Pages

Thursday, October 31, 2019

আন্দোলনকারীদের জবানে চিলির 'নেতাবিহীন আন্দোলন'


সাবওয়ের ভাড়া ৩% বাড়ানোটাই ছিল স্ফুলিঙ্গ, এই স্ফুলিঙ্গ যে আগুন ছড়িয়েছে সেই আগুনেই চিলিতে প্রায় ১২ দিন ধরে চলছে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ। এই বিক্ষোভ পরিণত হয়েছে গণআন্দোলনে, যা এখন চিলির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। ইতোমধ্যে ১৮ জন মারা গিয়েছেন, প্রায় ৭০০০ লোক গ্রেফতার হয়েছেন। তবু, আন্দোলন চলছেই। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন এই আন্দোলনকে বলছে 'নেতা-বিহীন আন্দোলন' (লিডারলেস মুভমেন্ট); এবং এই নেতা-বিহীন আন্দোলন প্রেসিডেন্টকে মন্ত্রীসভায় অদল-বদল করতে বাধ্য করেছে, ন্যূনতম মজুরির কিছুটা বৃদ্ধি করতে, এবং ধনীদের ওপর ট্যাক্স কিছুটা বাড়াতে বাধ্য করেছে।

কিন্তু, এই ধরণের পদক্ষেপ বিক্ষোভকারীদের খুশি করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। চিলির জনসংখ্যার মাত্র ১% মানুষের হাতে দেশের সম্পদের ৩৩% কুক্ষিগত। এই যে অর্থনৈতিক অসমতা চিলিতে বিরাজ করছে, এখানেই মূলত শেকড় গেঁড়ে আছে 'বিক্ষোভ'। অনেক বিক্ষোভকারীরা সরাসরি সংবিধান নতুন করে তৈরি করার ডাক দিচ্ছেন। গার্ডিয়ান পত্রিকা কয়েকজন আন্দোলনকারীদের কথা প্রকাশ করেছে। আমি নিচে আংশিক ভাবানুবাদ করে আন্দোলনকারীদের কথা তুলে দিলাম।

জুয়ান এঞ্জেল, বয়স ৬০,পেশায় স্কুল শিক্ষক। তিনি বলছেন, 'আমি পরিবর্তন চাই এবং এখনি চাই। জীবনযাপনের ব্যয় ক্রমাগতভাবে বাড়ছে, আমাদের টাকা-পয়সা পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এইসব ক্ষেত্রে খুব বাজেভাবে বিতরণ করা হয়। সামরিক বাহিনী, যাজক, রাজনীতিবিদ, কর্পোরেশন এরাই সুবিধাভোগী। এটা পরিবর্তন করতে হলে সংবিধানকেই পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছোট একটা দেশ। সম্পদ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা গেলে এখানেও অনেক উন্নতি সম্ভব। আমরা সুখ ও শান্তিতে ভরপুর দেশ হতে পারি। আমি ভয় পাচ্ছি না। আমার হারানোর কিছু নাই। আমি আমার ছয় মাস বয়সী নাতনীর জন্যই এটা করছি।' 

মেলিসা মেদিনা একজন মেকআপ শিল্পী। বয়স ২৫। তিনি জানাচ্ছেন যে, 'আমার দাদী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছেন, আমার মা তার সময়ে লড়েছেন; আমি এখন ছয় বছর বয়সী এক কন্যার মা এবং এবার আমার প্রতিবাদের পালা। আমরা দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন চাই যেন সে ২০ বছরের মধ্যে সেটা উপভোগ করতে পারে। আমাদের বেতন খুব বাজে, ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়, বাসায় যেতে আরো দু ঘণ্টা লাগে। যখন বাসায় ফিরি আমি আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে পারি না, কারণ সে ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের সাথে বাচ্চাকাচ্চা আছে, ছাত্ররা আছে, শ্রমিকরা আছে, বাবা-মা'রা আছে, চাচীরা আছে, দাদীরা আছে। দাদী-নানীরাও পরিবর্তনের জন্য চেঁচামেচি করছে। এই বয়সেও তারা লড়াই করছে। আমাদেরকে দেখুন, আমাদের চামচ, হাঁড়ি, প্যান এইসব নিয়ে প্রতিবাদ করতে চলে এসেছি। ওদের টিয়ারগ্যাসের বিরুদ্ধে আমাদের পানি ও বেকিং সোডা। তাদের হাতে রয়েছে টিয়ারগ্যাস, লকআপ, পুলিশি নির্যাতন, ধর্ষণ, নির্যাতন - এখন আপনি বলুন কে আসলে জিতছে এবং কে হারছে। এই লড়াই চলবে। হয়তোবা এইখান থেকে কোনো ইতিবাচক বিষয় আসবে না, এবং আমরা কিছুই জিতব না। কিন্তু, আমি এটার জন্য ৫০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নই যখন আমার মনে হবে আমি যথেষ্ট সাহসী ছিলাম না। আমি গলাফাটাচ্ছি, আমি লড়ছি। আমি পুলিশ দেখে দৌড়াচ্ছি, পায়ে গুলি খেয়েছি। এরপর আসবে আমার মেয়ের পালা। আমি চাই, তাকে যেন এই লড়াই করতে না হয়।'

আন্তোনিয়া দেল আলমেন্দ্রো একজন ২৫ বছর বয়সী চিত্র-নির্মাতা। তিনি বলছেন যে, 'জনগণকে দাস ও ক্রিমিনালের মতো ট্রিট করা হয়। আপনার যদি গুরুত্বপূর্ণ পদবী না থাকে বা টাকা-পয়সা না থাকে তাহলে আপনি কেউ না। আমাদের প্রথম দাবি হচ্ছে সংবিধান পরিবর্তন করা। আমরা ল্যাটিন আমেরিকার একমাত্র দেশ যেখানে স্বৈরাচারের আমলের সংবিধান এখনো জারি আছে। স্বৈরাচারের আমলের মতো একই আইন-কানুন এবং সেই একই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। আমরা দেখছি যে, এগুলো স্বৈরাচারী আমলের মতো এখনো সমানভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। তারা আমাদের স্টুপিড মনে করে। কিন্তু জনগণ জেগে উঠেছে এবং সরকারকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা স্টুপিড নয়।'

জার্মেন ডেভিড যেটা একজন শিক্ষার্থী। বয়স মাত্র ১৮। বলছেন যে, 'ছাত্র হিসেবে সান্তিয়াগোতে বসবাস করা খুব ব্যয়বহুল। আমার বাবা-মা আমরা উত্তর চিলির বাসিন্দা, তাই আমি এখানে একাই থাকি। আমি লড়ছি কম খরচের উন্নত শিক্ষার জন্য, ন্যায্য ভাড়ার জন্য, এবং আরো মর্যাদাবান জীবনের জন্য। কারণ, আমরা যা আয় করছি তা জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। আমি স্বাবলম্বী হওয়া চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না - জীবন যাপন এখানে খুব ব্যয়বহুল। আমি ছাত্র হিসেবে একটু শান্তিতে থাকতে চাই - এগুলো তো খুব সাধারণ চাওয়া। অনেকেই পুলিশের হাতে আহত হয়েছে, মারা গিয়েছেন, তবু ভীত নই। আমি শুধু বুঝতে পারছি না, তারা কেনো এতো শক্তি নিয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করতে গেলো।'

মারিয়া ৩২ বছর বয়সী আর্ট হিস্টোরির শিক্ষার্থী। তিনি বলছেন যে, যে মানুষগুলো সরকার চালাচ্ছে, এই মানুষগুলোর হাতেই আবার অর্থনৈতিক ক্ষমতা। একটি নিখুঁত চক্র। তারা আরো বেশি টাকা কামানো জন্য আইন বানাচ্ছে, এবং আমরা বাদবাকিরা আরো গরীব হচ্ছি। আন্দোলনের সময় সরকার মানুষকে মেরেছে, নারী-পুরুষকে ধর্ষণ করেছে। অনেকে চোখ হারিয়েছেন। স্বৈরশাসনের পর থেকে আসলে কখনোই মানবাধিকারকে সম্মান দেখানো হয় নি। আমরা ধনীদের দ্বারা দমিত হচ্ছি। এবং সময় এসেছে এটি শেষ করার। জনগণের জন্য এটাই সময় তারা যে ধরণের জিন্দেগী চায় সেটা বেছে নেয়ার।'

ক্রিশ্চিয়ান কুইরোগা। বয়স ৪৩, টেলিভিশনের ক্যামেরা সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলছেন যে, 'আমি চাই সরকার ও বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা যেন আমার দেশটাকে লুটপাট করা বন্ধ করে। যা আমাদের সেটা যেন বিক্রি করে দিতে না পারে। আমাদের দেশে যা আছে সব তারা বাইরে পাচার করে দিচ্ছে, এবং এসবের কোনো হিস্যা আমাদের কাছে আসে না। সোশিয়াল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের কল্যাণে চিলির লোকজনের চিন্তাপদ্ধতি আমূল বদলে গিয়েছে। চিলির পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ আরো বেশি উদার হচ্ছে। কিন্তু, শ্রম আইন এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা গত ৩০ বছরেও বদলায়নি। আমরা যদি নতুন সংবিধান পাই, আমি ঝাড়ু হাতে রাস্তা পরিষ্কার করে সাহায্য করব, দেশকে নতুন করে রাঙিয়ে তুলতে সাহায্য করবো।'

২১ বছর বয়সী টমি হেডস বলছেন যে, 'আমি ট্রান্সপিপলদের প্রতিনিধিত্ব করতে রাস্তায় নেমেছি। চিলিতে একজন ট্রান্সলোকের গড় আয়ু হচ্ছে মাত্র ৩৫। যে চাহিদার জন্য এখানে অনেকেই আন্দোলন করছেন, যেমন একটা সুষ্ঠু পেনশন, আমরা এটি ভাবতেও পারি না। আমরা আন্দোলন করছি কারণ, যৌন বিপ্লব বাদ দিয়ে কোনো সামাজিক বিপ্লব হয় না। আমার লক্ষ্য হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ও তার মন্ত্রীরা যা করেছে তার জন্য কারাগারে যায়। আমি ট্রান্স ও নন-বাইনারি পিপলদের রক্ষা করার জন্য আইন চাই। আমি কখনো কল্পনাও করি নাই, আন্দোলন এই বিশাল আকার ধারণ করবে। বিষয়গুলি খুব খারাপ ছিল: মানুষ মারা যাচ্ছিল, ট্রান্সরা মারা যাচ্ছিল, আদিবাসীরা মারা যাচ্ছিল। এবং, শেষ পর্যন্ত জনগণ জেগে উঠেছে, এবং বুঝেছে যে, যা হচ্ছিল এগুলো ভুল। গণতন্ত্রে, জনগণের হাতে ক্ষমতা থাকে। এবং সরকারকে আমাদের কথা শুনতে হবে।'


গার্ডিয়ানের মূল লেখার লিঙ্ক: Chile protesters: 'We are subjugated by the rich. It's time for that to end'

No comments:

Post a Comment