Sunday, October 18, 2020

আওয়ামী রেজিম আমাদের উপকারও করেছে!



আওয়ামীলীগ আমাদের কি কি উপকার করেছে- এমন বেশ কিছু লেখা কয়েকদিন আগে চোখে পড়েছে, বা হালকা চেখে দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে। আপাতত কপালে ‘আওয়ামীবিরোধী’ সিলমোহর লেগে গিয়েছে, ফলে সবাই ধরেই নেন যে আমি কেবল লীগের বিরুদ্ধেই কথা বলি। বহুদিন আগে একবার বইমেলাতে একজন বড়ো ভাই বলেছিলেন, আচ্ছা সরকার যদি কোনো ভালো কাজ করে তাহলে কেন ধন্যবাদ দেও না। তখন খুব তেজের সাথে কইছিলাম, সরকারকে টাকা পয়সা দিয়ে পুষতাছি তো ভালো কাজেরই জন্য; তার তো এটাই করার কথা! গ্লাসের অর্ধেক ভরার জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়ার চাইতে জরুরি ও দরকারি কাজ হইতাছে গ্লাসের অর্ধেক খালি কেন সেটা প্রশ্ন করা। জনগণ তো ট্যাক্স দিচ্ছে গ্লাস ভরার জন্য। কিন্তু, আজকাল মনে হইতাছে আওয়ামী রেজিমের কিছু ভালো দিকের কথা উল্লেখ করাও দরকার। নাইলে বিষয়টা খুব একপেশে হয়ে যায়!

আমি মনে করি, বিদ্যমান আওয়ামীরেজিম আমাদেরকে তিনটা বিষয় স্পষ্টভাবে উপলধ্বি করতে সাহায্য করেছে। হাসবেন না। এটা সত্য। একটু খুলে বলি, ভুল হলে ধরিয়ে দিয়েন; বেয়াদবি মাফ করবেন।
 
এক, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ নামক বর্গের স্বরূপ উদঘাটন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তি ক্ষমতায় নেই বলে বাংলাদেশের রথী-মহারথী বুদ্ধিজীবীরা এককালে পত্রিকার পাতায় পাতায় অশ্রু বিসর্জন করেছেন। তারা এমন এক দিনের স্বপ্ন দেখতেন যখন ক্ষমতায় থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিরোধী দলেও থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তাদের লেখাপত্র পড়ে বেড়ে উঠা আমার মনে হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ‘ক্ষমতায়’ আসলে দেশে বুঝি বেহেশত নেমে আসবে। কিন্তু লঙ্কায় যেই যাবে সেই তো রাবন হবে। যে পক্ষের শক্তিই ‘ক্ষমতা’য় যাচ্ছেন না কেন, যে ‘ক্ষমতা’ বা ‘ক্ষমতাকাঠামো’র মাধ্যমে এই পক্ষ ‘শক্তি’ পরিচালনা করবেন সেটাকে নিয়ে তো প্রশ্ন তোলা হয় নি। বা তুলতে চাওয়া হয় নি। ফলে, এই কাঠামোর সাথে যখন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ নামক ইডিওলজিক্যাল নির্মাণ যুক্ত হয়েছে, তখন সেটা যে কিরূপ ফ্যাসিবাদের জমিন তৈরি করেছে, ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামক গোষ্ঠীর মারপিটের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে! তখন তো খোদ আওয়ামীবুদ্ধিজীবীরা বলে উঠেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের নামে এসব বরদাশত করা হবে না। এসব বরদাশত না করতে চাইলেও তাদের দেখানো পথেই তাদের ‘পক্ষের শক্তি’ ক্ষমতায় গিয়ে যাবতীয় দুষ্কর্ম করে গিয়েছে এই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এর নাম নিয়েই। ফলে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’র ক্ষমতা আরোহনের মধ্যে আসলে একাত্তরে এই অঞ্চলের মানুষের যে গণজাগরণের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ তার কোনো সংযুক্তি নেই। যারা ‘ক্ষমতা’য় আসার জন্য সেই ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে ব্যবহার করেছিল, এবং আমি-আপনি এর বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনও যুগিয়েছি, তারা ক্ষমতার যখন একচেটিয়া দখল লাভ করল তখন তাদের কাছে এই ‘মুক্তিযুদ্ধে’র উপযোগীতা হচ্ছে কেবল রাষ্ট্রীয় (ও দলীয়) ভায়োলেন্সের বৈধতা হাসিল। ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনো ‘ইজমে’র বেলাতেই এটা সত্য। ফলে, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’র সাথে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এর দূরত্বটাকে স্পষ্ট করার কৃতিত্ব আওয়ামীরেজিমকে দেয়াই যায়।

দুই, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনার ‘পবিত্রকরণ’ ফ্যাসিবাদী চিন্তার উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামক একটা গোষ্ঠি যখন শিক্ষার্থীদের মারপিঠ করলো, তখন অনেক বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ করে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের মতন পবিত্র বিষয়ের নামকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। তারা প্রতিবাদের মাধ্যমে এটাও জানিয়ে দিলেন যে, মুক্তিযুদ্ধ একটি ‘পবিত্র’ বিষয়। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনারই রাজনৈতিক পটভূমি থাকে, রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকে। ঐতিহাসিক ঘটনার ইতিহাস, ইতিহাসের বয়ান, ইতিহাসের নির্মাণ সময়ের সাথে সাথে, রাজনীতির সাথে বদলাতে থাকে; বর্তমানে যাপিত রাজনৈতিক জীবন ও সমস্যার নিরিখে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে চোখ ফিরাতে হয়। ফলে প্রয়োজন পড়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের, উদ্ভব ঘটে নানান তত্ত্বের, নানান মতের, নানান পথের। কিন্তু ঘটনার ‘পবিত্রকরণ’ দিনশেষে খোদ ‘ঘটনা’কেই কাটছাট করে ফেলে, একধরণের নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে ‘ঘটনা’কে আটকে দেয়। অর্থাৎ, ‘ঘটনা’র কোন অংশ আপনি আলোচনা করতে পারবেন, আর কোন অংশ করতে পারবেন না, এমন একধরণের সরব বা নিরব নিষেধাজ্ঞা বা সেলফ-সেন্সরশীপ চালু হয়ে যায়। 

এই ‘পবিত্রকরণ’ একটি ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমাদের সেকুলার জাতীয়তাবাদীরা, যারা কিনা মুক্তিযুদ্ধকে সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেন, তারাই আবার মুক্তিযুদ্ধের আলোচনার মধ্যে এই ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য আরোপ করেন। এটা আসলে রাষ্ট্রের হাতে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার আইনকানুনের হাতিয়ার হয়েও উঠতে পারে। আবার, ‘ঘটনা’র পবিত্রকরণ ‘ঘটনা’র সাথে জড়িত গণমানুষের বিচিত্র অংশগ্রহণের বিচিত্রতাকে ন্যাস্যাৎ করে দিয়ে একটা নির্দিষ্ট মনমাফিক খোপে আটকাতে চায়; যার ফলে যেখানে জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা, সেই জনগণ তখন স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়। এর একটা নমুনা হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে ‘বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন’ টাইপের বাক্য বা বয়ানের উদ্ভব ঘটেছে। আমি গত বইতে দেখিয়েছিলাম, এই বাক্যটা কেবল এই অঞ্চলের জনগণের জন্য অবমাননাকরই নয়, বরঞ্চ অনৈতিহাসিকও বটে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীও এই বয়ানকে খারিজ করে দেয়। জনগণকে হাওয়া করে দিয়ে, জনগণের অবদানকে ‘গৌণ’ অবস্থানে ঠেলে দিয়ে, জনগণকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে ‘ব্যক্তি’কে চালকে আসনে বসিয়ে দেয়াটা ফ্যাসিবাদী চিন্তা ও রাজনীতির পক্ষে সহায়ক। মুক্তিযুদ্ধের ‘পবিত্রকরণ’ তাই আওয়ামীরেজিমের ফ্যাসিবাদী কলকব্জার গুরুত্বপূর্ণ অংশ; এটা তো এতদিনে আওয়ামীরেজিমই তার কর্মকাণ্ড দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে। 

তিন, বুদ্ধিজীবীদের রঙ চেনা এবং মুখোশহীন অবস্থায় আবিষ্কার করা। বাংলাদেশের মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের আসল চেহারা আওয়ামীরেজিমেই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। কে কখন কোন আলাপ চাউর করেন, কে কার ইশারায় নাচেন এই রেজিমের আগে সেটা এতো স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে বলে মনে হয় না। ক্রসফায়ার ইস্যুতে আমাদের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানকে পরীক্ষা করলেই এটা বোঝা যায়। আমি ও তুষার এক যৌথ লেখাতে ক্রসফায়ার ইস্যুতে বিএনপি আমলে এবং আওয়ামী আমলে দেশের একজন প্রযিতযশা বুদ্ধিজীবীর দুইটা লেখাকে তুলনা করে দেখিয়েছিলাম, কীভাবে রেজিম পরিবর্তনের সাথে সাথে একই ইস্যুতে বুদ্ধিজীবীদের মতামত পরিবর্তন হয়ে যায়। বুদ্ধিজীবীদের এই বাস্তবতা প্রায় সকল ইস্যুতেই পাওয়া যায়। 

কিংবা, এবার যখন দিল্লীতে মোদিবাহিনী রক্তাক্ত অধ্যায়ের জন্ম দিল, তখন এর প্রতিবাদ ঢাকাসহ সারাদেশেই দেখা দেয়। মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে মোদিকে না আনার জন্য আন্দোলন করা হলে দেশের নামকামানো বুদ্ধিজীবীরা বললেন যে, যারা মোদিকে আনার বিরোধীতা করতেছে তারা আসলে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। 

এবার যখন চীন-ভারত দ্বন্দ্ব একটু তুঙ্গে উঠলো, তখন পত্রিকার পাতায় বুদ্ধিজীবীরা চীনের একাত্তর-পচাত্তরের ভূমিকা নিয়ে লেখা শুরু করলেন। চীনের সাথে ব্যবসায়ী চুক্তির খবরাখবর বাদ দিয়ে তারা আসলে একাত্তরে চীনের ভূমিকা নিয়ে লেখা শুরু করলেন। এই যে কখন কোন ইস্যুকে নিয়ে লেখা হচ্ছে, এবং সেটা কীভাবে উপর থেকে নির্ধারিত হচ্ছে, কার মন যুগিয়ে বুদ্ধিজীবীতা করা হচ্ছে, এটা এতো পরিষ্কারভাবে আওয়ামীরেজিমের পূর্বে ধরা পড়েছে বলে মনে হয়না। গত বছর তিনেক পূর্বে যখন জর্জ অরওয়েলের নোটস অন ন্যাশনালিজম প্রবন্ধ পড়ছিলাম, তখন তো রীতিমতো আতকে উঠেছিলাম, আরে এতো দেখি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কথা বলছে! 

আমাদের বুদ্ধিজীবীদের যে হাল তাতে এই রাষ্ট্রের অবস্থা আরো একটু খারাপ হওয়ার কথা ছিল। ইনশাল্লা, ধীরে ধীরে সেটাও হবে। 

আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আমাদের এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ ক্ষমতায় না থাকলে বাংলা ‘আফগান’ হয়ে যাবে। মানে ‘আফগান’ শব্দ দিয়ে একদিকে মৌলবাদের জুজু দেখানো হয়েছে, অন্যদিকে ‘আফগান’কে ব্যর্থ রাষ্ট্রের উপমা হিসেবেও হাজির করা হয়েছে। কিন্তু, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’র আমলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্বাচন থেকে শুরু করে যাবতীয় ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউশনকে ধ্বংস করে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে তাতে নিজেই ‘ব্যার্থ রাষ্ট্রে’র উপমা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ এমন এক বাস্তবতায় এই রাষ্ট্রগণের দাঁড়িয়ে আছেন যখন তাদের যাবতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার ও বেঁচে থাকার মত একেবারে বেসিক অধিকারকেও মাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের মাথাবেচনেওয়ালা কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের আসল চেহারা আর কবেইবা আমাদের সামনে এমন ভাবে ফুটে উঠেছে! 

আওয়ামীলীগ যে কেবল এই তিনটা উপকার করেছে এমন না, খুজলে এমন আরো বহু ‘উপকার’ পাওয়া যাবে। আমার নিজের চর্চার সাথে রিলেভেন্ট তিনটা দিকের কথাই বলেছি মাত্র। আওয়ামী রেজিমের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেই হবে।

No comments:

Post a Comment