তাঁর ভাষায়, “যে জীবের যাবতীয় আচরণ যন্ত্রের মতো একান্ত নিয়ন্ত্রিত, সে কোন ভালো কাজ করতে পারে না।“ ব্যর্থ হওয়ার স্বাধীনতা থাকলেই কেবল সফল হওয়ার স্বাধীনতা কোন অর্থ বহন করে। ট্রাজেডি থাকলেই না বিজয় লাভ সম্ভব! এতে কেবল মানবজাতিই নয়, আল্লাহও জড়িত, যারা একে অপরের সাথে একটি জৈব বা অর্গানিক সম্পর্কের মধ্যে রয়েছেন; ইকবাল লিখছেন, “আল্লাহর এই ঝুঁকি গ্রহণই মানুষের ওপর তার অগাধ আস্থা প্রমাণ করে, এখন মানুষকে এই আস্থার ন্যায্যতা প্রমাণ করতে হবে।“

সময়ের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনও স্বগোত্রীয়। এই দুই ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক গতিবিধি তাঁদের ঐতিহাসিক সঙ্কট দ্বারাই রূপায়িত হয়েছিল; ইকবালের জন্য ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সঙ্কট, এবং বেঞ্জামিনের জন্য ছিল নাজিবাদের উত্থান। ইকবালের মতো বেঞ্জামিনও সময়ের এমন ধারণা নিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন, অর্থাৎ সময়ের যে ধারণা ইতিহাসকে পূর্বনির্ধারিত ও রৈখিক বলে অনুমান করে নেয়। কিন্তু ইকবাল যেখানে ধর্মীয় চিন্তার স্থিরাবস্থার পর্যালোচনা করেছিলেন, সেখানে বেঞ্জামিন মার্ক্সবাদকে গ্রাস করে ফেলা অশ্লীল হিস্টোরিসিজম বা ইতিহাসবাদের দিকে নিশানা তাক করেছিলেন।

ওয়াল্টার বেঞ্জামিন তাঁর নবম থিসিসে, পল ক্লি’র আঁকা ‘Angelus Novus’ নামক ছবিকে ‘ইতিহাসের ফেরেশতা’ হিসাবে নতুনভাবে হাজির করেন। এই ফেরেশতাকে এতো শক্তিশালী এক তুফান ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে যে তার সম্মুখে জমা ধ্বংসাবশেষ দেখতে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। বেঞ্জামিন লিখেন, “আমরা যাকে প্রগতি বলি তা এই তুফানের অপর নাম” এবং জমতে থাকা ধ্বংসাবশেষই হচ্ছে অতীতের সঙ্কটসমূহ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদীর কাজ হচ্ছে সচেতনভাবে এই টুকরোগুলোকে ব্যবহার করা, অতীতকে মুক্ত করা এবং ফলস্বরূপ বর্তমানকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করা। অ্যাক্টিভিস্টের জন্য এই কাজটি একজন ইতিহাসবিদের কাজ থেকে আলাদা; ইতিহাসবিদের জন্য ইতিহাস হচ্ছে প্রগতির অগ্রযাত্রায় অতিক্রান্ত একটি কাল। বেঞ্জামিন ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে হিস্টোরিসিজম বা ইতিহাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। 



                 Paul Klee : Angelus Novus


আল্লামা ইকবালও ঐশী জ্ঞান ও সময় বিষয়ক আলাপে একই কাজ করেন। প্রগতির মতোই জ্ঞান স্থিতিশীল নয়, বরঞ্চ এটা একধরনের আহরণ ও বিবর্তনকে বোঝায়। বেঞ্জামিনের ইতিহাসের ফেরেশতা যেমন অতীতের নিরন্তর প্রবাহ এক পলকেই দেখে ফেলে, তেমনি ইকবাল ঐশী জ্ঞানকে এমন এক ধারণা হিসাবে বিবেচনা করেন “যা আল্লাহকে সর্বজ্ঞ মনে করে, অর্থাৎ আল্লাহ এক অবিভাজ্য অনুভূতির মধ্যেই ইতিহাসের নিরন্তর প্রবাহকে এক চিরন্তন ‘এখন [বা বর্তমান]’-এর মধ্যে সাক্ষাৎভাবে অনুভব করেন”। তাঁর মতে, যদিও এই ধারণা অনাগত ভবিষ্যত ঘটনাবলী সম্পর্কে আল্লাহর পূর্বজ্ঞানের তত্ত্বকে রক্ষা করে, কিন্তু আল্লাহর স্বাধীনতার ধারণাকে বাতিল করে দেয়। “আল্লাহর সৃজনী-জীবনের জৈবিক সমগ্রের মধ্যে ভবিষ্যৎ অবশ্যই পূর্ব হতে বিদ্যমান। কিন্তু অবারিত সম্ভাবনারূপেই পূর্ব হতে বিদ্যমান, নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ঘটনারপরিক্রমার অবধারিত পর্যায়রূপে নয়।“

র‍্যাডিকেল সম্ভাবনার (contingency) পক্ষে একই ধরনের যুক্তি বেঞ্জামিন হাজির করেন। তিনি দাবি করেন, ইতিহাস কেবল তারিখ দিয়ে মাপজোক করা বা দলিলাদির মাধ্যমে অনাবৃত মহাফেজখানা নয়, বরঞ্চ এটা এমন কিছু যাকে বারবার তৈরি করতে হয়। ১৪তম থিসিসে বেঞ্জামিন লিখেন, “ইতিহাস হলো এমন এক নির্মাণ যার অবস্থান সমসত্ত্ব ও শূন্য সময়ে নয়, বরঞ্চ বর্তমানে[১] নির্মিত হচ্ছে।“ বেঞ্জামিন ৫ম থিসিসে বলেন, হিস্টোরিসিস্ট ধরে নেন যে, “সত্য কখনো আমাদের থেকে দূরে সরে যাবে না”, কারণ এটা সর্বদা সেখানেই রয়েছে। বেঞ্জামিন ষষ্ঠ থিসিসে দাবি করেন, এর বিপরীতে ইতিহাসের প্রতি ঐতিহাসিক বস্তুবাদীর দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে তাকে অবশ্যই “স্মৃতির নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে, কারণ এটি সঙ্কটকালে ঝলকে উঠে।“ একইভাবে ইকবালের মতে, “যদি ইতিহাসকে শুধু পূর্বে নির্ধারিত ঘটনা-পরিক্রমার ক্রমবিকশিত প্রতিচ্ছবি বলে মনে করা হয়, তাহলে তাতে অভিনবত্ব ও নব প্রেরণার কোন স্থান থাকে না; ‘সৃষ্টি’ শব্দটিই নিরর্থক হয়ে পড়ে। কেবল মৌলিক কর্মসম্পাদনে নিজেদের সক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের কাছে এই শব্দটি অর্থপূর্ণ হয়।“ ইকবালের কাছে আশারীয়রা যেমন, বেঞ্জামিনের কাছে হিস্টোরিসিস্টরাই তেমন।

বেঞ্জামিন স্মৃতিচারণের ইহুদি ঐতিহ্যকে টেনে আনেন যা তাকে ইতিহাসের এমন এক চর্চার দিকে নিয়ে যায় যেখানে বর্তমানের সাথে অতীত অনিবার্যভাবে সংযুক্ত রয়েছে। বেঞ্জামিন ১৮তম[২] থিসিসে লিখেন, “এটি সর্বজনবিদিত যে, ইহুদিদের ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়া নিষিদ্ধ। এর বিপরীতে তাওরাত ও প্রার্থনা স্মৃতিচারণের উপদেশ দেয়।“ বর্তমানের জমিনে পা রেখে অতীতের স্মৃতিচারণ করার ওপর ইহুদি কিতাবাদির জোরারোপ প্রতিটি মুহূর্তে মুক্তি ও স্বাধীনতার সুযোগ হাজির করে। ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনুমান করার ওপর নিষেধাজ্ঞা কাউকে কাউকে নাখোশ করতে পারে, কিন্তু বেঞ্জামিনের মতে “ইহুদিদের জন্য এই ভবিষ্যৎ সমসত্ত্ব ও শূন্য সময়ে রূপান্তরিত হয়নি। কারণ এতে প্রতিটি মুহূর্তই ছিল সরু দরজা, যার মধ্যদিয়ে মসিহ বা মাহদী প্রবেশ করতে পারেন।“ কেবল মুক্তিদায়ী ভবিষ্যতকে প্রত্যাশা করেই সময়ের সঙ্কটটি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না, বরঞ্চ বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তকে উদ্ধার করার সচেতন প্রয়াসের মাধ্যমেই সেই সংকটটি কাটিয়ে উঠতে হবে।


আল্লামা ইকবাল ও বেঞ্জামিন উভয়ের কাছে মানুষের সৃজনশীলতার সম্ভাবনা এই কারণে বিদ্যমান যে আমাদের সামনে যা ঘটতে যাচ্ছে তা জানা যায় না, বরঞ্চ সেটা সচেতনভাবেই তৈরি করতে হয়। এবং এই সংকটেই, তা আদমের পতন হোক বা প্রগতির তুফান হোক, আমাদের মুক্তির নতুন নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলে সৃজনশীল কর্ম ভবিষ্যতে কি ‘হওয়া উচিৎ’ তা বিবেচনা না করে বর্তমানের দিকে মনোযোগ দাবি করে। বেঞ্জামিন যখন প্রগতির পূর্বনির্ধারিত ধারণার বিচার বা পর্যালোচনা করেন, ইকবাল সেখানে সময়ের পূর্বনির্ধারিত ধারণার বিচার বা পর্যালোচনা করেন। উভয় চিন্তকই তাঁদের বিচারকে নিজস্ব ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করে মুক্তিমুখীন সিদ্ধান্তে পৌঁছান। ইকবাল একটা চিঠিতে লিখেন, “আমি বিশ্বাস করি মহাবিশ্বে ঐশী প্রবণতা বিদ্যমান, কিন্তু এই প্রবণতা অবশেষে একজন উচ্চতর মানুষের (higher man) মধ্যে পূর্ণ প্রকাশ খুঁজে পাবে, সময়ের অধীন কোন ঈশ্বরে নয়।“ বেঞ্জামিন ও ইকবালের মুখোমুখি কথোপকথন পাঠ করার মধ্যদিয়ে সময় ও ইতিহাসকে এমন এক জমিন হিসাবে পুনরুদ্ধার করা যায় যেখানে র‍্যাডিক্যাল চর্চা বাস্তবে পরিণত হয়।

ইকবালের ইসলাম এবং বেঞ্জামিনের ইহুদি ধর্মে সময় না-রৈখিক না-চক্রীয়, বরঞ্চ পুনর্জীবন-মূলক (regenerative)। মূলত এই গুণই আমাদেরকে একটি নতুন দুনিয়া কল্পনা করতে সাহায্য করে, যা পূর্বনির্ধারিত রৈখিকতা দ্বারা চালিত নয়, আবার স্থায়ী চক্রাকারে আবদ্ধও নয়। এটা বুঝতে পারার মানে হচ্ছে আমাদের অসাড়তা কাটিয়ে মুক্তির পথে ঝাঁপ দেওয়া। আমরা যেহেতু সমসাময়িক বৈশ্বিক সন্ধিক্ষণে—মানে বিরতিতে—নতুন সামাজিক সম্ভাবনাগুলো নিয়ে লড়াই করছি, সেহেতু আমাদেরকে এমন প্যারাডাইমে আবদ্ধ রাখা চলবে না যা একটি স্থিতাবস্থায় আমাদের কল্পনাগুলোকে জিম্মি করে রাখে। আমরা একটা সঙ্কটে আছি, কিন্তু এই সঙ্কটের মাধ্যমেই আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে খুঁজে পেতে পারি। 

___________

২৪শে জানুয়ারি, ২০২১

টীকা
[১] ওয়াল্টার বেঞ্জামিন এক্ষেত্রে জার্মান jetztzeit শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর ইংরেজি অনুবাদ here-and-now বা herenow করা হয়। এর বাংলা করলে দাঁড়ায় "এই ক্ষণে-এই মূহুর্তে"। বাংলার ভাবান্দোলনে বহুল ব্যবহৃত "বর্তমান" পদটি এর যথার্থ অর্থ প্রকাশ করে যা কিনা একই সাথে স্থান-কাল উভয়ই এবং এর ভাবকে ধারণ করে।

[২] ১৮তম থিসিস নয়, এখানে উদ্ধৃত হয়েছে পরিশিষ্টের বি(B) থেকে। দেখুন, হানা আরেন্ডের ভূমিকা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের Illuminations (ইংরেজিতে ১৯৬৮) গ্রন্থের ২৬৪ পৃষ্ঠা।

No comments:

Post a Comment