Pages

Thursday, October 24, 2019

কবীরের 'সদগুরু' ও এই জমানার 'বুদ্ধিজীবীর দায়ভার'


মধ্যযুগের কবি-সাধক কবীর তার কবিতায়সদগুরু’,‘সাধু’, ‘সত্যগুরুর কিছু চরিত্রের কথা বলেন। যিনিএই নয়নে অপরূপের রূপ দেখাইতে পারেন, যিনি প্রাণায়াম, পূজা, আচার হইতে স্বতন্ত্র সহজ সমাধি শিখাইতে পারেনতিনিই সাধু বা সদগুরু। এই সাধুদ্বার বন্ধ করান না, শ্বাস রোধ করান না, বিশ্বসংসার ত্যাগ করান নাআরো এগিয়ে গিয়ে বলেন, তার (কবীরের) প্রাণ সেই সত্যগুরুকে চায়যিনি সত্য প্রেমের প্যালা ভরিয়ানিজে যেমন পান করেন, তেমনি অন্যকেও পান করেন। 

কবীরের এই সদগুরু বা সাধুকে আমার হাল আমলেরবুদ্ধিজীবীবলে মনে হয়। কি কি করলেসাধুহয়ে উঠা যায়,  কবীরের যে উপদেশ বা পরামর্শ বা চাওয়া সেটা আসলে এই আমলের ভাষায় বললেবুদ্ধিজীবীর দায়ভারএই সদগুরু পূজা আচার হতে স্বতন্ত্র সহজ সমাধির শিক্ষা দিতে পারেন কবীরের এই যে চাওয়া, এই জমানায় বুদ্ধিজীবীদের কাছেও আমাদের চাওয়া এমনি। কোনো পূর্বানুমান বা সংস্কারের বশবর্তী না হয়ে তিনি যেনো তার মতামত তুলে ধরেন। মধ্যযুগের কবীর যা চাচ্ছেন, বিংশ শতাব্দীর অরওয়েলও একই জিনিস বলছেন। বুদ্ধিজীবীদের মানস জগত কীভাবে জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ভরপুর থাকে এবং বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী প্রবণতা কীভাবে বারেবারে তাদেরকে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছিল তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছিলেন তার এক প্রবন্ধে।জাতীয়তাবাদদিয়ে তিনিজাতীয়তাবাদজাতিসম্পর্কিত কোনো তত্ত্ব না দিয়ে বরঞ্চ একধরণের চিন্তাপ্রবণতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। যার মূল সুর হচ্ছে, কবীরের উপরোক্ত কথার মতো, বিভিন্ন ধরণের আচার-সংস্কার-মতাদর্শের টুলি আমাদেরবুদ্ধিজীবীতার (বা, ‘সাধুতা) একটি বড়ো অন্তরায়। 

পূর্ব থেকে আন্দাজ বা অনুমান করে কাজ শুরু করা, কোনো মতের দাস হয়ে পড়া,  মতাদর্শিক অন্ধত্ব এইসবই আসলে আমাদের দ্বার বন্ধ করে, আমাদের দৃষ্টির দরজা-জানালা বন্ধ করে আলো দেখতে দেয় না। আমাদের শ্বাস রোধ করে, চিন্তার সহজাত ক্ষমতা বিনষ্ট করে। কবীরের যিনিসাধুহবেন, তিনি এমন হবেন না, এই অন্ধত্ব বরণ করবেন না। যেমন করে অরওয়েল বলছেন, প্রত্যেক জাতীয়তাবাদীই মোহগ্রস্ত থাকেন, স্থিতিহীনতায় ভুগেন এবং সত্যের প্রতি উদাসীন থাকেন। সত্যকে শুধু অস্বীকারই করেন না, বরং এগুলো শুনতে না পারার মত একটা দারুণ ক্ষমতাও তাদের থাকে। 

মতাদর্শিক অন্ধত্ব সত্যকে অস্বীকার করতে প্রণোদনা দেয়, যেমন করে অরওয়েল বলছেন। কবীরও চান তাইসত্যগুরুকেসত্য প্রমের প্যালাপান করাতে বা করতে হবে। একেবারে হাল আমলের নোয়াম চমস্কি বুদ্ধিজীবীর দায়ভার আলোচনা করতে গিয়ে একেবারে গোড়াতেই বলেছিলেন যে, বুদ্ধিজীবীর কাজ হচ্ছে, মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরা। এই মিথ্যার মুখোশ খুলতে গেলে প্রশ্ন করতে হয় ক্ষমতাকে, বর্তমান বাস্তবতায় বললে, ক্রমাগত প্রশ্ন করতে হয় খোদরাষ্ট্রকে। ক্ষমতা ও রাষ্ট্রকে ক্রমাগত প্রশ্ন করাটাই বোধহয় বুদ্ধিজীবীদের একটা প্রধান দায়। 

কত সুন্দর করে কবেকার মধ্যযুগে কবীরবুদ্ধিজীবীর দায়-দায়িত্ব বাতলে গিয়েছেন। আমাদের অথচ বুদ্ধিজীবীরা এখনো  হাতড়ে বেড়াচ্ছেন অন্ধকারে …   

ফেসবুক পোস্ট: ২৪ নভেম্বর, ২০১৯ 


No comments:

Post a Comment