Wednesday, September 16, 2020

করোনাভাইরাস: যে আকস্মিকতা খোদ সম্ভাব্যতাকেই মুছে দিচ্ছে—ইমানুয়েল অ্যালোয়া



[অনুবাদকের মন্তব্য: করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ইমানুয়েল অ্যালোয়া (Emmanuel Alloa)-এর Coronavirus: A Contingency that Eliminates Contingency প্রবন্ধটি গত ২০শে এপ্রিলে CriticalInquiry সাইটে প্রকাশিত হয়। অনুবাদটি বোধিচিত্তের ফেসবুক পেজে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। 
 
দুনিয়াজুড়ে মানুষের মধ্যে করোনা মহামারির যে বিভিন্ন প্রভাব পড়তে যাচ্ছে তা নিয়ে মহামারির শুরু থেকেই বহু চিন্তকরা বাতচিৎ করছেন, নিজেদের অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। ইমানুয়েলের এই প্রবন্ধ শুরু হয়েছে খানিকটা সমালোচনার সুরে; তার মতে, মহামারি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে তাতে অনেকের মধ্যেই একধরণের ‘নিশ্চয়তা’র সুর রয়েছে। যেন এটা হওয়ার কথাই ছিল, এবং এরপর কী কী ঘটবে সবই প্রায় নিশ্চিত। এমনকি সবখানেই একটা ‘আবশ্যকতা’র সুর পাওয়া যাচ্ছে- এটা করতেই হবে, আর কোনো বিকল্প হাতে নেই। ‘নিশ্চয়তা’ ও ‘আবশ্যকতা’র এই যে ডিসকোর্স গড়ে উঠেছে ইমানুয়েল তার সমালোচনা করেন, তিনি বরঞ্চ করোনাভাইরাসকে একটা আকস্মিক ঘটনা বলেই অভিহিত করেন। এবং তার মতে, এই আকস্মিক ঘটনার মারাত্মক প্রভাব হচ্ছে, এই ঘটনা আসলে অন্যান্য সম্ভাবনা বা আকস্মিকতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। যেমন মহামারিকালে আমরা আমাদের জীবনকে এলগোরিদমের হাতে ছেড়ে দিয়েছি; ঘরে বসেই ক্লাস করছি, চিকিৎসা নিচ্ছি, খাবারের অর্ডার নিচ্ছি, মিটিং করছি। কিন্তু, এইসবই ঘটছে পরিচিত পরিমণ্ডলে; আমি যদি খোলা ময়দানে বের হই তাহলে আমাকে বহু অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে, অনেক অভাবিত-অপ্রত্যাশিত-বিষ্মিত লোকের সাথে মোলাকাত হতে পারে। এইসব হারিয়ে যাচ্ছে আবশ্যকতা ও প্রয়োজনীয়তার নিত্যনতুন ডিসকোর্সের তলে। 

ইমানুয়েল এই সম্ভব্যতাকে মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, এমনকি আমাদের গণতান্ত্রিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মূলবোধ হিসেবে দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস নেয়া হচ্ছে, শিক্ষকদের বলা হচ্ছে ক্লাস-লেকচার ভিডিও রেকর্ড করে রাখতে যেন তাদের অনুপস্থিতিতে এটাকে ব্যবহার করা যায়। আপাত দৃষ্টিতে সম্ভাবনাময় মনে হলেও, ইমানুয়েল এখানে গবেষকের বা শিক্ষকের ধর্মঘট করার অধিকার হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেন। 

ইমানুয়েল ‘সোশাল ডিস্ট্যান্সিং’ শব্দবন্ধের সমালোচনা করেন। তার মতে, করোনাভাইরাস কিছু জিনিস শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে, যেমন শারিরীক দূরত্ব মানেই মানব-দূরত্ব নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই সঙ্কট মানুষের মধ্যে সংহতি, সহমর্মিতাকে আরো সংযত করেছে, আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশি সবাই সবার দেখভালও করছে। তাই তিনি সতর্ক করেন, আমরা যেন এই মহামারির তলে আমাদের গণতান্ত্রিক জীবনের অন্যতম মৌলিক অনুষঙ্গকে কোরবান না করি। 

কৈফিয়ত: contingency শব্দের বাংলারূপ হিসেবে আকস্মিকতা/ সম্ভাব্যতা/ সম্ভাবনা তিনটাই বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করা হয়েছে। সবগুলো প্রায় সম-অর্থের হলেও বিষয়বস্তু অনুযায়ী একেক সময় একেকটা ব্যবহার করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে, এবং অনুবাদের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যে কোনোধরণের পরামর্শ-সমালোচনা সানন্দেই গ্রহণ করা হবে।] 


মূল প্রবন্ধ 

দুঃখজনকভাবে কৌশলটা আমাদের পরিচিত: প্রতিটি সঙ্কটের পেছনেই দায় চাপানোর জন্য নির্ধারিত কেউ থাকেই। সার্বভৌমত্ববাদীদের কাছে এই মহামারির জন্য দায়ী হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত সীমান্ত পারাপার। কমিউনিস্ট-বিরোধীদের কাছে এটা চীন সরকারের অবহেলা যা কিনা এর নাগরিকদের মরতে দিবে তাও ঝুঁকিপূর্ণ প্রাথিমক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। ষড়যন্ত্রবাদীদের জন্য এটি আমেরিকার রাসায়নিক অস্ত্র যার উপর গোয়েন্দা বিভাগ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। পতনবাদীরা আবার বেজায় খুশি, যেখানে অনেক বছর ধরেই তারা আসন্ন কেয়ামতের ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছে, অন্যরা একে অতি গতিশীলতা থেকে অত্যধিক ভোগবাদিতাসহ মানব প্রজাতির সাম্প্রতিক যাবতীয় ভুলের জাগতিক বা ঐশী ইশারা হিসেবে দেখছেন। মিশরের দশ গজবের জায়গায় একবিংশ শতকের এ ভাইরাস ঘটিত মহামারিকে বসানো হচ্ছে। সমষ্টিগতভাবে একটি বিরোপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করার জন্য এ সাধারণ দোষারোপ করা হতো। আর এর মধ্যেই আমাদের সেই সম্মিলিত পুনরুত্থানের ‘পরবর্তী সময়ে’ কী কী পাল্টাতে হবে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সমেত পূর্বাভাসগুলো শোনা যাচ্ছে। 

এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় যেটা লক্ষণীয় তা হলো যেই নিশ্চয়তার সুরে তারা এই্ রায়গুলো দিয়ে বসেন। কোনো কোনো শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যাগুলো পড়লে আরো বেশি অবাক হতে হয়। তাদের অধিকাংশই আমাদের সাথে যা ঘটছে তাতে অল্পই ধাক্কা খেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে, তারা এটাই ব্যাখ্যা করতে বেশি আগ্রহী যে, বছরের পর বছর তারা যা বলে এসেছেন তা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তাদের আত্মবিশ্বাস দেখে আমরা ইর্ষাণ্বিত হই। আসলে, সবকিছুই সহজতর হয়ে যায় যদি করোনা ভাইরাসের জন্য আর্থিক পুঁজিবাদ বা জৈব-রাজনৈতিক ব্যতিক্রম অবস্থাকে দোষারূপ করা যায়। পৃথিবী নামক এই গ্রহে এক মর্ষকামী প্রতিশোধের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থেকে মানবজাতির অংশ হিসেবে কেউ নিজেকে লজ্জিত মনে করতেই পারে, যেনবা অবশেষে মানবপ্রজাতিকে তার শতবর্ষের কৃতকর্মের শাস্তি দিচ্ছেন বসুধা-মাতা। প্রকৃতপক্ষে, হলিউড আমাদের যে কেয়ামতপরবর্তী দৃশ্য দেখিয়ে আসছে এতদিন ধরে পৃথিবীটা কি তার সাথেই অদ্ভূতভাবে মিলে যাচ্ছে না? ভূতুড়ে শহুর এবং মানবহীন রাজপথ? আবার উল্টো দিকে, ডিজনির পুরনো প্রামাণ্যচিত্র দ্য লিভিং ন্যাচার[১]-এ যেমন দেখানো হয়েছিল অতি প্রতিকূল পরিবেশেও কীভাবে আবারও জীবনই প্রধান হয়ে উঠে, এখন মনে হচ্ছে যেন লকডাউনের কারণে খালি পড়ে থাকা জায়গাগুলোর পুনর্দখল নিচ্ছে প্রকৃতি। গ্রিসের পোতাশ্রয়গুলোতে আবারও সাহস করে ফিরে আসছে তিমিরা, চিলিতে পাহাড়সারি থেকে বনবিড়ালেরা একেবারে শহরের কেন্দ্রে নেমে আসছে, ভেনিসে ক্রুজ জাহাজগুলো না থাকায় উপহ্রদের পানি আবারও স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। অতএব, করোনা সঙ্কটের প্রকৃত অর্থ আসলে এর জরুরি পরিবেশগত বার্তা; আঁদ্রে গর্জ থেকে শুরু করে গ্রেটা থুনবার্গের সতর্ক-সঙ্কেতে এতদিন আমরা যারা কান দেইনি এটা যেন বসুধা-মাতার পক্ষে থেকে তাদের মুখে এক জোরালো ঘুষি। 

আমরা যদি এই সঙ্কটের একটা সহজ ব্যাখ্যা দিতে পারি যা তাৎক্ষণিক সমর্থন আদায় করে নিতে পারে তাহলে বিষয়টা কত সরল হয়ে যায়! কেবল তখনই আমরা একা বা সবাই মিলে অনুতপ্ত হতে পারি। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এই কারণ-অনুসন্ধানের যন্ত্রটা পুরোদমে ছুটছে; বড় বড় সঙ্কটগুলো অনুভূতির কঠোর পরীক্ষার উর্ধ্বে, এবং দৃশ্যমানতার অভাবে সুবিধামতো গল্পের আশ্রয়গ্রহণ সহজতর হয়ে যায়, এমনকি যখন এগুলো আশ্বাস দেয়ার মতো একেবারে কিছুই করেনি। 

কিন্তু এই কৈফিয়তমূলক পলায়নের মুখোমুখি হয়ে ঘটনাকে অল্প মোকাবিলা করেই আমাদের যদি স্বীকার করতে হয় এই ঘটনা (event) আমাদের নিশ্চয়তাগুলোকে মারাত্মকভাবে খাটো করছে এবং ঘটনাটা জীবনের জন্য কতটা মর্মভেদী হতে পারে তা অস্বীকারের ঝুঁকির মধ্যেই এটি আমাদেরকে স্বাভাবিক অবলম্বনে ফিরে যেতে বাঁধা দিচ্ছে? এমনকি যদি কেবল এক মুহূর্তের জন্য হলেও, আমাদের সাথে যা ঘটছে তার সত্যিকারের অচেতন প্রকৃতিকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হয়? এই করোনা মহামারি আসলে স্বকীয়ভাবে অচেতন এবং এর কোনো অন্তর্নিহিত অর্থ নেই। এর প্রাদুর্ভাব যেমন আবশ্যক ছিল না, তেমনি রৈখিকও ছিল না। একটা ভাইরাসের আসলে একটা টেকটোনিক প্লেটের চেয়ে বেশি কোনো উদ্দেশ্য নেই, যখন পরেরটা সাথে করে সুনামির ঢেউ নিয়ে আসে। 

আমরা কেন এটা আসতে দেখি নি? বহু দুর্ভোগের পর, বিশেষত যেখানে অনেক প্রাণ হারাতে হয়েছে, আমাদেরকে এটা মেনে নিতে হচ্ছে, কিন্তু এই করোনাভাইরাসই একটি অনিশ্চয়তা, এবং অনিশ্চয়তা হিসাবেই এখনো টিকে আছে। অবশ্যই, এর প্রাদুর্ভাব সম্ভাব্য ছিল, এবং এমনকি অনেকেই এই ঘটনার সম্ভাব্য হিসেবে-নিকেষ করা শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু একটা সম্ভাব্যতা তো আর যৌক্তিক উপসংহার নয়। যেমন করে এরিস্টটল বহু আগেই বলে গিয়েছেন, সম্ভাব্যতা হচ্ছে অনেকগুলো বিষয়ের দৈবাৎ একের পর এক ঘটতে থাকা যার ফলে একটি নিরবিচ্ছিন্ন অনুক্রমের মতো মনে হয়, যদিও এর কোনো আবশ্যকতা নেই। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি কেনা-বেচার বাজার, যা কিনা কোভিড মহামারির সম্ভাব্য উর্বর জমিন, যেখানে পেংগোলিন, বাদুড় ও সাপের খাঁচা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে, সেটা আসলে এই অসচেতন সংস্পর্শের উত্তম চিত্র তুলে ধরে। এটা হোর্হে লুইস বোর্হেস কল্পিত বিখ্যাত চীনা বিশ্বকোষের মতো একই ধরণের অদ্ভুত শ্রেণিবিন্যাস বা ট্যাক্সোনমি অনুসারে সজ্জিত। 

আমরা অন্যতম যে বড়ো ঝুকির মুখে পড়তে যাচ্ছি তা হচ্ছে আবশ্যকতার একটা নতুন ডিসকোর্স দীর্ঘমেয়াদের জন্য প্রভাব রাখতে শুরু করবে। এটি যেমন মনযোগ দিবে ভাইরাসের অর্থ ও গোঁড়ার কারণ উদ্ধারে, তেমনি মনযোগ দিবে এর জন্য প্রয়োজনী যে সহজ-সরল প্রতিক্রিয়া রয়েছে সে দিকে। (‘আমাদেরকে শুধু করতে হবে… ধরণের জিগির)। এখানেই আসলে সবচেয়ে সর্বনাশা স্বাধীনতাধ্বংসের ফল পড়ে, কারণ তারা স্থায়ীভাবে এই বোধ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে যে, সমাধানের পথ বাতলানো হয়ে গিয়েছে, হয় এই দিকে নাহয় ওই দিকে! আবশ্যক ও অপরিহার্য প্রতিকার ও নির্দেশ কোনো ব্যতিক্রম স্বীকার করবে না। 

কিছুক্ষণের জন্য সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু নির্দিষ্ট মনোভাব গ্রহণ করাটা বোধগম্য, কারণ আর কোনো উপায় নেই। তবুও, দিনের পর দিন এই আকস্মিক ঘটনা, মানে এই করোনাভাইরাস, আমাদের জীবনে যে প্রভাব ফেলছে তার গভীর পরিবর্তনগুলো আমরা ইতোমধ্যেই অনুভব করছি। আরোপিত শারিরিক দূরত্বের ঘুচাতে আমরা টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, সামাজিকতা স্থগিত হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা ভার্চুয়াল-সহযোগী যন্ত্রাদির সাহায্য নিচ্ছি; এই যন্ত্রাদি নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করছে। কিন্তু জীবন পরিচালনার ভার এলগোরিদমের উপর ন্যাস্ত করার ফলে বড়ো বড়ো ঝুঁকি আবির্ভূত হচ্ছে। 

প্রবল মানব উপাদানযুক্ত পেশাগুলোর বেলায়, অবস্তুগত রূপ (dematerialized form) স্থানান্তর একধরণের স্থায়ী প্রাপ্যতা ও বর্ধিত মনযোগের বিভ্রম তৈরি করতে পারে, যেখানে প্রায়শই বিপরীতটাই ঘটে। কিছু কিছু স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে চিকিৎসাসংক্রান্ত এপয়েন্টমেন্টগুলো ভিডিওকনফারেন্সের মাধ্যমে করার সম্ভাবনা বিবেচনা করছে। ভিড় হ্রাস করা, এবং ফলে রোগীদের স্বার্থের নাম করেই আমরা এমন এক চিকিৎসার দিকে সরে যাচ্ছি যা আরো বেশি দূরবর্তী এবং বিমূর্ত। শিক্ষার ক্ষেত্রে, একই ধরণের ব্যবস্থা বিবেচনাধীন রয়েছে। যুক্তরাজ্যের কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই তাদের শিক্ষকদেরকে বলেছে সবকিছু ভিডিও আকারে রেকর্ড করতে যাতে তারা সেগুলো অসুস্থ বা অনুপস্থিতির বেলায় সম্প্রচার করতে পারে। এই ধরণের উদ্যোগ একজন গবেষককে তার ধর্মঘট করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, কারণ যদি শ্রেণীকক্ষের কোর্স যখন তখন ডাউনলোডযোগ্য সমতুল্য কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যায়, তখন কাজে যোগ না দেয়ার আর কি মানে থাকতে পারে? আমরা খুব সহজেই কল্পনা করতে পারি, শিক্ষার্থী অভ্যর্থনার মতো মানব অংশ জড়িত ক্রিয়াকলাপগুলো স্থানান্তরিত হয়ে যাবে একধরণের মিথ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দূরববর্তী হাজিরায়, যা অনেকটা আউটসোর্সের বাণিজ্যিক মডেলের মতোই। 

করোনাকালে সংবরণ বা সীমিত রাখার এই অভিজ্ঞতা আমাদেরকে বেশ কয়েকটি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেয়। এটা সত্য নয় যে, শারিরীক দূরত্ব আবশ্যকভাবে মানব দূরত্বের সমতুল্য হতে হবে (যে কারণে সামাজিক দূরত্ব বা সোশিয়াল ডিসট্যান্স শব্দবন্ধ ব্যবহার করা বেমানান); আমরা এমন অনেক ঘটনাই দেখেছি, যেখানে এই সঙ্কট আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশি, এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলোর মধ্যকার সংহতির বন্ধনকে আরো দৃঢ় করেছে। তবে নাগরিকদের সমস্ত ‘অপ্রয়োজনীয়’ ক্রিয়াকলাপ স্থগিত করতে বলার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ এমন কিছু বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন যেগুলো স্বকীয়ভাবে সামাজিক সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করে: আকস্মিক দেখা হয়ে যাওয়া, অভাবিত আদান-প্রদান, অপ্রত্যাশিতভাবে কারও সামনে গিয়ে পড়া। ব্যক্তিকে কেবল “আবশ্যিক“ এর প্রতিই মনোযোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়ার মাধ্যমে আমরা মূলত কেবল পরিচিতদের মহলেই ফিরে যাচ্ছি, সেই সম্ভাবনা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছি যা কিনা সকল মানবিক সম্পর্কের প্রভাবক। সকলের মিলিত হ্‌ওয়ার মতো উন্মুক্ত স্থান হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অপ্রত্যাশিত ঘটনারও বিলুপ্তির ঘটবে। এই বন্দিদশার কালে, চাহিদা অনুযায়ী টেলিভিশনের এলগোরিদম আমাদের প্রিয় সিনেমা বা সিরিজের সরবরাহকারী হয়ে উঠছে, খাবার-দাবার অর্ডার দেয়া মাত্রই দরজার সম্মুখে চলে আসছে, এমনকি ডেলিভারি ম্যানের মুখ দেয়ার পূর্বেই সে চলে যাচ্ছে। 

যেদিকে তাকান না কেন, আবশ্যকতা বা প্রয়োজনীয়তার এই ডিসকোর্স চূড়ান্ত আধিপত্য লাভ করেছে, এবং অনিশ্চয়তার আউটসোসিং দিনশেষে কেবল একটা সাধারণ গাণিতিক চলক বা চলরাশিতে পরিণত হচ্ছে। এটা সত্য যে, এই সাধারণ বন্দিদশার যুগে সামাজিক জীবন অদৃশ্য হয়ে যায় নি। ভার্চুয়াল খানাপিনা-ডিনারের সমন্বয় করতে ক্যালেন্ডারের সাহায্যে লিঙ্কগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্ত, এখানেও আবার, আমরা যে ‘অন্য’দের খুঁজে পাচ্ছি সেই অন্যদের সাথে আমরা ইতোমধ্যেই পরিচিত ছিলাম। আসন্ন মোলাকাতের পরিকল্পনাকে নিখুঁত করার সময়ে আমরা নিজেদেরকে সত্যিকারের সুযোগ তৈরি থেকে বঞ্চিত করছি। আমরা ইতোমধ্যেই যাদেরকে চিনি ও জানি (বা, বিভিন্ন ডেটিং সাইট ‘আমাদের সাথে মিলবে’ বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাদের পাঠাচ্ছে) তাদের সাথে মোলাকাত করার মাধ্যমে আমাদের জন্য র‍্যাডিক্যালি ভিন্ন বলে কোনো কিছুর জায়গা আর কই থাকলো- যাকে স্টিফেনি মালার্মে বলেন ‘মোলাকাতের তাৎক্ষণিক সজীবতা’। 

আসুন আমরা সতর্ক থাকি যেন এই মহামারির কাছে সমস্ত গণতান্ত্রিক জীবনের অপরিহার্য মূল্যবোধটি বিসর্জন না দেই: এর দৈবতাংশটুকু (share of randomness), এর সম্ভাব্যতাটুকু। এর কারণ হচ্ছে, কোনো গণতান্ত্রিক বিধানই এক এবং সকলের জন্য স্থির হতে পারে না, বরঞ্চ মৌলিকভাবেই আবশ্যিকতার ঘাটতি থাকে, যেন এর সদস্যরা একসাথে পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং তারা যা চান সেটার আকার দিতে পারেন। সুতরাং খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের সাধারণীকৃত প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাতে আমরা নিজেদের আরও বেশি নিশ্চয়তার মধ্যে সমাহিত না করে ফেলি, বরং এটা মেনে নিতে হবে যে এই সম্ভাব্যতা/ আকস্মিকতা আমাদের কল্পজগতে প্রবেশ করবার একটা শক্তিশালী ফাঁটল হতে পারে। 

অনুবাদকের নোট: 
[১] এটা সম্ভবত দ্য লিভিং ডেজার্ট হবে। দ্য লিভিং নেচার নামে ডিজনির কোনো ডকুমেন্টারির হদিস অনলাইন পাড়ায় পাইনি। তবে ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দ্য লিভিং ডেজার্ট -এর সাথে উপরোক্ত বিষয়বস্তুর মিল রয়েছে।

No comments:

Post a Comment