Pages

Wednesday, November 27, 2019

ইলিয়াসের ডায়েরি: নজরুল, ভাসানী, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও অন্যান্য

ছবিতে ব্যবহৃত স্কেচ অনলাইন থেকে নেয়া হয়েছে।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত স্কেচ অনলাইন থেকে নেয়া হয়েছে।


আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। ইলিয়াস বাংলা কথাসাহিত্যের একটি মানদণ্ড হয়ে আছেন। তাঁর গল্প-উপন্যাস যেমন শিল্পের জন্য ক্ষুধার্ত মনের খোরাক জুগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি তাঁর গল্প-উপন্যাসের চুলচেরা বিশ্লেষণও চলছে। ইলিয়াস ডায়রি লিখতেন। সেই ডায়রিগুলো নিয়ে আরেক কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের সম্পাদনায়আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়রিশিরোনামে বই প্রকাশিত হয়েছে। শাহাদুজ্জামান এককালে ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, এটি তাঁরকথা পরম্পরাবইতে আছে। শুধু আমার দৃষ্টিতেই নয়, অনেকেই মনে করেন, বাংলাসাহিত্যের অন্যতম ধ্রুপদী উপাদান হচ্ছে শাহাদুজ্জামান - ইলিয়াসের এই কথোপকথন। ইলিয়াসকে বোঝার জন্য, তাঁর সাহিত্যের গভীরতা বোঝার জন্য এই সাক্ষাৎকার যে কোনো পাঠকের জন্যই - তা তিনি সাহিত্যিক হোন আর গবেষক হোন - সমান গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে ইলিয়াসের ডায়রিটাও। বইয়ের ভূমিকায় শাহাদুজ্জামান জানাচ্ছেন যে, ডায়েরি অন্তরালে চর্চার বিষয়। এতে ফুটে থাকে একজন ব্যক্তিমানসের মানচিত্র।ব্যক্তিমানসের মানচিত্রও তো আবার স্থান-কাল নিরপেক্ষ নয়, উপরন্তু, এই ব্যক্তি যদি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হয়ে থাকেন তাহলে আমাদের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। তবে, এখানে পুরো ডায়েরি নিয়ে আলোচনা নয়। কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে ইলিয়াসের কিছু আগ্রহোদ্দীপক মন্তব্য রয়েছে ডায়েরিতে, সেগুলোই তুলে ধরবো। হুবুহু। 


ডায়েরিতে ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭৬, ১৯৮০, ১৯৮১, ১৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯৫ বছরগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এগুলোও বিচ্ছিন্নভাবে। ১৯৬৮,১৯৬৯ এর ডায়রিতে উনষত্ত্বরের গণঅভ্যুত্থানের দৈনন্দিন ঘটনার বিবরণ টুকে রেখেছেন। কখনো বেশ বড়ো করেই বিবরণ দিয়েছেন। কোন এলাকায় মিছিল বের হয়েছে, কোন এলাকায় পুলিশ-সেনাবাহিনীর গুলিতে আন্দোলনকারীরা নিহত হয়েছেন তার ঘনঘন উল্লেখ পাওয়া। কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছে না, যশোরের দিকে গরুচোরের উপদ্রব বেড়েছে এসব খবরও ডায়েরিতে টুকে রেখেছেন ইলিয়াস। আমরা যারা চিলেকোঠার সেপাই পড়ছি, আমরা খুব সহজেই আন্দাজ করে নিতে পারি এইসব আসলে উপন্যাসেরই উপাদান। তাঁর ডায়েরিতে যে ছোটছোট খবর বা বিবরণ বা সংবাদ পাই, তারই এক বিস্তৃত নির্মাণ দেখা যায় চিলেকোঠার সেপাইতে। একজন কথাসাহিত্যিক কতটা জীবনমুখী, বা বাস্তবদ্বারা চালিত বা নির্মোহভাবে বাস্তবকে দেখা ও বোঝার সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তা ইলিয়াসের সৃষ্টি ও ডায়েরি পাশপাশি রাখলেই বোঝা যায়। আবার, ইলিয়াসের একমাত্র প্রবন্ধসংকলন সংস্কৃতির ভাঙা সেতুর অনেক উপাদানও ডায়েরি দেখা যায়।উপন্যাসের উদ্ভব, সামন্ত সমাজের অবসান ও ধনবাদী সমাজের উত্থান  - এই সংক্রান্ত ডায়েরির ছোটছোট নোট আসলেউপন্যাস ও সমাজবাস্তবতাপ্রবন্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯৫ সালের ডায়েরিতেব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসের বিকাশ’, ‘ব্যক্তি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিসর্বস্বতা’, ‘উপন্যাসে সৃষ্টি ব্যক্তির উত্থানের সঙ্গে’, ‘রবীন্দ্রনাথই প্রথম একজন ব্যক্তির অনুসন্ধান করেন উপন্যাসে’ - এমন টুকরো টুকরো মন্তব্য উপরোক্ত প্রবন্ধের প্রস্তুতির অংশ বলেই মনে হয়। পুরো ডায়েরিজুড়ে লেখা রয়েছে বিভিন্ন জন্যে উক্তি, বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসের ডায়লগ, কোরানের আয়াত, কবিতা ইত্যাদি। আছে গল্প-উপন্যাসের খসড়া। মাঝেমধ্যে রিভিউ দিয়েছেন সিনেমার, বা মন্তব্য করেছেন ম্যাকিয়াভেলির কোনো নাটকের। ব্যক্তিগত সফর, সম্পর্ক, আবেগ-অনুভূতিও আছে। 

ইলিয়াসের গল্প-উপন্যাসের খসড়াগুলো আফসোস তৈয়ার করে। বিশেষ করে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি যে উপন্যাস রচনা করার কাজে হাত দিয়েছিলেন সেটা তো আর ক্যান্সারের কারণে সফল হতে পারেন নি। ইলিয়াস স্কেচ আঁকতেন। ডায়েরিতে তাঁর গল্পের জন্য স্কেচও রয়েছে।  

ইলিয়াসের ডায়েরিতে দৈনন্দিন বিষয়াদি, কবিতা, উদ্ধৃতি, গল্প-উপন্যাসের খসড়া ইত্যাদি ছাড়াও মাঝেমধ্যে দুয়েক লাইন বা ছোট ছোট প্যারা করে বিভিন্ন বিষয়, বা ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য টুকে রেখেছেন। যেমন, নজরুল, ভাসানী, রবীন্দ্রসঙ্গীত, লোকগীতি ইত্যাদি। এই মন্তব্যগুলো যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা পড়ামাত্রই যে কারো মনে হতে পারে; যেহেতু মন্তব্যকারী ইলিয়াস, সেহেতু মন্তব্যগুলোর গুরুত্ব আমরা বুঝি।  আপাতত টুকে রাখি, পর্যালোচনা- সমালোচনা- আলাপ-আলোচনা পরের কাজ।   

কাজী নজরুল ইসলাম ও মওলানা ভাসানী  

১৯৬৮, ১৯৬৯ সালের ডায়েরিতে বিভিন্ন স্থানে মওলানা ভাসানীর সমাবেশ ও ভাষণের কথা ইলিয়াস উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি শেখ মুজিবের সভা সমাবেশের কথাও এসেছে। তবে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তারিখে কাজী নজরুল ইসলাম ও মওলানা ভাসানীর মধ্য একটা তুলনামূলক মন্তব্য করেছেন ইলিয়াস। মোট ৮টা পয়েন্টে তুলে ধরা ভাসানীর সাথে নজরুলে এই তুলনা খুব কৌতূহলোদ্দীপক। মন্তব্যটা নিম্নরূপ: 

১. নজরুল ইসলাম কোন ছকের মধ্যেই পড়েন না। মূলত তিনি রোমান্টিক কবি কিন্তু তার অনুভূতিপ্রবণতা তাঁকে কখনো কখনো সাধারণ শোষিত মানুষের দুঃখ যন্ত্রনায় অভিভূত করে তুলেছে। ক্রোধ, ভালোবাসা প্রভৃতি সম্পূর্ণতা লাভের পূর্বেই তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেছে, তাই কোন অনুভূবই সম্পূর্ণ করে পাওয়ার উপায় তার কবিতায় প্রায় নেই বললেই চলে। 
২. এই সম্পূর্ণতা ও পরিণতি লাভের জন্য যে পরিমাণ সংহতি ও স্থিতধী হওয়া দরকার তা তাঁর ছিলো না, একেবারে ছিলো না। যে কোনো ঘটনা তাকে বিচলিত করত, যেকোনো অনুভবে আন্দোলিত হতেন তিনি। একটি ঘটনা বা অনুভব রচনায় এসে গেছে বড় দ্রুত, কোনরকম পরিশোধন ছাড়াই। অসাধারণ ক্ষমতার বলে তিনি সেগুলোকে শিল্পে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন। অনেকে একেবারেই পারেননি। সাম্যবাদ বা প্রেম, ইসলাম বা শ্যামা যাই তাঁর জীবনে যতটুকু তরঙ্গ তুলুক তার তাৎক্ষণিক চিত্র তাঁর রচনায় পাওয়া যাবে।  যত ক্ষীনতম স্পন্দনের প্রতিফলন ঘটানোই ছিল তাঁর চিত্তের বৈশিষ্ট্য। Emotion recollected in tranquility কবিতা সম্পর্কে ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই সংজ্ঞা তার কবিতায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তার কবিতায় ইমোশন সর্বদাই কম্পমান। কাঁপতে কাঁপতেই তার আবির্ভাব, একটি পূর্ণরেখা গ্রহণের আগেই সে আবেগের বিলীনতা প্রাপ্তি। এর ফলে মানুষ তার কবিতায় ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে বটে কিন্তু সেই ক্রোধ কোন শক্তিতে পরিণত হতে দেয় না। ম্যাক্সিম গোর্কি কি মায়াকোভস্কির স্থির সংকল্প তার নেই। কোন সামাজিক প্রেক্ষাপট আলোচনা তাই অনুপস্থিত।
৩. মার্ক্সিস্ট বা লোকহিতে বিশ্বাসী কোন কবিই এই আবেগের ভগ্নাংশ উপস্থিত করতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যে মার্ক্সিস্ট ভাবনার যথোচিত প্রকাশ এ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
৪. বাঙালি রাজনীতির ক্ষেত্রেও কমিউনিস্ট পার্টি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রকাশ, সমাজতন্ত্রের ধারণাকে মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করতে করে দেয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীগণ যেমন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের প্রচেষ্টাকারী সাহিত্যকর্মীগণও কোনো ছায়া রাখতে সক্ষম হন নাই বললেই চলে।
৫. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কোনরকমে নির্দিষ্ট মন্তব্য বা সংকল্প ছাড়াই রাজনীতি করেছেন। আসামের শোষিত সম্প্রদায়ের কষ্ট তাঁকে অভিভূত করেছে, পাকিস্তানোত্তরকালে বিরোধী দল গঠন, নানা সময়ে বিভিন্ন বামপন্থী আন্দোলনে নেতৃত্বদান, আবার ইসলামের নাম ব্যবহার, ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বাসনা প্রভৃতি এই সংহতি ও সুনির্দিষ্ট রাজনীতির অভাবের ইঙ্গিত করে, কমিউনিস্টদের ব্যর্থতাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
৬. সংগীতে নজরুল ইসলাম ভারতীয় গানের সনাতন রীতিকেই অগ্রসর করে নিয়ে গেছেন। তাঁর গানে আসরের আমেজ, বেলোয়ারি কাঁচের আওয়াজে এই গান মুখরিত। রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানকে আসর থেকে টেনে নিয়ে এসেছেন ব্যক্তির কানে, নজরুল ইসলাম আসরে ফেরার পক্ষপাতি। এই যে সামন্ত মেজাজ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীতে যাকে ঝেড়ে ফেলবার প্রয়াস, নজরুল ইসলামে তারই পুনঃপ্রতিষ্ঠার আয়োজন।
৭. একদিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও শোষনের তীব্র প্রতিবাদ, এবং অন্যদিকে সামন্ত একটি সঙ্গীত প্রথার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দেওয়া - এই ধরনের স্ববিরোধিতা নজরুল ইসলামের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা চলে। মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রেও কি তাই হয়নি? সাম্রাজব্যবাদ বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা প্রত্যেকেরই স্বীকৃতি অর্জন করেছে। আবার জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধেও তার সংগ্রাম। পক্ষান্তরে পীর প্রথা, ধর্মীয় কেন্দ্র স্থাপনের প্রচেষ্টা প্রভৃতি কি তাঁর সামন্ত মনোভাবের পরিচয় বহন করে না?
৮. নজরুল ইসলাম ও মওলানা ভাসানী দুজনের মধ্যেই এনার্কিস্ট হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ধরনের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের ফলে সেই ধরণের বিশেষণ কারো সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়। 

রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত 

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম ও রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ইলিয়াস টুকরো টুকরো মন্তব্য ডায়েরির বিভিন্ন জায়গায় করেছেন। ১৯৭৬ সালের ৬ জুলাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা  শিরোনামে তিনি ৭ পয়েন্টের একটা নোট লিখেছেন। কোন কোন পর্যায়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো সেই বিষয়ে মন্তব্য। পুরোটা নিম্নরূপ: 

১. রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম যুগ কেবল মহিলা শিল্পীদের সুগ। শান্তিনিকেতন পর্বের আগে থেকেই ছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, পরে আসেন সাহানা দেবী, অমলা দেবী, অমিয়া ঠাকুর, মালতী ঘোষাল, কনক দাস, অনীতা দেবী, রেণুকা দাশগুপ্ত, সতী দেবী প্রমুখ। এই পর্যায়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত কেবল উচ্চবিত্ত সংস্কৃতিবান [?] বাঙালি পৰিবোধসমূহেই প্রচলিত ছিলো, এমনকি ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত কোনো পরিবারের কোথাও রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা একরকম হয়ই নি।
২. চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রথম গাওয়া হয় দিনের শেষে ছায়াছবিতে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে। দিনের শেষে (পঙ্কজ মল্লিকের সুর), এবং অন্য একটি ছবিতে [?] সায়গলের কণ্ঠেআমি তোমায় যতও কানন দেবীর কণ্ঠেসবার রঙে রং মেশাতে হবে' সারাদেশে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলে। এরপর কানন দেবীরএদিন আজি কোন ঘরে গো' এবং সায়গলেরতোমার বীণায়', কানন দেবীরআমার বেলা যে যায়, সেদিন দুজনে', 'তিমির দুয়ার খোলোপ্রভৃতি গান একেবারে সাধারণ শ্রোতাদেরও বিশেষভাবে স্পর্শ করেছিলো 
৩. সাম্প্রতিক কালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তার ইতিহাসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরও একটি স্থান অনস্বীকার্য। তার গাওয়া প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়পাগলা হাওয়ার বাদলদিনেরেকর্ড বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনচিত্ত জয় করে। এই পর্যায়ে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কথাও বলা চলে। এই তিনজনই রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কেবল বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহার করবার ক্ষেত্রে এরা তিনজনই পথ প্রদর্শকের কাজ করেছেন।
৪. সৌভাগ্যক্রমে এদের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী সুচিত্রা মিত্র ও রাজেশ্বরী দত্তের আবির্ভাব ঘটে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতাে প্রচুর পরিমাণে অনুসারী সৎ থাকলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধ্রুপদাংশের ভিত্তিতে রচিত অংশ এঁদের কল্যাণেই ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। দেব্রত বিশ্বাস বিতর্কিত হলেও অত্যন্ত শক্তিশালী শিল্পী । দেব্রত বিশ্বাস ও সুচিত্রা মিত্র সম্পূর্ণ দুই বিপরীত। বিন্দুতে অবস্থান করলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুদ্ধতা রক্ষায় ও একই সঙ্গে শুচিবায়ু ত্যাগ করে তার আবেদন সঞ্চার করার প্রচেষ্টায়ও দুজনের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 
৫. সন্তোষ সেনগুপ্ত একাধারে শিল্পী (কেন বাজাও) ও অন্যদিকে কর্মী হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপক প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। সুবিনয় রায়, সুমিত্রা সেন ও সাগর সেন এই তিনজন শিল্পীই নিজস্ব কোনাে বৈশিষ্ট্য স্থান করতে পারেননি, কিন্তু মুক্তভঙ্গীতে সঙ্গীত পরিবেশনে তিনজনই সার্থক। আশোকতরু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য স্থাপনে ইতিমধ্যেই সার্থকতার চিহ্ন রেখেছেন। অর্ঘ্য সেন, অরবিন্দ বিশ্বাস, বাণী গুহ ঠাকু প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। 
৬. দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিদেব ঘােষ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং- এঁদের তিনজনই এখন পর্যন্ত রবীন্দ্রসুতির শুদ্ধতা নির্ণয়ের শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্প ও ব্যঞ্জনা সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন এঁদের কণ্ঠেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের প্রচলনে কিংবা জনপ্রিয়তা অর্জনের ক্ষেত্রে এঁদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয় । 
৭. রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন সামাজিক উন্নয়নের একটি সােপান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আকাশবাণী কলকাতা ও অন্যান্য কেন্দ্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা বাড়াবার জন্য কিংবা ভারতীয় শােষক সমাজের কোনো পূঢ় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার জন্য এই গানকে যে বিকৃত উপায়ে প্রচার আরম্ভ করেছেন তা রীতিমতো আতঙ্কজনক। বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া লোকজনের ড্রইংরুমের শোভা বৃদ্ধি করবার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হতে শুরু হয়েছে ঢাকাতেও। ঢাকায় কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নেই; নজরুল গীতিতে ফিরোজা বেগম, লোকগীতিতে আব্বাসউদ্দিন ও আবদুল আলীমের মতো কোনো প্রতিভা রবীন্দ্রসঙ্গীতে এখনো পাওয়া যায় নি। 

১৯৮৪ সালের ডায়েরিতেও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর কিছু মন্তব্য পাওয়া যায়। অক্টোবরের ৪ তারিখ লিখছেন: 

আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন শহরবাসী বা শহরবাসী না হয়েও বুর্জোয়া চেতনা যাদের মধ্যে একটুখানি শেকড় পেয়েছে তারা তাদের আবেগের সঙ্কট ও বেদনাকে সবচেয়ে নিবিড় করে অনুভব করেন রবীন্দ্রসংগীতে, রবীন্দ্রনাথই আধুনিক সমস্যাকে, যতোটা বাণীতে নয়, সুরের মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছেন তার চেয়ে বেশি। সুর ও বাণীর এমন সফল ও সুসমঞ্জস্য সমন্বয় পৃথিবীর কোনো কথাসঙ্গীতে আছে কি না সন্দেহ। সমস্ত শিল্পকলার নানারকম ভঙ্গী প্রচুর থাকা সত্ত্বেও সেগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। সামন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিল্পকলায় কাছে আত্মসমর্পণ না করে একেবারে ব্যক্তিচেতনার সংকট ও সমস্যাকে স্পর্শ করার জন্য এখন পর্যন্ত এরচেয়ে উপযুক্ত গান পাওয়া যায়নি।
কিন্তু অন্যান্য বুর্জোয়া আধুনিক শিল্পের মতোই রবীন্দ্রসঙ্গীত একেবারেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু এই মহৎ প্রতিষ্ঠানটি আধুনিক বুর্জোয়া মানসিকতার সৃষ্টি, তাই সামন্ত দর্শন প্রকাশে তৎপর হলেও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি শেষ পর্যন্ত বুর্জোয় মানসিকতাসম্পন্ন শহুরে মানুষের মানসিক বেদনা ও সংকটে সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন কি কলকাতাতেও এরকম জনপ্রিয় হয়নি। কলকাতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচলন ছিলো কেবল উচ্চবিত্ত আধুনিক রুচির পরিবারের মধ্যে। এরপর বিত্তের পরিমাপ না বাড়লেও বুর্জোয়ারুচির ক্রমপ্রসারমানতার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেক বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করে।

১৯৯৫ সালের ডায়েরিতে ইলিয়াস রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আরো কিছু মন্তব্য লিখেছেন, বিচ্ছিন্ন ভাবে। শান্তিনিকেতনে বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তুতিমূলক কিছু নোট লক্ষ করা যায়। জানুয়ারির ৭ তারিখ ইলিয়াস লিখছেন,

১. শান্তিনিকেতনে এসে এখানকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে বসা বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি লেখকের জন্য এক পরম সৌভাগ্যের বিষয়। দুই বাংলাদের মধ্যে সমস্ত ভেদ সমস্ত বিভেদ সত্ত্বেও তাদের সাধারণ ঐক্যসূত্র রবীদ্রনাথ ঠাকুর। শুনেছি গ্রিকদের মদহ্যে প্রাচীনকালে সহস্র সংঘর্ষ সত্ত্বেও মিল ছিলো হোমার। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে হোমাদের চেয়েও বড়ো, তিনি আমাদের কেবল কবিতা বা গান দেন নি, আমাদের এলোমেলো ভাবনা সংগঠিত করার শক্তি প্রদান করেছেন। তাঁর নিজের সংসারে এসে কথা বলা মুশকিল। 
৪. রবীন্দ্রনাথই প্রথম একজন ব্যক্তির অনুসন্ধান করেন উপন্যাসে। উপন্যাস হিসেবে যাই হোক সমাজের অসঙ্গতিগুলো ব্যক্তিকে পীড়া দিচ্ছে।

গণসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়েরির বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত বেশ কিছু মন্তব্য পাওয়া যায়। কখনো এক বাক্যে, সিন্ধান্তরূপে, আবার কখনো পুরো এক প্যারাজুড়ে ব্যাখাসহ। ১৯৮৪ সালের ৫ অক্টোবর ইলিয়াস লিখছেন, 

গণসঙ্গীতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই যে মানুষ এর দ্বারা সমষ্টিগতভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। খুব ভালাে বক্তৃতাও মানুষকে উত্তেজিত করে তােলে কিন্তু সুরের বাহন বলে গণসঙ্গীত শুধু উত্তেজনার সৃষ্টি করে না, মানুষের সংকল্পকে সংহত করতে সাহায্য করে। সঙ্গীত হলেও সঙ্গীতের অন্যান্য রূপের সঙ্গে এর পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। যে কোনো সঙ্গীত মানুষকে স্পর্শ করে তার নিজস্ব চেতনায়, তার নিজের ব্যক্তিগত বেদনা ও আনন্দকে তীক্ষ করে সাজিয়ে নিজের অস্তিত্বকে আরো তীব্র ও গভীরভাবে বুঝিয়ে দেয়। গজল হােক কি ঠুংরি হোক, টপ্পা কিংবা খেয়াল হোক হান মানে ব্যক্তিগত বেদনা বা আনন্দকেই উস্কে দিয়ে একান্ত জীবনযাপনে নিজেকে ভালো করে অনুভব করার ইন্ধন যোগানো। রবীন্দ্রসঙ্গীত বুর্জোয়া মধবিত্তের শিক্ষিত চেতনাকে সবচেয়ে গভীরভাবে নাড়া দিতে পারে। গণসঙ্গীত এদিক থেকে বেশ আলাদা। গণসঙ্গীতের বাণী ও সুর মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বেদনা বা আনন্দকে ছাপিয়ে ওঠে। এই ব্যক্তিগত অনুভূতিকে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে তা এমনভাবে হৃদয়কে স্পর্শ করে যে শ্রোতা একটি সামাজিক জীব হিসাবে আর দশজনের সঙ্গে একাত্ম বােধ করেন। তিনি যদি সামাজিক ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট থাকেন এবং এই অসুন্তুষ্টি যদি মধ্যবিত্নের সৌখিন বেদনাবিলাস না হয়, এই ব্যবস্থার উচ্ছেদের জন্য যদি তার কোনােরকম সংকল্প বা এমন কি ইচ্ছাও থাকে তো তা আরো জোরদার হয়ে ওঠে। ইচ্ছা বা আবেগ সংকল্পের আকার নেই। মধ্যযুগের ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিকূল ও বৈরী অবস্থান থেকে বেরিয়ে ব্যক্তির উদ্ভব ঘটে। সমাজ ও শিল্পসংস্কৃতির চর্চায় এই ব্যক্তির বিকাশ দেখতে পাই দীর্ঘ কয়েকশ বছর ধরে। বিকাশের স্তর পার হয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এখন একটি অনড় ও অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বাঙলাভাষার সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে এর উদ্বোধন। তাঁর পদক্ষেপ ছিলো বেশ বলিষ্ঠ ও সাহসী। আর ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে ঐ সময়েই এটা অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ছিলো। রবীন্দ্রনাথের হাতে এর শুশ্রুষা ঘটে, এই ব্যক্তি আক্রমণাত্মক নয়, এর পরিণতি ইতিবাচক। … [অসমাপ্ত] 

১৯৮৮ সালের ডায়েরিতে লোকসঙ্গীত নিয়ে দুয়েক লাইনের মন্তব্য বা এক বাক্যে উপস্থাপিত কিছু সিদ্ধান্ত ইলিয়াস লিখে রেখছেন। এই সিদ্ধান্তগুলো সংস্কৃতির ভাঙা সেতু  প্রবন্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নভেম্বরের ২০ তারিখহেমাঙ্গ বিশ্বাসশিরোনামে লেখা রয়েছে,

ক. লোকসঙ্গীত। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে লোকসঙ্গীতের সমস্যার আলোচনা হতে পারে না! লোকসাহিত্য ও লোকসঙ্গীতের জন্মদাতা গ্রামের অধিবাসীদের জীবনের বিপর্যয় ও লোকসঙ্গীতের বিপর্যয়কে পাশাপাশি দ্যাখা দরকার। সাম্প্রতিককালে লোকসঙ্গীতকে ভদ্রসমাজে ব্যবহারের চেষ্টা করা হলেও সমাদর ও সমঝদারির প্রমাণ পাওয়া যায় না।
খ. রাগসঙ্গীত গুরুর কাছে বসে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখা সম্ভব। তার ঘরণা থাকতে পারে, কিন্তু লোকসঙ্গীতের ঘরণা নেই। যা আছে তা হলো । কানে শোনে ও চোখে দেখে মনের ভাবে গান শেখা লোকসঙ্গীতের গায়কের বৈশিষ্ট। পদ্ধতিটা হলো। কারণ গানে সেই প্রকৃতি ও মানুষের ছবি থাকে। শহরের বুদ্ধিজীবীর পক্ষে এই ছবি দ্যাখা সম্ভব নয়। 
ঘ. গণজীবনে নিত্যনৈমত্তিক কর্মলীলা থেকে লোকসঙ্গীতের প্রবাহটি উৎসারিত, শহুরে শিক্ষিত সমাজের সে ধারা থেকে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা সঙ্কটের গোঁড়ার কথা। 
ঙ. Commercial গান। মানসিকভাবে লোকসঙ্গীতের গায়ক ও আলোচকগন অবক্ষয়ের শিকার। লোকসঙ্গীতের মূল ও অপরিহার্য বিষয় জীবনস্পন্দন এদের মধ্যে অনুপস্থিত। 
 
ছ. ধর্ম প্রভাবমুক্ত আদি কমিউনিটি সৃষ্ট বিশেষ অনুপ্রেরণা improvised স্বতঃস্ফূর্ত লোকসংগীতগুলি সুরে ও রচনায় আবেগ ও আবেদনশীল। এরপর যখন ভণিতার যুগ এসে বিশেষ রচয়িতার আবির্ভাব হলো সেখানে ব্যষ্টি সমষ্টিচেতনারই ধারক। 
জ. আধুনিক কালে লোকসঙ্গীতের যে চর্চা শহরে চলে তা অনেকটা academic, এখানে লোকসঙ্গীত জনবিচ্ছিন্ন সামগ্রী। 
ঝ. শহুরে sophistication লোকসঙ্গীতের ক্ষতি করে।
ঞ. লোকসঙ্গীত জীবনমুখী, কিন্তু অসার, মানবদেহ অসার, এসব গানের কথা ওপর থেকে চাপানো, লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্যের পরিপন্থী দর্শনচিন্তা।  
ট. আন্তর্জাতিকতা। জাতীয়তাবাদ লোকসঙ্গীতের পরিপন্থী।
ঠ. দেশ এখনো কৃষিনির্ভর। গ্রাম ও শহরের দূরত্ব পরিবহনে কমে এলেও আর্থিক বন্টনে সে দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামে শিক্ষার জৌলুস উপরে উপরে বাড়লেও অশিক্ষা ও কুশিক্ষার অন্ধকার বেড়েছে অনেক।

It is the people who create the music, we only arrange it. … 


দেশের বুদ্ধিজীবী 

১৯৮৮ সালের ৫ এপ্রিল ইলিয়াস পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে বুদ্ধিজীবীদের নিরবতা বিষয়ে লিখছেন, 
কোনো দেশের সচেতন মানুষ মাত্রেই দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকবেন বলে ধরে নেয়া হয়। শিক্ষিত, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী বলে যারা পরিচিত তারা দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ, তাদের সমস্যা, তাদের আশাআকাঙ্ক্ষা সম্বদ্ধে শুধু জ্ঞাত নয় বরং উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত না থাকলে দ্বায়িত্ববান ব্যক্তি বলে তাদের চিহ্নিত করা চলে।
বাঙ্গালি শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা চট্টগ্রামের উপজাতি বলে পরিচিত সম্প্রদায়সমূহ সম্বদ্ধে যে চরম উদাশীন্যের পরিচয় দিচ্ছেন তাতে তাদের চরম দায়িত্বহীনতার চরিত্রই প্রকাশিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে চাকমা, মুরং, মার্মা প্রভৃতি সম্প্রদায় দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে যেরকম মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন, নিজের ঘরে তারা পরবাসীতে পরিণত হয়েছেন, পাহাড়ি এলাকার জনপদে জনপদে ঘরবাড়ি দগ্ধ হচ্ছে, আদিবাসীরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আরো দূরে আশ্রয় নিচ্ছে এবং শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর মার ঠেকাবার জন্য শেষ পর্জন্ত গেরিলা যুদ্ধে নিয়োজিত হচ্ছে।
      
চাকমারা সংখ্যায় অল্প, বাঙ্গালিদের তুলনায় তাদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রসার অনেক কম। ফলে প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে তাঁরা যেকোন বিদেশী শক্তির সাহায্য নিতে পারেন। আসলেও তাই ঘটেছে…[অসমাপ্ত]

১৯৭৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে ইলিয়াস বাঙালি মুসলমান বিষয়ে মন্তব্য করছেন: 

বাংলা কবিতায় নজরুল ইসলাম, সঙ্গীতে আলাউদ্দীন খাঁ ও আব্বাসউদ্দিন, নৃত্যকলায় বুলবুল চৌধুরী ও চিত্রকলায় জয়নুল আবেদিনের আবির্ভাব ঘটে পাকিস্তান হওয়ার আগেই। এমনকি বাঙলার রাজনীতিতে ফজলুল হকের প্রভাব বিস্তার ১৯১৬-১৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। হিন্দু আধিপত্য মুসলমান সাংস্কৃতিক বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায় একথা  যে ঠিক নয়, তার প্রমাণ এঁদের সাফল্যেই বােঝা যায়। রাজনীতি ও শিল্পকলার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তান হওয়ার আগেই অনন্তঃ দুএকজন করে মুসলমানের নাম পাওয়া যাবে যারা সমগ্র বাঙলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই নিজেদের যথাযােগ্য আসন অধিকার করতে পেরেছেন। এই আসন কেউ তাদের দয়া করে দান করেনি, কিংবা কোনাে অগ্রসর সম্প্রদায়ের উদার মনোভাবের কল্যাণে তারা এই প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি, এই মর্যাদা ভরা অর্জন করেছিলেন নিজেদের প্রতিভা এবং কৃতিত্বের সাহায্যেই। মায়ন কবির কিংবা আবু সায়ীদ আইয়ুব কিংবা শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর বুদ্ধিবৃত্তির গভীর চর্চা সমগ্র দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের অনুপস্থিতি বড়ো চোখে পড়ে যেখানে তাঁদের কৃতিত্ব ও সার্থকতা একেবারে শূন্যতার পর্যায়ে পড়েছে। সে ক্ষেত্র হলো বাঙলা কথাসাহিত্য। 
বাঙলা গদ্যেও বাঙালি মুসলমানের মর্যাদা অর্জন খুব সাম্প্রতিক কালের নয়। মীর মােশাররফ হােসেন তাে খ্যাতি অর্জন করেছিলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবদ্দশাতেই।

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ   

১৯৮৮ সালের ২০ মে ডায়েরিতে ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটি মন্তব্য করেন।বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধশিরোনামের এই ছোট নোটে ইলিয়াস লিখছেন: 

ইদানিং বাংলাদেশের গল্প উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজিত অবস্থা এবং রাজাকারদের দাপট বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে, মার খাচ্ছে, সব জায়গায় কেবল হেরে যাচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধাদের এই অবস্থাটিই গল্প উপন্যাসে প্রধান। আবার ওদিকে যারা দালাল ছিল তাদের রবরবা, ক্ষমতা তাদের হাতে, টাকা পয়সাও সব তাদের হাতে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে যুদ্ধোত্তর এই করুণ চেহারা।
এর মানে কী? মুক্তিযুদ্ধ কি তবে ব্যর্থ হয়েছে? কেবল পতাকা বদলের মধ্যে যুদ্ধের সাফল্য বোঝা যায়না। পাকিস্তান কিন্তু অনেক বেশি সফল হয়েছিলো। নেতিবাচক হলেও পাকিস্তানে স্থুল ও অরুচিকর এক ধরনের পাকিস্তানি মনোভাব দারুণ দাপটে টিকে ছিলো। ১৯৫৮ সাল থেকে সামরিক শাসনের মধ্যে না থাকলে এই দাপট হয়তো আরো দুচার দশক থাকতো। ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের সচেতন করলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, প্রশাসন, ওপরতলার সংস্কৃতিতে পাকিস্তানি ব্যাপারটাই প্রধান ছিলো।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এতো তাড়াতাড়ি মুখ থুবড়ে পড়লো কেন? এর কারণ কি এই যে মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতপকশে মুক্তিযুদ্ধ নয়? মুক্তিযুদ্ধের এখনো আর কতো বাকি?

সাহিত্য-কথা 
ইলিয়াসের পুরো ডায়েরিজুড়েই সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখা বিষয়ে বিবিধ মন্তব্য পাওয়া যায়। যেমন, ১৯৮৮ সালে মে মাসের ৩১ তারিখে লিখিত ডায়েরিতে পাওয়া যায়:  
১. সমৃদ্ধ রুশ গদ্য। 
২. রুশ কথাসাহিত্যে সমাজবাস্তবতা। 
৩. রুশ লেখকদের জন্য তাদের শিল্পকর্মের সঙ্গে জানা অপরিহার্য। রুশ লেখকদের লেখায় message. ডস্টয়ভস্কি, টলস্টয়, গোগোলে, গোর্কি 
৪. বিপ্লবপূর্ব রুশ সাহিত্যে আপোষ নেই, দুই মেরুকে পাওয়া যায়। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলা সাহিত্যে তার অভাব। বাংলা কথাসাহিত্যের সূত্রপাত বলতে গেলে আপোষকামিতার মধ্যে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র। America-Unlce Torm's Cabin বইতে আপোশ লক্ষ্য করি। 
৫. Political নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিলো, Lenin, Stalin, Trotsky সবাই literature-এর চর্চা করতেন। Mao-Tse Tungপক্ষান্তরে ভারতে গান্ধি, নেহেরুর আত্মজীবনী ছাড়া উল্লেখ করার মতাে কিছুই নেই। 
৬. ভোটের রাজনীতিতে দরকার পোস্টার, বিপ্লবের জন্য চাই সাহিত্য।

শিশু-কিশোরদের সাহিত্য কীভাবে লিখতে হবে সে সংক্রান্ত মন্তব্য পাওয়া যায় একই সালের ২০ জুলাইয়ের ডায়েরির মধ্যে।
শিশু ও কিশোরদের সম্বোধন করে কথা বলতে হলে লেখককে নিজের বয়স উজিয়ে যাওয়ার দরকার হয় না। তবে মনযোগ দিয়ে তাদের দেখতে হয় এবং তাদের উপযোগী ভাষা ও ভঙ্গী রপ্ত করতে না পারলে লেখকের পরিশ্রম পত্ত হতে পারে। যে গল্প ছোটদের জন্য লেখা তার মধ্যে তাই সাধারণ শিল্পগুণের অতিরিক্ত আরো কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যাতে তা তাদের মধ্যে সাড়া ফেলতে পারে।

ইতি-কথা
ইলিয়াসের ডায়েরির পড়তে গিয়ে যে কোনো পাঠকেরই আফসোস হবে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের প্রস্তুতি-পর্ব দেখতে দেখতে বাঙলাভাষার যে কোনো পাঠকের মনেই দীর্ঘশ্বাস জন্ম নিবে। কোনো সন্দেহ নেই। ইলিয়াসের ডায়েরির একটা বাক্য দিয়েই লেখাটা শেষ করি। এটা কি ইলিয়াসের উক্তি নাকি অন্য কারো উক্তি তা জানি না। খোজও নেই নি। 

‘Freedom has no purpose. And it is not found on this earth. All we can find here is the struggle for freedom. We struggle to obtain the unattainable - that is what separates man from beasts’

বইয়ের বিজ্ঞাপন
শাহাদুজ্জামানের গ্রন্থনা ও সম্পাদনায়আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়েরিপ্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। ২০১৩ সালে। 


No comments:

Post a Comment